রাজশাহীতে কঙ্কাল নিয়ে ভয়ঙ্কর ব্যবসা

প্রকাশ : ২০ অক্টোবর ২০১৬, ১০:২১

রাজশাহীতে কঙ্কাল নিয়ে ভয়ঙ্কর ব্যবসায় মেতে উঠেছে একটি চক্র। এতে জড়িয়ে পড়েছেন মেডিক্যাল কলেজের (রামেক) কিছু শিক্ষার্থী, মর্গের ডোম, বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকের কয়েকজন অসাধু মালিক আর সীমান্তের কিছু চোরকারবারী।

কয়েক মাস আগেই রাজশাহী মহানগরীর শ্রীরামপুর এলাকায় জেলা প্রশাসকের বাংলোর সামনে থেকে ১২টি কঙ্কালসহ চারজনকে আটক করেছিল পুলিশ। এরপরেও থামেনি কঙ্কালের কারবার। মঙ্গলবার রাত ৮টার দিকে এবার রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের মর্গ থেকেই পুলিশ উদ্ধার করেছে ১৫টি মাথার খুলি ও বিভিন্ন হাড়গোড়। মর্গের দোতলার একটি কক্ষ থেকে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একটি দল কঙ্কালগুলো উদ্ধার করে।

এ সময় কঙ্কাল কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে মর্গের দুই ডোমকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা হলেন, নগরীর বাকীর মোড় লক্ষ্মীপুর এলাকার বিপন কুমার (৫৫) ও নীরেন রবিদাস (৪২)।

নগর ডিবি পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল হান্নান জানান, রামেক মর্গে কঙ্কাল সংরক্ষণ করে কেনাবেচার গোপন সংবাদের ভিত্তিতে মঙ্গলবার রাতে তারা সেখানে অভিযান চালান। অভিযানে মর্গের দোতলার একটি কক্ষ থেকে খণ্ড খণ্ড অবস্থায় ১৫টি কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়। এ সময় কঙ্কাল কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ওই দুই ডোমকে আটক করা হয়। পরে রাতেই তাদের নামে বিশেষ ক্ষমতা আইনে রাজপাড়া থানায় একটি মামলা করা হয়। সকালে তাদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায় পুলিশ।

ওসি আরও জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বিপন ও নীরেন দাবি করেছেন, চোরাকারবারীরা তাদের ভারত থেকে খণ্ড খণ্ড অবস্থায় কঙ্কাল এনে দেয়। তারা তখন হাড়গোড় জোড়া দিয়ে বিক্রির ব্যবস্থা করেন। এ চক্রের সঙ্গে জড়িত আছেন কয়েকজন মেডিক্যাল শিক্ষার্থী, বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকের কয়েকজন মালিক ও সীমান্ত এলাকার কিছু চোরকারবারী।

এদিকে মেডিক্যাল কলেজের মর্গেই এতোগুলো কঙ্কাল পাওয়ায় বিষয়টি নিয়ে তদন্তে মাঠে নেমেছে সরকারি কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দাদের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসছে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্যও। সরকারি একটি গোয়েন্দা সংস্থার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এসব তথ্য জানিয়েছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা বলেন, রাজশাহীতে কঙ্কাল ব্যবসা পরিচালনা করছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটের এক এক জন সদস্য নির্দিষ্ট একটি ধাপে কাজ করেন। বেশিরভাগ কঙ্কালের যোগান মিলছে ভারত থেকে। কিছু কঙ্কাল আসছে কবর থেকে চুরি হয়ে। আর কিছু কঙ্কাল মিলছে মর্গ থেকেই। পূর্ণাঙ্গ একটি কঙ্কাল তৈরিতে যেসব হাড় প্রয়োজন তা কেনা হয় পাঁচ হাজার টাকায়। আর একটি কঙ্কাল বিক্রি হয় ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকায়।

বুধবার দুপুরে কঙ্কাল ব্যবসার অদ্যপ্রান্ত নিয়ে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেন রামেক মর্গের একজন ডোম। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনিও জানিয়েছেন কঙ্কাল ব্যবসার নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য।

তিনি জানান, রামেক মর্গের ডোমেরা বেতন পান মাসে ২০ টাকা। তাদের বাপ-দাদারাও বেতন পেয়েছেন ২০ টাকা। এ জন্য তাদের ময়নাতদন্তের পর লাশের স্বজনদের কাছ থেকে জুলুম করে টাকা আদায় করতে হয়। তাই আয়ের পথ সহজ করতে প্রায় সবাই কঙ্কালের কারবারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। কিন্তু কারবারে তাদের দায়িত্ব খুব কম। তারা শুধু বিভিন্ন স্থান থেকে আসা গলিত লাশ থেকে হাড়গোড় বের করে পরিস্কারের পর পূর্ণাঙ্গ একটি কঙ্কাল তৈরি করে দেন। কখনও কখনও বেওয়ারিশ গলিত লাশ থেকে বের করে নেয়া হয় হাড়গোড়। তারপর গলিত মাংসের ভেতর বাঁশের কঞ্চি ভরে সেলাই করে দেয়া হয়। সেসব লাশ কেউ পরীক্ষা করে দেখে না। গলিত লাশের কোনো স্বজন থাকলেও তারা তা পরীক্ষা করেন না। ফলে এসব লাশ থেকে হাড় চুরি করা তাদের জন্য অনেক সহজ।

তিনি আরও জানান, সিন্ডিকেটের সদস্য হিসেবে রাজশাহীর বিভিন্ন গ্রামে-গঞ্জে কিছু মাদকসেবী লাশ চোর আছে। তারা কবরস্থান থেকে লাশের হাড়গোড় চুরি করে এনে ডোমদের হাতে দেয়। তবে সিংহভাগ কঙ্কাল আসে রাজশাহীর চর মাঝাড়দিয়াড় সীমান্ত পথে ভারত থেকে। এ গ্রামের উজ্জল, সুকচাঁন, আরিফুল, ফজলু, লিটন, মাজান, মুন, মুরোজা ও শরিফুলসহ অন্তত ২০ জন চোরাকারবারী আছেন, যাদের কাজ শুধু কঙ্কাল আমদানি করা। এরপর তারাই রামেকের ডোমদের হাতে তা পৌঁছে দেন। মাঝাড়দিয়াড়ের সীমান্ত এলাকার ভারতীয় গ্রামগুলোর চোরাকারবারীরা ওই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষের হাড় সংগ্রহ করে এপারের চোরাকারবারীদের হাতে তুলে দেয়।

সূত্র আরও জানায়, রামেকের মর্গের ডোমেরা খণ্ড খণ্ড হাড় ও মাথার খুলি দিয়ে এক একটি পূর্ণাঙ্গ কঙ্কাল তৈরী করেন। তারপর চাহিদা মতো এসব কঙ্কাল নিয়ে যান নগরীর লক্ষ্মীপুর কাঁচাবাজার এলাকার বাসিন্দা ও একটি বেসরকারি ডায়গনস্টিক সেন্টারের মালিক আলমগীর হোসেন, লক্ষ্মীপুর জিপিও এলাকার মামুন ওরফে কানা মামুন, ইসলামী ব্যাংক মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী আবদুস সবুর, বারিন্দ মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী রায়হান ও ওয়াহেদ এবং রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী ছাত্রলীগ নেতা মিনহাজুল। তারা এক একটি কঙ্কাল ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকায় বিভিন্ন বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে, মেডিক্যাল শিক্ষার্থীদের কাছে এবং সায়েন্টিফিক দোকানে বিক্রি করেন। প্রতিটি কঙ্কালের কাজ করে দেয়ার জন্য ডোমদের দেয়া হয় দুই থেকে তিন হাজার টাকা।

মেডিক্যাল শিক্ষার্থীদের কঙ্কাল ব্যবসায় জড়িয়ে পড়া এবং মর্গে কঙ্কাল নিয়ে এমন কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে কথা বলতে বুধবার বিকেলে রামেকের অধ্যক্ষ প্রফেসর ডা. মাসুম হাবিবের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন দেয়া হয়। কিন্তু তিনি ফোন না ধরায় এ ব্যাপারে তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

রাজশাহী নগর গোয়েন্দা পুলিশের ওসি আবদুল হান্নান বলেন, মঙ্গলবার ১৫টি কঙ্কালসহ দুই ডোমকে গ্রেপ্তারের পর তারাও পুলিশকে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে। তারা জানিয়েছে, মেডিক্যাল কলেজেরই কিছু শিক্ষার্থী কঙ্কালের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন। কিছু কঙ্কাল সীমান্তপথে ভারত থেকে মর্গে আসছে। আবার কিছু আসছে কবর থেকে। কিছু হাড়গোড় বেওয়ারিশ লাশের শরীর থেকেও ময়নাতদন্তের সময় বের করে নেয়া হয়। কঙ্কাল ব্যবসার পুরো চক্রটি সম্পর্কে একটি ধারণা পেয়েছে পুলিশ। তাদের সবার দিকে নজরদারি করা হচ্ছে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত