ডেল কার্নেগি

প্রকাশ : ২৬ নভেম্বর ২০১৭, ১১:০১

“আপনি কে বা আপনার কী আছে তার ওপর আপনার সুখ নির্ভর করে না, সুখ নির্ভর করে আপনি কেমন চিন্তা করেন তার ওপর” - অসাধারণ প্রভাব বিস্তারকারী এই উক্তিটি ডেল কার্নেগির। 

মনোবিজ্ঞানীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আধিপত্য বিস্তার করে আছেন ডেল কার্নেগি। ডেল ব্রাকেনরিডজ কার্নেগি ছিলেন একজন আমেরিকান লেখক, অধ্যাপক ও একাধারে বিখ্যাত আত্ম-উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণমালার উদ্ভাবক। তিনি দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। প্রথম জীবনে তেমন সাফল্য না পেলেও এখন সারা বিশ্বে একজন সফল ব্যক্তিত্ব হিসেবে অমর হয়ে আছেন তিনি। তাঁর প্রশিক্ষণ কর্মশালায় অংশ নিয়ে হাজার হাজার হতাশ মানুষ আশার আলো দেখেছেন। মানুষকে সফল হতে তিনি উদ্দীপনামূলক অনেক বই লিখেছেন। এ বইগুলো আজও অনেকের আগ্রহের বিষয়। তাঁর লেখা পড়ে তারা উদ্বুদ্ধ হন। তাঁর কর্মপদ্ধতি অনুসরণ করে লাভ করেন সাফল্য। 

তাঁর লেখা ‘হাউ টু উইন ফ্রেন্ডস অ্যান্ড ইনফ্লুয়েন্স পিপলস’ ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত বইটি আজ প্রচণ্ড জনপ্রিয়। সে সময় বইটি বেস্ট সেলারের মর্যাদা পায়। তিনি ১৯৪৮ সালে প্রকাশিত হাউ টু স্টপ ওরিং অ্যান্ড স্টার্ট লিভিং, লিঙ্কন দ্য আননোন এবং আরও অনেক বইয়েরও লেখক। তাঁর বইয়ের বিশেষত্ব- নিজের প্রতিক্রিয়ার ভিন্নতার মধ্য দিয়ে অন্যের ব্যবহারে পরিবর্তন আনা সম্ভব।

২৪ নভেম্বর, ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে মিশৌরীর মেরিভিলে ডেল কার্নেগি জন্মগ্রহণ করেন। কার্নেগি ছিলেন অত্যন্ত দরিদ্র কৃষক পরিবারের দ্বিতীয় সন্তান। বাবা জেমস উইলিয়াম কার্নাগি ও মা আমান্দা এলিজাবেথ হারবিসন। মুলত তাদের পারিবারিক পদবী ছিল কার্নাগি। বালক বয়সে তিনি প্রতিদিন ভোর চারটায় উঠে গৃহপালিত গরুগুলো থেকে দুধ দোয়াতেন। এ কাজের ভেতরেও তিনি ওয়ারেন্সেবার্গের সেন্ট্রাল মিশৌরি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা চালিয়ে যান। কলেজ শেষে তাঁর প্রথম চাকরিটি ছিল সেলিং করোস্পন্ডেন্স কোর্সেস টু রেঞ্জারস। পরে তিনি আর্মর অ্যান্ড কোম্পানির জন্য বাকন (লবণ জারিত শূকরের মাংস), সাবান এবং লার্ড (শূকরের চর্বি মিশ্রিত করা) তৈরি করতেন। তিনি ফার্মের প্রধান হিসেবে তার সেলস টেরিটরি দক্ষিণ ওমাহ, নেব্রারাস্কতে সফলতা লাভ করেন।

১৯১১ সালে ৫০০ ইউএস ডলার সঞ্চয়ের পর তিনি তাঁর বহুদিনের অধ্যাপক হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিক্রয় সেবা ত্যাগ করেন। তিনি নিউইয়র্ক আমেরিকান একাডেমি অব ড্রামাটিক আর্টসে যোগ দেন। একবার একটি রোড শো ‘পলি অব দ্য সাইকেলে’ তিনি ড. হার্টলির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। কিন্তু অভিনেতা হিসেবে তেমন সাফল্য পাননি। প্রডাকশন বন্ধ হয়ে গেলে তিনি নিউইয়র্ক প্রত্যাবর্তন করেন। চাকরিহীন অবস্থায় ব্রোকের কাছে ওয়াইএমসিএ-এর ১২৫ নম্বরে বাস করতে শুরু করেন। পাবলিক স্পিকিংয়ের ধারণাটি তিনি ওখানেই লাভ করেন। ৮০% মোট লভ্যাংশে তিনি ওয়াইএমসিএ পরিচালকের কাছে শিক্ষা প্রদানের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন। 

তিনি তাঁর প্রথম সেশনে ইম্প্রভাইজিংয়ের ওপর আলোচনা শেষ করেন ও ছাত্রদের ‘রাগান্বিত হয় এমন কিছু’ বিষয়ের ওপর বক্তৃতা প্রদান করতে বলেন। শ্রোতার সামনে ভয়হীন বক্তব্য প্রদানের পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। এভাবে ১৯১২ সালের শুরুতে ডেল কার্নেগি কোর্সের সূচনা করেন। কার্নেগি আমেরিকানদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করেছিলেন। প্রতি সপ্তাহে এতে তাঁর আয় দাঁড়াত ৫০০ থেকে ১০ হাজার ইউএস ডলার।

সম্ভবত তার সফলতার সূচনা ঘটে নামের শেষ অংশ কার্নাগি থেকে কার্নেগিতে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে। তিনি তা করেন সেসময়ের বহুল শ্রদ্ধেয় ও পরিচিত ব্যক্তিত্ব এন্ড্রু কার্নেগির নামে। ১৯১৬ সালে ডেল কার্নেগি হল ভাড়া নিতে সক্ষম হন। কার্নেগির লিখিত সংগ্রহশালার প্রথম প্রকাশ ‘পাবলিক স্পিকিং : এ প্র্যাক্টিক্যাল কোর্স ফর বিজিনেস ম্যান’ (১৯৩২)। তার সেরা অবদান ‘হাউ টু উইন ফ্রেন্ডস অ্যান্ড ইনফ্লুয়েন্স’ বইটি। ১৯৩৬ সালে বইটি প্রথম আত্মপ্রকাশের পর বেস্ট সেলারের স্বীকৃতি পেয়েছিল। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে ১৭তম মুদ্রণও জোটে বইটির ভাগ্যে। কার্নেগির মৃত্যু নাগাদ বইটি বিশ্বের ৩১টি ভাষায় রচিত পাঁচ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছিল এবং সাড়ে চার লাখের মতো ছাত্র কার্নেগির প্রতিষ্ঠান থেকে স্নাতক লাভ করে। 

বাংলায় অনূদিত তাঁর উল্লেখযোগ্য বইগুলো হচ্ছে- আত্মবিশ্বাসে সাফল্য ও বক্তৃতা শেখা, স্বামীর সাফল্যে স্ত্রীর কর্তব্য, দুশ্চিন্তাহীন নতুন জীবন, ধনী যদি হতে চান, ধনী হওয়ার অব্যর্থ ৫৫ উপায় ও প্রতিপত্তি ও বন্ধুলাভ। ডেল কার্নেগি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইউএস সামরিক বাহিনীকে সহায়তা করেছিলেন।

ব্যবসায়ের জন্য ডেল কার্নেগির একটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচী রয়েছে। এটি হচ্ছে ব্যবসায়ের জন্য একটি শিক্ষামূলক প্রোগ্রাম, যার ভিত্তি কার্নেগির শিক্ষা-প্রণালী। ৮০টিরও বেশি দেশে উপস্থাপিত হয়ে ১৯১২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ও বিশ্বজুড়ে ৮০ লাখ লোক কার্নেগির এই শিক্ষা পদ্ধতি গ্রহণ করেন। কোর্সটি মূলত একটি মালিকানা পদ্ধতি, টিম ডাইনামিক্স ও ইন্ট্রা-গ্রুপের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আন্তঃপারস্পরিক সম্পর্ক, চাপ সহনীয় ও দ্রুত পরিবর্তনীয় কর্মক্ষেত্রের অবস্থা মোকাবেলায় শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। অন্য বিষয়গুলোও এতে প্রাধান্য পায়। যোগাযোগ, সৃজনশীল সমস্যা সমাধান ও নেতৃত্ব গঠনেও ভূমিকা পালন করে। কোর্সটির মূলত ৫টি ধাপ, যা ধারাবাহিক উন্নয়নচক্র নামে গঠিত : ১. দৃঢ় আত্মবিশ্বাস গঠন ২. লোকদক্ষতা বাড়ানো ৩. যোগাযোগ দক্ষতা বাড়ানো ৪. নেতৃত্বের উন্নয়ন ৫. চারিত্রিক উন্নয়ন ও চাপ কমানো।

ডেল কার্নেগি ১৯২৭ বিয়ে করেন ললিতা বাউকেরকে। তার প্রথম বিবাহিত জীবন ছিন্ন হয় ১৯৩১ সালে। এরপর ৫ নভেম্বর ১৯৪৪ সালে তিনি ডরোথি প্রাইস ভেন্ডারপোলকে বিয়ে করেন। ডরোথিও পরে বিবাহ বন্ধন ছিন্ন করেন। ভেন্ডারপোলের ঘরে দুটি মেয়ে ছিল। প্রথম মেয়ে রোসমেরি ভেন্ডারপোলের প্রথম ঘরের সন্তান। কার্নেগির ঘরে জন্ম নেন ডনা ডেল কার্নেগি। ডেল কার্নেগি ৬৬ বছর বয়সে ইউরেমিয়া জটিলতাসহ হকিংস রোগে মারা যান ১ নভেম্বর ১৯৫৫। তিনি নিজ বাড়ি ফরেস্ট হিলস, কুইন্স, নিউইয়র্কে মৃত্যুবরণ করেন।

ডেল কার্নেগী মানুষের আচার-আচরণ, মনস্তত্ত্ব নিয়ে বিশদ গবেষণা করেছেন। তিনি দেখেছেন, আমাদের দৈনন্দিন অভ্যাসেই লুকিয়ে আছে আমাদের সফলতা অথবা ব্যর্থতা, হতাশা। গবেষণায় দেখা যায়, অতীতের সেই মানুষেরাই বেশী সফল নেতৃত্ব দিয়েছেন যারা ঝুঁকি মোকাবেলা করতে প্রস্তুত থাকতেন, লক্ষ্যে পৌছানোর জন্য নিজের সিদ্ধান্ত দলের উপর চাপিয়ে দিতেন না, বরং সবার উপর বিশ্বাস স্থাপন। এমনকি স্বার্থপর, আত্মভোলা মানুষের চেয়ে সেই মানুষ ক্যারিয়ারে বেশী সফলতা অর্জন করেন যারা তার চারপাশের মানুষের আবেগের মূল্য দেন, তাদের বোঝার চেষ্টা করেন এবং ভালো সম্পর্ক বজায় রাখেন। কার্নেগির গবেষণার বিপুল ভান্ডার থেকে সারাংশ হিসেবে এই ৩ টি অভ্যাসের কথা জানা যায় যা বিশ্বের অধিকাংশ সফল মানুষেরা চর্চা করে থাকেন।

১. মানুষকে বুঝুন, ক্ষমা করতে শিখুনঃ
“বোকারাই একমাত্র সমালোচনা, অভিযোগ আর নিন্দা করে সময় নষ্ট করতে পারে, আর তারা তা করেও,” কার্নেগীর মতে, “কিন্তু যার আত্মনিয়ন্ত্রণ সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব রয়েছে সে অন্যকে বোঝার এবং ক্ষমা করার মানসিকতা রাখে।” 

আপনার চারপাশের মানুষকে আমি যত বুঝতে পারবেন তত তাদের প্রয়োজন কি, চাহিদা কি এই বিষয়গুলো আপনার নখদর্পণে চলে আসবে। কার্যক্ষেত্রে আপনার সহকর্মী বা নিম্নপদস্থদের চাহিদা বুঝে আপনি এগিয়ে যেতে পারবেন। আপনাকে অনেক সিদ্ধান্ত নিজের এই গুণটির উপর ভরসা করেই নিতে হবে। যেমন, কর্মীরা বোনাস চায় কিনা, কর্মীদের কাজের আগ্রহ বাড়াতে কি করা উচিৎ, কাকে কোন কাজটি দিলে আপনি হতাশ হবেন না ইত্যাদি। আপনি যদি সমালোচনার পথ বেছে নেন তাহলে অন্যের ভুলগুলো আরো বেশী চোখে পড়বে। আপনার প্রতিযোগী থাকবেই। নিন্দা না করে বরং ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলুন তাদের সাথে। ক্ষমা করতে শিখুন। নির্ভার মন আপনার কাজের গতি বাড়িয়ে দেবে।

২.যোগ্যতার মূল্যায়ণ করুনঃ 
সফল মানুষেরা তাঁদের কর্মীদের ভালো কাজের প্রশংসা করেন মন খুলে। তাদের যোগ্যতার মূল্যায়ন করেন, দেন প্রাপ্য সম্মান এবং সম্মানী। কার্নেগী দেখেছেন, যোগ্যতার মূল্যায়ণ মানুষের কর্ম ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। একই সাথে অনবরত সমালোচনা একটা মানুষের স্বপ্নকে ধ্বংস করে দিতে যথেষ্ঠ। উপযুক্ত সম্মান মানুষের বিশ্বস্ততা বাড়ায়, আনুগত্য বাড়ায়। যে কোন প্রতিষ্ঠানে মূল কাজ তুলে আনে কর্মীরা। তাদের কাজের সঠিক প্রশংসা করুন। তবে অবশ্যই একজনকে ছোট করে আরেকজনের প্রশংসা করবেন না। আপনার এই অভ্যাস আপনার কর্মীদের মধ্যে আন্তরিকতা বজায় রাখার পাশাপাশি আপনার প্রতিটি প্রজেক্টে কাজের গতি বাড়িয়ে এনে দেবে সফলতা।

৩। সহানুভূতিশীল হোনঃ 
ডেল কার্নেগির মতে, “মানুষকে প্রভাবিত করার সবচেয়ে ফলপ্রসু উপায় হল তাদের জীবনের না পাওয়াগুলো নিয়ে কথা বলা এবং তাদেরকে সঠিক পথ দেখানো।”

এ ব্যাপারে তিনি হেনরি ফোর্ড এর একটি উক্তি তুলে ধরেন, “সফলতার যদি কোন গোপন রহস্য থেকে থাকে তা হল, অন্যের দৃষ্টিভঙ্গিকে বুঝতে পারা এবং তার সমস্যাগুলো তার চোখ দিয়ে তার মত করেই দেখতে পারা যেমনটা আমরা নিজের সমস্যাকে দেখতে পাই।”

ডেল কার্নেগীর মতে, সফল মানুষেরা অন্য মানুষকে ভুল পথ দেখিয়ে ভ্রান্ত করে না বরং সঠিক পথ দেখিয়ে তার উপকার করে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত