বঙ্গবন্ধুর নামেই জনগণ যুদ্ধ করেছে: ইন্দিরা গান্ধী

প্রকাশ : ০৬ মার্চ ২০১৭, ১১:২৯

সাহস ডেস্ক

ভারতের প্রয়াত সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আত্মজীবনী গ্রন্থ ‘মাই ট্রুথ’ বইতে তিনি লিখেছেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুর নামেই যুদ্ধ করেছিলো-‘তারা (বাংলাদেশের মানুষ) তখন যা কিছু করেছে, তা তাঁর নামে এবং তাঁর জন্যেই করেছে’।

গান্ধীর এ বইতে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে তাঁর ব্যক্তিগত অনুভূতির স্বত:স্ফুর্ত অভিব্যক্তির প্রকাশ ঘটেছে। জাতির পিতা সম্পর্কে তিনি বলেন, “তিনি অত্যন্ত সংবেদনশীল, হৃদয়বান ব্যক্তি ছিলেন: যতটা না তিনি শাসক ছিলেন, তারও চেয়ে বেশি ছিলেন জাতির পিতা।”

সাক্ষাৎকার ও অন্যান্য উৎস থেকে গ্রন্থিত ‘মাই ট্রুথ’ একটি বিরল এবং সত্যিকার অর্থেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। এ বইতে ইন্দিরা গান্ধীর নিজের ভাষায় তাঁর জীবন চিত্রায়িত হয়েছে। ১৯৮০ সালে যখন তিনি ক্ষমতার বাইরে ছিলেন তখন এই বইটির প্রথম সংস্করণ একই সময়ে ভারত ও ফ্রান্স থেকে প্রকাশিত হয়।

১৯৭১ সালের ভয়াল ২৫ মার্চের কালরাত্রির মাত্র এক সপ্তাহ আগে ১৮ মার্চ গান্ধী কংগ্রেস পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা এবং তৃতীয়বারের মতো ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।

গান্ধীর বর্ণনা অনুযায়ী সেসময় ভারতে একটি অন্যরকম পরিস্থিতি বিরাজ করছিলো- “কংগ্রেসে সংকট, তার ধারাবাহিকতায় প্রতিযোগিতাপূর্ণ অসহিষ্ণু মনোভাব, নির্বাচনী প্রচারণা এবং এর ফলাফল সবকিছু মিলিয়ে দেশে একটি উত্তপ্ত অবস্থা বিরাজ করছিলো এবং তাদের উচ্চাশাকে প্রশমিত করা কঠিন হয়ে পড়েছিলো।

তা সত্বেও পূর্ব পাকিস্তানে কি ঘটছে সে বিষয়ে তিনি ভালোভাবেই অবগত ছিলেন। “প্রথমেই আমরা জানতে পেরেছিলাম যে পাকিস্তানীরা মুজিব (জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) কে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করার বদলে যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে।”

গান্ধী অনতিবিলম্বেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে অভাবনীয় কিছু ঘটতে যাচ্ছে। তিনি লিখেছেন, “একাত্তরের যুদ্ধ কোন সাধারণ যুদ্ধ ছিলো না। এটা যতোটা ধর্মীয় বিষয় তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক বিষয় ছিলো।”

তিনি লিখেছেন, “আমাদের পক্ষে যতটা সম্ভব ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা এর থেকে দূরে ছিলাম” যদিও “কিছু করার জন্য আমাদের ওপর চাপ ছিলো এবং কিছু মানুষ মনে করছিলেন যে আমাদের সৈন্য পাঠানো উচিত”।

১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি মস্কো সফরে যান। সেখান থেকে পরে অক্টোবরে তিন সপ্তাহের রাষ্ট্রীয় সফরে ইউরোপিয়ান দেশগুলো সফর করেন। “ তাদের দেশের জনগণকে একথা বলতে যে যদি পাকিস্তানীদের ওপর তাদের কোন প্রভাব থাকে তাহলে সেই প্রভাব খাটিয়ে তাদের আরো দায়িত্বশীল হতে হবে।”

যুদ্ধের একেবারে শুরু থেকেই গান্ধী বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন। “আমার মনে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ ছিলোনা যে বাংলাদেশীরা তাদের স্বাধীনতা অর্জন করবে। একবিন্দুও সন্দেহ ছিলো না। কিন্তু একটাই প্রশ্ন যদি তারা জয়ী হয়, তবে সেটা কখন ঘটতে যাচ্ছে এবং তখন আমাদের অবস্থানটা কোনদিকে হবে? যদি শুধু ভৌগলিক অবস্থানের বিবেচনায় আমরা কোন ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি তার মূল্য আমরা দিতে পারবো না।

রিফিউজিদের মুখ থেকে শুনে এবং দেশ ও বিদেশের গণমাধ্যমে বর্ণিত নৃশংসতা ও ভয়াবহ রক্তপাতের ঘটনা সম্পর্কে জেনে এ প্রশ্নও মনে জেগেছিলো যে জয় যখন দোরগোড়ায় তখন বড় ধরনের রক্তপাতেরই বা যৌক্তিকতা কি?

গান্ধী আরো লিখেছেন যে, ভারত কখনোই এশিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে আগ্রহী ছিলোনা। তিনি বলেন, আমরা আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোতে ছোট দেশগুলোকে উৎসাহিত করতাম। আমরা শ্রীলংকা, নেপাল, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ এবং এরকম অনেক দেশকেই একই পরামর্শ দিতাম। যেন কেউই মনে না করে যে আমরা বড় আকৃতির কারণে অন্যদের জন্য চাপ সৃষ্টি করছি। কিন্তু আমরা মনে করেছি প্রত্যেক দেশকে সত্যিকার অর্থেই মুক্ত হওয়া উচিত, স্বাবলম্বি এবং তাদের লক্ষ্য অর্জনে স্বাধীন হওয়া উচিত।

তিনি এও বিশ্বাস করতেন যে, এই বিশ্ব পরস্পরনির্ভরতার বিশ্ব। তবে পরস্পর নির্ভরতার বিষয়টি কোন দেশের সার্বভৌমত্ব বাদ দিয়ে নয়। অন্যের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করলেই সম্পর্কের অবনতি হয়।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত