বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ: সংবিধানে সংযুক্তি এবং ‘সংকলিত’ ৪/৫ মিনিট

প্রকাশ : ০৭ মার্চ ২০১৭, ১৮:২৬

মমতাজুল ফেরদৌস জোয়ার্দার

২০০৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের উপর প্রায় আড়াই’শ প্রতিবেদন আমি পড়েছি এবং সেগুলো সব আমার সংগ্রহে আছে। এর আগেও ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে লেখা অনেক প্রতিবেদন আমি পড়েছি। সবাই বিভিন্ন আলোকে তাদের মতামত ব্যাখ্যা করেছেন। এই প্রতিবেদনগুলো সব একসাথে করলে হাজার পৃষ্ঠার উপরে একটা বই হবে। ৭ মার্চের ভাষণের স্বপক্ষে হাজার, হাজার পৃষ্ঠা লিখেও শেষ করা যাবে না। এই ভাষণের প্রায় প্রত্যেকটা শব্দ তার স্বপক্ষে যৌক্তিক ব্যাখ্যার দাবি রাখে।

যতগুলো প্রতিবেদন আমার কাছে আছে তার মধ্যে ১০৫টা প্রতিবেদনে সময়ের উল্লেখ করা হয়েছে, সর্বনিম্ন কেউ লিখেছেন ১৭ মিনিটের আর সর্বোচ্চ ৪৩ মিনিটের। আমার মনে হয় ৪৩ মিনিট এটা একটা অনিচ্ছাকৃত ভুল, সম্ভবত উনি ২৩ মিনিট লিখতে চেয়েছিলেন। কারণ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ যারা লিখেছেন তা হল ২২ মিনিট। উল্লেখিত ১০৫টি প্রতিবেদনের পরিসংখ্যান নিম্নরূপ-

১৭ মিনিট লেখা হয়েছে ৭টা প্রতিবেদনে
১৮ মিনিট লেখা হয়েছে ২৫টা প্রতিবেদনে
১৯ মিনিট লেখা হয়েছে ৪৭টা প্রতিবেদনে
২০ মিনিট লেখা হয়েছে ১৮টা প্রতিবেদনে
২২ মিনিট লেখা হয়েছে ৭টা প্রতিবেদনে
৪৩ মিনিট লেখা হয়েছে ১টা প্রতিবেদনে

সর্বোচ্চ ৪৭টা প্রতিবেদনে ১৯ মিনিট বলা হয়েছে। তাহলে কি আমরা ধরে নেব এটা ১৯ মিনিটের শব্দমালা ছিল? সেটা বোধকরি সেটা ঠিক হবে না, কারণ যারা প্রতিবেদনগুলো লিখেছেন তারা কেউই যাচাই-বাছাই করেছেন বলে মনে হয় না। উনারা কোথাও পড়েছেন সেটাই লিখেছেন। টেলিফোনে অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম ও ড. মুনতাসীর মামুন আমাকে সেরকমই বলেছেন।

এক্ষেত্রে ৭ মার্চের ভাষণের একটু সাহায্য নিতে পারি। এই ভাষণের যে কথাগুলো আমার মনে সবথেকে বেশি দাগ কেটেছে তা হল, ‘যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশী হলেও একজন যদিও সে হয় তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।’ ন্যায্য কথাটা মেনে নেবার মত সাহস পৃথিবীতে খুব কম মানুষেরই আছে। সংখ্যাগরিষ্ট কিন্তু ন্যায্য বাক্তি বা সরকার সব সময় নির্বাচত করে না তার ভুরি, ভুরি উদাহরণ পৃথিবীতে আছে। চিন্তা করে দেখেনতো একজন নেতা কতটা সৎ, সাহসী, আত্মবিশ্বাসী ও উদার হলে এ কথা বলেতে পারে। ন্যায্য কথা মেনে নেবার মত বড় গণতন্ত্র আর হতে পারে না। আমি মনে করি গণতন্ত্রের এটাই সব থেকে আধুনিক এবং সঠিক সংজ্ঞা।

৭ মার্চ ২০১১ দৈনিক জনকন্ঠে কবি নির্মলেন্দু গুণ ৭ মার্চ- ঐতিহাসিক ভাষণ-দিবস প্রবন্ধে লিখেছেন, ঐ ভাষণ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় ও প্রাসঙ্গিক কিছু তথ্য সকলের অবগতির জন্য বলি- ১৯৭১-এর ৭ মার্চ ২:৩০র মধ্যে সভাস্থলে আসার কথা থাকলেও, নিরাপত্তাজণিত কারণে বেশ কিছুটা বিলম্বে ৩টা ১৫ মিনিটে বঙ্গবন্ধু সভাস্থলে আসেন এবং ৩-২০মি. তিনি ‘ভায়েরা আমার’ বলে তাঁর অলিখিত ভাষণ শুরু করেন। ঐ অগ্নিগর্ভ, মহাকাব্যিক ভাষণের স্থায়িত্বকাল ছিলো প্রায় ২০ মিনিট। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ছিলো রবিবার। [তথ্যসূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক/দৈনিক সংগ্রাম, ৮ মার্চ ১৯৭১] জাতীয় প্রেসক্লাব সভাপতি মুহম্মদ শফিকুর রহমান অনেকটা একই রকম তথ্য দিয়েছেন তার শনিবার, ১০ মার্চ ২০১২, দৈনিক জনকন্ঠে ‘৭ মার্চের ভাষণ ॥ যেভাবে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি আমাদের হলো’ প্রবন্ধে। উনি বলেছেন, মাত্র ১৯ মিনিটে ১০৯৫ শব্দ-বুলেটের মালা গেঁথে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে শেষ করেন। ৩টা ২৩ মিনিটে ভাষণ শুরু করেন এবং শেষ করেন ৪টা ৪২ মিনিটে। বঙ্গবন্ধু কোন মিলিটারি বিশেষজ্ঞ বা যুদ্ধ গবেষক ছিলেন না, তবু ১৯ মিনিটের একটি ভাষণে তখনকার পরিস্থিতিতে কি কি করণীয় তার সবই বলে দিলেন। একজন রাজনৈতিক গেরিলা কমান্ডারের মতো। কিভাবে সরকার গঠন করতে হবে কিভাবে একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করতে হবে, তার রাজনৈতিক, সামাজিক, প্রশাসনিক ও সামরিক দিকগুলো বলে দিলেন। মার্চ ০৭, ২০১১  দৈনিক ইত্তেফাকে নূহ-উল-আলম লেনিন উনার ‘৭ মার্চের ভাষণ এবং বাঙালির সশস্ত্র গণঅভু্যত্থানের শিল্পরূপ’ প্রবন্ধে কবি গুণের মতই তথ্য দিয়েছেন, উনি বলেছেন, সুনামি বা ভূমিকম্পের মতো মাত্র ২০ মিনিটের একটা বক্তৃতা একটি জাতির ইতিহাসের দৃশ্যপট বদলে দিতে পারে_ এটা ভাবতেও বিস্ময়বোধ হয়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ। সেদিনের রেসকোর্স ময়দানের উত্তাল জনসমুদ্র। অপেক্ষমান জনতার কাছে প্রতিটি মিনিট যেন এক একটা শতাব্দী। অপরাহ্ন ৩টা ১৫ মিনিটে মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন তিনি। সমুদ্রগর্জনে মুখর জনসমুদ্র ‘জয় বাংলা_ জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনিতে চরাচর প্রকম্পিত করছে। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি এবং কালো মুজিবকোট পরিহিত দীর্ঘদেহী শ্যামকান্ত মানুষটি মঞ্চের সামনে, ডানে, বামে_ চারদিকে জনতার উদ্দেশে হাত নেড়ে তাদের অভিনন্দনের জবাব দেন। তারপর ঠিক বেলা ৩টা ২০ মিনিটে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে জলদগম্ভীর কণ্ঠে উচ্চারণ করেন, ‘ভায়েরা আমার’।

