অবহেলায় পড়ে আছে রাবির প্রথম শহীদ মিনার

প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৯:১২

রাবি প্রতিনিধি

ষাটের দশকে স্বৈরশাসক আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলনের সময়ের কথা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রায় এক দশক পেরিয়ে গেছে। কিন্তু তখন পর্যন্তও বিশ্ববিদ্যালয়ের গড়ে ওঠেনি ভাষা শহীদদের জন্য কোন স্মৃতির মিনার। মায়ের ভাষার জন্য জীবন দেয়া বীরদের স্মরণে প্রিয় বিদ্যাপিঠে থাকবেনা কোন স্মৃতির মিনার, তা কি করে হয়?

বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। আব্দুল হামিদ, আব্দুর রাজ্জাক, আবুল হোসেন, আবুল কাশেম, আব্দুল হাই, একরামুল হক খুদ, মুস্তাফিজুর রহমান সুজা, প্রভাত কুমার প্রমুখ কয়েক রাবি ছাত্র পণ করলেন শহীদ মিনার গড়ার। ১৯৬৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ কলা ভবনের দক্ষিণে আম বাগানে রাতারাতি গড়ে তুললেন ভাষা শহীদদের স্মরণে প্রথম শহীদ মিনার। পরে রাবি কেন্দ্রীয় সংসদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রচেষ্টায় এ শহীদ মিনার পূর্ণাঙ্গতা পায়।

কিন্তু ’৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী রাতের অন্ধকারে বোমা মেরে গুড়িয়ে দেয় ছাত্রদের সেই ভালোবাসার মিনার। স্বাধীনতার পর স্থান বদলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শের-ই-বাংলা ফজলুল হক হলের সামনে চার একর জমিতে বর্তমান কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারটি নির্মাণ করা হয়।

এরপর থেকেই মনযোগ হারায় রাবিতে ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত প্রথম শহীদ মিনারটি। বেদির কয়েকটি ইটের টুকরো ছাড়া গুড়িয়ে দেয়া মিনারটির আর কিছু অবশিষ্ট নেই। রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগের অভাবে তাও হারিয়ে যেতে বসেছে। এমনকি অধিকাংশ শিক্ষক-শিক্ষার্থীই জানেন না রাবির এই প্রথম শহীদ মিনারটি সম্পর্কে।

আবৃত্তি সংগঠন স্বনন’র গোড়ার দিকের কর্মী কবি মোহাম্মদ কামাল। বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলো থেকে শহীদ মিনারটিকে অবহেলায়, অযত্নে পড়ে থাকতে দেখে আসছেন। বললেন, ‘অধিকাংশ শিক্ষক-শিক্ষার্থীই জানেন না রাবির প্রথম শহীদ মিনারটি কোথায়। মিনাটির ধ্বংসাবশেষে ছেলেমেয়েরা না জেনেই বসছে, জুতা পায়ে মাড়িয়ে যাচ্ছে, সিগারেট ফঁকছে। এসব দেখে আমার খুব কষ্ট হয়। আমরা অনেক বার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বলে এসেছি জায়গাটাকে ঘিরে রেখে সংরক্ষণ করে রাখতে। এতে করে এই ঐতিহাসিক জায়গাটি টিকে থাকবে, নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীরাও তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শহীদ মিনারটিকে চিনবেন, জানবেন।’

শহীদুল্লাহ কলা ভবনের দক্ষিণের আম বাগানে প্রতিনিয়ত শিক্ষার্থীরা বসে আড্ডা দেন। পাশের ইট বিছানো রাস্তা দিয়ে হেঁটে যান। কিন্তু অধিকাংশ শিক্ষার্থীই জানেন না সেখানে একটি শহীদ মিনার আছে। আফসোস করে রাবি শিক্ষার্থী হারুন অর রশিদ বললেন, ‘দেশের দ্বিতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শহীদ মিনারটি এভাবে অরক্ষিত রাখা ঠিক নয়। ভাষার জন্য আত্মোৎসর্গকারীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য মিনারটি নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই এই শহীদ মিনারটি সম্পর্কে জানেন না। ফলে না জেনেই শিক্ষার্থীরা প্রতিনিয়ত মিনারটির ওপর বসছেন, হেঁটে যাচ্ছেন। এতে করে ভাষা শহীদদের যতটা অবমাননা করা হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি আমাদের বাঙালিত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। আশা করি, শহীদ মিনারটি সংরক্ষণে প্রশাসন দ্রুত ব্যবস্থা নেবেন।’

দীর্ঘদিন ধরে শহীদ মিনারটি সংরক্ষণে করার দাবি করে আসছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সংগঠন। কয়েক বছর আগে বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা স্ব-উদ্যোগে শহীদ মিনারটি বাঁশ-দড়ি দিয়ে ঘিরে রাখেন। এছাড়া প্রতি বছর ‘চিহ্ন’ মেলা’য় দর্শণার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য মিনারটি ঘিরে রাখা হয়।

২০১৫ সালের ৫ নভেম্বর স্বনন’র ৩৪তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে সংগঠনটির কর্মীরা প্রথমবার শহীদ মিনারটিতে ফুল দিয়ে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর থেকে প্রতিবছর শহীদ দিবস ও আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস এবং সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে স্বনন কর্মীরা শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে এবং মিনারটি সংরক্ষণের দাবি জানিয়ে আসছেন।

স্বনন’র সাবেক আহ্বায়ক জিএম ইকরামুল কবীর বলেন, ‘ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য নির্মিত রাবির প্রথম এই শহীদ মিনারটিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গুড়িয়ে দেয়। সেই হিসেবে এটি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিও বহন করে। তাই আমাদের প্রাণের দাবি, শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালার মাধ্যমে এই শহীদ মিনারটি যথাযোগ্য মর্যাদায় সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হোক।’

এ বিষয়ে রাবি উপ-উপাচার্য অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান বলেন, ‘রাবির প্রথম শহীদ মিনার হিসেবে এটি সংরক্ষণ করা যেতে পারে। কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের পাশেই শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভকে ঘিরে করা চত্বর হচ্ছে। এর সঙ্গে মিনারটিকে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হবে।’

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত