বিজয়ের তিন দিন পর ভাটিয়াপাড়া মুক্ত হয়

সারা দেশ যখন বিজয়ের আনন্দে উত্তেলিত, সেই সময়ও গোপালগঞ্জের ভাটিয়াপাড়ায় পাক হানাদাররা যুদ্ধ করে যাচ্ছিল। বিজয়ের তিন দিন পর প্রচণ্ড যুদ্ধে পাক সেনারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।

আজ ১৯ ডিসেম্বর গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীর ভাটিয়াপাড়া শত্রুমুক্ত দিবস। এ দিন মিত্র ও মুক্তি বাহিনীর ত্রিমুখী আক্রমণে পাক বাহিনীর দখলে থাকা কাশিয়ানী উপজেলার ভাটিয়াপাড়া ওয়্যারলেস স্টেশনের ক্যান্টনমেন্টের পতন ঘটে। ভাটিয়াপাড়ামুক্ত দিবস উপলক্ষে নেওয়া হয়েছে ব্যাপক কর্মসূচি।

১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে এক প্লাটুন সশস্ত্র পাক সেনা রেলযোগে এসে কাশিয়ানীর অদূরবর্তী ভাটিয়াপাড়া ওয়্যারলেস সেন্টার দখল করে অবস্থান নেয়। রাজাকারদের সহায়তায় পাক সেনারা ১৩ এপ্রিল আওয়ামী লীগ নেতা কে এম আমজাদ হোসেন, বাগঝাপা গ্রামের মোক্তার শেখ, মাজড়ার হাবিবুর রহমান বাবু মিয়ারসহ শতাধিক ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। মাজড়া গ্রামের জহির উদ্দিন মৌলভীর ছেলে বেলায়েত, যদু মিয়ার স্ত্রী ও বাগঝাপা গ্রামের আক্কাস শেখকে গুলি করে হত্যা করে। পরদিন ১৪ এপ্রিল পোনা গ্রামের ছয়টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে এবং খোকা মৌলভীসহ ১১ জনকে গুলি করে হত্যা করে পাক সেনারা।

মে মাসের শেষ দিকে খালিদ ফিরোজ ও আক্কাস হোসেনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা এলাকায় গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে। জুলাই-আগস্ট মাসে ভারত থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা এলাকায় প্রবেশ করে যুদ্ধ শুরু করে। ওড়াকান্দি মিড হাইস্কুলে কাশিয়ানী মুক্তিযুদ্ধের কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল গঠন করে ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা নূরুল কাদির জুন্নুর ছোট ভাই ইসমত কাদির গামা। রামদিয়া এসকে কলেজ, সাজাইল গোপী মহন হাইস্কুল, রাতইল স্কুল, জয়নগর স্কুলসহ অনেক স্থানে মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্প স্থাপন করে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেন।

অক্টোবর মাসে উপজেলার ফুকরা লঞ্চঘাট এলাকায় খুলনা থেকে নদীপথে আসা তিনটি লঞ্চ ভর্তি পাক সেনাদের সঙ্গে মুক্তি বাহিনীর ছয় ঘণ্টাব্যাপী মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এ সংঘর্ষে পাক বাহিনীর অর্ধশতাধিক সেনা নিহত হয়। বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

গোপালগঞ্জ-ফরিদপুর-নড়াইল জেলার সীমান্তে অবস্থিত এবং ভৌগোলিক ও মুক্তিযুদ্ধের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ রেলস্টেশন ও নদীবন্দর ভাটিয়াপাড়া দখল নিয়ে পাক হানাদার ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে লড়াই হয় কয়েক দফা। পাক বাহিনীর ভাটিয়াপাড়া মিনি ক্যান্টনমেন্টটি গোপালগঞ্জের অন্তর্ভুক্ত হলেও গোপালগঞ্জ-ফরিদপুর-নড়াইল অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ্যবস্তু ছিল ওই মিনি ক্যান্টনমেন্টটি।

দীর্ঘ ৯ মাসব্যাপী ৬৫ জনের শক্তিশালী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি গ্রুপ এখানে অবস্থান করে এলাকায় নিরীহ মুক্তিকামী মানুষের ওপর নির্যাতন, নিপীড়ন ও হত্যাযজ্ঞ চালায়। অনেক মুক্তিকামী মানুষকে পাক বাহিনী হত্যা করে মধুমতি নদীর পানিতে ফেলে দেয়। ভাটিয়াপাড়ার পাক বাহিনীর ক্যাম্পটি দখল নিয়ে ৬ নভেম্বর দুটি মারাত্মক যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধা বাবুল, ইসমত কাদির গামার নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী টানা ১৫ ঘণ্টা যুদ্ধ করে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে। এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের ঘায়েল করতে পাক বাহিনী আকাশ পথে গুলি ও বোমা বর্ষণ করে। কিন্তু সেদিন অসীম সাহসী মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হাটেনি। পাক বাহিনী যথেষ্ট ঘায়েল হয় এ যুদ্ধে।

এ ওয়্যারলেস ক্যাম্প দখল নিয়ে দ্বিতীয় দফায় যুদ্ধ হয় ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের দিনে। ৩ দিন যুদ্ধের পর ১৯ ডিসেম্বর খুব ভোরে নড়াইল জেলার দিক থেকে ৮ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর মঞ্জুর, নড়াইল জোনের মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার ক্যাপ্টেন হুদা, লে. কর্নেল জোয়ান, কামাল সিদ্দিকী, গোপালগঞ্জ ও ফরিদপুরের দিক থেকে ক্যাপ্টেন ইসমত কাদির গামা ও বাবুলের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী সম্মিলিতভাবে ভাটিয়াপাড়ার মিনি ক্যান্টনমেন্টে আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বাত্মক হামলা ও বীরোচিত সাহসী যুদ্ধে অবশেষে ১৯ ডিসেম্বর সকাল ১০টার দিকে মুক্তি ও মিত্র বাহিনীর যৌথ কমান্ডারের কাছে ৬৫ জন পাক সেনা আত্মসমর্পণ করে। এ যুদ্ধে ৬ জন পাক সেনা নিহত হয়। অপর দিকে, কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা নিহত ও আহত হন। এরপর ভাটিয়াপাড়ার ওয়্যারলেস স্টেশনের মিনি ক্যান্টনমেন্টে ওড়ানো হয় লাল-সবুজের পতাকা।