‘মৃত্যুর পর আমাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেবেন না’

প্রকাশ : ১৬ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৭:৫২

সাহস ডেস্ক

দেশের টানে সম্মুখযুদ্ধে লড়ে উপাধি পেয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধার। তবে সেই উপাধি এখন আর চান না। এমন কী মৃত্যুর পর দাফনের সময় রাষ্ট্রীয় মর্যাদাও চান না তিনি। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) চিঠি দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা মো. আবুল হোসেন। 

সম্প্রতি সারা দেশে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই নিয়ে অনিয়মের বিরুদ্ধে এভাবেই প্রতিবাদ করেছেন মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন।

একাত্তরে রণাঙ্গনের এই বীর সেনানীর বাড়ি জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার ফুলছেন্না গ্রামে। তিনি ১১ নম্বর সেক্টরের (তৎকালীন কিশোরগঞ্জ মহকুমা বাদে ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলা এবং রংপুর ও গাইবান্ধার কিছু অংশ) অধীনে যুদ্ধ করেন। 

১৫ ডিসেম্বর (বৃহস্পতিবার) ক্ষোভ প্রকাশ করে আবুল হোসেন বলেন, একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার বিবেকের তাড়না আছে। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা বীর উপাধি পেয়ে যাচ্ছেন। এর প্রতিবাদস্বরূপ ‘বীর’ উপাধি বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যত দিন বেঁচে থাকব, একজন সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে থাকতে চাই। আর দাফনের সময় রাষ্ট্রীয় মর্যাদা নেব না। কারণ, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারাও তো দাফনের সময় একই মর্যাদা পাবেন।

মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন গত ১২ ডিসেম্বর (মঙ্গলবার) মেলান্দহের ইউএনও তামীম আল ইয়ামিনের কাছে এই চিঠি দিয়েছেন। দুই পৃষ্ঠার চিঠিতে তিনি সারা দেশে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ে ওঠা বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে কথা বলেছেন। পাশাপাশি ভুয়া ও নামধারী মুক্তিযোদ্ধাদের দাপটে ভবিষ্যতে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের কী অবস্থা হতে পারে, তা উল্লেখ করছেন।

এবিষয়ে ইউএনও বলেন, আমার মনে হয়, মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই নিয়ে অনিয়মের অভিযোগে তিনি কষ্ট পেয়েছেন। সেই অভিমান থেকে তিনি এমন চিঠি দিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ করা হচ্ছে।

চিঠিতে বলা হয়েছে, দেশ স্বাধীন হওয়ার দুই যুগ পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অসহায় মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়ান। ভাতা ও সম্মান দুটিই চালু করেন। প্রধানমন্ত্রী প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরির ওপর তাগিদ দেন। কিন্তু একটি কুচক্রী মহল সময়ে সময়ে এর সুযোগ নিয়েছে। তারা বহু অমুক্তিযোদ্ধার নাম তালিকাভুক্ত করেছে। অনেকে মুক্তিযুদ্ধকালে শিশু ছিল। তারাও তালিকায় নাম উঠিয়েছে। অনেকে যুদ্ধই করেননি, কিন্তু যুদ্ধাহত ভাতা নিচ্ছেন। মূলত মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে এসব হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কিছু প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারও আঁতাত রয়েছে। ফলে অনেকে এখন মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কটূক্তির সাহস পাচ্ছেন।

চিঠিতে মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের বাছাই করতে নতুন করে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই শুরু করার নির্দেশ দেন। যেসব মুক্তিযোদ্ধা ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ করলেও তালিকার বাইরে ছিলেন, তাঁদের অন্তর্ভুক্তিই ছিল লক্ষ্য। কিন্তু মাঠপর্যায়ে তা হয়নি। অর্থের বিনিময়ে নতুন তালিকায় অমুক্তিযোদ্ধাদের নাম ঢোকানো হয়েছে।

চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা এখন বয়োবৃদ্ধ। দিনে দিনে তাঁদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। ওদিকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বাড়ছে।

চিঠিতে আরও বলা হয়, স্বাধীনতার ৪৬ বছরেও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা হয়নি। ভবিষ্যতে হবে—এমন বিশ্বাসও নেই। কারণ, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ঠেকাতে সারা দেশ থেকে বহু দরখাস্ত গেছে। কিন্তু তা কোনো কাজে আসেনি। এর মূলে রয়েছে ওই মোটা অঙ্কের টাকার লেনদেন। অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাও ‘টাকার কাছে চুক্তিতে আবদ্ধ’ বলে চিঠিতে অভিযোগ করা হয়েছে।

মেলান্দহ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক কমান্ডার আনোয়ার হোসেন বলেন, ওই সব অভিযোগ তাঁর ব্যক্তিগত।

জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেন, মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই থেকে শুরু করে যারা তালিকা করেন, তাদের জন্য এটা একটা সতর্কসংকেত। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধারা হচ্ছেন আমাদের আত্মমর্যাদার জায়গা। এই জায়গায় যেন কোনো দুর্নীতির সুযোগ তৈরি না হয়, সে বিষয়ে সবাইকে খুব সতর্ক থাকতে হবে। কোনো প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যাতে বাদ না পড়েন, এটাও দেখতে হবে। আবার দুর্নীতি যাতে জায়গা করে না নিতে পারে, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে।’

সাহস২৪.কম/জুয়েনা/আল মনসুর 

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত