পারস্যের কবি হাফিজ

প্রকাশ : ১৮ আগস্ট ২০১৭, ১৫:৪৬

পারস্যের কবি হাফিজের মৃত্যুর ১০০ বছরের মধ্যে তাঁর কোন জীবনী রচিত হয়নি। কাজেই তার জীবনের অধিকাংশ ঘটনা আঁধারে রয়ে গেছে। তার জন্ম-মৃত্যুর সঠিক তারিখ নিয়ে ইরানেও তাই নানা মুনির নানা মত। হাফিজের সম্ভাব্য মৃত্যুর সাল ৭৯১ হিজরি বা ১৩৮৯ খ্রিস্টাব্দ। তাঁর খাজা শামস-উদদীন মোহাম্মদ হাফিজ-ই-শিরাজী। পারস্যের সুফি কবি। 

পারস্যের (বর্তমান ইরান) শিরাজ শহরে কবি হাফিজ শিরাজী মোসল্লা নামক স্থানে চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে জন্মগ্রহণ করেন। এই ইরানি কবিকে বুলবুল-ই-শিরাজ বলা হত। ইরানের নিশাপুর ছাড়া আর কোন নগরই শিরাজের মত বিশ্বজোড়া খ্যাতি লাভ করেনি। ইরানের প্রায় সমস্ত শ্রেষ্ঠ কবিরই তীর্থভূমি এই শিরাজ নগরী। ইরানিরা হাফিজকে আদর করে ‘বুলবুল-ই-শিরাজ’ বলতেন। হাফিজকে তারা শুধু কবি বলেই ভালোবাসে না; তারা হাফিজকে ‘লিসান-উল-গায়েব’ (অজ্ঞাতের বাণী), ‘তর্জমান-উল-আসরার’ (রহস্যের মর্মসন্ধানী) বলে আরো বেশি শ্রদ্ধা করেন। ইরানে হাফিজের কবর জ্ঞানী-গুণীজনের শ্রদ্ধার স্থান।

হাফিজের পিতা বাহাউদ্দীন ইসপাহান নগরী থেকে ব্যবসা উপলক্ষে সিরাজে এসে বসবাস করেন। তিনি ব্যবসায়ে বেশ সমৃদ্ধিও লাভ করেন । কিন্তু মৃত্যুকালে সমস্ত ব্যবসায় এমন গোলমালে জড়িয়ে রেখে যান যে শিশু হাফিজ ও তার মা ঐশ্বর্যের কোল থেকে একেবারে দারিদ্র্যের করাল গ্রাসে নিপতিত হন। বাধ্য হয়ে তখন হাফিজকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অর্থোপার্জন করতে হয়। কোন কোন জীবনী লেখক বলেন, দারিদ্র্যের নিষ্পেষণে হাফিজকে তার জননী অন্য একজন সঙ্গতিসম্পন্ন বণিকের হাতে সমর্পণ করেন। সেখানে থেকেই হাফিজ পড়াশুনা করার অবকাশ পান। যেভাবেই হোক, হাফিজ যে কবি-খ্যাতি লাভ করার আগে বিশেষরূপে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন, তা তার কবিতা পড়েই বোঝা যায়।

কবি হাফিজের আসল নাম শামসুদ্দিন মোহাম্মদ। ‘হাফিজ’ তার ‘তখল্লুস’, অর্থাৎ কবিতার ভনিতায় ব্যবহৃত উপনাম। যারা সম্পূর্ণ কোনআন মুখস্থ করতে পারেন, তাদেরকে আরবি ভাষায় ‘হাফিজ’ বলা হয়। তার জীবনী লেখকরাও বলেন, হাফিজ তার পাঠ্যাবস্থায় কোরান মুখস্থ করেছিলেন। তাঁর পাঠ্যাবস্থায়ই তিনি স্বভাব দক্ষতায় কবিতা রচনা করতে আরম্ভ করেন, কিন্তু তা তেমন আদর লাভ করতে পারেনি। কিছুদিন পরে ‘বাবা-কুহী’ নামক শিরাজের উত্তরে পর্বতের উপরে এক দরগায় ইমাম আলি নামক এক দরবেশের সাথে তার সাক্ষাৎ হয়। সেদিন ‘বাবা-কুহীতে রাতভর ধর্মোৎসব হচ্ছিল। হাফিজও ওই উৎসবে যোগ দিতে গিয়েছিলেন। ইমাম আলি এ সময় হাফিজকে রহস্যময় কোন ঐশী খাবার খেতে দেন এবং বলেন, এর পরই হাফিজ কাব্যলক্ষ্মীর রহস্যপুরীর সব ঐশ্বর্যের অধিকারী হবেন। এই বিবরণে কতটা কল্পনারস মিশে আছে তা নিশ্চিতভাবে বলা না গেলেও এটা সত্য যে হাফিজের সমস্ত জীবনী লেখকই এই ঘটনার উল্লেখ করেছেন। শুধু উল্লেখ নয়, বিশ্বাসও করেছেন।

জাতীয় কবি নজরুল ও পারস্যের কবি হাফিজের যোগসূত্রের অন্যতম মাধ্যম ফারসি সাহিত্য। তার আগে এদেশে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিস্তারের পটভূমিটি জানা জরুরি। ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজী হিজরীর পঞ্চম শতকের শেষভাগে এসব অঞ্চলে রাজকার্য পরিচালনার শুরুতেই ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের বিস্তারে গুরুত্বারোপ করেন। বিশেষ করে ফারসি ভাষা বিস্তারের জন্য তিনি রংপুরে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলায় ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিস্তারের এটিই প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ। এরপর নাসিরউদ্দিন বোগরা খান হিজরী সপ্তম শতকে ফারসি ভাষা সম্প্রসারণের ক্ষেত্র প্রসারিত করেন। পরবর্তীতে একই শতকে বাংলার সুলতান গিয়াস উদ্দিন আযম শাহ ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নে সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেন। সুলতান গিয়াস উদ্দিন আযম শাহ এসময় ফারসি সাহিত্যের অমর প্রতিভা ইরানের মহাকবি হাফিজকে বাংলা ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানান। কথিত আছে যে, গিয়াস উদ্দিন আযম শাহের আমন্ত্রণ পেয়ে মহাকবি হাফিজ বাংলায় আগমনের জন্য যাত্রা করেন, কিন্তু জাহাজে ওঠার আগে সমুদ্রে প্রবল ঝড় উঠলে একে দৈবের অশনিসংকেত ভেবে হাফিজ ফিরে যান। জীবৎকালে তাঁর আর বাংলা-ভারত সফর করা সম্ভব হয়নি।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিরাজ ভ্রমণ করেছিলেন ১৯৩২ সালে। কেমন ছিল শিরাজ তখন? জানা যাক রবীন্দ্রভাষ্যেই: ‘শিরাজ শহরটি যে প্রাচীন তা বলা যায় না। আরবেরা পারস্য জয় করার পরে তবে এই শহরের উদ্ভব। সাফাবি-শাসনকালে শিরাজের যে শ্রীবৃদ্ধি হয়েছিল আফগান আক্রমণে তা ধ্বংস হয়ে যায়। আগে ছিল শহর ঘিরে পাথরের তোরণ, সেটা ভূমিসাৎ হয়ে তার জায়গায় উঠেছে মাটির দেয়াল। নিষ্ঠুর ইতিহাসের হাত থেকে পারস্য যেমন বারবার আঘাত পেয়েছে পৃথিবীতে আর-কোনো দেশ এমন পায় নি, তবু তার জীবনশক্তি বার বার নিজের পুনঃসংস্কার করেছে। বর্তমান যুগে আবার সেই কাজে সে লেগেছে, জেগে উঠেছে আপন মূর্ছিত দশা থেকে।’

হাফিজ তার জীবদ্দশায় তার কবিতাসমূহ (দীওয়ান) সংগ্রহ করে যাননি। তার বন্ধু গুল-আন্দামই সর্বপ্রথম তার মৃত্যুর পর ‘দীওয়ান’ আকারে হাফিজের সমস্ত কবিতা সংগ্রহ ও সংগ্রথিত করেন। হাফিজের পঞ্চশতাধিক যে কবিতা আমরা পেয়েছি, তাছাড়াও অনেক কবিতা হারিয়ে গেছে, বা তিনি সংগ্রহ করতে পারেননি। কবি হাফিজ ছিলেন উদাসীন সুফি। তার নিজের কবিতার প্রতি তার মমতাও তেমন ছিল না। তাই কবিতা লিখবার পরই তার বন্ধুবান্ধব কেউ সংগ্রহ না করে রাখলে তা হারিয়ে যেত। কিন্তু তার কবিতার অধিকাংশই গজল-গান, লেখা হওয়ামাত্র মুখে মুখে গীত হত। ধর্মমন্দির থেকে শুরু করে পানশালা পর্যন্ত সবখানেই তার গান আদরের সাথে গীত হত।

সেই সময় তৈমুরের সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল সমরকন্দ। হাফিজ তখন লিখলেন তাঁর কালজয়ী সেই কবিতাটি :
“কালো তিল কপোলে সেই সুন্দরী,
আপন হাতে ছুঁলে হৃদয় আমার,
বোখারা তো কোন ছার, সমরখন্দও
খুশি হয়ে তাকে দেবো উপহার।”

প্রিয়ার গালের একটি তিলের জন্য বোখারা আর সমরখন্দ বিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন হাফিজ৷ নিজের প্রিয়ার গালের সুন্দর তিলের বিনিময়ে তৈমুরের সাম্রাজ্যের রাজধানী বিলিয়ে দিতে চান হাফিজ, এ কথা শুনে তৈমুর ভীষণ ক্রোধান্বিত হয়ে পারস্য জয়ের সময় হাফিজকে ডেকে পাঠান। উপায়ন্তর না দেখে হাফিজ তৈমুরকে বলেন যে তিনি ভুল শুনেছেন, শেষের চরণের ‘সমরকন্দ ও বোখারা’র পরিবর্তে ‘দো মণ কন্দ ও সি খোর্মারা’ হবে। ‘আমি তার গালের তিলের বদলে দু মণ চিনি ও তিন মণ খেজুর দান করব!’ আবার কেউ কেউ বলেন, হাফিজ এই উত্তর দেননি। তিনি নাকি দীর্ঘ কুর্নিশ করে বলেছিলেন, সম্রাট! আমি আজকাল এই রকমই অমিতব্যয়ী হয়ে পড়েছি! এই জবাব শুনে তৈমুর এত আনন্দ পান যে, শাস্তি দেয়ার বদলে হাফিজকে তিনি বহুমূল্য পারিতোষিক দেন। হাফিজের নামে এরকম অনেক গল্প চালু আছে।

হাফিজের প্রায় সব কবিতা ‘শাখ-ই-নবাৎ’ নামক কোনো ইরানি সুন্দরীর স্তবগানে মুখরিত। অনেকে বলেন, ‘শাখ-ই-নবাৎ’ হাফিজের দেয়া আদরের নাম। তার আসল নাম হাফিজ গোপন করে গেছেন। কোন ভাগ্যবতী এই কবির প্রিয়া ছিলেন, কোথায় ছিল তার ঘর, এ নিয়ে অনেকে অনেক জল্পনা-কল্পনা করেছেন। রহস্য-সন্ধানীদের কাছে এই হরিণ আঁখি সুন্দরী আজো রহস্যের আড়ালে রয়ে গেছেন। অনেকেই মনে করেন হাফিজ যৌবনে হয়তো শরাব-সাকির উপাসক ছিলেন, তবে পরে যে তিনি সুফি, সাধকরূপে সারা বিশ্বের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেছিলেন তা প্রত্যেক ইরানিই বিশ্বাস করেন।

তাঁর মৃত্যু নিয়ে একটি বিস্ময়কর গল্প প্রচলিত আছে। শিবলী নোমানী, ব্রাউন সাহেব প্রভৃতি পারস্য সাহিত্যের সকল অভিজ্ঞ সমালোচকই এই ঘটনার উল্লেখ করেছেন। হাফিজের মৃত্যুর পর একদল লোক তার জানাজা পড়তে ও কবর দিতে অসম্মতি জানায়। হাফিজের ভক্তদলের সাথে এ নিয়ে বিবাদের সৃষ্টি হলে কয়েকজনের মধ্যস্থতায় উভয়দলের মধ্যে এই শর্তে রফা হয় যে, হাফিজের সমস্ত কবিতা একত্র করে একজন লোক তার যে কোন স্থান খুলবে; সেই পৃষ্ঠায় প্রথম দুই চরণ কবিতা পড়ে হাফিজের কি ধর্ম ছিল তা ধরে নেয়া হবে। এরপর উভয়দল মিলে মহাসমারোহে হাফিজকে এক দ্রাক্ষাকুঞ্জে সমাহিত করেন। সে স্থান আজও ‘হাফিজিয়া’ নামে প্রসিদ্ধ। দেশ-বিদেশ থেকে লোক এসে আজও কবির কবরে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করে। এ যুগেও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসা হাফিজভক্তরা সন্ধ্যা থেকেই তাঁর মাজারে ভিড় করতে থাকে। কারণ, হাফিজ হলেন প্রেমের কবি। তাঁর কবিতায় প্রেমের কথকতায় প্রেমিককূল আবেগাপ্লুত হয়ে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে সন্ধ্যার আলোআঁধারিতে তাঁর সমাধিপ্রাঙ্গনে আসে।

হাফিজ পারস্য ছেড়ে কখনো কোথাও যাননি। স্বদেশের প্রতি তার অণু-পরমাণুতে অপূর্ব মমতা সঞ্চিত ছিল। বহু কবিতায় তার ‘মোসল্লা’ এবং ‘রোকনাবাদে’র খালের প্রশংসা দেখতে পাওয়া যায়।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত