শ্রী যোগেশচন্দ্র ঘোষ

প্রকাশ : ০৩ এপ্রিল ২০১৭, ১১:০০

সাহস ডেস্ক

শ্রী যোগেশচন্দ্র ঘোষ। দুস্থ-অসহায় মানুষের কল্যাণে নিবেদিত একটি প্রাণ! প্রখ্যাত আয়ুর্বেদ শাস্ত্রবিশারদ এবং শিক্ষাবিদ। তিনি আয়ুর্বেদ শাস্ত্র সম্পর্কিত বহু গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি সাধনা ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর জীবনের একমাত্র সাধনা ছিল ‘সাধনা ঔষধালয়’। যে ঔষধালয়ের খ্যাতি এ দেশ ছাড়িয়েও সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। নব নব সৃষ্টির মাঝেই যোগেশ বাবু বেঁচে ছিলেন। ১৯৭১ সালে ৪ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হন মহৎপ্রাণ এই মানুষটি।

যোগেশচন্দ্র ঘোষ ১৮৮৭ সালে শরীয়তপুরের গোঁসাইরহাট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯০২ সালে ঢাকার কে এল জুবিলী স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করেন। ১৯০৪ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে এফ.এ. পাশ করেন। এর পর ১৯০৬ সালে কুচবিহার কলেজ থেকে বি.এ. এবং ১৯০৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নশাস্ত্রে এম.এ. পাশ করেন। ১৯০৮ থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত ভাগলপুর কলেজে ও ১৯১২ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত জগন্নাথ কলেজে রসায়নশাস্ত্র বিষয়ের অধ্যাপনা করেন। ১৯৪৭-১৯৪৮ পর্যন্ত জগন্নাথ কলেজের অধ্যক্ষের দ্বায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৮ সালে শিক্ষকতা পেশা থেকে অবসর গ্রহণ করেন। যোগেশচন্দ্র লন্ডন কেমিক্যাল সোসাইটি-র ফেলো (১৯১১-১৯৭১) এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেমিক্যাল সোসাইটির সদস্য ছিলেন।

যোগেশচন্দ্র ঘোষ ১৯১৪ সালে ঢাকায় আয়ুর্বেদ ঔষধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান সাধনা ঔষধালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর গবেষণা ও সাধনার ফলে বাংলাদেশে আয়ুর্বেদ চিকিৎসা পদ্ধতি ও ঔষধ প্রস্তুত প্রণালী আধুনিক মানে উন্নীত হয়। তিনি রোগ-ব্যাধির কারণ ও লক্ষন, আয়ুর্বেদ চিকিৎসার তত্ত্ব এবং এর ব্যবহার পদ্ধতি সম্পর্কে বহু বই লিখে গেছেন। তার আয়ুর্বেদ সংক্রান্ত বইগুলোর মধ্যে ‘অগ্নিমান্দ্য ও কোষ্ঠবদ্ধতা’, ‘আরোগ্যের পথ’, ‘গৃহ-চিকিৎসা’, ‘চর্ম ওসাধারণ স্বাস্থ্যবিধি’, ‘চক্ষু-কর্ণ-নাসিকা ও মুখরোগ চিকিৎসা’, ‘আমরা কোনপথে’, ‘আয়ুর্বেদ ইতিহাস’, ‘Whither Bound Are We’ ও ‘Home Treatment’ উল্লেখযোগ্য।

পঁচিশে মার্চ ১৯৭১। পুরনো ঢাকার সূত্রাপুর এলাকার অনেকেই এরই মধ্যে শহর ছেড়ে পালিয়ে গেছে। সমস্ত এলাকায় বাড়ি কাম কারখানায় কেবল যোগেশ বাবু রয়ে গেলেন। বিরাট এলাকা জুড়ে সাধনা ঔষধালয় কারখানা। এখানেই তিনি কাটিয়েছেন জীবনের অধিকাংশ সময়, গবেষণা করেছেন! তাঁর একমাত্র সাধনাস্থল এই কারখানা, এখানকার একেকটা ইটে আছে তাঁর মমতার ছোঁয়া! নিঃসঙ্গ জীবনের একমাত্র সাথীরা ছিল কারখানার শ্রমিকরা। সবাই যখন কাজ সেরে ফিরে যেত তখন কেবল থাকতেন, সুরুজ মিয়া এবং রামপাল।

সুরুজ মিয়া এবং রামপাল কারখানার দারোয়ান। তাঁরা দীর্ঘ ১৭ বছর যোগেশ বাবুর সঙ্গে কাটিয়েছে। ২৫ শে মার্চের পর সবাই যখন একে একে বাবুকে ফেলে চলে গেল, গেলেন না কেবল এই ২ জন! ২৫ শে মার্চের পরের ঘটনা। ৩ এপ্রিল দিবাগত গভীর রাত। একটি মিলিটারী জীপ এসে থামলো। ৫/৬ জন সশস্ত্র সৈনিক জীপ থেকে নামলো। তাদের সবার হাতে ভারী অস্ত্র। একে একে গেটের তালা ভেঙ্গে ফেললো তারা। কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুড়লো।

পাহারাদার সুরুজ মিয়ার হাতের বন্দুকও গর্জে উঠলো। সেনাদের দিকে তাক করে তিনিও গুলি ছোড়া শুরু করলেন। শুরু হলো অসম যুদ্ধ। সামান্য অস্ত্র, সামান্যতম অস্ত্রচালনায় পারদর্শী একজন সাধারণ বাঙালি সুরুজ মিয়া পাহারাদারের কাছে হার মানলো পাক সৈন্যরা। রাতের আধারে পাক সেনারা পালিয়ে গেল। সুরুজ মিয়া যোগেশ বাবুকে বললেন পালিয়ে যেতে। যোগেশ বাবুর এক কথা, মরতে হয় দেশের মাটিতে মরব। আমার সন্তানসম এই সব ছেড়ে আমি কোথায় যাবো?

৪ এপ্রিল সকাল। পাকিস্তানী আর্মি আবারও ফিরে এলো, বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র এবং লোকবল নিয়ে। পাক সেনারা নীচে সবাইকে লাইন করে দাঁড় করালো। এরা যোগেশ বাবুকে উপরে নিয়ে গেল। রাইফেলের মুখে ওই বয়স্ক মানুষটা কি বলেছিলেন তা কোনদিন আর জানা হবে না! পাক সেনারা তাঁকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছে। তাদের উল্লাসধ্বণী নীচে ভেসে আসছিল! নীচের লোকজনরা সুযোগ বুঝে পালিয়ে প্রাণ বাঁচালেন।

যোগেশচন্দ্র ঘোষ নামের বয়স্ক এই মানুষটা শুধু পড়ে ছিলেন এলোমেলো ভঙ্গিতে, মৃত। শরীরে অজস্র বেয়নেটের দাগ নিয়ে। পাক আর্মিরা শুধু তাঁকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, লুটে নিয়ে গিয়েছিল যোগেশ বাবুর অর্জিত সমস্ত সম্পদ। কেবল নিতে পারেনি এ দেশের জন্য যোগেশ বাবুর একবুক ভালোবাসা!

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত