অপারেশন হিট স্ট্রং ২৭ এর আদ্যোপান্ত

প্রকাশ : ২৮ আগস্ট ২০১৬, ১৫:৫৬

সাহস ডেস্ক

নারায়ণগঞ্জ শহরের পাইকপাড়া বড় কবরস্থান সংলগ্ন আবাসিক ভবন ‘দেওয়ান বাড়ি’। ছিমছাম তিনতলা বাড়িটির তৃতীয় তলায় যে আস্তানা গেড়েছে দুধর্ষ জঙ্গিরা প্রতিবেশীরা তা বুঝতেই পারেনি।

শুক্রবার (২৬ আগস্ট) গভীর রাতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যখন ভবনটি ঘিরে তৎপরতা শুরু করে, তখনই তারা বুঝতে পারেন-কিছু একটা হচ্ছে।

শুক্রবার (আগস্ট ২৬) দিবাগত রাত থেকে বাড়িটির চারপাশে অবস্থান নিলেও শনিবার সকাল ৯টা ০৫ মিনিটে মূল অভিযান শুরু করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। এর আগে তাদের আত্মসমর্পণের সুযোগ দেয়া হলেও তা প্রত্যাখ্যান করে জঙ্গিরা।

অবশেষে শনিবার (২৭ আগস্ট) সকাল নয়টা থেকে শুরু হওয়া দুঃসাহসিক অভিযানে প্রাণ হারায় দেশের দুধর্ষ ‘জঙ্গি মাস্টারমাইন্ড’ তামিম চৌধুরী। তামিমের সঙ্গে মারা যায় তার দুই সহযোগীও।

অভিযান শুরু হয় সকাল ৯ টা ৩৫ মিনিট। ঘিরে থাকা বাড়িটিতেই যে জঙ্গিরা অবস্থান করছে তা নিশ্চিত হয় পুলিশ ও অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পুলিশের পক্ষ থেকে জঙ্গিদের উদ্দেশ্যে বলা হয় আত্মসমর্পণ করতে। যদি তারা তা করে তাহলে তাদেরকে গ্রেপ্তার করে আইনি সহায়তা দেওয়া হবে। কিন্তু এ আহবানে কান না দিয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর অবস্থান লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছুঁড়ে মারে জঙ্গিরা। তাদের এই হামলার জবাব দিতে শুরু করতেই নিহত হন তামিমসহ তিনজন।  

‘দেওয়ান বাড়ি’র পাশের চায়ের দোকানদার মোক্তার হোসেন বলেন, এদের কাউকে দেখিনি কোনদিন। আজকে সকালেই জানতে পারি এরা জঙ্গি। সকাল ৭টায় দোকান খুলতে এলে পুলিশ বলে, আজ আর দোকান খুলতে হবে না। পরে দোকানেই বসে থাকি। এখান থেকেই আমি গুলির শব্দ পাই একটু পর পর।

স্থানীয় হোটেল মালিক জাহাঙ্গীর বলেন, আমি ফজরের পরপরই কারিগর নিয়ে কাজ শুরু করি, একটু পরই পুলিশ জানায়, দোকান বন্ধ করে যেন ভিতরে কাজ করি। পরে গুলির শব্দ পাই। দোকান খুলে দেখি, সাংবাদিক আর পুলিশ। জানতে পারি এখানেই জঙ্গি নিহত হয়েছে।

বাড়ির মালিকের চাচাতো ভাই সালাউদ্দিন দেওয়ান জানান, বাড়ির মালিক নুরুদ্দিন দেওয়ান স্ত্রী রুনা এবং তিন ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে বাড়িটিতে থাকেন। বড় ছেলে এইচএসসির ছাত্র। মেজো ছেলে পড়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে, ছোট ছেলে কেজি-১ এ পড়ে। সবার ছোট বোন।

তিনি আরো বলেন, নুরুদ্দিন দীর্ঘদিন জাপানে ছিলেন। সেখান দেশে ফেরার পর নিতাইগঞ্জসহ কয়েকটি স্থানে কাটা কাপড়ের ব্যবসাসহ বিভিন্ন ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হন। বর্তমানে বাসা ভাড়া ছাড়া তার আর কোন আয় নেই।

বাড়ির মালিক নুরুদ্দিন দেওয়ান জানান, নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় মুরাদ ও রানা পরিচয়ে বাসা ভাড়া নিয়েছিল জঙ্গিরা। তারা বাসাটি ভাড়া নেয় গত জুলাই মাসে।

নুরুদ্দিন দেওয়ান জানান, জাপান থেকে দেশে ফিরে প্রায় ১৫ বছর আগে তিনতলা বাড়িটি করেন তিনি। এর দ্বিতীয় তলার পুরোটা নিয়ে তিনি থাকেন। তৃতীয় তলায় উত্তর ও দক্ষিণ দিকে একটি করে মোট দুটি ফ্ল্যাট আছে। এরমধ্যে উত্তর দিকের ফ্ল্যাটটি ভাড়া নেয় জঙ্গিরা।

তিনি(নুরুদ্দিন দেওয়ান) আরো জানান, জুলাই মাসে জঙ্গিরা মুরাদ ও রানা নামে বাসাটি ভাড়া নেয়। তারা নিজেদের পরিচয় দেয় ওষুধ কোম্পানির চাকরিজীবী হিসেবে।
ভাড়া দেওয়ার পর আমি একাধিকবার ওই বাসায় গেছি। গিয়ে দেখেছি, তারা কেউ রান্না করছে, কেউ শুয়ে আছে।গত দেড় মাসে তাদের সন্দেহজনক কিছু আমার চোখে পড়েনি।

পাইকপাড়া বড় মসজিদের খাদেম মাহমুদুল জানান, ফজরের নামাজ পড়তে উঠে দেখি পুলিশ আর পুলিশ।রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে দেওয়ান বাড়ি ঘিরে রেখেছে পুলিশ।তারপর গুলি আর গুলির শব্দ।

মসজিদের পাশে বড় কবরস্থান লাগোয়া দেওয়ান বাড়িতে অভিযান পরিচালনা করে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। তাদের সহযোগিতা করে পুলিশ, র‌্যাব ও জেলা গোয়েন্দা পুলিশ এবং ময়মনসিংহের পুলিশ ও গোয়েন্দা পুলিশের কয়েকটি ইউনিট।

জুলাই মাসে বাসা ভাড়া নেয়া তিন জঙ্গিকে কখনো দেখেনি এলাকাবাসী।

বাসার নিচতলার ভাড়াটিয়া খাজা জানান, তিনি এক মাস ধরে এদের দেখছেন এ বাড়িতে। কখনো কথা হয়নি তার সাথে এদের কারো। এমনকি কারো নাম পর্যন্ত বলতে পারেন না তিনি। তবে তিনি জানান, এরা প্রতিদিন সকালে বাড়ি থেকে বের হয়, আবার বিকালে ফিরে আসে। রাতে এদের মধ্যে দুজন থাকতো, কখনো কখনো কিছু মানুষ আসতো বাসায়।

ভ্যানগাড়ি চালক খাজা আরো জানান, কখনো এদের কাউকে এলাকায় নামাজ পড়তে দেখেননি তিনি।

বেলা পৌনে ১১টায় সমাপ্তি ঘোষণা করা হয় ‘অপারেশন হিট স্ট্রং-২৭’ এর। জেলা পুলিশের সহকারী সুপার (ডিএসবি) ফারুক হোসেন জানান, ঘণ্টাব্যাপী অভিযানে নিহত হয়েছে তিনজঙ্গি। এই অপারেশনে আমরা এক কালো অধ্যায়ের সমাপ্তি টানলাম।

ঢাকা মহানগর পুলিশের বম ডিসপোজাল ইউনিটের ইনচার্জ অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন জানান, উই আর নট স্যাটিসফায়েড। ওদের জীবিত ধরতে পারলে, ধ্বংস হওয়ার আগে কাগজপত্র জব্দ করতে পারলে আরো তথ্য পাওয়া যেতো। কিন্তু জঙ্গিরা গুরুত্বপূর্ণ সব কাগজপত্র পুড়িয়ে দিয়েছে।

ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, পুলিশের আইজি একে এম শহিদুল হকসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও স্থানীয় সংসদ সদস্যরা।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত