বাঙালির মুক্তির দিন আজ

প্রকাশ : ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৮:২৮

১৬ ডিসেম্বর। একাত্তরের এই দিনে কুয়াশায় জড়ানো হালকা শীতের বিকেলে রমনার রেসকোর্স ময়দানে দাম্ভিক পাকিস্তানি সেনারা পায়ের কাছে অস্ত্র নামিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিল মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সামনে। এর মাধ্যমে সূচিত হয় বাঙালীর বিজয় গাঁথা।

সেই বিজয় গৌরবের বাঁধভাঙ্গা আনন্দের দিন আজ। একই সঙ্গে লাখো স্বজন হারানোর শোকে ব্যথাতুর-বিহ্বল হওয়ারও দিন আজ। আজ বাঙালির মহান বিজয় দিবস।

একাত্তরের এই দিনে প্রভাতী সূর্যের আলোয় ঝিকমিকিয়ে ওঠে বাংলার শিশিরভেজা মাটি। অবসান হয় পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর সাড়ে তেইশ বছরের নির্বিচার শোষণ, বঞ্চনা আর নির্যাতনের কালো অধ্যায়। নয় মাসের জন্ম-যন্ত্রণা শেষে এদিন জন্ম নেয় একটি নতুন দেশ, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

৫৫ হাজার বর্গমাইলের এই সবুজ দেশে ৪৫ বছর আগে আজকের এই দিনে উদয় হয়েছিল হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সূর্য। যে সূর্য কিরণে লেগে ছিল রক্ত দিয়ে অর্জিত বিজয়ের রং। সেই রক্তের রং সবুজ বাংলায় মিশে তৈরি করেছিল লাল সবুজ পতাকা। সেদিনের সেই সূর্যের আলোয় ছিল নতুন দিনের স্বপ্ন, যে স্বপ্ন অর্জনে অকাতরে প্রাণ দিয়েছিল এ দেশের ৩০ লাখ মানুষ।

এবার অন্য রকম গণজাগরণ ও আবহে বিজয় দিবস পালন করছে জাতি। বিজয়ের আনন্দের এই দিনে শহীদ পরিবারের সদস্যদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ কিছুটা হলেও কমিয়েছে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যে দাবি তুলেছিল, তা বাস্তব রূপ দিয়েছেন তিনি। শত ষড়যন্ত্রের কুহেলিকা, জাতীয়-আন্তর্জাতিক রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে কুখ্যাত কসাই কাদের মোল্লাসহ অনেক রাজাকারের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে বর্তমান সরকার। অন্যান্য শীর্ষ নরঘাতক যুদ্ধাপরাধীও এখন কারাগারের অন্ধপ্রকোষ্ঠে।

গোটা জাতি এখন সব যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে আদালতের রায় কার্যকর দেখার দৃঢ় প্রত্যয়ে ঐক্যবদ্ধ। শেখ হাসিনার সরকারই একাত্তরের হন্তারকদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেশকে অভিশাপমুক্ত করবে, কলুষমুক্ত হবে বাঙালি জাতি সেটি দেখার প্রত্যাশায় প্রহর গুনছে।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ছিল বৃহস্পতিবার। এ দিনের সকালে জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের কর্মকর্তা জন আর কেলি পৌঁছান সেনানিবাসের কমান্ড বাঙ্কারে। সেখানে নিয়াজি নেই, ফরমান আলীকে পাওয়া গেল বিবর্ণ ও বিধ্বস্ত অবস্থায়। নিচু কণ্ঠে ফরমান আলী জানান, আত্মসমর্পণ-সংক্রান্ত ভারতীয় বাহিনীর প্রস্তাব তারা মেনে নিয়েছেন। কিন্তু তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ায় ভারতে সেই সংবাদ পাঠাতে পারছেন না। কেলি প্রস্তাব দিলেন, জাতিসংঘের বেতার সঙ্কেত ব্যবহার করে তিনি বার্তা পৌঁছে দিতে পারেন।

আত্মসমর্পণের জন্য বেধে দেওয়া সময় সকাল সাড়ে নয়টা থেকে আরও ছয় ঘণ্টা বাড়ানো ছাড়া ভারতীয় বাহিনীর সব প্রস্তাব মেনে নিয়ে আত্মসমর্পণের বার্তা পৌঁছানো হয় জাতিসংঘের বেতার সঙ্কেত ব্যবহার করে। ভারতে তখন সকাল নয়টা ২০ মিনিট। কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডের (বর্তমান শেক্সপিয়ার সরণি) একটি দোতলা বাড়ি। বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সচিবালয় আর প্রধানমন্ত্রীর দফতর। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সকাল। বরাবরের মতো সেদিনও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কক্ষের দরজা একটু খোলা। উদ্বিগ্ন প্রধানমন্ত্রী।

আনুমানিক সকাল ১০টায় তাজউদ্দীন আহমদের ফোনটি বেজে উঠল। কথা হলো। চোখেমুখে সব পাওয়ার আনন্দ। প্রধানমন্ত্রী জানালেন ‘সবাইকে জানিয়ে দাও, আজ আমরা স্বাধীন। বিকেল চারটায় আত্মসমর্পণ।’

এদিকে সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে মিত্রবাহিনী ঢাকায় প্রবেশ করল। এর আগেই মিরপুর ব্রিজ দিয়ে ঢাকায় ঢুকে পড়েছে কাদের সিদ্দিকীর বাহিনী। বিকেলে ঢাকা রেসকোর্স ময়দান (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) প্রস্তুত হলো ঐতিহাসিক মুহূর্তের জন্য। ঠিক যেখান থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একাত্তরের সাতই মার্চ বজ্রকণ্ঠে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন।

বেলা একটা নাগাদ কলকাতা থেকে ঢাকা এসে পৌঁছান ইস্টার্ন কমান্ডের যৌথবাহিনীর প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা, চীফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জ্যাকব, মুক্তিবাহিনীর উপ-অধিনায়ক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খোন্দকার। দুপুর একটার পর জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সে বসে আত্মসমর্পণের দলিল তৈরির বৈঠক। এক পক্ষে নিয়াজি, রাও ফরমান আলী ও জামশেদ। অপর পক্ষে জ্যাকব, নাগরা ও কাদের সিদ্দিকী।

সিদ্ধান্ত হয়, দলিলে স্বাক্ষর করবেন বিজয়ী বাহিনীর পক্ষে ভারতের ইস্টার্ন কমান্ড ও বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর জয়েন্ট কমান্ডিং ইন চীফ লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা এবং বিজিত বাহিনীর পক্ষে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজি।

ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই জেনারেল অরোরা আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য বিমান ও নৌবাহিনীর চীফ অব স্টাফসহ কলকাতা থেকে ঢাকায় পৌঁছান। নিয়াজি অভ্যর্থনা জানান যৌথ বাহিনীর কমান্ডারকে। এর পর আসে সেই মাহেদ্রক্ষণ। পরাজিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজি রেসকোর্স ময়দানে এলেন। সামরিক বিধি অনুসারে বিজয়ী ও বিজিত সৈনিকরা শেষবারের মতো জেনারেল নিয়াজিকে গার্ড অব অনার জানায়।

বিকেল চারটায় নিয়াজি ও অরোরা এগিয়ে গেলেন ময়দানে রাখা একটি টেবিলের দিকে। জেনারেল অরোরা বসলেন টেবিলের ডান দিকের চেয়ারে। বাম পাশে বসলেন জেনারেল নিয়াজি। দলিল আগে থেকেই তৈরি ছিল। জেনারেল অরোরা স্বাক্ষর করার জন্য দলিল এগিয়ে দেন নিয়াজির দিকে। তখন বিকেল ৪টা ৩১ মিনিট। অবনত মস্তকে জেনারেল নিয়াজি দলিলে স্বাক্ষর করে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে নিলেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে। মুজিবনগর সরকারের পক্ষে এ সময় উপস্থিত ছিলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খোন্দকার।

দীর্ঘ নয় মাসের দুঃস্বপ্নের অবসান ঘটিয়ে বাঙালি জাতির জীবনে এলো নতুন প্রভাত। এলো হাজার বছরের কাঙ্খিত স্বাধীনতা। পাক হানাদারদের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বাঙালি জাতি অর্জন করে তাদের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি, লাল-সবুজের পতাকা। বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম জাতি হিসেবে নিজেদের গর্বিত পরিচয় হয় নির্দিষ্ট। বিজয়ের মুক্তির নিশান ওড়ে বাংলার সর্বত্র। রক্ত লাল পতাকায় সিঞ্চিত হয় বাঙালীর চেতনা।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত