‘বাবা সেহরি খেয়েছি, ইফতার একসঙ্গে করবো’
প্রকাশ : ২৪ জুন ২০১৭, ২১:৩৬
‘বাবা তুমি চিন্তা করিও না। বগুড়া পার হয়েছি। ফোনের চার্জ শেষ হয়ে যাচ্ছে। হয়তো ফোন বন্ধ হয়ে যাবে। দুপুরের মধ্যেই বাড়ি যাবো ইনশাল্লাহ। সেহরি খেয়েছি, ইফতার একসঙ্গে করবো।’
মোবাইল ফোনে এভাবেই শেষ কথা বাবাকে বলেছিলো মজনু মিয়া। কিন্তু তার বাড়ি ফিরে ইফতার করা হলো না।
শনিবার ভোরে রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার কলাবাড়ী এলাকায় ট্রাক উল্টে নিহত ১৭ জনের মধ্যে মজনু মিয়া একজন। মজনু মিয়া লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার চন্দ্রপুর ইউনিয়নের উওর বত্রিশ হাজারী গ্রামের জাহাঙ্গীর আলমের ছেলে। শনিবার সকালে মজনুর বাড়িতে গেলে তার বাবা জাহাঙ্গীর আলমের সাথে কথা হলে জানা যায় বাবা-ছেলের সর্বশেষ মোবাইলের কথন।
মজনুর বাবা জানান, মজনু ঢাকায় বাটা কোম্পানিতে চাকুরি করেন। মজনু মুরগীর মাংস খুব ভালোবাসেন। তাই ছেলে ছুটি পেয়েছে শুনে বাড়ির বড় মুরগীটা রান্না করা হয়। শুক্রবার সন্ধ্যার আগে বাড়ি পৌঁছার কথা ছিল মজনুদের। কিন্তু যানজটের কারণে তাদের ট্রাকটি সেহরি করায় সিরাজগঞ্জে। আমার জন্য পাজ্ঞাবি, ওর মায়ের জন্য শাড়ি নিয়েছে। বাটা সু কোম্পানিতে চাকুরী করার সুবাদে গ্রামের অনেকের জন্য সু নিয়েছে। বগুড়া পার হওয়ার পর সর্বশেষ মোবাইলে কথা হয় বাবা ছেলের। ওই ট্রাকের যাত্রী ছিল মজনুর চাচাত বোন বন্যা। সেও মৃত্যুর মিছিলে সামিল হয়েছে মজনুর সাথে। আহত হয়েছে মজনুর চাচা ঝন্টু মিয়া ও চাচি জামিনাসহ অনেকেই।
মজনুর বাড়ি গেয়ে দেখা যায়, মজনুর মা মাহফুজা বেগম ছেলের মৃত্যুর খবরে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। জেগে উঠলেও সাথে সাথে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছেন তিনি।
একই গ্রামের কোহিনুর ইসলাম ৬ বছর ধরে ঢাকায় কাজ করেন। একমাত্র মেয়ে কুলসুমের বিয়ের সময় করা ঋণ পরিশোধ করতেই ঢাকায় কাজ শুরু করেন দিনমজুরের। সর্বশেষ রমজানে বাড়ি এসেছিলেন। আবারও চলে যান ঢাকায় ঈদের খরচ যোগাতে। বাসের টিকিট মিলাতে ব্যর্থ হয়ে ঝুকি নিয়ে গ্রামের অন্যদের সাথে ট্রাকে উঠেন কোহিনুর ইসলাম। বাবার বাড়ি ফেরার সংবাদে একমাত্র ছেলে রুবেল খুশিতে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলো। এ সড়ক দুর্ঘটনায় ওই ট্রাকের যাত্রী মজনু ও শিশু বন্যা ও কোহিনুরসহ কালীগঞ্জ ও আদিতমারী উপজেলায় ১৭ জনের প্রাণহানীর ঘটনায় পুরো এলাকায় শোকের মাতম। ১৭ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হলেও অনেকের খোঁজ পাচ্ছেন না স্বজনরা।
নিহত ১৬ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলেন, রবিউল ইসলাম, নাসিদা আক্তার, আজিজুল ইসলাম, আলমগীর হোসেন, দেলোয়ার হোসেন, জসিম উদ্দিন, আনিছুজ্জামান, সুর্পণা, কোহিনুর ইসলাম, শহিদুল ইসলাম, মজনু মিয়া, সাদ্দাম হোসেন, মুনির হোসেন, রফিকুল ইসলাম ও খলিল মিয়া।
তাদের মধ্যে লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলায় ১২ জন, আদিতমারী উপজেলায় ২ জন, পাশ্ববর্তী কুড়িগ্রাম জেলায় ২ জন ও ময়মনসিংহ জেলায় ১ জনের বাড়ি বলে জানা গেছে। বাসের টিকিটি না পেয়ে তারা সিমেন্ট বোঝাই ট্রাকে করে বাড়ি যাচ্ছিলেন।
এ দিকে নিহত পোশাক শ্রমিকদের প্রত্যকের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন রংপুর জেলা প্রশাসক ওয়াহেদুজ্জামান। এছাড়া আহতদের প্রত্যেককে ৫ হাজার টাকা করে চিকিৎসা খরচ দেওয়ার কথাও জানিয়েছেন তিনি।