আমিই সরকার: বঙ্গবন্ধু

প্রকাশ : ১৩ মার্চ ২০১৭, ১২:১৬

সাহস ডেস্ক

১৯৭১ সালের ১৩ মার্চ এক বিদেশী সাংবাদিক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার পরিকল্পনা (ইউডিআই) রয়েছে কিনা; বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তখন সতর্কভাবে জবাব দেন, ‘না, এখন পর্যন্ত নয়।’

একই সময়ে অপর এক বিদেশী সাংবাদিক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রশ্ন করেন, প্রদেশে পাকিস্তান সরকারের কর্তৃত্বকে তিনি চ্যালেঞ্জ করছেন কি-না, জবাবে তিনি বলেন, ‘সরকার বলতে আপনি কি বোঝাতে চান? আমিই সরকার।’

শেষ পদক্ষেপ হিসেবে পাকিস্তান সরকার সামরিক অভিযানের জন্য পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের (পিআইএ) বেশীর ভাগ ফ্লাইট বাতিল করে এসব ফ্লাইটে সিভিল পোশাকে ‘সরকারি যাত্রী’ হিসেবে সেনা সদস্য ও সেনা কর্মকর্তাদের এখানে নিয়ে আসে।

ইয়াহিয়া যুক্তরাষ্ট্রকে এক বার্তায় স্পষ্টভাবে জানান, বাঙালিদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার যে কোনো আন্দোলনের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনী ব্যবহার করা হবে।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক সহকারি হেনরি কিসিঞ্জার এক স্মারকে প্রেসিডেন্টকে বলেন, পাকিস্তানীরা পুরো মাত্রায় সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা করছে।

বিষয় পাকিস্তান
পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এবং পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনী পাকিস্তানে অখ-তা বজায় রাখতে প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মনে হচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক বাহিনী প্রতিস্থাপনে পাশাপাশি ৬ মার্চে ইয়াহিয়া কঠোর বক্তব্য রাখেন এবং স্পষ্টভাবে সতর্ক করেন যে, বিচ্ছিন্নতার জন্য যে কোনো প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে সেনা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধিতে ক্রমাগত সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তান উইং শক্তিশালী করা হচ্ছে।

পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ধীরে ধীরে স্বাধীনতা ঘোষণার দিকে তার কন্ঠ চড়া করছেন। প্রাথমিক রিপোর্টের চেয়ে তাঁর মার্চের ভাষণে পুরো ভাষণের বক্তব্য ছিলো আরো কঠোর এবং এতে মনে হচ্ছে তাঁর পশ্চাদপসরণ ছিলো কৌশলগত। তিনি স্পষ্ট করেছেন যে, ঘটনাক্রম স্বাধীনতার খুব কাছাকাছি। ‘বন্ধন মুক্তি’ তাঁর লক্ষ্য এবং সেটি অর্জন ছাড়া তিনি পিছু হটবেন না।

শেখ মুজিবুর রহমান খোলাখুলিভাবে ইয়াহিয়াকে সংখ্যালঘু হিসেবে এবং একমাত্র তাঁর আওয়ামী লীগই দেশের বৈধ কর্তৃপক্ষ হিসেবে তুলে ধরেছেন।

আওয়ামী লীগ প্রেসিডেন্ট মুজিবুর রহমান ঢাকায় রেসকোর্সে ৭ মার্চ এক জনসভায় ভাষণ দিয়েছেন এবং সরকারের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত রাখার ডাক দিয়েছেন। এতে সকল সরকারি অফিস ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, যদি সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হয়, পূর্ব পাকিস্তানের সৈন্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়া হয় এবং ক্ষমতা জননগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে হস্তান্তর করা হয় তাহলে ২৫ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঘোষিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের বিষয়টি বিবেচনা করবেন।

আমাদের ইসলামাবাদ দূতাবাসের বিশ্বাস পশ্চিম পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের বন্ধন মুক্তির জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের লক্ষ্য অপরিবর্তিত থাকবে। এখন পর্যন্ত বোধগম্য এটা যে, এর তাৎপর্য ‘ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের অধীনে পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন’, তবে এটি একটি ধারণা এর বেশী কিছু নয়।

শেখ মুজিবুর রহমান দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, তিনি যে মুক্তি চান তা কেবল সরাসরি স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমেই সম্ভব। গত রোববার তাঁর বক্তব্যে ধীরে ধীরে লক্ষ্য অর্জনের পরামর্শ দেয়া হয়েছে, যাতে সরাসরি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘাতের ঝুঁকি এড়ানো যায়। একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণায় এ ধরনের ঝুঁকি রয়েছে।

এই রাজনৈতিক অবস্থায় অপর অংশে পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনৈতিক নেতা জেড এ ভুট্টোর রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশে মোটামুটি শান্ত রয়েছেন। ভুট্টোর এ্যাসেম্বলিতে যোগদান প্রত্যাখ্যানের মধ্যদিয়ে মধ্য ফেব্রুয়ারিতে এই সংকটের শুরু। ভুট্টো পূর্ব পাকিস্তানে তাঁর রাজনৈতিক সমর্থন সংহত করার কাজ করছেন এবং যাতে পরিবেশটি ছিলো মৈত্রী সূচক প্রতিভাত হয়।

সিদ্ধান্তসমূহ
আসছে দিনগুলোতে ইয়াহিয়া নয়তো পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে বর্তমান অবস্থায় রাজনৈতিক সমাধানের প্রক্রিয়া বের করতে হবে- যা পাকিস্তানের অখ-তা রক্ষা করবে। শোনা যাচ্ছে, ইয়াহিয়া অতি দ্রুত শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য ঢাকা যাচ্ছেন।

এ অবস্থায় যা ঘটতে পারে তা হলো- ১. ইয়াহিয়া শেখ মুজিবুর রহমানের চ্যালেঞ্জ উপেক্ষা করে শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য নেতাদের গ্রেফতারের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এবং পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক চাপ সৃষ্টি করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে দুটি সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। ক. এই নিপীড়নের জবাবে শেখ মুজিবুর রহমান গান্ধীর ধরনে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন চালাতে পারেন। খ. পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর সক্ষমতার অভাবে দীর্ঘমেয়াদে পুরো মাত্রায় বিদ্রোহ দেখা দিতে পারে।

২. একটি স্থিতি অবস্থা তৈরি হতে পারে এতে সেনাবাহিনী অথবা বেসামরিক কোনো পক্ষ এই অচলাবস্থা নিরসনে জোরালো উদ্যোগ গ্রহণে প্রস্তুত নয় এবং প্রত্যেকেই আশা করবে অন্য কেউ এ সমস্যা সমাধানে প্রথমে এগিয়ে আসবে। এ অবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমান আন্দোলনে কর্মসূচি দীর্ঘায়িত করে পর্যায়ক্রমে অনায়াসেই পূর্ব পাকিস্তানে কার্যত নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠতে পারেন।

৩. ইয়াহিয়া আরো কৌশলী রাজনৈতিক উদ্যোগ নিতে পারেন, শেখ মুজিবুর রহমান ও ভুট্টোর পরিকল্পনা সমন্বয়ে উদ্যোগ নিতে পারেন এবং কোন ধরনের সুরাহা ছাড়াই সময়ক্ষেপণ করতে পারেন। যদি এসব উদ্যোগ ব্যর্থ হয় পাকিস্তান পরিস্থিতি পুনরায় অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠতে পারে।

যদি পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয় তাহলে আমাদের ভবিষ্যত সম্পর্ক বিপন্ন হতে পারে। এ ক্ষেত্রে আমাদের কর্তব্য হবে ভারসাম্যপূর্ণ- এ্যাপ্রোচ গ্রহণ করা যদিও তা হবে রক্ষণাত্মক অবস্থান।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত