আজ তাঁদের হারিয়ে যাওয়ার দিন

প্রকাশ : ৩০ আগস্ট ২০১৬, ১১:২২

বকর
১১ আগস্ট, ১৯৭১, ঢাকা ইন্টারকন্টিনালে দ্বিতীয় দফায় একটি মারাত্মক বিস্ফোরণ ঘটানোর নেপথ্যে মূল নায়ক ছিলো ১৮ বছর বয়সী একটি ছেলে, ক্র্যাক প্লাটুনের সর্ব-কনিষ্ঠ গেরিলা - মোহাম্মদ আবু বকর। ঢাকা ইন্টারকনে তাঁর সেই দুঃসাহসিক অ্যাকশনের খবর বিশ্ব গণমাধ্যমে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল, ভীত নাড়িয়ে দিয়েছিলো পাকিস্থানী মিলিটারীদের দাম্ভিকতা, যারা ঢাকাকে সবচেয়ে বেশি সুরক্ষিত করে রেখেছিলো। আঠারো বয়সী এক বাঙালি ছেলে সেই উচু নাকের দাম্ভিকতার উপর পাড়িয়ে গিয়ে ওদের সবচেয়ে নিরাপত্তাবেষ্টিত জায়গায় হামলা চালিয়ে স্বগৌরবে বের হয়ে এসেছিলো। পাক মিলিটারি পাগলা কুকুর হয়ে গিয়েছিলো তারপর, এই দুঃসাহসী যুবককে ৩০ আগস্ট ভোরে গুলশান-২ এর বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় পাক আর্মিরা। নাখালপাড়া ড্রাম ফ্যাক্টরী সংলগ্ন এম.পি হোস্টেলের বদ্ধ কামড়ায় অমানুষিক নির্যাতন চলে এই গেরিলার উপর, সেদিনের পর বকর আর ফিরে আসেনি ...

হাফিজ 
শহীদ হাফিজ বেহালা বাজাতেন, সেই সুত্রে আলতাফ মাহমুদের সাথে সখ্যতা ছিল অনেক বছরের। হাফিজকে আলতাফ মাহমুদের ছায়া সঙ্গী বলে ডাকা হত। একাত্তরের যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে গান রচনার সুত্র ধরে গেরিলা অপারেশনেও দেখা গেছে এই দুজনকে একসাথে। ৩০ অগাস্ট পাক সেনাদের হাতেও তাঁরা একসাথে ধরা পরেন। অত্যাচারের মাত্রা এতোই বেশী ছিল যে হাফিজ টর্চার সেলেই ৩১ অগাস্ট মৃত্যু বরণ করেন।

আলতাফ মাহমুদ 
৩৭০ নম্বর আউটার সার্কুলার রোডের বাসায় থাকতেন আলতাফ মাহমুদ। একাত্তরের গেরিলাদের জন্য এক দুর্গ বাড়ি হিসেবে পরিচিত ছিল তাঁর বাড়িটি। এ সময়ই তিনি মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন এবং ঢাকা শহরে কতগুলো অপারেশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফের নির্দেশে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে একটি অপারেশন হয় আলতাফ মাহমুদের অংশগ্রহণে। তাঁদের কাছে প্রচুর বিস্ফোরক থাকায় সেগুলো নিরাপদে রাখার স্থান পাওয়া নিয়ে দেখা দেয় সমস্যা। আলতাফ মাহমুদ নিজ দায়িত্তে সব গোলাবারুদ তাঁর বাসায় কাঁঠাল গাছের নিচে পুঁতে রাখেন। আগস্টের শেষ সপ্তাহে ক্র্যাক প্ল্যাটুনের সামাদ নামে একজন গেরিলা ধরা পড়েন। পাঞ্জাবি পুলিশ ও সেনাবাহিনীর হাতে মার খেয়ে তিনি আলতাফ মাহমুদের বাসার কাঁঠাল গাছের নিচে লুকিয়ে রাখা গোলাবারুদের কথা বলে দেন। ৩০ আগস্ট ভোরবেলা আর্মিরা প্রথমে আলতাফ মাহমুদকে ওই ট্রাঙ্ক ভর্তি অস্রসহ ধরে নিয়ে যায়। তারপর তাঁকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

আজাদ 
১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট। রাতে বাড়িতে হামলা চালায় পাকিস্তানি সেনারা। ধরা পড়ে ক্র্যাক প্লাটুনের একদল তেজী মুক্তিযোদ্ধা। আজাদকে ধরে নিয়ে গিয়ে রাখা হয় রমনা থানায়। আজাদের মা ছেলের সঙ্গে দেখা করতে যান। ছেলেকে বলেন, “শক্ত হয়ে থেকো বাবা। কোন কিছু স্বীকার করবে না।” আজাদ তখন মার কাছে ভাত খেতে চায়। মা ভাত নিয়ে এসে ছেলেকে আর পায়নি। আর কোনদিনও মায়ের বুকে ফিরে আসেনি মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আজাদ। ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন আজাদের মা। ঠিক ৩০ আগস্টেই মারা যান তিনি। পুরো ১৪বছর ভাত মুখে তুলেন নি। কেবল একবেলা রুটি খেয়ে থেকেছেন। কারণ তার একমাত্র ছেলে আজাদ ভাত চেয়েও খেতে পারেনি সেদিন। অপেক্ষা করেছেন ১৪ টা বছর ছেলেকে ভাত খাওয়াবেন বলে। ১৪বছর তিনি কোন বিছানায় শোন নি। মেঝেতে শুয়েছেন শীত গ্রীষ্ম কোন কিছুতেই তিনি পাল্টান নি তার এই পাষাণ শয্যা। কারণ তার ছেলে নাখালপাড়া ড্রাম ফ্যাক্টরী সংলগ্ন এম.পি হোস্টেলের মিলিটারি টর্চার সেলে বিছানা পায় নি।

বদি
বদিউল আলম ঢাকা শহর ও এর আশেপাশে বেশ কয়েকটি দুর্ধষ অপারেশনে অংশ নেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো : ৮ আগস্ট ফার্মগেটে পাক বাহিনীর চেকপোস্ট অপারেশন, ১১ আগস্ট হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের ভেতরে বিস্ফোরণ ঘটানো, ১৪ আগস্ট গ্যাস বেলুনের মাধ্যমে ঢাকা শহরের আকাশে বাংলাদেশের অনেকগুলো পতাকা উড়ানো, ১৯ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনে অপারেশন, ২৫ আগস্ট ধানমন্ডির ১৮ ও ২০ নম্বর রোডে অপারেশন। এসব অভিযান এখনও তাদের দুর্ধর্ষতা ও দুঃসাহসিকতার উদাহরণ। মায়ের আদেশ মেনে বদিউল আলম ‘ক্র্যাকপ্লাটুনে’র সদস্য হিসেবে ঢাকা ও ঢাকার আশেপাশের এলাকায় একের পর এক দুর্ধর্ষ ও দুঃসাহসিক সফল অপারেশন পরিচালনা করছিলেন। ২৯ আগস্ট ধানমন্ডিতে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পাক-বাহিনীর একটি দল হঠাৎ করেই বাড়ি ঘেরাও করে। বদিউল জানালা টপকে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তা কাজে আসেনি। পাক-হায়েনারা সেখান থেকে শুধু বদিউলকেই ধরে নিয়ে যায়। এরপরে তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।

জুয়েল
১৯ আগস্ট সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার ষ্টেশন অপারেশনের সময় পাকবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে তিনি আহত হন। এরপর তাকে মগবাজারে প্রখ্যাত সুরকার আলতাফ মাহমুদের বাসায় চিকিৎসার জন্য আনা হয়। আলবদরের তৎকালীন সেকেন্ড ইন কমান্ড আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ এই খবরটা পৌঁছে দেয় স্থানীয় পাকিস্তানি ক্যাম্পে। ২৯শে আগস্ট পাকবাহিনী হামলা চালায় জুয়েলের বাড়িতে। আহত অবস্থায় জুয়েলকে ধরে নিয়ে আসে ক্যাম্পে। ক্রাক প্লাটুনের তথ্য ও সকলের পরিচয় জানার জন্য প্রচণ্ড অত্যাচার চালানো হয় তার উপর। যে হাত দিয়ে একদিন স্বাধীন বাংলাদেশের ওপেনিং ব্যাটসম্যান হিসেবে প্রতিপক্ষের বোলারদের উপর চড়াও হতে চেয়েছিলেন,সে হাতের দুটো আঙ্গুল কেটে ফেলে পাকবাহিনী নির্মম নিষ্ঠুরতায়। প্রচণ্ড নির্যাতনের মুখেও একটা কথা বলেননি তিনি। ৩১ শে আগস্টের পর তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। ধারনা করা হয় তাকে ৩১শে আগস্ট ক্রাক প্লাটুনের অন্য সকল যোদ্ধার সাথে হত্যা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য শহীদ জুয়েলকে মরণোত্তর বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তার বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ১৪৮ বাংলামায়ের এক অকুতোভয় বীর সন্তান এভাবেই স্বাধীন বাংলাদেশের টেস্ট দলের ওপেনিং ব্যাটসম্যান হবার স্বপ্ন বুকের গহীনে নিয়ে হাসতে হাসতে জীবন উৎসর্গ করেন।

রুমি
সেক্টর-২ এর অধীনে মেলাঘরে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এই সেক্টরটির পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন খালেদ মোশাররফ ও রশিদ হায়দার। প্রশিক্ষণ শেষ করে তিনি ঢাকায় ফেরত আসেন এবং ক্র্যাক প্লাটুনে যোগ দেন। ক্র্যাক প্লাটুন হল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা আক্রমণ পরিচালনাকারী একটি সংগঠন। রুমী ও তার দলের ঢাকায় আসার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন হামলা করা। এ সময় তাকে ঝুঁকিপূর্ণ আক্রমণ পরিচালনা করতে হয় যার মধ্যে ধানমণ্ডি রোডের একটি আক্রমণ ছিল উল্লেখযোগ্য। ধানমণ্ডি রোডের অপারেশনের পর রুমী তার সহকর্মীদের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ১৯৭১ সালের ২৯ আগস্ট তিনি তাঁর নিজের বাড়িতে কাটান, এবং এই রাতেই বেশকিছু গেরিলা যোদ্ধার সাথে পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। পাকিস্তান হানাদার বাহিনী একটি অজ্ঞাত উৎস থেকে তথ্য নিয়ে বেশ কিছুসংখ্যক যোদ্ধাকে গ্রেপ্তার করেন যার মধ্যে ছিলেন আলতাফ মাহমুদ, আবুল বারাক, আজাদ ও জুয়েল। ৩০ আগস্টের পর রুমী ও তার সহযোদ্ধাদের আর পাওয়া যায়নি।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত