শয়তান পূজারীদের হাতেই কী তবে মাইকেল জ্যাকসনের মৃত্যু?
প্রকাশ : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৫:০০
ইলিউমিনাতি! নামটি শুনলেই আমাদের সবারই মনে পরে যায় সিনেমা শুরুর প্রথম দৃশ্যের কথা, যেখানে বড় বড় অক্ষরে ইলিউমিনাতির নামটি চোখে পড়ে। ড্যান ব্রাউন এর বিখ্যাত উপন্যাস ‘অ্যাঞ্জেলস অ্যান্ড ডেমন্স’, সিনেমার মধ্যে ‘লারা ক্রফট;টম্ব রাইডার’, ‘ন্যাশনাল ট্রেজার’, ‘দ্যা ব্রাদারহুড’, অথবা টিভি সিরিজ ‘বোন্স’, ‘অ্যামেরিকান ড্যাড’, এমনকি ভিডিও গেমস ‘অ্যাসাসিন্স ক্রীড’, ‘কল অফ ডিউটি’ ইত্যাদি সব জায়গায় ইলিউমিনাতির নাম অসংখ্যবার এসেছে। কিন্তু কি এই ইলিউমিনাতি? কোনো ব্যাক্তির নাম নাকি কোনো প্রোডাকশন কোম্পানির নাম?
আসলে “ইলুউমিনাতি” হলো একটি গ্রুপ অথবা সংঘ যারা শয়তানের পূজা করে অর্থাৎ ‘ডেভিল ওরশিপার’। অ্যানশেল মসেস রথচাইল্ড ছিলেন ইলিউমিনাতির প্রথম প্রতিষ্ঠাতা।
অ্যানশেলদের পারিবারিক সুদের ব্যাবসা ছিল, ফলে জন্ম থেকেই তিনি ছিলেন ধনী। পরবর্তীতে এই রথচাইল্ড পরিবার ধীরে ধীরে ইউরোপের ব্যাংকিং ব্যাবসা নিয়ন্ত্রন করা শুরু করে এবং আরও পরে গোটা পৃথিবীর ব্যাংকিং ব্যাবসার নিয়ন্ত্রন রথচাইল্ড পরিবারের হাতে চলে যায়। ডঃ আডাম্ ওয়াইসফ, ইহুদি ধর্মযাজক এবং বাভারিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইহুদি আইনের অধ্যাপক। তিনি এতো মেধাবি ছিলেন যে মাত্র ২১ বছর বয়সে অধ্যাপক পদ পান।
১৭৭৩ সালে পোপ ১৪তম ক্লেমেন্ট, আডাম্ ওয়াইসফকে জাজ প্রিষ্ট পদ থেকে অপসারণ করেন, কারণ হিসাবে পোপ দেখান যে, ওয়াইসফ বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন, আর তিনি প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশী ধনী ছিলেন। ১৭৭০ সালের কোন এক সময়ে অ্যানশেল মসেস রথচাইল্ড তার সবচেয়ে ধনী ও প্রভাবশালী ১২ জন বন্ধু সহ আডাম্ ওয়াইসফকে জার্মানির রথচাইল্ড ম্যানসনে আমন্ত্রন জানান এবং একটি সংঘ গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেন। পরবর্তীতে তারা ১৭৭৬ সালের ১ মে “অর্ডার অফ দি ইলিউমিনাতি” নামের একটি সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা করেন।
ইলিউমিনাতি মানে আলোকিত মানুষ। তারা নিজেদের আলোকিত মানুষ হিসাবে মনে করে গোটা পৃথিবী পরিচালনা করার উদ্দেশে এই সংঘ গড়ে। আডাম্ ওয়াইসফ বলেন, সংঘের নামটি লুসিফেরিয়ান বা শয়তানি বিদ্যা থেকে প্রাপ্ত। ইলিউমিনাতির ল্যাটিন অর্থ “আলোর ধারক”। সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে বিতাড়িত হওয়ার আগে শয়তানকে লুসিফার এবং আলোর ধারক নামে ডাকা হত। সেখান থেকেই “অর্ডার অফ দি ইলিউমিনাতি” নামটি এসেছে। ১৭৮৩ সালের মধ্যে ইউরোপে ইলিউমিনাতির ৬০০ জন সদস্য হয় এবং ১৭৮৬ সালের মধ্যে পুরো ইউরোপ, আফ্রিকা এবং অ্যামেরিকায় অসংখ্য গুপ্ত মন্দির বা লজ তৈরি হয়।
মজার বিষয় হচ্ছে ইলিউমিনাতি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মাত্র কয়েক মাস পরেই ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই আমেরিকা মুক্তির চুক্তি বা ডেকোরেশন অফ ইন্ডিপেন্ডেন্স স্বাক্ষরিত হয়। তাতে ৯৭ জন স্বাক্ষর করেন, আর তাদের মধ্যে ৯ জন ছিলেন আরেকটি গুপ্ত সংঘ “ফ্রিম্যাসন” এর সদস্য। যাদের মধ্যে বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন, জন অ্যাডামস ও টমাস জেফারসনের নাম উল্লেখযোগ্য। পরবর্তী সময়ে ইলিউমিনাতি ধীরে ধীরে অ্যামেরিকায়ও চলে আসে। ১৭৭৯ সালের মধ্যে অ্যামেরিকায় প্রায় ১৪টি ইলিউমিনাতি গুপ্ত মন্দির বা লজ তৈরি করা হয়।
আমেরিকায় ইলিউমিনাতির সদস্য সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। মূলত আমেরিকার তৃতীয় প্রেসিডেন্ট (১৮০১ -১৮০৯) টমাস জেফারসন ইলিউমিনাতিতে যোগ দেওয়ার কারণেই আমেরিকায় ইলিউমিনাতি বিস্তার লাভ করে। অনেক ফ্রিম্যাসনরাও ইলিউমিনাতিতে যোগ দান করেন। আর এভাবেই এ দুই গুপ্ত সংঘ যৌথভাবে বেড়ে উঠতে থাকে। জন অ্যাডামসও ইলিউমিনাতিতে যোগ দেন কিন্তু পরে ইলিউমিনাতির আসল উদ্দেশ্য জানতে পেরে তিনি এর বিরোধিতা করেন। ১৮৩০ সালে ইলিউমিনাতির প্রধান প্রতিষ্ঠাতা ওয়াইসফের মৃত্যুর পর ১৮৩৪ সালে মজিনি নামের এক ইটালিয়ান ব্যক্তিকে “অর্ডার অফ দি ইলিউমিনাতি” এর প্রধান বানান হয়। প্রধানত রথচাইল্ডরা ইলিউমিনাতির পেছনে থেকে সংগঠনটি নিয়ন্ত্রন করতো। আর সামনে অন্য মানুষের নাম প্রচারিত হয় যাদের কে “Front men of the Illuminati” বলা হয়।
মজিনি ছিলেন ইটালির সবচেয়ে প্রভাবশালী একটি পরিবারের সন্তান, এবং ইটালির বিপ্লবী নেতা। ইলিউমিনাতির প্রধান হবার পর তিনি ইটালির প্রভাবশালী পরিবারগুলোকে একত্রিত করে আরেকটি সংঘ তৈরি করেন যাকে আমরা মাফিয়া নামে চিনি। মাফিয়া ছিলো ‘অর্ডার অফ দি ইলিউমিনাতির’ই একটি অংশ।
বর্তমানে ইলিউমিনাতির বিস্তৃতি আরো ছড়িয়ে পড়েছে। ইলিউমিনাতি এখন পুরো মুভি ইন্ডাস্ট্রি, মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি নিয়ন্ত্রণ করে আর তারা তাদের কার্যকলাপ পরিচালনা করে বিখ্যাত ব্যাক্তিদের কাজে লাগিয়ে। প্রথম দিকে বেশির ভাগই না জেনে এই গুপ্তসংঘে যোগদান করেন। পরে এদের আসল উদ্দেশ্য জানতে পেরে অনেকেই ছেড়ে চলে যান কিন্তু তাদের উপর নেমে আসে মৃত্যুর মতো ভয়ঙ্কর শাস্তি। ইলিউমিনাতির কার্যকলাপ সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো ধারণা আজও পাওয়া যায়নি। তাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে জানতে গেলে ইলিউমিনাতির সঙ্গে জড়িত ছিলো এইরকম অনেক বিখ্যাত ব্যাক্তির কথা জানা যায়। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন...
১) জন এফ কেনেডি : ধারণা করা হয় ইলিউমিনাতির প্রথমসারির মেম্বার ছিলেন আমেরিকার ৩৫ তম (১৯৬১-১৯৬৩) সাবেক প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি। এবং উনার মাধ্যমে এই গ্রুপটি আরো শক্তিশালী হতে চায়। কিন্তু উনি বেঁকে বসেন। এক সম্মেলনে উনি বলেন, "There's a plot in this country to enslave every man, woman and child. Before I leave this high & noble office, I intend to expose this plot.” ফলস্বরুপ পরের সম্মেলনে অজ্ঞাত পরিচয়ধারীরা ওপেন ব্রাশফায়ার করে খুন করে উনাকে।
২) টুপাক শাকুর : স্মরণকালের সেরা Rapper উনি। 1990-1996 পর্যন্ত টুপাকের জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। ইলিউমিনাতি কাজে লাগায় উনারও জনপ্রিয়তাকে। উনার প্রায় সব মিউজিক ভিডিওতে থাকতো ইলুমিনাতির সাবলিমিনাল ম্যাসেজ। উনিও পরে একসময় ইলুমিনাতির বিরুদ্ধতা প্রকাশ করেন এবং অসংখ্য লাইভ রিয়েলিটি শোতে ইলিউমিনাতি নিয়ে বলেন। টুপাক বলেন, "They got money for the war but can't feed the poor" রিয়েলিটি শোর এক উপস্থাপিকার প্রশ্নের জবাবে টুপাক রিপ্লাই দেন, "Death is not the greatest loss in life. The greatest loss is what dies inside while still alive. Never surrender.” শেষ পর্যন্ত উনিও ব্রাশ ফায়ার এর শিকার হন। সমাপ্তি ঘটে কিংবদন্তি Rap singer এর।
৩) মাইকেল জ্যাকসন : ‘থ্রিলার’ সঙ্গীত খ্যাত কিংবদন্তি পপসিঙ্গারও ইলিউমিনাতির রোষের শিকার হয়েছিলেন। উনি বিভিন্ন সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, "I need you to know that this is very important what we are fighting for because I am tired. I am really tired of manipulations. I am really tired on how the press is manipulating everything that has been happening to the situation. They do not tell us the truth.They are lying. They make me child molester. I really want to tell u about them.”
মাইকেল জ্যাকসনের বোন লা টয়া জ্যাকসন বলেন, মাইকেল প্রায় উনাকে বলতেন, ‘They are trying to kill me.” তাই মাইকেল জ্যাকসনের হটাত মারা যাওয়াটা আজো রহস্যময়।
ইলিউমিনাতির বিভিন্ন প্রতীক আছে। আমরা দুই আঙ্গুল উঁচিয়ে ‘রক এন্ড রোল’ এর যে সাইন দেখাই, সেটা শয়তানের সাইন। তাছাড়া স্ট্যাচু অফ লিবার্টির হাতে যে জ্বলন্ত মশাল আছে সেটাকে বলা হয় আলোকবর্তিকা। কিন্তু এই মশাল শয়তানের একটি রূপ ‘লুসিফার’ এর সাইন। ইলুমিনাতির সবচেয়ে পপুলার সাইন হলো পিরামিডের ভিতর একটি চোখ, যেটি আমেরিকার এক ডলার নোটে আছে।
এখানেই শুধু শেষ নয়। জন লেনন, কার্ট কোবেইন, জিম মরিসন, মারটিন লুথার কিং জুনিয়র, বব মারলি, ব্রুস লি, এমনকি প্রিন্সেস ডায়না সহ অনেক বড় বড় ব্যাক্তিত্ব ইলিউমিনাতির ষড়যন্ত্রের শিকার হন।
হিপ হপ সিঙ্গার Jay–Z, সঙ্গীতশিল্পী রিয়ান্না, জাস্টিন বিবার, ব্রিটনি স্পিয়ারস, লেডি গাগা, এমনকি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ইলিউমিনাতির বর্তমান সদস্য।