বাঙালির বন্ধু ফাদার মারিনো রিগন আর নেই

প্রকাশ | ২১ অক্টোবর ২০১৭, ১৩:৩৮

অনলাইন ডেস্ক

বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিক ও মুক্তিযোদ্ধা ফাদার মারিনো রিগন আর নেই। ইতালির ভিচেঞ্চায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার (২০ অক্টোবর) সন্ধ্যায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বলে তার ভাগ্নি মারতা আলেসান্দ্রো জানিনের বরাত দিয়ে প্যারিস প্রবাসী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রবীশঙ্কর মৈত্রী জানিয়েছেন।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি অসুস্থ ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও সেবা দেওয়ার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। বাংলাদেশ সরকার ২০০৯ সালে তাকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব প্রদান করে।

বাংলাদেশ সময় শুক্রবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে ফেইসবুক লাইভে এসে রবীশঙ্কর মৈত্রী বলেন, দার্শনিক, লেখক, অনুবাদক ও মানবসেবক ফাদার মারিনো রিগন দেহত্যাগ করেছেন। এই মাত্র তিনি মায়াত্যাগ করে চলে গেছেন। ২০১৪ সাল থেকে তিনি ইতালির ভিচেঞ্চায় বিশেষ যত্নে ছিলেন। তার আর বাংলাদেশে ফেরা হল না। ফাদার রিগনের ভাগ্নি মারতা জানিন ইতালির ভিল্লভেরলা থেকে শোক সংবাদটি জানালেন।

ফাদার মারিনো রিগন ১৯২৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ইতালির ভেনিসের কাছে ভিল্লভেরলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে আসেন। দেশের নানা জায়গা ঘুরে বাগেরহাটের মংলা উপজেলার হলদিবুনিয়া গ্রামে দীর্ঘদিন বসবাস করেন তিনি।

ধর্মের গণ্ডি পেরিয়ে বাংলাদেশের মানুষের দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষার প্রসার, চিকিৎসা সেবা ও দুঃস্থ নারীদের উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। বাংলা শিল্প-সাহিত্য নিয়ে গবেষণার পর তা ইতালীয় ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন ফাদার মারিনো রিগন। তার হাত দিয়ে ইতালীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলিসহ প্রায় ৪০টি কাব্যগ্রন্থ, লালন সাঁইয়ের ৩৫০টি গান, জসীম উদদীনের নকশীকাঁথার মাঠ, সোজন বাদিয়ার ঘাট ছাড়াও এ দেশের গুরুত্বপূর্ণ কবিদের অনেক কবিতা।

ফাদার রিগনের ইতালীয় ভাষায় অনূদিত রবীন্দ্রকাব্যের একাধিক গ্রন্থ ফ্রেঞ্চ, স্পেনিশ ও পুর্তগিজ ভাষায় অনূদিত হয়। ১৯৯০ সালে তিনি ইতালিতে রবীন্দ্র অধ্যয়ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন।

ফাদার রিগন বাংলার নকশিকাঁথাকেও তুলে ধরেছেন ইতালির বিভিন্ন শহরে। তার প্রতিষ্ঠিত শেলাবুনিয়া সেলাই কেন্দ্রের উৎপাদিত নকশিকাঁথার চারটি প্রদর্শনী হয় ইতালির বিভিন্ন শহরে।

ফাদার রিগনের কর্মপরিধির বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে শিক্ষামূলক কার্যক্রম। তার প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয় ১৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য তিনি বৃত্তির ব্যবস্থাও করেছিলেন। ১৯৮৬ সালে ফাদার রিগনের সহযোগিতায় বাংলাদেশের একটি নৃত্যনাট্যের দল ‘নকশীকাঁথার মাঠ’ মঞ্চায়ন করে ইতালির মঞ্চে।

২০০১ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হলে তার পরিবারের সদস্যরা তাকে ইতালি নিয়ে যেতে চান। তখন তিনি তার স্বজনদের শর্ত দিয়েছিলেন যে, ইতালিতে তার যদি মৃত্যু হয় তাহলে মরদেহটি বাংলাদেশে পাঠাতে হবে। ইতালির স্বজনেরা মেনে নেন তার জুড়ে দেওয়া শর্ত। এরপর তিনি উন্নত চিকিৎসায় ইতালি যান। সেখানেও অস্ত্রোপচারের আগে স্বজনদের কাছে তার শেষ মিনতি ছিল, আমার মৃত্যু হলে লাশটি বাংলাদেশে পাঠাবে, বলেছেন রবীশঙ্কর মৈত্রী।