কবি নির্মলেন্দু গুণ তার তথ্যসূত্র সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, বাকি দু’জন প্রায় একই রকম তথ্য দিয়েছেন কিন্তু উৎস বলেননি। ততকালীন সময়ে দৈনিক ইত্তেফাকের মত নির্ভরযোগ্য পত্রিকা আর ছিল না, অতএব ইত্তেফাকের তথ্যটাই আমরা মোটামুটি ঠিক বলে ধরে নিতে পারি, সেটাই বোধকরি ন্যায্য কাজ হবে। সবথেকে বড়কথা ভাষণটা ২০মিনিটের না হয়ে যদি ১৭ মিনিটের হয়ে থাকে, সেটাই গেল কোথায়? সংবিধানে যতটুকু সংযোজন করা হয়েছে তার অডিও/ভিডিওর দৈর্ঘ্য ১০ মিনিট ৪৩ সেকেন্ড। সরকারের তথ্যমন্ত্রণালয় একটা ভিডিও ছেড়েছে বাজারে যার শুরুতে ইংলিশে লেখা আছে- Department of Films and Publications, Ministry of Information, Government of the people's Republic of Bangladesh, Presents. শেষে Translated by: Tito Chowdhury, Edited by : Professor Kabir Chowdhury. এই ভিডিওর দৈর্ঘ্য ১৪ মিনিট ৫০ সেকেন্ড, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য ১৩ মিনিট ৫৬ সেকেন্ড। You Tube এ একটা ভিডিও ফুটেজ পাওয়া যাচ্ছে missing footage 7th march বলে যার দৈর্ঘ্য ৩৭ সেকেন্ড কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য ২৭ সেকেন্ড। ৩৭ সেকেন্ডের এ ভিডিওটা জন্মযুদ্ধ ৭১ কত্ত্বৃক প্রকাশিত। বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ নিবেদিত, পরিকল্পনা ও পরিচালনায় মোনায়েম সরকার  একটা ভিডিও You Tube এ আছে সেখানে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য ১৩ মিনিট ০৩ সেকেন্ড। সর্বমোট যা আমরা পাচ্ছি তা হল ১৪ মিনিট ২৩ সেকেন্ড। এখন আমার প্রশ্ন হল ভাষণটা যদি ১৭ মিনিটেরও হয়ে থাকে তাহলে বাকি ২ মিনিট ৩৭ সেকেন্ড গেল কোথায়?

একটা প্রতিবেদনে একজন লিখছেন ১০ মিনিট ৪৩ সেকেন্ডের যে অডিও এটা নাকি তাজউদ্দিন আহমেদ সম্পাদনা করেছিলেন। যারা এ ভাষণ সম্পাদনা করেছেন তাদের প্রতি যথেষ্ট সম্মান রেখেই আমি বলছি, এটা কোন বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র না যে অশ্লীল দৃশ্য আছে আর সেটা বাদ দিয়ে দেখাতে হবে। যারা এটা কাটা ছেড়া করেছেন তাদের কারোরই এটা ভুলে যাওয়া উচিত হয়নি যে এটা আমাদের জাতির পিতার ভাষণ। উনার কথাগুলো অবিকৃত, আপরিবর্তিত অবস্থায় শোনার সাংবিধানিক-অসাংবিধানিক সকল অধিকার আমার এবং আমাদের প্রত্যেকটা নাগরিকের আছে।

একটা ব্যাপার আপনারা লক্ষ্য করে থাকবেন যখন সংবিধানে ১০ মিনিট ৪৩ সেকেন্ড আবার তথ্যমন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত ভিডিও ১৩ মিনিট ৫৬ সেকেন্ড এর অর্থ সরকারের দু’টো সংস্থার কাজের মধ্যে কোন সমন্বয় নেই। সংবিধানে লেখা হয়েছে ‘১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ তারিখে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া ঐতিহাহিক ভাষণ।’ কোথাও বলা হয়নি এটা সম্পাদিত ভাষণ। কিন্তু এটা যে কাটা ছেড়া করা হয়েছে  সেটা প্রমানিত হবে তথ্যমন্ত্রণালয় প্রদত্ত ভাষণটা শুনলেই। তথ্যমন্ত্রণালয় অবশ্য সততা দেখিয়েছে তারা বলেছে এটা প্রফেসর কাবির চৌধুরী সম্পাদিত অর্থাৎ ওটাও পুরো ভাষণ নয়। তার প্রমাণ জন্মযুদ্ধ৭১ কর্তৃক প্রকাশিত অংশটুকু।

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ, জাতীর পিতার যে ভাষণের নির্দেশনার উপর দেশ স্বাধীন হয়েছিল সে ভাষণকে নজিরবিহীন সম্বন্বয়হীন ভাবে, মিথ্যাচারের মাধ্যমে, দায়সারার মত সংবিধানে সংযোজন করবে এটা মেনে নেওয়া যায় না। মিথ্যাচার বললাম এ কারণে যে, সেখানে বলা হয়নি এটা সম্পাদিত। একটা প্রবন্ধে একজন লিখেছেন ভাষণের এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু থেমে গিয়ে বললেন এইমাত্র খবর পেলাম পাকবাহিনী আমার বক্তিতার সম্প্রচার বন্ধ করে দিয়েছে। তারপর উনি রেডিও এবং টেলিভিষণের কর্মচারীদের দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। এগুলো সবই ওই ভাষণের অংশ, আমাদের ইতিহাসের অংশ। অপরিবর্তিতভাবে ভাষণটা দেখতে পেলে, নতুন প্রজন্মের কাছে তৎকালীন পরিস্থিতি প্রাণবন্ত হবে, ইতিহাস বুঝতে সুবিধা হবে। যেহেতু এগুলো আমাদের ইতিহাসের অংশ অতএব এর সবকিছু আমরা দেখতে চাই, শুনতে চাই, পড়তে চাই। সম্মানিত স্পিকার ও সংসদ সদস্যদের কাছ থেকে এরকম দায়সারাভাবে ঐতিহাসিক ভাষণের সংবিধানে সংযুক্তি লজ্জাজনক এবং ঘৃণার। এখানেই কথা শেষ না যে অংশটুকু সংবিধানে সংযুক্ত করা হয়েছে সেখানেও অসংখ্য ভুল। অন্য শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, সমার্থক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ সংবিধানে লেখা হয়েছে: এদেশের মানুষ অর্থনীতি, রাজনীতি, সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে। কিন্তু এটা ঠিক না বঙ্গবন্ধু বলেছেন, এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে।’ আরেক জায়গায় লেখা হয়েছে, ‘আমরা পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি’, কিন্তু বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘যা আমার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি।’ রামেন্দু মজুমদার তার বইয়ে লিখেছেন জামার পয়সা।’

কিন্তু জাতীয় সংসদ যে অবহেলায় কাজটা করেছেন সেজন্য তাদের উচিত জাতীর কাছে ক্ষমা চাওয়া, এবং বিশেষজ্ঞদের নিয়ে বসে সঠিকভাবে পুরো ভাষণটা সংবিধানে সংযোজন করা অথবা বাদ দেওয়া কিন্তু কোন অবস্থায়ই বিকৃতভাবে না। এ জাতীয় ভুলের পর জাতীয় সংসদের স্পিকারের ঐ পদে থাকা নীতিগতভাবে উচিত না।

যতগুলো নিবন্ধ আমি পড়েছি এদের মধ্যে যে সকল বিশিষ্ট ব্যক্তির টেলিফোন নাম্বার যোগাড় করতে পেরেছি তাদের সাথে কথা বলেছি। আভিনেতা পিযুষ বন্দোপধ্যায়কে ফোন করেছিলাম ৭ মার্চ ২০১০ এ কালের কন্ঠে লেখা উনার একটা নিবন্ধ ‘৭ মার্চ আমাদের অহঙ্কারের দিন’ নিয়ে কথা বলার জন্য। উনি আমাকে যথেষ্ট সময় দিয়েছেন, চমৎকার আচরণ করেছেন, যা আমি জীবনে ভুলবো না। যখন আমি উনাকে বলেছি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে আপনার সাথে কথা বলতে চাই, উনি কোন রকম ব্যস্ততা দেখাননি। উনাকে জিজ্ঞাসা করলাম আপনি লিখেছেন,‘মাত্র ১৮ মিনিটে তিনি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি।’ এ তথ্য কোথা থেকে? উনার উত্তর- উনি কোন গবেষক নন, প্রতিবেদনটা উনি লিখেছেন মনের আবেগ থেকে আর সময়ের ব্যাপারটা কোথাও পড়েছেন তাই। ঐদিন মিটিংএ উনি উপস্থিত ছিলেন, বললেন উনার হাতে ঘড়িও ছিল কিন্তু ঘড়ি দেখার কথা উনার কখনও মনে হয়নি। কি সুন্দর উনার স্বীকারোক্তি। সেদিন রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত প্রায় সকলেই তো সম্মহিত ছিল ঘড়ি দেখার কথা খেয়াল থাকে কারো?

৭ মার্চের ভাষণটা আমি প্রথম পড়ি অভিনেতা রামেন্দু মজুমদার সম্পাদিত ‘বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ’ বইয়ে। প্রতিলিপি শুরুর আগে উনি লিখেছেন,‘৭ই মার্চ, ১৯৭১ ঢাকার রেসকোর্সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়। কমপক্ষে ১০ লক্ষ লোক তাদের নেতার কাছ থেকে নির্দেশ গ্রহণ করার জন্যে এক জনসভায় সমবেত হয়। বেশীর ভাগ লোকই বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা শুনতে চাইছিলেন। বঙ্গবন্ধু দেরীতে সভাস্থলে আসেন। তাঁর ১৮ মিনিটের বক্তৃতায় বাঙালীর মুক্তি............।’ আপনারা দেখছেন রামেন্দু মজুমদার নিজে লিখছেন এটা ১৮ মিনিটের বক্তৃতা অথচ উনি লিপিবদ্ধ করেছেন ১০ মিনিট ৪৩ সেকেন্ডের অডিও, কিন্তু উনার বইয়ে কোথাও সেকথাটা উনি উল্লেখ করেননি। বঙ্গবন্ধু ‘ভায়েরা আমার-’ বলে বক্তব্য শুরু করেছিলেন এ শব্দ দু’টোও উনি এড়িয়ে গেছেন। শেষে উনি লিখেছেন,‘[সূত্রঃ টেপ রেকর্ডিং]’।

৭ই মার্চ ২০১২, দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকায় আব্দুল গাফ্‌ফার চৌধুরী লিখেছেন, ‘আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য, আমি ইতিহাসের এই ক্ষণজন্মা নেতাকে দেখেছি। তাঁর সানি্নধ্য পেয়েছি। তাঁর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ শুনেছি। আমেরিকায় গৃহযুদ্ধের পর গেটিসবার্গে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের ঐতিহাসিক ভাষণটি শোনা এবং তা রিপোর্ট করার পর এক মার্কিন সাংবাদিক লিখেছিলেন, ‘লিঙ্কনের এই ভাষণ শোনা ও তা লেখার পর মনে হচ্ছে, আমার সাংবাদিকতা এখানেই শেষ হলে ভালো হয়। কারণ, আমি একটি ইতিহাসের অন্তর্গত হয়ে গেছি।’ আমারও মাঝেমধ্যে মনে হয়, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি স্বকর্ণে শোনার পর এবং তা নিয়ে অজস্র লেখা লেখার পর আমিও সাংবাদিকতায় ইতি টানলে ক্ষতি ছিল না। কারণ, আমিও একটি ইতিহাসের অন্তর্গত হয়ে গেছি এবং অন্তর্গত হয়ে আছি।’ এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন রামেন্দু মজুমদার কতবড় গুরুত্বপূর্ণ, ঐতিহাসিক ও স্পর্শকাতর একটা বিষয় অসর্তকতায়, অবহেলায় সম্পাদন করেছেন। আমার মনে হয় উনি যখন ভাষণটা লিপিবদ্ধ করেছেন খেয়াল করে দেখেননি এটা কত মিনিটের, অথচ উনার উচিত ছিল সর্বোচ্চ সর্তক থাকা। রামেন্দু মজুমদারের সাথে ১২/১১/২০১৫ তারিখে আমি কথা বলেছিলাম। উনি অবশ্য স্বীকার করেছিলেন, আমার অভিযোগ সঠিক কিন্তু ঐই পর্যন্তই। পরবর্তী পদক্ষেপ উনি নেননি, একটা সংশোধন প্রয়োজন ছিল সেটা উনি করেননি।

২০১৫ সালের অক্টোবরের ৯ তারিখে নূহ-উল-আলম লেনিনের সাথে ১৯ মিনিট ৫০ সেকেন্ড কথা বলি তখন উনি আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য ছিলেন। উনাকেও আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে, আপনি লিখেছেন ২০ মিনিটের ভাষণ কিন্তু বহুল প্রচলিত ভাষণটা ১০ মিনিট ৪৩ সেকেন্ডের বাকি অংশ গেল কোথায়, এটা আসলেই ২০ মিনিটের বক্তব্য ছিল কিনা? উনার উত্তর আমার কাছে বোমা বিস্ফোরণের মতই ছিল। লেনিন বললেন ভাষণটা ১৯/২০ মিনিটের সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। আরও জানালেন ভাষণটা সংবিধানে সংযোজন করা হয়েছে (উনার কাছেই আমি প্রথম জানতে পারলাম ব্যাপারটা)। সংবিধানে সংযোজন করার আগে নাকি তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে ভাষণের মূল কপির একটা সিডি সব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল এবং উনাকেও একটা কপি দেওয়া হয়েছিল। মতামতের জন্য যে কিভাবে এটা সংবিধানে সংযোজন করা হবে। লেনিন আমাকে জানালেন সব মন্ত্রণালয় মিলে সিদ্ধান্ত নেয় যে, যেহেতু বাজারে ১০ মিনিট ৪৩ সেকেন্ডের অডিও/ভিডিও বহুল প্রচলিত, এখন পুরো ভাষণটা ছাপালে অহেতুক বির্তক হবে।  উনি আরও বললেন পুরানো হয়ে যাবার কারণে ভাষণের অনেক জায়গা বোঝা যাচ্ছে না, কোন কথা দু’বার আছে। এ কারণে সম্পাদিত অংশটাই সংবিধানে সংযোজনের সিদ্ধান্ত হয়। তখন আমি উনাকে চেপে ধরি বির্তক তো আপনারা কোনভাবেই এড়াতে পারবেন না, কারণ তথ্যমন্ত্রণালয় যে ভিডিও বাজারে ছেড়েছে এই ভিডিওর দৈর্ঘ্য ১৩ মিনিট ৫৬ সেকেন্ড এবং এ ভিডিওর কোন কথা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না। ঐদিন লেনিন আমার কথার সন্তোষজনক উত্তর দিতে না পেরে রাজনীতিক চটুলতায় ব্যাপারটা এড়িয়ে গেলেন। এখানে আমার একটা প্রশ্ন সব মন্ত্রণালয়ের মতামত যখন নেওয়া হচ্ছিল তখন তথ্যমন্ত্রণালয় কি ঘুমাচ্ছিল? তারা কেন বললো না যে, আমরা একটা অকাজ করে ফেলেছি ১৩ মিনিট ৫৬ সেকেন্ড বাজারে ছেড়েছি।

একটা ব্যাপার পরিষ্কার স্বাধীনতার পক্ষের একটা সরকার, যে সরকারের প্রধান জাতীর পিতার কন্যা। সেই সরকার তথ্য গোপন করছে, তথ্য বিকৃতভাবে উপস্থাপন করছে তথা ইতিহাস বিকৃত করছে কিন্তু কিসের স্বার্থে? সরকারের মন্ত্রী না হয়েও নূহ-উল-আলম লেনিন যদি পূর্নাঙ্গ ভাষণের কপি পেতে পারে তাহলে আমি কেন পাবো না, সমগ্র জাতি কেন পাবে না? মনে রাখবেন, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের ব্যক্তিগত সম্পদ না, উনি সমগ্র বাংলাদেশের তথা সারা বিশ্বের নিপিড়ীত মানুষের।

৭ মার্চের ভাষণের সর্বসাকূল্যে যতটুকু আমি শুনেছি তা হল ১৪ মিনিট ২৩ সেকেন্ড, সেখানে কোন কথা দু’বার আছে বলে আমার মনে হয়নি। ঘোর-প্যাঁচ বাদ দিয়ে যদি আমরা তথ্যমন্ত্রণালয় প্রদত্ত ১৪ মিনিট ৫০ সেকেন্ডের ভিডিওটা দেখি তাহলে ঠিক ৭ মিনিট ৩৯ সেকেন্ডের পর যে বাক্যগুলো আসে তা হল, ‘আমি পরিষ্কার মিটিংএ বলেছি যে এবারের সংগ্রাম আমার মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ আর ১৪ মিনিট ১৯ সেকেন্ডের পর যে বাক্যগুলো আসে তা হল, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বাক্যগুলো অনেকটা একরকম দেখালেও এক অর্থ বহন করে না।

প্রথমে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘আমার মুক্তির সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।’  উনি ৭ মার্চের আগে পাকিদের সাথে যখন মিটিংএ বসেছিলেন তখন তাদেরকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, সেটাই ৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানে উনি প্রথমে জনগণকে অবহিত করেছন। মনে রাখতে হবে প্রথমবার উনি বলেছেন আমার মুক্তির সংগ্রাম, আমাদের না। অর্থাৎ উনি জনগণকে প্রস্তুত করলেন, জনগণের অভিপ্রায় বুঝতে চেষ্টা করলেন। তারপর ভাষণের প্রায় শেষ পর্যায়ে চূড়ান্ত কথাটি বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ নূহ-উল-আলম লেনিন সহ যাদেরই এ ব্যাপারে দ্বিমত আছে তাদেরকে আমি পরামর্শ দিতে পারি ভাষণটা মনযোগ সহকারে বারবার শুনতে কিন্তু কোন অবস্থায়ই অনুরোধ করতে পারি না।

স্ববিরোধী তথ্য দিয়েছেন তিনজন লেখক-

তারিখ খবরের কাগজের নাম নিবন্ধের নাম লেখকের নাম ভাষণের দৈর্ঘ্য
৭ মার্চ ২০১০ দৈনিক জনকন্ঠ উনিশ মিনিটে রচিত হলো একটি ইতিহাস আবদুল মান্নান ১৯ মিনিট
৭ মার্চ ২০১২ প্রথম আলো একাত্তরের ৭ মার্চ ও বাংলার বিদ্রোহ আবদুল মান্নান ১৭ মিনিট
৭ মার্চ ২০১৪ দৈনিক ইত্তেফাক নিরস্ত্র বাঙালির সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তর তোফায়েল আহমেদ ১৮ মিনিট
৭ মার্চ ২০১২ দৈনিক জনকন্ঠ অগ্নিঝরা মার্চ ॥ নিরস্ত্র বাঙালীর সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তর তোফায়েল আহমেদ ১৯ মিনিট
৭ মার্চ ২০১৪ বাংলাদেশ প্রতিদিন প্রবল উত্তেজনাময় এবং আবেগঘন মুহূর্ত ছিল সেদিন তোফায়েল আহমেদ ১৮ মিনিট
৭ মার্চ ২০১১ যুগান্তর স্বাধীনতা সংগ্রামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন তোফায়েল আহমেদ ১৯ মিনিট
৭ মার্চ ২০১৪ দৈনিক ইত্তেফাক ঐতিহাসিক ৭ মার্চ আজ ফারাজী আজমল হোসেন ২২ মিনিট
৬ মার্চ ২০১৫ দৈনিক ইত্তেফাক ঐতিহাসিক ৭ মার্চ আজ ফারাজী আজমল হোসেন ২২ মিনিট
৭ মার্চ ২০১১ দৈনিক ইত্তেফাক আজ ঐতিহাসিক ৭ মার্চ ফারাজী আজমল হোসেন ২২ মিনিট
৭ মার্চ ২০১০ দৈনিক ইত্তেফাক আজ ঐতিহাসিক ৭ মার্চ ফারাজী আজমল হোসেন ২০ মিনিট

আবদুল মান্নান, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় উনি প্রথম আলোতে লিখেছেন ১৭ মিনিট আর দৈনিক জনকন্ঠে ১৯ মিনিট। মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ দু’টো নিবন্ধে ১৮ মিনিট আর দু’টো নিবন্ধে ১৯ মিনিট। ফারাজী আজমল হোসেন তিনটা নিবন্ধে ২২ মিনিট আর একটা নিবন্ধে ২০ মিনিট।

কিছু অতিউৎসাহী লেখক আবার শব্দ সংখ্যা পর্যন্ত উল্লেখ করেছেন, এদের সংখ্যা সর্বসাকূল্যে চারজন-

তারিখ খবরের কাগজের নাম নিবন্ধের নাম লেখকের নাম শব্দ সংখ্যা
৭ মার্চ ২০১৪ দৈনিক ইত্তেফাক নিরস্ত্র বাঙালির সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তর তোফায়েল আহমেদ ১১০৮টি শব্দ সংবলিত
৭ মার্চ ২০১২ দৈনিক জনকন্ঠ অগ্নিঝরা মার্চ ॥ নিরস্ত্র বাঙালীর সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তর তোফায়েল আহমেদ ১১০৮টি শব্দ সংবলিত
৭ মার্চ ২০১৪ বাংলাদেশ প্রতিদিন প্রবল উত্তেজনাময় এবং আবেগঘন মুহূর্ত ছিল সেদিন তোফায়েল আহমেদ ১১০৮টি শব্দ সংবলিত
৭ মার্চ ২০১১ যুগান্তর স্বাধীনতা সংগ্রামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন তোফায়েল আহমেদ ১১০৮টি শব্দ সংবলিত
১০ মার্চ ২০১২ দৈনিক জনকন্ঠ ৭ মার্চের ভাষণ ॥ যেভাবে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি আমাদের হলো মুহম্মদ শফিকুর রহমান ১০৯৫ শব্দ-বুলেটের
৭ মার্চ ২০১৫ আলোকিত বাংলাদেশ রাজনৈতিক যোগাযোগে ৭ মার্চের ভাষণ ড. প্রদীপ কুমার পান্ডে ও মামুন আ. কাইউম ১ হাজার ১০৭ শব্দের ভাষণে

যেখানে এই ভাষণটা কত মিনিটের সেটাই ঠিক করে বলা যাচ্ছে না, সেখানে এরা শব্দ গুনলেন কিভাবে? তোফায়েল আহমেদ, মুহম্মদ শফিকুর রহমান, ড. প্রদীপ কুমার পান্ডে ও মামুন আ. কাইউম এ চারজন তিন রকম ভিন্ন তথ্য দিয়েছেন। এক কথায় বলা যায় এদের কারোর কথা ঠিক না, শুধু বাগড়ম্বর। প্রথম জন সরকারের মন্ত্রি, দ্বিতীয় জন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি, তৃতীয় ও চতুর্থ জন শিক্ষক গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। জাতি এদের কাছ থেকে দায়িত্বশীল আচরণ আশা করে। মুহম্মদ শফিকুর রহমান পেষাদার সাংবাদিক, উনি কোন তথ্য দিলে যাচাই-বাছই করবেন না এটা কেমন কথা? ড. প্রদীপ কুমার পান্ডে ও মামুন আ. কাইউম উনারা সাংবাদিক তৈরির কারখানার মাস্টার। যেখানে শিক্ষক এত উদাসীন, উনারা যে সাংবাদিক তৈরি করবেন তারা কি হবে? আমার তো মনে হয় তারা সব মাহফুজ আনামের মত তৌবা সাংবাদিক হবে আর যাচাই-বাছাই ছাড়াই আর্মির দেওয়া সংবাদ পরিবেশন করবে। ড.  পান্ডে ও কাইউম তামাশার আরও একধাপ উপরে গেছেন, সেটা হল উনারা লিখেছেন বঙ্গবন্ধু প্রতি মিনিটে ৫৮ থেকে ৬০টি শব্দের ব্যবহার করেছিলেন। এ দিয়ে উনারা কি বোঝাতে চেয়েছেন যে, সাংবাদিক তৈরির মাস্টার হলে কি হবে অংকটাও উনারা ভাল জানেন, তাই না?  ড.  পান্ডে ও  কাইউম আপনারা যে হিসাব দিয়েছেন তাতে একজন মানুষ কোন বই যদি সাধারণভাবে পড়ে তাহলেও মিনিটে ৫০/৬০ শব্দ বলতে পারবে। আর ঐদিন কবি (বিদেশীদের ভাষায় Poet of Politics) তাঁর অমর কবিতাখানি শুনিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু প্রতি মিনিটে ৯৫টির মত শব্দ ব্যবহার করেছেন। সন্দেহ থাকলে নীচের পরিসংখ্যান থেকে অংকটা করে নিন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কিছু লিখতে গেলে সবারই সর্তক থাকা উচিত, উনার সবকিছুই এখন ইতিহাস, সেটা যেন বিকৃত না হয়।

সর্বমোট ভাষণের যতটুকু আমরা পেয়েছি তা হল ১৪ মিনিট ২৩ সেকেন্ড, এর প্রতিলিপি তৈরি করলে শব্দ সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১৩৬৯। আর সংবিধানে সংযোজিত ১০ মিনিট ৪৩ সেকেন্ডের প্রতিলিপি তৈরি করলে শব্দ সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১০৯৬। আমি প্রায় বলেছি এ কারণে যে, কিছু শব্দ বঙ্গবন্ধু ব্যবহার করেছেন যেমন: ‘ননবাঙালী, দিয়েননা, শান্তিপূর্ণভাবে, ফাঁসিকাষ্টের।’ এই শব্দগুলোকে আবার ভেংগে, ভেংগে লেখা যেতে পারে যেমন: ‘নন বাঙালী, দিয়েন না। শান্তিপূর্ণ ভাবে, ফাঁসি কাষ্টের।’ এক্ষেত্রে কি হবে চারটা শব্দ বেড়ে যাবে। আমার একার পক্ষে এ রকম একটা ঐতিহাসিক দলিলের প্রতিলিপি তৈরি করা সম্ভব না এবং সে সাহসও আমি রাখি না। প্রথম যখন আমি প্রতিলিপি তৈরি করি তারপর আবার যখন ভিডিওর সাথে মিলিয়েছি ভুল বেরিয়েছে। তবে একথা আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি এখন পর্যন্ত আমার পড়া আর যে কোন প্রতিলিপির চেয়ে এটা ভাল।

এ পর্যন্ত ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর দেয়া ভাষণটি নিয়ে যতগুলো লেখা পড়েছি, তার মধ্যে ৮ই মার্চ ২০১১, দৈনিক জনকন্ঠে অধ্যাপক মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারীর, ‘অবহেলায় এখনও ইতিহাসের কালজয়ী ভাষণটি’ আমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। কারণ উনি যে দিকটা নিয়ে শংকা প্রকাশ করেছেন সেটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাননি। সবাই কম বেশী ভাষণের বিষয়বস্তু বিশ্লষণে ব্যস্ত। একটা কথা মনে রাখতে হবে যদি মূল ভাষণটায় সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা না যায় তাহলে  বিশ্লষণের বিষয়বস্তুই হারিয়ে যাবে। আসুন অধ্যাপক মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারীর ভাষায় শুনি উনি কি বলেছেন:

‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা, সংরক্ষণ, দলিলপত্র অবিকৃতভাবে উপস্থাপনের যথেষ্ট অনুকূল সময় ছিল না। যারা কাজটি করেছিলেন তারা যথেষ্ট সময় দিতে পারেননি, তাদের নানা সমস্যা এবং অভাব ছিল, অভিজ্ঞতারও যথেষ্ট অভাব ছিল। সে কারণেই কিছু কিছু তথ্য যথাযথভাবে সংগৃহীত হয়নি। সেটি স্পষ্টই চোখে ধরা পড়ে। ধরম্নন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি মুদ্রিত করার বিষয়টি। ওই দলিলপত্রের তৃতীয় খণ্ডে এতে মুদ্রিত হয়েছে (৭০০-৭০২ পৃষ্ঠা)। মনে হচ্ছে ভাষণটিকে স্রেফ কোন একটি ক্যাসেট থেকে কেউ একজন শুনে তুলে দিয়েছেন_তেমনভাবেই কাজটি সম্পন্ন হয়েছে তবে সম্পাদনা হয়নি। যে ভাষণের ঐতিহাসিক গুরুত্ব এতবেশি তা এতোটা দায়সারাভাবে মুদ্রণ করার কোন সুযোগ আসলে নেই। এটি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বে দেখার বিষয় ছিল। এ ভাষণটি মুদ্রণের জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি অবশ্যই করা উচিত ছিল। কিন্তু সম্পাদনা পরিষদ তা করেননি বলেই মনে হয়। যে সময়ে কাজটি হয়েছিল তখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় যে সরকার ছিল তারা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে বিশেষ মর্যাদায় মুদ্রণের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে তা আশা করা সম্ভব ছিল কি না তাই হয়ত সম্পাদনা পরিষদ ভেবে কূল পায়নি। তারা তখন এই ভাষণটিও অন্য আর দশটি বক্তৃতার মতো লিখে দিতে পারাটাকেই গুরুত্বত্বপূর্ণ মনে করেছিল। ফলে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি ওই খণ্ডে যেভাবে মুদ্রিত হয়েছে তা যে সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ হয়নি সেটি এখন অনেকের কাছেই স্পষ্ট হওয়ার কথা। কেন ভাষণটি যথাযথ হয়নি বলে আমি মনে করি তার একটি ব্যাখ্যা আমার রয়েছে। সেটি আমি গত বছর দৈনিক কালের কণ্ঠে ৭ মার্চের লেখায় এবং ২০০৯ সালে ১ জুলাই ভোরের কাগজে প্রকাশিত লেখাতেও তুলে ধরেছিলাম। আমি আশা করেছিলাম বর্তমানে যেহেতু আওয়ামী লীগ সরকার ৰমতায় আছে, তারা হয়ত বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটির এমন বেহাল অবস্থা থেকে উদ্ধারের উদ্যোগ নেবে। কিন্তু দুই বছরই এ ক্ষেত্রে সরকারকে নীরব থাকতে দেখে মনে হচ্ছে, সরকারের কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিই হয়ত আমার লেখাটি দেখেননি বা পড়েননি। সে কারণে এবারও আবার লিখছি। দয়া করে আগের দু’টো লেখাসহ এ লেখাটিতে উত্থাপিত বিষয়টি নিয়ে ভেবে দেখুন, সিদ্ধান্ত নিন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি কেউ বলছেন ১৮ মিনিটের, কেউ বলছেন ১৯ মিনিটের। তবে বিটিভিতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের যে ভিডিওটি রয়েছে তা মাত্র ১০ মিনিটের, অন্যদিকে বাংলাদেশ বেতারে যে ক্যাসেটটি রয়েছে তা ১৮ মিনিটের। এতে ৮ মিনিট সময়ের বক্তব্য নিয়ে একটি সমস্যা তৈরি হয়ে আছে। সচরাচর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণের যে ক্যাসেট বিভিন্ন স্থানে বাজানো হয়ে থাকে তার সবগুলোর দৈর্ঘ্য এবং বক্তব্য অভিন্ন নয়। এগুলো যাচাই-বাছাই করে ক্যাসেট করা হয়নি। একদিকে মুদ্রিত আকারে যে ভাষণটি পাওয়া যাচ্ছে তাতে বেশ কিছু ভুল রয়েছে, অন্যদিকে ভাষণের অডিও এবং ভিডিওতেও বেশ কিছু গরমিল পরিলক্ষিত হচ্ছে। এমনটি হওয়ার কারণ হচ্ছে, ভাষণটি মুদ্রণের সময়ও কোন প্রামাণিকরণ কমিটি বিভিন্ন অডিও-ভিডিও ক্যাসেট যাচাই-বাছাই করে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি দেখেননি, সরকার এ পর্যন্ত এ বিষয়ের ওপর কোন কমিটিই গঠন করেনি, একই সঙ্গে অডিও-ভিডিওর ক্ষেত্রেও একই সমস্যা বিরাজ করছে। ফলে ভাষণের অডিও-ভিডিও এবং মুদ্রিত কোন রূপই গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেনি। এতে প্রমাণিত হয়, আমরা বঙ্গবন্ধুর এমন ঐতিহাসিক ভাষণকে এ পর্যন্ত নানাভাবে অবহেলা বা উপেক্ষা করে এসেছি। এটিকে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দলিলের মর্যাদা দেয়ার বিষয়টিই আমরা এখনও পর্যন্ত উপলব্ধি করতে পারিনি।’

১৮/২/২০১৭ তারিখে আমি ড. মুনতাসীর মামুনের সাথে কথা বলেছিলাম উনার লেখা ৭ই মার্চের উপর দু’টো নিবদ্ধ নিয়ে। দু’টো লেখায় ৭ই মার্চ ২০১২ তে ছাপা হয়েছিল, এদের মধ্যে একটা আমার ব্লগ ডট কম ‘কেন মনে থাকে ৭ মার্চ।’ আরেকটা কালের খবরে ‘সাতই মার্চের ভাষণ আমার অহঙ্কার’ দু’টো প্রতিবেদনেই উনি লিখেছেন উনিশ মিনিটের ভাষণ। উনাকে আমি জিজ্ঞাসা করি আপনি তো নিশ্চিত যে এটা ১৮/১৯ মিনিটের ভাষণ উনি হ্যাঁ সূচক উত্তর দিয়েছেন। তারপর আমার কাছে যে পরিসংখান গুলো আছে উনাকে জানালাম এবং জিজ্ঞাসা করলাম আমরা কেন পুরো ১৯ মিনিটের ভাষণটা পাচ্ছি না? উনি কোন কিছুরই সন্তোষজনক উত্তর দেননি। উনার লেখা দু’টোর কথা বললেন ২০/২৫ বছর আগের, পূর্ণমূর্দ্রণ করেছে। কিন্তু ২০/২৫ আগে তো কেউ ৭ মার্চ লিখত না। তারপরও হয়তো অতি উৎসাহি পত্রিকা এটা করেছে। কেউ যদি তার লেখায় সুনির্দিষ্টভাবে তথ্যসূত্র উল্লেখ না করে ধরে নেব তথ্য তার নিজের, কিন্তু উনি বললেন সেই সময়ের রেফারেন্স। যা হোক উনার মত একজন ইতিহাসবিদ এরকম ঐতিহাসিক ব্যাপার নিয়ে যখন লেখেন তখন আরো যত্নবান হওয়ায় শ্রেয়। উনি আমাকে বললেন এটা নিয়ে বিতর্ক (controversy) করে লাভ নেই। আমি উনার সাথে কোন বিতর্ক করতে চাইনি প্রয়োজনও ছিল না। তবে আমি নিশ্চিত আমার কাছে যে পরিসংখান আছে তার বিপরীতে কোন সন্তোষজনক উত্তর উনার কাছে ছিল না। ড. মামুন আমাকে বললেন শেখ হাসিনার যে বইটা বঙ্গবন্ধু জাদুঘর থেকে বেরিয়েছে সেটা দেখতে। সেটা আমাকে দেখতে হবে কেন, সেটা তো উনারই দেখা উচিত। কারন উনি লিখেছেন ১৯ মিনিট, আর সেটা প্রমাণ করার দায়িত্বও উনার। হক কথা হচ্ছে ড. মামুন এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানেন না। কথপোকথনের এক পর্যায়ে একটু রাগান্বিতভাবে বললেন আপনার যেটা মনে হয় ধরে নিন। বা প্রফেসর কাবির চৌধুরি যেটা সম্পাদনা করেছে সেটা নেওয়ার জন্য। কোন তথ্য নিশ্চিত না হয়ে কোন পণ্ডিতের উপর নির্ভর করে সে তথ্য ব্যবহার করা কি ঠিক হবে, যেখানে সে তথ্যর ব্যাপারে আমি নিজেই সন্দিহান? আর আপনার তথ্য অনুযায়ী প্রফেসর কাবির চৌধুরি ইংলিশ সাব-টাইটেলের সম্পাদনা করেছেন সে ভিডিওটা কাটা ছেঁড়া করা তা আমি একশ ভাগ নিশ্চিত এবং প্রমাণও করতে পারবো। এক সময়ের চুয়াডাংগা কলেজের এর এক মাস্টার আপনাদের প্রতিষ্ঠানের হেড মাস্টার পর্যন্ত হয়েছিল, মাঝে মাঝেই আপোসহীন তাপসীর নির্দেশে নতুন নতুন ফর্মূলা দেয়, আমাকে কি সেগুলোও গ্রহণ করতে বলেন।

এরপর উনি বললেন যে, বঙ্গবন্ধু ভাষণ শেষ করে নেমে গেছেন, আবার এসেছেন ২/৩ মিনিট কথা বলেছেন আবার নেমে গেছেন, এবং এসব কথাগুলো অপ্রাসঙ্গিক ছিল। তখন আমি একটু কঠিন সুরেই উনাকে জিজ্ঞাসা করি অপ্রাসঙ্গিক ছিল। উনি আবারো একই কথা বললেন, হ্যাঁ অপ্রাসঙ্গিক ছিল। তাই ওগুলো ভাষণ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। যদি সেটাই হয়ে থাকে তাহলে তো ভাষণটা ১৯ মিনিটের না, এটা ১০ মিনিটের বা ১৩ মিনিটের। তাহলে ড. মামুন কেন তার নিবন্ধে ১৯ মিনিটের লিখলেন সে প্রশ্ন করার অধিকার নিশ্চয় আমার আছে। নাকি উনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ একারণে যা খুশি তাই বলবেন আর আমাদের গ্রহণ করতে হবে। ড. মামুন এটা আপনার ‘জয় বাংলা’ উপন্যাস না যে কল্পনা প্রসূত চিন্তা ভাবনা থেকে লিখলেন। আপনাকে সব বিষয় নিয়ে লিখতে হবে এমন বাধ্যবাধকতাও তো নেই।

ড. মামুনের কাছেই প্রথম শুনলাম বঙ্গবন্ধু অপ্রাসঙ্গিক কথা বলেছেন, কেউ এ অভিযোগ এর আগে করেছে বলে শুনিনি। ড. মামুন গুরুতর একটা অভিযোগ করেছেন যে, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু অপ্রাসঙ্গিক কথা বলেছেন। আমি মনে করি এ কথা বলে উনি বঙ্গবন্ধুকে অসম্মানিত করেছেন। এ অভিযোগ নিয়ে আমি আমি কবি নির্মলেন্দু গুণের সাথে কথা বলেছিলাম, উনি ড. মামুনের সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন। আর ‘বঙ্গবন্ধু ভাষণ শেষ করে নেমে গেছেন, আবার এসেছেন ২/৩ মিনিট কথা বলেছেন আবার নেমে গেছেন।’ এ ফর্মূলাও নাকচ করে দিয়েছেন। (কবি সেদিন রেসকোর্স ময়দানে সাংবাদিক হিসাবে উপস্থিত ছিলেন।)

কবি আমাকে এও বলেছে যে, ড. মামুন ও শাহরিয়ার কবির এরা ১৯৭১ এ বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করেছেন, এরা ভাসানীর অনুসারী ছিলেন। এ কারণেই কি বঙ্গবন্ধুর ভাষণটা সঠিকভাবে সংরক্ষের চেয়ে রেসকোর্স ময়দান পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবার তাড়া উনাদের বেশি। ময়দান পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া যেমন জরুরী তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি জরুরী ভাষোণটাকে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা। নাকি ড. মামুন কোথাও কোন লোভণীয় প্রস্তাব পেয়েছেন যে, অসর্মথীত তথ্য দিচ্ছেন।

ড. মামুনের এমন কোন লেখা নেই যা ‘জনকণ্ঠে’ বেরিয়েছে আর আমি পড়ি নাই। উনার সব লেখার কপিও আমার কাছে আছে। কোন একটা লেখায় দু’নেত্রী সম্পর্কে একটু লিখেছিলেন। বলেছিলেন, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কিছু লিখলেও, ‘উনার কাছে কোন কাজে গেলে আবার সব ভুলে যান, এক কাপ চা খাওয়ান,’ এরকম কিছু। ড. মামুনের কাছে একটা অনুরোধ দয়া করে আরেকবার আপনার আপার কাছে যান এক কাপ চা খান, আর উনাকে বলেন সরকারি জেল খানা থেকে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটাকে মুক্ত করে দিন। আমরা দেখি সেখানে কতটা অপ্রাসঙ্গিক কথা আছে। আর আপাকে বলেন একটা জাতীয় কমিশন করে সঠিকভাবে ভাষণটাকে লিপিবদ্ধ করার জন্য। আর এ জাতীয় কমিশনের একজন সদস্য হিসাবে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারীর নাম আমি প্রস্তাব করছি। আর আপনার যদি জানা না থাকে, তাহলে জেনে নিন বাংলাদেশ বেতারে ১৮/১৯ মিনিটের ভাষণটা এখনও অসম্পাদিত অবস্থায় আছে। যেটা আমাদের সাবেক স্পিকার হুমায়ন রশীদ চৌধুরীর ভাস্তে নাসার আহমেদ চৌধুরী রেকর্ড করেছিলেন এবং এ রেকর্ডটা ৮ মার্চ ১৯৭১ অবিকৃত অবস্থায় রেডিও থেকে সম্প্রচার করা হয়েছিল।

কিছু লেখক আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গে দেওয়া ভাষণের সাথে বঙ্গবন্ধুর তুলনা করতে পেরে মনে হয় আত্মতুষ্ট। ওগুলো পড়ে আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে এদের নেতা লিংকন না বঙ্গবন্ধু? ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম সহ অনেকেই লিখেছেন এ ভাষণের সাথে অন্য কোন ভাষণের তুলনা হতে পারে না, সেটা আমারও কথা। কারণ বঙ্গবন্ধু যে পটভূমিতে ভাষণটা দিয়েছেন, সেখানে আব্রাহাম লিংকনের পটভূমি সম্পূর্ণ ভিন্ন। আব্রাহাম লিংকন ছিলেন একটা স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপতি, তাঁর দেশের গৃহযুদ্ধে যারা প্রাণ দিয়েছিলেন তাদের স্মৃতিতে, সম্মানে উনি বক্তব্যটা দিয়েছিলেন। পক্ষান্তরে বঙ্গবন্ধু একটা বর্বর, অমানবিক, স্বৈরাচারী, কুশিক্ষিত, হিংস্র পশুর মত সামরিক শক্তির কবল থেকে নিজের দেশকে মুক্ত করার জন্য, স্বাধীন করার জন্য বক্তৃতা করেছিলেন যা ছিল অলিখিত। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সেদিনের সেই দূরদর্শি বক্তৃতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার দ্বার উন্মোচিত করেছিল। নিঃসন্দেহে আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গের বক্তৃতাও একটা কালজয়ী ভাষণ। যুক্তরাষ্ট্রে সর্বোচ্চ সতর্কতায় সেটা সংরক্ষণ করা হয়েছে, সেটা রাষ্ট্রিয় সম্পদ। যারা কথায়-কথায় ভাষণটার তুলনা করেছেন লিংকনের ভাষণের সাথে তারা কিন্তু একবারও দাবি রাখেননি, লিংকনের ভাষণটা যেভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর ভাষণটাও সেভাবে সংরক্ষণ করা হোক। এ ব্যাপারে অধ্যাপক মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারীই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নিবন্ধ লিখেছেন বিভিন্ন পত্রিকায় পরপর কয়েক বছর। বোধহয় ফলাফল না পেয়ে উনিও ক্লান্ত হয়ে গেছেন।

প্রকৃত পক্ষে ৭ মার্চের ভাষণেই আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা হয়ে গেছে। তর্কের ক্ষাতিরে তর্ক না করে হৃদয় দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করলে খুবই পরিষ্কার। একটা নবজাত শিশু কিন্তু তার মাকে বলে না, আমাকে খাবার দাও আমার ক্ষিদে পেয়েছে। পেটে ব্যাথা করছে ঔষধ দাও। শিশুর কান্না শুনে মা বোঝে কোনটা ক্ষিদের আর কোনটা ব্যাথার। ভাষণের এক জায়গায় বঙ্গবন্ধু বলেছেন, সরকারি কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হবে, খাজনা ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হোল- কেউ দেবে না।’ এর অর্থ কি, এটা কি স্বাধীনতার ঘোষণার চেয়েও বেশী না? এখানেই শেষ না এরপরও উনি বলেছেন, ‘তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ্‌। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ নাকি এটা বলা খুব জরুরী ছিল, ‘আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি।’

অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ৭ মার্চ ২০১২ ‘ভাষার জাদু : বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ’ নিবন্ধে লিখেছেন, ‘এক বিদেশি সাংবাদিক ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সকাল থেকেই একজন দোভাষী খুঁজছিলেন, সেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ভাষণ দেবেন তা তাৎক্ষণিক ইংরেজি করে তাকে শোনাবে, সে জন্য। দুপুরের আগে আমার সঙ্গে তার যোগাযোগ হলো, বললাম ভাষণ শুরুর আগে টিএসসিতে এসে তার সঙ্গে রেসকোর্স মাঠে যাব। মাঠে সেদিন কত মানুষ ছিল, কেউ বলতে পারবে না। হয়তো ১০ লাখ। হয়তো আট লাখ। কিন্তু মনে আছে ভাষণ শুরুর আধঘণ্টা আগে যখন বিদেশি সাংবাদিককে সঙ্গে নিয়ে বেরোই, মনে হলো সারাদেশ ভেঙে পড়েছে রেসকোর্স মাঠে। সাংবাদিকদের জন্য মঞ্চের সামনে জায়গা ছিল। সাংবাদিক হাত ধরে আমাকে টেনে সেখানে নিয়ে গেলেন। আমি আমার কপালকে ধন্যবাদ দিলাম। এত সামনে থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে পাব, ভাবতেও পারিনি। আমি প্রথম তিন-চার লাইন দ্রুত অনুবাদ করলাম, কিন্তু সাংবাদিক আমাকে থামিয়ে দিলেন। ‘আমি বরং ভাষণটা শুনি, তুমি যদি পার, মনে রাখার চেষ্টা কর, পরে আমাকে অনুবাদে শুনিও’- সাংবাদিক বললেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পুরোটা সময় সেই সাংবাদিক একাগ্রতা নিয়ে ঠায় বসেছিলেন_ তার মুখ দেখে মনে হচ্ছিল তিনি প্রতিটি বাক্য বুঝছেন, যেন বঙ্গবন্ধু বাংলাতে নয়, ইংরেজিতে ভাষণটা দিচ্ছেন। এবং আশ্চর্য, শুনতে শুনতে ভাষণটা আমার মাথায় একটা জায়গা করে নিল। বিকেলে চারুকলায় সাংবাদিককে যখন মূল বিষয়গুলো অনুবাদ করে দিচ্ছিলাম, দেখতে পেলাম, আমার গলাতেও যেন আলাদা একটা জোর এসেছে, যেন ভাষণটা আমাকে আলাদা শক্তি যোগাচ্ছে। সাংবাদিক বললেন, কী ছিল শেখ সাহেবের ভাষণে? আমি কিছু বলার আগে তিনি নিজেই বললেন, ‘নিশ্চয়ই জাদু। ইট ওয়াজ সিম্পলি ম্যাজিক্যাল’, তিনি বললেন। একজন অন্য ভাষার মানুষ সেও বুঝেছে যে ঐই ভাষণে জাদু ছিল, যেখানে যাদু আছে সেখানে সব কথা তো ভেঙ্গে বলার দরকার নেই।

৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু যা বলেছেন সেটা সরাসরি স্বাধীনতার চেয়ে বেশী অর্থ বহন করে, কিন্তু সেট বুঝবার মত শিক্ষাটা থাকা দরকার। অতি বামপন্থিরা চেয়েছিল বঙ্গবন্ধু সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা করুক। এটা করলেই উনি হটকারী নেতা হিসাবে বিশ্বের কাছে চিহ্নিত হতেন, আর সেই সুযোগটাই পাকি’রা নিতে চেয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ভুট্টোর মত কুটনি ছিলেন না এবং কুটনির মত কুটনামিও উনি ঘৃণা করতেন। উনি গণতান্ত্রিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক শিক্ষাই শিক্ষিত ছিলেন, এবং সে শিক্ষার আলোকেই দিক নির্দেশনা দিয়েছন সেদিন। যাতে সাপ মরেছ, কিন্তু লাঠি ভাঙ্গেনি।  তা না হলে পাকি কামানের গুলি ও বোমার আঘাতে উপস্থিত দশ লাখের ক’জন বেঁচে থাকতো সেটা ভাবার বিষয়। মনে রাখতে হবে সেদিন বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় সব মানুষগুলো রেসকোর্সে উপস্থিত ছিল। সেদিন বঙ্গবন্ধু সহ সবাই মারা গেলে আজও বাংলাদেশ স্বাধীন হত না। বঙ্গবন্ধু কৌশলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলেই ২৫ মার্চ পর্যন্ত জাতি প্রস্তুতি নিতে পেরেছিল। দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতারা ঢাকা ছাড়তে পেরেছিল। ১৭ এপ্রিল মুজিব নগরে সরকার গঠন করা গেছে। ততকালীন সময়ে ইত্তেফাকের সাংবাদিক আমির হোসেন উনার ‘বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ’ ৭ মার্চ পরবর্তি সময়ের বিশদ বর্ণনা করেছেন। মুক্তি যে স্বাধীনতার চেয়ে বড় এখন সেট বোঝা যাচ্ছে। পাকিস্তান থেকে আমরা স্বাধীন কিন্তু মুক্ত না। একমাত্র বঙ্গবন্ধুর মুক্তির কথা বলেছিলেন অন্য কারো মাথায় মুক্তির কথা আসেনি। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত পাকি চরেরা মুক্তমণা লেখক ও ব্লগারদের হত্যা সহ বিভিন্ন রকম অপকর্মে জড়িত, আমাদের দেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য পাকিরা সব সময় তৎপর।  

অতী বামরা বঙ্গবন্ধুকে চাপে রেখেছিলেন স্বাধীনতার সরাসরি ঘোষণা দেবার জন্য। যাতে স্বাধীনতা বিপর্যস্ত হয়। উগ্রবাম্পন্থিরা পাকি চর তার প্রমাণ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর পরিষ্কার হয়ে গেছে, এরা সবাই প্রায় স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি জিয়া, এরশাদের চাটুকারিতা করেছে। অথচ স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সরকারকে এরা নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে, এমন কোন কুকাজ নেই যা এরা করেনি।

এক বাম নেতা (দবির উদ্দিন) নৌকা মার্কা নিয়ে ভোটে জিতে খালেদার পদতলে নিজেকে সপে দিয়েছে। ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মুস্তাফিজুর রহমান বাবুল খালেদার মামলার দিন রাস্তায় মোনাজাত করে। আর সি.পি.বি নেতা সেলিম ২১ ফেব্রুয়ারি উর্দূ ভাষায় ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিয়ে শহীদ মিনারে ফুল দিতে যায়। বাংলাদেশের যে দল বাংলায় স্লোগান দিতে পারে না তাদের নিঃবন্ধন থাকে কেমনে সেটাই আমার বোধগম্য না।

সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ (সাবেক ইপিসিএস ও মুজিবনগর কর্মকর্তা) মার্চ ০৭, ২০০৯ ভোরের কাগজে, ‘৭ মার্চ আমাদের ডি ফ্যাক্টো স্বাধীনতা দিবস’ নিবন্ধে লিখেছেন, ‘আমরা সেদিন থেকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। এডভোকেট নুরুল কাদের মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটি বস্তুনিষ্ঠ তথ্যবহুল বই লিখেছেন, একে মিনি এনসাইক্লোপেদিয়া বলা চলে। বইটির নাম ‘২৬৬ দিনে স্বাধীনতা’। এই বইতে তিনি লিখেছেন যে আমাদের স্বাধীনতা দিবস পালিত হওয়া উচিত ৭ মার্চ। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাই মনে করি। প্রখ্যাত আইনজীবী এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম সাহেবের কাছে বিষয়টি নিয়ে কিঞ্চিত আলাপ করার সুযোগ হয়েছিল। আমার এখন মনে নেই। কি যেন আইনগত জটিলতা রয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেলেন। আমরা আমজনতা অনেক সময় বেশি আবেগ দিয়ে কথা বলি। আইনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা আমাদের ঢুকার কথা নয়। তবে আবারো বলবো যে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণ অনন্য এবং অসাধারণ। এখনো যতোবার শোনা যায়, তৃঞ্চা মেটে না। মনে হয় আরো শুনি। উনি আরো লিখেছেন, ‘জেনারেল জিয়া ‘৭৮ সালে বিজয় দিবসের প্রাক্কালে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেয়ার সময় বলেছিলেন যে ‘৭১-এর ২৭ মার্চ তিনি জাতিকে এই আহবান জানিয়েছিলেন। অথচ জাতীয়বাদী বুদ্ধিজীবীরা যার ভেতর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি রয়েছেন, তারা আবিষ্কার করলেন যে জিয়া ২৬ মার্চে এই ঘোষণা দিলেন। গোটা জাতী কুম্ভকর্ণের নিদ্রায় শায়িত ছিলেন, জিয়ার আহ্বানে লাফ দিয়ে উঠে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেন।’

কিছু জ্ঞানপাপী, কুবুদ্ধিজীবি ও রাজনৈতিক পতিতা মিলে আজকাল একটা বিতর্ক তৈরি করেছে যে, বঙ্গবন্ধু জয় পাকিস্তান বলেছিলেন। স্বাধীনতার এত বছর পর একথা ধোপে টেকে না। এ.আর. খন্দকার, খন্দকার মুসতাকেরই ভাই। পাকিস্তানি চর মুসতাক যেমন ঘাপটি মেরে ছিল। এও সেই একই চিজ, পাকি টাকায়, পাকি উস্কানিতে নতুন সূত্র দিল। এই রাজনৈতিক পতিতাটা এরশাদের মন্ত্রীসভায় ছিল, ছিল শেখ হাসিনার মন্ত্রীসভায় আর এখন পাকি ছায়া মন্ত্রীসভায়। খন্দকার কি সেদিন রেসকোর্স মাঠে উপস্থিত ছিলেন? উনি তখন পাকি ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন কেমনে ৪০/৫০ বছর পর বিতর্ক সৃষ্টি করতে হবে। ঐদিন রেসকোর্স মাঠে দশ লাখের মত মানুষ ছিল কেউ শুনলো না, বঙ্গবন্ধু জয় পাকিস্তান বলেছেন আর উনি পাকি ক্যাণ্টোনমেন্টে বসে শুনলেন।

সেদিন অভিনেতা আলী জাকের, আভিনেতা পিযুষ বন্দোপধ্যায়, কবি নির্মলেন্দু গুণ ঐ জনসভায় উপস্থিত ছিলেন উনারা তো এরকম মিথ্যা তথ্য দিচ্ছেন না। বরং অভিনেতা আলী জাকের সাপ্তাহিক ২০০০এ এই মিথ্যাচারের তীব্র প্রতিবাদ করেছেন, আর কবি শামসুর রাহমান তার ত্রুটির জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। ২৭/২/২০১৭ তারিখে আমি কবি নির্মলেন্দু গুণের সাথে প্রায় এক ঘন্টা কথা বলি। আমাকে উনি বলেছেন রেসকোর্স ময়দানে সেদিন কবি সাংবাদ প্রতিবেদক হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ভাষণটা শোনার জন্য, জয় বাংলা  বলেই উনি ভাষণ শেষ করেছেন। কবি আরো বললেন বিচারপতি হাবিবুর রহমান, এ.আর. খন্দকার এদের কথার প্রতিবাদ উনি যথাসময়ে বিভিন্ন পত্রিকায় করেছেন তার কোন উত্তর এই নষ্ট মানুষগুলোর নেই। পাকি হাড়ের লোভে এ জাতীয় কিছু লোক ঘেউ-ঘেউ করবে, বি.এন.পির কিছু নেতা উস্কানি দেবে, আর প্রথম আলোর মতিউর রহমান এদের পিঠে হাত বোলাবে। কুত্তাকে ঘেউ-ঘেউ করতে দেওয়ায় ভাল এক সময় ক্লান্ত হয়ে থেমে যাবে। ততকালীন ছাত্রনেতা আ.স.ম. রব সেদিন মঞ্চে বঙ্গবন্ধুর কাছে উপস্থিত ছিলেন, ৭ই মার্চ ২০১৫ চাঁদপুর ওয়েবের সাথে এক সাক্ষাতকারে স্মৃতিচারণ করে বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু জয় বাংলা বলে ভাষণ শেষ করেছেন।’

এখন যখন পত্রিকায় দেখি ‘৭মার্চ’, ‘২১ফেব্রুয়ারি’ আমার কষ্ট হয়। ব্যাপারটা এ রকম, ধরেন এক সুন্দরী রমনী পহেলা বৈশাখে বৈশাখি সাজে সেজে বেরিয়েছে। দুর্বৃত্বরা তার সাজ-সজ্জা, অলংকার সব কেড়ে নিয়ে তার চুল ছেঁটে জিনসের প্যাণ্ট আর টি সার্ট পরিয়ে ছেড়ে দিল। ঐ মহিলাকে এখন কেমন দেখাবে বলেন, তাকে কি আর রমনী বলে মনে হবে? অলংকার বিহিন ৭ মার্চ দেখলে কেমন যেন করুন মনে হয়, আর ইতিহাসের সাথে মেলে না। বঙ্গবন্ধু ভাষণটা ৭ মার্চে না ৭ মার্চে দিয়েছিলেন। ভাষা সৈনিকেরা ২১ ফেব্রুয়ারি না ২১ ফেব্রুয়ারি প্রাণ দিয়েছিল। আব্দুল গাফফার চৌধুরী লিখেছিল, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ ২১ ফেব্রুয়ারি না। উনি কি ২১ ফেব্রুয়ারি দিয়ে আপনাদের একটা নতুন গান লিখে দিতে পারবেন, সেটা কি ইতিহাসের অংশ হবে? প্রতিদিন কর্মক্ষেত্রে আমাকে বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষের সাথে মিশতে হয়, কারো কাছে শুনিনি তাদের ভাষা থেকে এ অলংকার গুলো বাদ দেওয়া হয়েছে। পন্ডিতদের কাছে অনুরোধ যারা এটা করেছেন, আপনাদের যত খুশি ভাষার এ অলংকার ছিনতাই করুন। কিন্তু ঐতিহাসিক দিনগুলো লেখার ক্ষেত্রে সেটা করবেন না বরং বাধ্যতামূলক করুন। সংবিধানে যত ভুলই করুক ভাষণটা লেখার ক্ষেত্রে তারা কিন্তু ‘৭ মার্চ লেখেনি ৭ই মার্চ লিখেছে। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ না বলে ‘৭ মার্চের’ ভাষণ বললে ভিতরে সেই আগুন জ্বলে না।

আর এ আগুন জ্বালিয়ে রাখতে হবে তা নাহলে দেশ স্বাধীন হয়েছে ঠিকই কিন্তু মুক্ত হবে না।

লেখক, প্রবাসি বাংলাদেশি
নূর্ণবের্গ, জার্মানী।
[email protected]

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত