আজ সূর্যমণি গণহত্যা দিবস

প্রকাশ : ০৬ অক্টোবর ২০১৬, ১১:৫০

পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার সূর্যমণি গণহত্যা দিবস আজ (৬ অক্টোবর)। এইদিনে উপজেলার আঙ্গুলকাটা গ্রামের ২৫ হিন্দু বাঙালিকে এক দড়িতে বেঁধে স্থানীয় রাজাকার বাহিনী নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে।

১৯৭১ সালের ৬ অক্টোবর এই দিন ভোর রাতে মঠবাড়িয়ার হিন্দু অধ্যুষিত আঙ্গুলকাটা গ্রাম থেকে ৩৭ জন নিরাপরাধ হিন্দু বাঙালিকে ধরে নিয়ে যায় স্থানীয় রাজাকার বাহিনী। ওই রাতে ৫০/৬০ জনের স্থানীয়ভাবে সংগঠিত একটি রাজাকার বাহিনী গ্রামের হানা দিয়ে ব্যপক ধরপাকড় ও লুটপাট চালায়। ৩৭ জন হিন্দু বাঙালিকে ঘুমন্ত  অবস্থায় বাড়ি থেকে তুলে নেয়। তাঁদের মধ্যে ৭ জনকে রাতভর মঠবাড়িয়া থানায় আটকে রেখে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। পরের দিন মোটা অংকের অর্থের বিনিময় সাত জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়। বাকী ৩০ জনকে মঠবাড়িয়া শহর হতে আড়াই কিলোটিার দূরে সূর্যমণি বেড়িবাঁধের ওপর এক লাইনে দাঁড় করিয়ে নির্মমভাবে গুলি  করে হত্যা করে। এ সময় ভগ্যক্রমে গুলি খেয়ে বেঁচে যায় পাঁচ জন বেঁচে গেলে বাকী ২৫জন ঘটনাস্থলেই সেদিন শহীদ হন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ, সমর্থন ও মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দানের অপরাধে স্বাধীনতা বিরোধীরা তাঁদের ওপর এ নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়। 

স্বাধীনতার এতো বছর পেরিয়ে গেলেও ২৫ শহীদের রক্তে রঞ্জিত সূর্যমনি গ্রামের এ বধ্যভূমিতে আজও কোন স্মৃতিস্তম্ভ নির্মান হয়নি। এমনকি এই জীবনদানের যথাযথ স্বীকৃতিও পায়নি শহীদ পরিবারগুলো। তবে ওই স্থানে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করার জন্য ২০০১ সালের ৭ জানুয়ারি তৎকালীন বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী আ.খ.ম জাহাঙ্গীর হোসেন ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তারপর ভিত্তি প্রস্তরেই স্থবির !

সেদিন যাঁরা সূর্যমণিতে শহীত হয়েছিলেন তাঁরা হলেন, জিতেন্দ্র নাথ মিত্র, শৈলেন মিত্র, বিনোদ বিহারী, ফনীভূষন মিত্র, ঝন্টু মিত্র, নগেন কিত্তুনীয়া, অমল মিত্র, সুধাংশ  হালদার, মধুসুদন হালদার, প্রয়নাথ হালদার, সীতানাথ হাওলাদার, অন্নদা হাওলাদার, অনিল হাওলাদার, হিমাংশু মাঝি, জিতেন মাঝি, সুধীর মাষ্টার, অমেলেন্দু হাওলাদার,  অচীন মিত্র, অরুণ মিত্র, নিরোধ পাইক ও কমল মন্ডল ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। 

প্রাণে বেঁচে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধা সুনীল মিত্র বলেন, ওই রাতে আমার বাবা ও ছোটভাইকে সহ আমাকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমার বাবা ও ভাইকে থানায় আটক করে নির্যাতনের পর ছেড়ে দেওয়া হলে আমার নিরাপরাধ ছোটভাই অষ্টম শ্রেণির ছাত্র শৈলেন মিত্রকে স্বাধীনতা বিরোধীরা সূর্যমণিতে গুলি করে হত্যা করে।

শহীদ বিরাংশু কুমার হালদারের ছেলে বিকাশ চন্দ্র হালদার ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, মুক্তিযুদ্ধে আমরা স্বজনহারা হয়েছি। তবে শহীদ পরিবারগুরোর প্রতি কেউ নজর দেয়নি । গণহত্যার স্থানে আজও স্মৃতিস্তম্ভ পর্যন্ত হলনা। এই উপক্ষো দু:খজনক।

২০০১ সালে সূর্যমণি গণহত্যার ঘটনায় বিচার দাবিতে সাত জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে একটি মামলা দায়ের করা হয়। ওই সময়ে সূর্যমণিতে রাজাকারদের গুলি খেয়ে বেঁচে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধা জ্ঞানেন্দ্র মিত্র (৬২) বাদী হয়ে মঠবাড়িয়া সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে মামলাটি দায়ের করেছিলেন। আদালতের তৎকালীন বিচারিক হাকিম মো. কবির উদ্দিন প্রামানিক মামলাটি গ্রহন করে ফৌজদারী কার্যবিধির ১৫৬ (৩) ধারায় তদন্ত পূর্ববক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মঠবাড়িয়া থানার অফিসার ইনচার্জকে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। পরে পুলিশ মামলাটি মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষে গঠিত ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ারভূক্ত করতে সুপারীশ করে। এ কারণে মামলাটি ট্রাইব্যুনালে অন্তর্ভূক্ত হয়।

মামলায় জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা সাবেক সংসদ সদস্য এম, এ জব্বার ইঞ্জিনিয়ারকে প্রধান আসামী করে সাত জনের নামে মামলা করা হয়। এছাড়া মামলায় আরও ৬০/৬৫ জনকে অজ্ঞাত নামা আসামী করা হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চূড়ান্ত রায়ে অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধি জব্বার ইঞ্জিনিয়ারের আমৃত্যু কারাদণ্ড হয়। তবে তিনি বর্তমানে পলাতক রয়েছেন। 

সূর্যমণি বধ্যভূমি সুরক্ষা কমিটির সভাপতি ও মুক্তিযোদ্ধা পরিমল চন্দ্র হালদার সূর্যমণি গণহত্যায় ২৫ শহীদের স্বীকৃতি ও ওই স্থানে একটি স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণের দাবি জানিয়ে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের এত ত্যাগের পরও শহীদ পরিবার ও গণহত্যার স্থান উপেক্ষিত থাকা দুঃখজনক।

 

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত