শিক্ষাবিদ সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়

প্রকাশ : ২৯ নভেম্বর ২০১৭, ১৬:৪৪

 

২৬ নভেম্বর ছিল ভাষাতাত্ত্বিক, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের জন্মবার্ষিকী। তিনি ১৮৯০ সালের ২৬ নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গের হাওড়ার শিবপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হরিদাস চট্টোপাধ্যায় ও মাতার নাম কাত্যায়নী দেবী। খ্যাতনামা এই ভাষাতত্ববিদ, জাতীয় অধ্যাপক এবং ভারত-সোভিয়েত সাংস্কৃতিক সমিতির প্রাক্তন সভাপতি ছিলেন। পাণ্ডিত্যের স্বীকৃতিস্বরূপ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে ‘ভাষাচার্য’ উপাধি দেন।

তাঁর পিতা হরিদাস চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ইংরেজদের সওদাগরি অফিসের কেরানি। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় কৈশোরে অনেক কষ্ট করে বিদ্যা অর্জন করেছেন। ১৯০৭ সালে মতিলাল শীল ফ্রি স্কুল থেকে এনট্রান্স পরীক্ষায় ষষ্ঠস্থান অধিকার করে তিনি মাসিক কুড়ি টাকা বৃত্তি পান। 

১৯০৯ সালে স্কটিশচার্চ কলেজ থেকে এফ.এ.পরীক্ষায় তৃতীয় স্থান অধিকার করেন। ১৯১১ সালে প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে বি.এ ও ১৯১৩ সালে ইংরেজি অনার্স নিয়ে প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন। তারপর ১৯১৪ সালে এম.এ পাস করার পর কলকাতা বিদ্যাসাগর কলেজে ইংরেজি ভাষার অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ওই বছরই কমলাদেবীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। পরের বছর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর শ্রেণীর ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক-এর কাজে যোগ দেন সুনীতি। ১৯১৯ সাল পর্যন্ত তিনি ওই দায়িত্ব পালন করেন। ইতিমধ্যে ১৯১৮ সালে সংস্কৃত মধ্য পরীক্ষায় পাস করে প্রেমচাঁদ -রায়চাঁদ বৃত্তি ও জুবিলি গবেষণা পুরস্কার পান।

১৯১৯ সালে ধ্বনিতত্ব সম্পর্কে ভারত সরকারের বৃত্তি পেয়ে ইউরোপ যান সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। তিনি সেখানে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফোনেটিক্স-এ ডিপ্লোমা পান এবং ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে ডি.লিট উপাধি পান। লন্ডনে তিনি বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের কাছে ফোনেটিক্স বা ধ্বনিতক্ত্ব, ইন্দো-ইউরোপিয়ান লিঙ্গুয়িস্টিকস্, প্রাকৃত, ফরাসি সাহিত্য, পুরাতন আইরিশ, ইংলিশ ও গোথির ভাষা বিষয়ে পড়াশোনা করেন। প্যারিসে সারবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র হিসেবে যোগ দিয়ে ভারতীয় আর‌ ভাষাতত্ত্ব, স্লাভ ও ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষাতত্ত্ব, অস্ট্রো-এশীয় ভাষাতত্ত্ব, প্রাচীন সগক্তিয়ান ও খোটানি ভাষা, গ্রিক ও লাটিন ভাষার ইতিহাস প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনা করেন এবং গবেষণা করেন।

১৯২২ সালে ভারতে ফেরার পর স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়কে ভারতীয় ভাষাতত্ত্বের প্রথম ‘খয়রা’ অধ্যাপক পদে বসান। এ দায়িত্ব তিনি দীর্ঘ ৩০ বছর সামলেছেন। ১৯৫২ সালে চাকুরি থেকে অবসর নেওয়ার পর এমেরিটাস অধ্যাপক পদে তাঁকে বসান হয়। তাঁর গবেষণা দ্বিতীয় খণ্ডে প্রকাশের পরই তাঁর নাম নিজের দেশে ও বিদেশে বোদ্ধাজনদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর লন্ডন থেকে ‘ইন্দো আরিয়ান অ্যান্ড হিন্দি’, কিরাতজনকৃতি, বেঙ্গলী ফোনেটিক রিডার’-এসব নামে কয়েকটা বই প্রকাশিত হয়।

সুনীতি কুমার ১৯২৭ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে সুমাত্রা, জাভা, বোর্নিয়ো ও শ্যামদেশে যান এবং ওইসব দেশে ভারতের সংস্কৃতি ও শিল্প-সাহিত্য বিষয়ে বক্তব্য রাখেন। তাঁর ‘দীপময় ভারত’ গ্রন্থটাতে সে-সময়কার ওইসব দ্বীপ সম্পর্কে পুঙ্খনাপুঙ্খ আলোচনা আছে। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ১৯৩৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে লন্ডনের ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অফ ফোনেটিক্স সায়েন্সের দ্বিতীয় অধিবেশনে যোগ দিতে ইউরোপ গমন করেন। তখন তিনি ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে লোকগাথা সংগ্রহ করেন।

সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় ১৯৩৬ সালে রয়াল এশিয়াটিক সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন। এরপর ভাষাতত্ত্বের সম্মেলন ও সেমিনার উপলক্ষে বিভিন্ন সময়ে এশিয়া, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও আফ্রিকার অনেক জায়গায় তাঁকে যেতে হয় এবং বক্তব্য রাখতে হয় এবং আলোচনায় অংশ গ্রহণ করতে হয়। ১৯৪৬ সালে করাচিতে হিন্দি সাহিত্য সম্মেলনের জাতীয় ভাষা বিভাগের সভাপতি করা হয় তাঁকে। ১৯৪৮ সালে এলাহাবাদ-এর হিন্দি সাহিত্য সম্মেলন তাঁকে হিন্দি ভাষায় অবদানের জন্য ‘সাহিত্য বাচস্পতি’ উপাধি দেয়।

সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় ১৯৫০ এবং ১৯৫১ সালে ইউনেস্কোর অামন্ত্রণে ‘ব্রেইল অক্ষর’ কমিটিতে যোগ দিতে প্যারিসে যান। ১৯৫০ সালে তাঁকে হল্যান্ডের সোসাইটি অফ আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সের সদস্যপদ দেয়া হয়। ১৯৫৫ সালে অসলোর 'নরওয়েজিয়ান আকাডেমি অফ সায়েন্স' তাঁকে অনারারি সদস্যপদ দান করে। কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে আমন্ত্রণ জানালে তিনি সে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তব্য রাখেন। চিনের গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার-এর আমন্ত্রণে ১৯৫৫ সালে ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতিনিধি দলের সঙ্গে তিনিও সেখানে যান। ১৯৫৫ সালে সোভিয়েত আকাডেমি অফ সায়েন্সের নিমন্ত্রণে তিনি সেখানে গিয়ে ‘স্লাভ জাতি’ সম্বন্ধে বক্তব্য রাখেন। ১৯৬০ সালে মস্কোয় প্রাচ্যবিদদের সম্মেলনে গিয়ে বহির্মঙ্গোলিয়াতেও যান তিনি।

১৯৫২ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গ পরিষদের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৩ সালে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে তাঁকে 'পদ্মবিভূষণ' উপাধি প্রদান করা হয়। মানবিক তত্ত্ব সম্পর্কে গবেষণার জন্য ১৯৬৬ সালে তাঁকে ‘জাতীয় অধ্যাপক’ সম্মান দেওয়া হয়। বাল্টিক প্রজাতন্ত্রগুলোর জাতিগোষ্ঠীগুলো সম্পর্কে তাঁর লেখা বই খুবই সমাদৃত হয়। ভারত ও আর্মেনিয়ার সাংস্কৃতিক যোগসূত্রের তথ্যযুক্ত তাঁর ‘মনোগ্রাফটা’ও উল্লেখ করতেই হয়। বেশ কয়েকবছর তিনি ভারত-সোভিয়েত সাংস্কৃতিক সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় ১৯৬৬ সালে ভারত সরকার আয়োজিত শিক্ষা-সংস্কৃতিমূলক দুই মাসের সফরে আফ্রিকা ও ইউরোপের কয়েকটা দেশ ভ্রমণ করেন। চেকোশ্লোভাকিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ৬০০ বছর পূর্তি উৎসব উপলক্ষে বিশেষ পদক দিয়ে তাঁকে সম্মানিত করে। বঙ্গ সাহিত্যেও তাঁর বিশেষ অনুসন্ধিৎসা ছিল। হরেকৃষ্ণ সাহিত্যরত্নের সহযোগিতায় তিনি চণ্ডীদাস-এর পদাবলির প্রামাণ্য সংস্করণ প্রকাশ করেন। তিনি ইংরেজি ভাষায় জয়দেবের পরিচিতি লেখেন এবং বিশ্বসাহিত্যের পটভূমিকায় রবীন্দ্র সাহিত্যের বিচার-বিশ্লেষণ করেন। ১৯৬৯ সালে তাঁকে সাহিত্য একাডেমির সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। 

১৯৭১ সালে তাঁকে ইউনেস্কোর ভাষাবিষয়ে সংবাদদাতার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি অনেকগুলো গুরুত্ববাহী পাণ্ডিত্যপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ৩৮০টি। শেষজীবনে ‘রামায়ণ’-এর উৎস সম্পর্কে তাঁর লেখা ও আলোচনা সম্পর্কে প্রবল বিতর্ক দেখা দেয়। ভাষাতত্ত্ব এবং ভাষাবিজ্ঞান ছাড়াও গান, চিত্রকলা-বিষয়ে তাঁর আগ্রহ ও অনুসন্ধিৎসা ছিল। সারাজীবনই তিনি নতুন নতুন জ্ঞান সংগ্রহ করার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে ‘ভাষাচার্য’ উপাধি দিলে তিনি আনন্দের সঙ্গে তা গ্রহণ করেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শব্দতত্ত্ব গ্রন্থটি তাঁকে উৎসর্গ করেছেন।

তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো- Bengali Phonetic Reader (১৯২৮), বাংলা ভাষাতত্ত্বের ভূমিকা (১৯২৯), ভারতের ভাষা ও ভাষা সমস্যা (১৯৪৪), সরল ভাষা প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ (১৯৪৫), ভারত সংস্কৃতি (১৯৫৭), সংস্কৃতি কী (১৯৬১), World Literature and Tagore (১৯৭১) ইত্যাদি। বহু ভাষাবিদ, পণ্ডিত সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় দেশে-বিদেশে বহু সম্মাননা ও পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৭৭ সালের ২৯ মে তিনি পরলোকগমন করেন।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত