শহীদ জননী জাহানারা ইমাম

কথাসাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ এবং ঘাতক দালাল বিরোধী আন্দোলনের নেত্রী শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ১৯২৯ সালের ৩ মে-এর এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন। একাত্তরে তার জ্যেষ্ঠ পুত্র শফি ইমাম রুমী কয়েকটি গেরিলা অপারেশনের পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন। পরবর্তী সময়ে নির্মমভাবে শহীদ হন। বিজয় লাভের পর রুমীর বন্ধুরা রুমীর মা জাহানারা ইমামকে সকল ‘মুক্তিযোদ্ধার মা’ হিসেবে বরণ করে নেন। রুমীর শহীদ হওয়ার সূত্রেই তিনি 'শহীদ জননী'র মযার্দায় ভূষিত হন।

জাহানারা ইমামের ডাক নাম জুড়ু। ১৯২৯ সালের ৩ মে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ত্রিশ ও চল্লিশ দশকের রক্ষণশীল বাঙালি মুসলমান পরিবার বলতে যা বোঝায়, সে রকম একটি পরিবারেই জন্মেছিলেন তিনি। জাহানারা ইমামের বাবা সৈয়দ আবদুল আলী ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। মা সৈয়দা হামিদা বেগম।

শিক্ষক হিসেবে তার কর্মময় জীবনের প্রথমকাল কাটে ময়মনসিংহ শহরে। সেখানে বিদ্যাময়ী বালিকা বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসাবে ১৯৪৮ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত তিনি কর্মরত ছিলেন। এরপর তিনি ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক (১৯৫২‌‌-১৯৬০), বুলবুল একাডেমি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক (১৯৬২-১৯৬৬) এবং ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের প্রভাষক (১৯৬৬‌-১৯৬৮) হিসেবে তার কর্মজীবন অতিবাহিত হয়। তিনি কিছুদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটেও খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবেও কাজ করেন।

রাজনৈতিক জীবনে জাহানারা ইমাম হারান স্বামী ও সন্তানকে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জাহানারা ইমামের ছেলে মুক্তিযোদ্ধা শফি ইমাম রুমী শহীদ হন। এছাড়া যুদ্ধের সময় তার স্বামী শরীফ ইমামও ইন্তেকাল করেন।

যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি দাবিতে প্রতিষ্ঠা করেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। ১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামী তাদের দলের আমীর ঘোষণা করলে বাংলাদেশে জনবিক্ষোভের সূত্রপাত হয়। বিক্ষোভের অংশ হিসেবে ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি ১০১ সদস্যবিশিষ্ট একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয় জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে। এ কমিটির আহ্বায়ক করা হয় তাকেই।

পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী প্রতিরোধ মঞ্চ, ১৪টি ছাত্র সংগঠন, প্রধান প্রধান রাজনৈতিক জোট, শ্রমিক-কৃষক-নারী এবং সাংস্কৃতিক জোটসহ ৭০টি সংগঠনের সমন্বয় ঘটে এই কমিটিতে। পরবর্তীকালে ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২ ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ গঠিত হয়। এই কমিটিতেও সর্বসম্মতিক্রমে এর আহ্বায়ক নির্বাচিত হন জাহানারা ইমাম।

এই কমিটি ১৯৯২ সালে ২৬ মার্চ ’গণআদালত’-এর মাধ্যমে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের ঐতিহাসিক বিচার অনুষ্ঠান করে। ১২ জন বিচারক সমন্বয়ে গঠিত গণআদালতের চেয়ারম্যান জাহানারা ইমাম গোলাম আযমের ১০টি অপরাধ মৃত্যুদণ্ডযোগ্য বলে ঘোষণা করেন।

গণআদালতের রায় প্রতিষ্ঠা করে গণআদালতে যুদ্ধাপরাধীদের রায় কার্যকর করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান। যার জন্য সরকার জাহানারা ইমামসহ ২৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে অ-জামিনযোগ্য মামলা করে। পরে হাইকোর্ট তাদের জামিন মঞ্জুর করেন।

এরপর লাখো জনতার পদযাত্রার মাধ্যমে জাহানারা ইমাম ১২ এপ্রিল ১৯৯২ সালে গণআদালতের রায় কার্যকর করার দাবি সংবলিত স্মারকলিপি নিয়ে জাতীয় সংসদের  স্পিকার, প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার কাছে পেশ করেন। এতে ১০০ জন সংসদ গণআদালতের রায়ের পক্ষে সমর্থন ঘোষণা করেন।

জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় দেশব্যাপী গণস্বাক্ষর, গণসমাবেশ, মানববন্ধন, সংসদ যাত্রা, অবস্থান ধর্মঘট, মহাসমাবেশ ইত্যাদি কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে আন্দোলন আরো বেগবান হয়।

যুদ্ধাপরাধীর বিচার দাবিতে সরকার ৩০ জুন ১৯৯২ সালে সংসদে ৪ দফা চুক্তি করে। ২৮ মার্চ ১৯৯৩ সালে নির্মূল কমিটির সমাবেশে পুলিশ বাহিনী হামলা চালায়। পুলিশের লাঠিচার্জে আহত হন জাহানারা ইমাম এবং তাকে পিজি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এমনকি বিদেশেও গঠিত হয় নির্মূল কমিটি। শুরু হয় ব্যাপক আন্দোলন। পত্র-পত্রিকায় সংবাদ শিরোনাম হয়ে উঠলে আন্তর্জাতিক মহলেও ব্যাপক পরিচিতি অর্জন করেন জাহানারা ইমাম। গোলাম আযমসহ একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবির আন্দোলনকে সমর্থন দেয় ইউরোপীয় পার্লামেন্ট। আন্দোলন ব্যাপকতা লাভ করে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে।

২৬ মার্চ ১৯৯৩ সালে স্বাধীনতা দিবসে গণআদালত বার্ষিকীতে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গণতদন্ত কমিটি ঘোষিত হয় এবং আরো আটজন যুদ্ধাপরাধীর নাম ঘোষণা করা হয়।

এ সময় খুব দ্রুত শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকলে জাহানারা ইমাম ২ এপ্রিল ১৯৯৪ সালে চিকিৎসার জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান ডেট্টয়েট হাসপাতালের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। মুখগহ্বর থেকে ক্যান্সারে আক্রান্ত হন তিনি। ফলে বিপজ্জনক দানাগুলো অপসারণ করা আর সম্ভব হয়নি। এ সময় বাকশক্তি হারিয়ে ফেললে ছোট ছোট চিরকুট লিখে প্রিয়জনদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা চালিয়ে যেতেন তিনি। ২২ জুনের পর থেকে তার অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে শুরু করে।

এরপর ২৬ জুন ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৭টায় মিশিগানের ডেট্টয়েট নগরীর সাইনাই হাসপাতালে ৬৫ বছর বয়সে জাহানারা ইমাম শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

৪ জুলাই ১৯৯৪ সাল বিকেলে শহীদ জননীর মরদেহ বাংলাদেশে আনা হয়। তৎকালীন জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সমন্বয় কমিটির নেতৃবৃন্দের সঙ্গে শহীদ জননীর লাশ গ্রহণ করেন তৎকালীন জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেত্রী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা।

শহীদ জননীর জানাজা শেষে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিযোদ্ধা কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। এ সময় মুক্তিযুদ্ধের আট জন সেক্টর কমান্ডার শহীদ জননীকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। তার মৃত্যুতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি ২৮ জুন থেকে ৪ জুলাই পর্যন্ত শোক সপ্তাহ এবং ৬ জুলাই জাতীয় শোক দিবস পালন করে।

জাহানারা ইমাম শিশু সাহিত্য, অনুবাদ, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বিভিন্ন বই লিখেছেন। ‘একাত্তরের দিনগুলি’ তার বিখ্যাত গ্রন্থ।

তিনি স্বাধীনতা পদক (১৯৯৭), বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৮), কমর মুশতরী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৮), বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯১), আজকের কাগজ হতে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা পুরস্কার (বাংলা ১৪০১ সনে), নারী গ্রন্থ প্রবর্তনা (১৯৯৪), রোকেয়া পদক (১৯৯৮) প্রভৃতি পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।