মুছে যাচ্ছে বীর বিক্রম জগৎজ্যোতি দাসের নাম

প্রকাশ : ১৫ নভেম্বর ২০১৭, ১৩:৩০

সাহস ডেস্ক

১৯৭১-এর ১৬ নভেম্বর ১ অগ্রহায়ণ ২৭ রমজান, মঙ্গলবার। মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিঝরা এই দিনে ভাটি বাংলার অন্যতম অকুতোভয় গেরিলা কমান্ডার জগৎজ্যোতি দাস শ্যাম হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলার নিজ জন্মস্থান জলসুখা গ্রাম থেকে ৪ কিলোমিটার উত্তরে বদলপুর গ্রামের দক্ষিণে কৈয়ার বিল নামক স্থানে পাকবাহিনীর সাথে সম্মুখ সমরে এক সহযোদ্ধাসহ প্রাণ হারান। হবিগঞ্জের এই সূর্য সন্তান বীর বিক্রম জগৎজ্যোতি দাসের নাম যেনো মুছে যাচ্ছে স্মৃতির পাতা থেকে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় অস্থায়ী সরকার জগৎজ্যোতিকে মরণোত্তর সর্বোচ্চ পদক প্রদানের ঘোষণা দিয়েও সেই ঘোষণা রক্ষা করা হয়নি। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে তাকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। এই পুরস্কারও বাস্তবে প্রদান করা হয় আরও ২ যুগ পর। হবিগঞ্জে অবস্থিত মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদগণের স্মৃতিফলক স্তম্ভেও তার নাম উঠানো হয় আন্দোলন করে।

হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলার জলসুখা বাজার সংলগ্ন ইছবপুর মহল্লার জীতেন্দ্র চন্দ্র দাস ও হরিমতি দাসের কনিষ্ঠপুত্র জগৎজ্যোতি দাসের জন্ম ১৯৪৯ সালের ২৬ এপ্রিল। ১৯৬৮ সালে আজমিরীগঞ্জের এএবিসি হাই স্কুল থেকে ২য় বিভাগে এসএসসি পাশের পর জগৎজ্যোতি উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণে ভারতের আসামে কাকা ননীগোপাল দাসের বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখানে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর সেখানকার সেনাবাহিনীতে ভর্তি হন। জগৎজ্যোতি দাস শ্যাম সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করে চাকুরীতে যোগদানের দু’দিন পূর্বে পুনরায় মাতৃভূমি জলসুখায় ফিরে আসেন। দেশে ফিরে প্রথমে জলসুখা কৃষ্ণগোবিন্দ পাবলিক হাইস্কুলে ৭৫ টাকা বেতনের শিক্ষকতার চাকুরী নেন। পরবর্তীতে সেই চাকুরী ছেড়ে সুনামগঞ্জ কলেজে গিয়ে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হন। 

১৯৭১ সনে সুনামগঞ্জ কলেজে জগৎজ্যোতি ছিলেন সুনামগঞ্জ ছাত্র ইউনিয়নের প্রথম সারির কর্মী। এ সময়ই সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেয়ার লক্ষ্যে সদলবলে ভারতের শিলংয়ে ট্রেনিং নিতে যান তিনি। নেতৃত্ব গুণ সম্পন্ন সংবেদনশীলতা, কঠোর পরিশ্রমী এবং ইংরেজী ও হিন্দি ভাষায় অনর্গল কথোপকথনে পারদর্শিতা ও দক্ষতার কারণে জগৎজ্যোতি বাংলাদেশ ও ভারতীয় উচ্চ পদস্থ সেনা অফিসারদের সুনজরে ছিলেন। শুরুতেই মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা দলের নেতা মনোনীত করে জগৎজ্যোতিকে ভাটি অঞ্চলে সুনির্দিষ্ট দায়িত্বে পাঠিয়ে দেয়া হয়। পরবর্তীতে এ দলটিই ‘দাস পার্টি’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানী ও রাজাকারদের কাছে দাস পার্টি ছিল মূর্তমান এক আতঙ্কের নাম। আর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে সাফল্যের প্রতীক। মুক্তিযুদ্ধে টেকেরঘাট সাব সেক্টরের অধীনে বিস্তীর্ণ ভাটি অঞ্চল শত্রুমুক্ত রাখার দায়িত্ব পড়ে জগৎজ্যোতির উপর। দিরাই, শাল্লা, আজমিরীগঞ্জ, বানিয়াচং, জামালগঞ্জ, তাহিরপুর, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনার ভেড়ামোহনা, কালনী, কুশিয়ারা, সুরমার নৌপথ পাক দখলমুক্ত রাখার যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় জগৎজ্যোতির ‘দাস পার্টি’। ভাটির জনপদে শত্রুদের ভিত কাপিয়ে দেন জগৎজ্যোতি। দাসপার্টির মুহূর্মুহূ আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পাকিস্তান সরকার রেডিওতে ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়, এই রুট দিয়ে চলাচলকারী ব্যক্তিদের জানমালের দায়িত্ব সরকার নেবে না।

 হিলালনগর যুদ্ধে পাকিস্তানীদের গানবোট ধ্বংস করে দেয় জগৎজ্যোতির নেতৃত্বে দাস পার্টি। ১৭ আগস্ট পাহাড়পুরে শ্যামের বুদ্ধিমত্তা ও বীরত্বে রক্ষা পায় অসংখ্য নিরীহ বাঙালির প্রাণ ও নারীর সম্ভ্রম। এখানেও পিছু হটে পাকিস্তানীরা। এর পর একের পর এক যুদ্ধজয়ী অভিযান চলতে থাকে জগৎজ্যোতির নেতৃত্বাধীন দাস পার্টির। ভেড়াহরে শত্রুদের কার্গো কনভয় ধ্বংস করে দেয়া হয়। সদরপুর ব্রীজ উড়িয়ে ঠেকিয়ে দেওয়া হয় হায়েনাদের।

জগৎজ্যোতি দাসের সাথে যুদ্ধে অংশ নেয়া বানিয়াচংয়ের সাবেক ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী মোমিন বলেন, ভাটি এলাকায় জগৎজ্যোতি দাসের নেতৃত্বে যে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল তা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সবসময় আতঙ্কে রাখত। জগৎজ্যোতিকে থামানোর জন্য সামরিক কায়দায় সুবিধা না করতে পারে তারা রাজাকারদেরকে ব্যবহার করে। কিন্তু জগৎজ্যোতি অবিচল আস্থার সাথে একের পর এক সফল অভিযান পরিচালনা করেন। কিন্তু যুদ্ধের পর প্রাপ্ত স্বীকৃতি তিনি পাননি।

তার সাথে যুদ্ধ করা হবিগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এর সাবেক সভাপতি রাশিদুল হাসান কাজল বলেন, জগৎজ্যোতি দাস তার সহযোদ্ধাদের জীবন বাঁচাতে পালানোর সুযোগ করে দিয়ে নিজেই মরনপণ লড়াই চালিয়ে যান। তার সাথে ইলিয়াসও ছিলেন অকুতোভয়। বদলপুর যুদ্ধে ইলিয়াস গুলিবিদ্ধ হলে জগৎজ্যোতি নিজের মাথার গামছা খুলে ইলিয়াসের রক্তপড়া বন্ধ করেন। তখন ইলিয়াস পালানো প্রস্তাব দেন। এই প্রস্তাবে গর্জে উঠে জগৎজ্যোতির বীর কণ্ঠ। তেজোদীপ্ত সুরে বলেন পালাবো না সবটাকে শেষ করে তবে যাব। একাই বারো জন পাকসেনাকে খতম করেন তিনি।

জগৎজ্যোতি দাস বদলপুরের যুদ্ধে শহীদ হলে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রসহ অলইন্ডিয়া রেডিও এবং বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশিত হয়। তার বীরত্বগাঁথাও গণমাধ্যমে প্রচার হয়।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত