চলে গেলেন কিংবদন্তি সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী

প্রকাশ : ৩০ জুলাই ২০১৮, ১০:৩৬

 

চলে গেলেন কিংবদন্তি সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী। রেখে গেলেন অসামান্য সব বাংলা ছোটগল্প ও উপন্যাস। প্রয়াণকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৬ বছর। দীর্ঘদিন ধরেই শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন। ২৯ জুলাই, ২০১৮ রবিবারে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বর্ষীয়ান এই সাহিত্যিক।

১৯২২ সালের ২৮ ডিসেম্বরে মেদিনীপুরের খড়্গপুরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ পাশ করেন তিনি। যুক্ত ছিলেন কলকাতার এক নামী সংবাদ পত্রিকার সঙ্গে। অল্প বয়স থেকেই তিনি লেখালেখি শুরু করেছিলেন। সেকালে 'যুগান্তরে' প্রকাশিত হয়েছিল জীবনের প্রথম গল্প ‘উদয়াস্ত’। সেই শুরু। খুব অল্প সময়ের ব্যবধানেই পাঠকের ভালবাসা জিতে নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর বহু বিখ্যাত উপন্যাসের মধ্যে ‘বনপলাশীর পদাবলী’, ‘এখনই’, ‘খারিজ’, ‘লালবাঈ’, ‘দ্বীপের নাম টিয়ারং’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

উপন্যাসের মতো গল্পেও তাঁর নিপুন দক্ষতা ছিল। ‘ভারতবর্ষ’-এর মতো ছোটগল্প বাংলা ছোটগল্পের এক অমোঘ মাইলফলক হয়ে রয়েছে। তাঁর উপন্যাসের সংখ্যা পঞ্চাশটিরও বেশি। ছোটগল্প লিখেছেন তিনি শতাধিক। ১৯৮৮ সালে সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন ‘বাড়ি বদলে যায়’ উপন্যাসের জন্য। এছাড়া পেয়েছিলেন রবীন্দ্র পুরস্কারও। কর্মজীবনে দীর্ঘদিন জড়িয়ে ছিলেন আনন্দবাজার পত্রিকার সঙ্গে। একাধিক বিখ্যাত চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে তাঁর গল্প ও উপন্যাস থেকে। তার মধ্যে অন্যতম হল উত্তমকুমার পরিচালিত ‘বনপলাশীর পদাবলী’, মৃণাল সেন পরিচালিত ‘খারিজ’ ও তপন সিংহ পরিচালিত ‘ এক ডক্টর কি মউত’। এছাড়া দ্বীপের নাম টিয়ারঙ, একদিন অচানক, পিকনিক, এই চলচ্চিত্রগুলিও তৈরি হয়েছিল তাঁর রচিত উপন্যাস থেকেই।

রমাপদ চৌধুরী প্রত্যক্ষ করেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের করুণ কঠিন দৃশ্য, যুদ্ধোত্তর দাঙ্গা, দেশ বিভাগের ফলে বসতভিটা ফেলে অশ্রুসজল চোখে মানুষের চলে যাওয়া, চোখের জলে তাদের বিদায় দিতে দিতে চোখের সীমানায় উদ্বাস্তু, বাস্তুত্যাগী মানুষের আগমন। ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। কলকাতার বুকে মন্বন্তরের বীভৎসতা। দেখেছেন স্বাধীনতার প্রাপ্তির উচ্ছ্বাস আর অসারতা। এর মধ্যে দিয়ে লতিয়ে উঠছে গণবিক্ষোভ, বামপন্থী রাজনীতির উত্থান। ঘটেছে মধ্যবিত্তের বিকাশ। সমাজে মধ্যবিত্তের মানসিকতার প্রভাব-দোলাচল, অনিশ্চয়তা, হতাশা, প্রতারণা ইত্যাদি সব দেখেছেন। এ সব কিছু গল্পকার রমাপদ চৌধুরীর মানসভূমে সাহিত্যের ভাষা ও বিষয়বস্তু তৈরি করছিল নিশ্চয়ই। তাঁর গল্প-উপন্যাসে এসব বিষয় এসেছে বিভিন্ন ভাবে। কখনও সরাসরি, কখনও প্রতিক্রিয়া হিসেবে। তবে তাঁর গল্পে একটি যুগযন্ত্রণা প্রকাশ পায়। যে কারণে তিনি বিভিন্ন ভাবে সমাজের কপটতার মূলে আঘাত করেছেন। বিষয়বস্তু নির্বাচন করেছেন সে ভাবেই। গল্প দিয়েই রমাপদ চৌধুরীর সাহিত্য যাত্রা শুরু। পরবর্তীতে তিনি সার্থক উপন্যাসও রচনা করেছেন একাধিক। তবে উপন্যাস ও গল্পের বিষয়বস্তু আলাদা। তিনি খুব সচেতন হিসেবে এর প্রকরণ করেছেন। ঔপন্যাসিকের কাছে গল্পকারের দৃষ্টিভঙ্গির কৃতিত্ব কোথায় তাও তিনি নির্ণয় করেছেন। তিনি একটি মহাযুদ্ধের দৃশ্যকল্প সামনে এনে বুঝিয়ে দিয়েছেন সেই কৃতিত্ব।

তাঁর সম্পর্কে একটা কথা বলা হতো 'তিনি না লিখেই লেখক'! আসলে তিনি খুব কম লিখতেন বলেই এমন বলা হতো। লেখালেখির ব্যাপারে খুঁতখুঁতে ছিলেন। সারা জীবনে যা লিখেছেন তাতেই পেয়েছেন পাঠক আনুকুল্য। নিজের লেখার ব্যাপারে তাঁর খুঁতখুঁতে থাকার অন্যতম প্রমাণ তিনি রীতিমতো ঘোষণা করে লেখা থামিয়ে দিয়েছিলেন বেশ কয়েক বছর আগেই।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত