পটুয়া কামরুল হাসান

প্রকাশ : ০৩ ডিসেম্বর ২০১৭, ১১:৪৭

পটুয়া কামরুল হাসানের প্রকৃত নাম আবু শরাফ মোহাম্মদ কামরুল হাসান। ১৯২১ সালের ২ ডিসেম্বর পিতার কর্মস্থল কলকাতায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার নারেঙ্গা গ্রামে। পিতা মোহাম্মদ হাশিম ছিলেন তিলজলা গোরস্থানের সুপারিনটেন্ডেন্ট।

কামরুল হাসানের শিক্ষাজীবন কাটে কলকাতায়। তিনি কলকাতার মডেল এম ই স্কুল (১৯৩০-৩৫) এবং কলকাতা মাদ্রাসায় (১৯৩৬-৩৭) প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। ১৯৩৮ সালে তিনি কলকাতার গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস-এ ভর্তি হন এবং ১৯৪৭ সালে চিত্রকলায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্রজীবনে চিত্রাঙ্কনের পাশাপাশি তিনি বয়েজ-স্কাউট, শরীরচর্চা, ব্রতচারী আন্দোলন, শিশু সংগঠন মণিমেলা, মুকুল ফৌজ ইত্যাদি কর্মকান্ডে যুক্ত ছিলেন। ১৯৪৫ সালে শরীরচর্চা প্রতিযোগিতায় তিনি বেঙ্গল চ্যাম্পিয়ন হন।

দেশবিভাগের পর কামরুল হাসান ঢাকা চলে আসেন এবং শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সঙ্গে মিলিত হয়ে ঢাকায় একটি আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন (১৯৪৮)। ঢাকায় চিত্রকলার চর্চা ও প্রসারের লক্ষ্যে ১৯৫০ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন আর্ট গ্রুপ। ১৯৬০ সালে তিনি ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প কর্পোরেশনের নকশা কেন্দ্রের প্রধান নকশাবিদ নিযুক্ত হন এবং ১৯৭৮ সালে উক্ত পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

কামরুল হাসান বাংলাদেশের স্বাধিকার ও অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন (১৯৬৯-৭০) এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও বেতার দপ্তরের শিল্প বিভাগের পরিচালকের দায়িত্বও পালন করেন। এ সময় পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের রক্তপায়ী, হিংস্র মুখমণ্ডল সম্বলিত একটি পোস্টার এঁকে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। পোস্টারটির শিরোনাম: ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে।’ ১৯৮৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি হৃদরোগে মৃত্যুর কয়েক মিনিট পূর্বে তিনি অনুরূপ আরেকটি স্কেচ আঁকেন ‘দেশ আজ বিশ্ববেহায়ার খপ্পরে’ শিরোনামে। কামরুল হাসানের এসব চিত্রকর্মের মধ্য দিয়ে তাঁর রাজনৈতিক সচেতনতা, অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে নির্ভীক প্রতিবাদী মানসিকতা, গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং সমাজসচেতনতাই প্রকাশিত হয়েছে।

কামরুল হাসানের চিত্রকলার প্রধান উপাদান নর-নারী (বিশেষত রমণীর শরীর), পশুপাখি (প্রধানত গরু ও শৃগাল), সাপ ও প্রকৃতি। এসবের মধ্য দিয়ে তিনি আবহমান বাংলার গ্রামীণ সমাজের সামগ্রিক রূপ, বাংলার নিসর্গ, স্বৈরশাসকদের অত্যাচার, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার চিত্র চমৎকারভাবে তুলে ধরেন। তাঁর অঙ্কিত চিত্রকলা ষাটের দশকে বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের আন্দোলনে, সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে এবং ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে জনসাধারণকে দারুণভাবে উজ্জীবিত করেছে।

কামরুল হাসানের শিল্পীসত্তা গড়ে উঠেছে বিভিন্ন চেতনার সমন্বয়ে, বিভিন্ন মেজাজের একসূত্রতায়; তিনি বেড়ে উঠেছেন বিভিন্ন প্রতিবেশে, তাঁর প্রকাশ বিভিন্ন মেরুতে। এর সব কটি নিয়েই তিনি। এর কোনো একটির চমৎকারিত্ব অবশ্যই সম্পূর্ণের চমৎকারিত্ব। কিন্তু কামরুল হাসান ছড়িয়ে থাকেন বিভিন্ন ডাইমেনশনে অথবা মাত্রায়। তাঁকে আলাদা করে বিচার করে, বিভিন্ন শিল্প উপাদান আলাদা আলাদা পরীক্ষা করে তাঁর সম্পূর্ণ পরিচয় পাওয়া সম্ভব নয়। তাঁকে জানতে হলে তাঁর সকল প্রকাশভঙ্গির সঙ্গে পরিচিত হতে হবে। যে নারীদেহ তাঁর চিত্রে দিয়েছে একই সঙ্গে গতি এবং স্থিতিশীলতা, সেই নারীদেহ সম্পর্কেই বলা যাক। কামরুল হাসান, সহজ অর্থে, নারীর নগ্নতাকে এক নান্দনিক মাত্রায় উপস্থাপিত করেছেন। অবগাহন, চিঠি অথবা প্রসাধন যেদিকে চোখ ফেরানো যায়, নারী তাঁর সব কর্মকাণ্ডে একটা বড় আসন নিয়ে উপস্থিত। 

নারীদেহের সহজ আকর্ষণ, ভারী স্তন ও নিতম্ব কামরুল হাসানের ছবিতে যেন আরো ব্যাপ্তি পেয়েছে। শিল্পীর প্রথম দিককার ছবিগুলোতে নারীদেহ অতি নিখুঁত ও নিয়মনিষ্ঠভাবে আঁকা হয়েছে। এসব ছবিতে ক্যানভাসজুড়ে নারী প্রতিকৃতি রং ও রেখার সহযোগিতায় উদ্ভাসিত।

পঞ্চাশের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে (ও ষাটের দশকে) আঁকা নারী প্রতিকৃতিগুলি আধা-জ্যামিতিক পদ্ধতিতে ও রেখার ভাংচুরের মাধ্যমে উপস্থাপিত। এসব ছবিতে প্রথমেই যে-বিষয়টি দর্শককে আকৃষ্ট করে সেটি হলো রং ও রেখার একাগ্রতা। বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আনুপাতিক যোগাযোগ ক্ষুণ্ন করে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ইচ্ছামতো উপস্থাপনায় তিনি নারীদেহকে স্টাডি করেছেন বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। ফিগারগুলো অতঃপর একই সঙ্গে লীলায়িত এবং বিকশিত হয়েছে। নারীদেহের প্রতি কামরুল হাসানের এই পক্ষপাতিত্ব তাঁর শিল্পচেতনার এক উদ্ভাসিত রূপ নির্মাণ করে। একজন রেনোয়াঁ বা একজন ডেগার মধ্যে যে শৈল্পিক সূক্ষ্মানুভূতি এসব নির্মাণকে রসোত্তীর্ণ করে, কামরুল হাসানের বেলাতেও তা ষোলো মাত্রায় প্রযোজ্য। 

কামরুলের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হলো একটি জায়গায় : যেখানে তিনি নারীর সামাজিক জীবনের স্থবিরতাকে ফুটিয়ে তুলতে চান (সে রকম ছবির সংখ্যা কম হলেও সেগুলোকে আমাদের বিবেচনায় নিতে হয়)। সেসব ছবিতে নারীদেহ স্থবির ও গতিহীন একটি মাত্রায় তার বিপন্নতাকে জানান দেয়। তার দেহটা থাকে, প্রাণ থাকে না। (যেমন তাঁর মধ্যম ও শেষ পর্যায়ের কয়েক ছবিতে) তখন তিনি – শুধু নারীদেহ সম্বন্ধেই বলি কেন – অন্য ছবিতেও কিছুটা ভাবলেশহীন একটা ভাব ফুটিয়ে তোলেন। নারীর নিম্নবর্গীয়তাকে এভাবে তিনি ব্যাখ্যা করেন। রঙের ব্যাপারে কামরুল হাসানের সহজ সাবলীল প্রতিক্রিয়া বিশিষ্টার্থক হয়েছে অন্য এক স্থানে। বিভিন্ন সময়ে তিনি কয়েকটি ‘ডেকোরেশন পিস’ এঁকেছেন। রঙের নিপুণ সমাবেশে সূক্ষ্ম সুন্দর প্যাটার্নে আঁকা এসব ছবি এক একটি অনুভূতির প্রতীক। এসব ছবিতে শিল্পী বাংলার আলপনা পদ্ধতিকে আরো ঋদ্ধ করেছেন।

কামরুল হাসানের সার্থকতার একটি বড় ভিত্তিভূমি রচনা করেছে তাঁর রেখাসৌষ্ঠব, এবং এ বিষয়টি একটু বিস্তারিত আলোচনা দাবি করে। গতি ও শক্তির অপূর্ব সমন্বয় তাঁর রেখাছবি বা ড্রইংয়ে। ড্রইংয়ে পূর্ণতা ও প্রচণ্ডতার এমন যোগাযোগ খুব কমই চোখে পড়ে। রেখায় জড়তা থাকলে, ড্রইং দুর্বল হলে কোনো নির্মাণ শিল্পোত্তীর্ণ হতে পারে না, যদিও দু’একটি ব্যতিক্রম বিরল নয়। কিন্তু ড্রইং ও রেখাজ্ঞানে অপটু, অস্থির শিল্পীরা যখন সরাসরি নির্বস্তুক ও বিমূর্তকলায় পৌঁছে যান, তখন বিচলিত হতে হয়, অথচ কী ধৈর্য ও কী আত্মত্যাগের মাধ্যমে একজন সত্যিকার শিল্পী গড়ে ওঠেন, একজন সেজান বা পিকাসো বা কামরুল হাসানের কাজ দেখলে তা বোঝা যায়।

কামরুল হাসানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন যাঁরা, তাঁর বন্ধু-বান্ধব অথবা সতীর্থরা, তাঁরাও জানেন না সারাজীবনে তিনি কত স্কেচ এঁকেছেন। কামরুল হাসানের নিজের কাছেই হয়তো কোনো হিসাব ছিল না। এত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এসব, বহু মানুষের ব্যক্তিগত, অথবা অনেক প্রতিষ্ঠানের সংগ্রহে এবং হয়তো অনেকগুলো হারিয়েও গেছে। এখন হাতের কাছে যা পাওয়া যায় এবং যেগুলোর প্রতিলিপি সংগ্রহ করা সম্ভব, সেগুলোই আমাদের বিবেচনায় রাখতে হয় তাঁর স্কেচ সম্পর্কে নতুন একটি মূল্যায়নের সময়। খেরো খাতায়, টুকরো কাগজে, সিগারেটের প্যাকেটের ভেতরে, দেশলাইয়ের বাক্সে – কত বিচিত্র জায়গাতে তিনি এঁকেছেন তাঁর স্কেচগুলো। কিন্তু কিসের ওপর আঁকছেন থেকে কী আঁকছেন, সেটিই বড় বিবেচনা হয়ে দাঁড়ায় তাঁর ক্ষেত্রে। আমার ভাবতে কষ্ট হয়, কামরুলের কত চমৎকার স্কেচ না জানি নষ্ট হয়ে গেছে, খেয়াল না করে কেউ ফেলে দিতেও পারে, যেমন মানুষ খালি সিগারেটের বা ম্যাচের বাক্স ফেলে দেয়।

কামরুল হাসানের স্কেচগুলোর বেশিরভাগই স্বয়ংসম্পূর্ণ, অর্থাৎ তারা নিজেরা এক একটি স্বয়ম্ভূ শিল্পকর্ম। তাদের বিষয় আছে, তাদের প্রকাশে শিল্পীর পরিপূর্ণ আন্তরিকতা আছে। কিন্তু কোনো কোনো স্কেচ বৃহৎ কোনো কাজের ইঙ্গিতবহ, বড় কাজের ছোট একটি মডেলও বলা যায় তাদের। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, এই শেষোক্ত উপায়ে যখন একটি স্কেচ তিনি আঁকতেন, তার একটি আন্তরিক রূপও সেই সঙ্গে তিনি কল্পনা করে নিতেন। এ জন্য ছোট থেকে বড়তে পৌঁছাতে কোনো যান্ত্রিকতার বাধা থাকত না। তাছাড়া, তাঁর জলরঙে করা বড় অনেক ছবি দেখে আমার মনে হয়েছে, তাদের ভেতর কোথায় যেন একটি স্কেচ লুকিয়ে আছে, ওই স্কেচটা শুধু ছবির কাঠামো বা কঙ্কালের পেছনে যে উঁকি দেয় তা নয়, পল ক্লের ছবির মতো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটি প্রকাশপ্রক্রিয়াকে তা মূর্তও করে। সাদামাটা একজন শিল্পীর কাছে স্কেচ জিনিসটি সীমাবদ্ধতার সূত্রপাত করে, স্কেচ জিনিসটি খুব যান্ত্রিক হতে পারে যদি তাতে গতিশীলতা না থাকে, গভীরতা না থাকে। কামরুলের স্কেচে এসব ছিল, এবং যেসব বড় ছবিতে, যেখানে ফর্ম ও স্পেস সাজানোর স্বাধীনতা প্রচুর, এই vision-এর ব্যাপ্তি বা গভীরতা ছিল।

কামরুল হাসানের স্কেচের অন্য একটি বৈশিষ্ট্য ছিল তাদের অনুবৈশ্বিক ঘনবদ্ধতা। স্কেচ বলতে আমরা সাধারণত যা বুঝি – ড্রইং, লাইনের আঁকিবুকি, সংক্ষিপ্ত ফিগার, মিতব্যয়ী স্পেস, কালি, কাঠ কয়লা অথবা পেনসিলের তাৎপর্যময় আচরণ, নির্মাণের, বিশেষ করে প্রতিস্থাপনার তারল্য – তার সঙ্গে একটি বিষয় আছে, যা গুরুত্বপূর্ণ হয় স্কেচের ক্ষেত্রে, তা হলো স্পেসের ঘনবদ্ধতা। কিন্তু এই ঘনবদ্ধতাকে অনেকে শুধুই ক্ষুদ্রায়ন বলে ধরে নেন, অর্থাৎ বৃহতের একটি সীমিত প্রতিরূপ। কিন্তু কামরুল হাসানের স্কেচ তার পরিসরগত ক্ষুদ্রতাকে সহজেই অতিক্রম করে যায়। আমরা যে বিষয় দেখি, চিন্তা দেখি, প্রতীক বা উৎপ্রেক্ষা দেখি অথবা দর্শন দেখি একটি স্কেচে তার প্রবল উপস্থাপনা পরিসরকে অপ্রধান করে দেয়। এটি সম্ভব হয় কামরুলের অনুবৈশ্বিক vision- এর জন্য। তিনি সম্পূর্ণ বিশ্বকে একটি ক্ষুদ্র গণ্ডিতে স্থাপন করেন, বিশ্বটি তাতে আঁটাসাঁট হয় না, বরং ক্ষুদ্র পরিমণ্ডলে অনেক বেশি তীক্ষè এবং তীব্রভাবে তা আমাদের সামনে ধরা দেয়। সত্য যে, কামরুলের এমন অনেক স্কেচ আছে, যাদের পেছনে কোনো বিশাল অনুপ্রেরণা নেই, যারা নিতান্ত আঁকিবুকি, যারা কোনো অলস মুহূর্তে আপনা থেকে আঙুলের ডগায় এসে গেছে। এদের মূল্য আছে আমাদের কাছে, কামরুলের অনুপ্রেরণাহীন ছবিগুলো তার বৈচিত্র্যের পূর্বাপর একটি পরিচয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যেসব স্কেচ কামরুল এঁকেছেন ভেতরের তাগিদ থেকে সেগুলোর ভেতর অনুবৈশ্বিক একটি সামূহিকতা রয়ে গেছে।

কামরুল হাসানের স্কেচগুলো দেখে মনে হয়, তাদের স্বতঃস্ফূর্ততাকে কোনোভাবে বিপন্ন না করেও এক ধরনের শৈল্পিক শাসন তিনি চালিয়েছেন তাদের রেখা অথবা ফর্মগত প্রকাশের ক্ষেত্রে। রেখা যত বলিষ্ঠ হয়, স্কেচে তত গতিশীলতা আসে, এজন্য রেখাকে তিনি পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখেন; কিন্তু মাঝে মাঝে রেখাগুলো পরস্পরসংলগ্ন হয়ে বিছিয়ে থাকে, তাদের আলাদা করা যায় না, মাঝে মাঝে তারা বহির্গামী হয়, অথবা ভেঙে যায় মাঝপথে। এই নিয়ন্ত্রণ ও রেখার স্বাধীন বিচরণ আসলে স্কেচচিত্রের একটি অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্যকেই তুলে ধরে, এবং তা হলো বৈপরীত্য অথবা কনট্রাস্ট। প্রথমে পরিসরের ক্ষুদ্রতা ও চিন্তার বিশালতা একটি কনট্রাস্ট তৈরি করে, তারপরও আছে সাদা-কালোর দ্বন্দ্ব, আয়োজনের সামান্যতা এবং অনুরণনের প্রকাণ্ডতার মধ্যবর্তী বিবাদ। স্কেচ যে একটি শৃঙ্খলা দাবি করে, তা হলো আয়োজনের। কোন বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, কোনটি নয়, এ ব্যাপারে ধারণাটি সম্যক না হলে বিপদ, কারণ স্কেচ (ও দর্শকের চোখ) রেখার সঞ্চালনেই প্রধানত আটকে থাকে। পিকাসোর এরকম একটি চিন্তা ছিল যে, স্কেচে fluidity বা তারল্য না আনতে পারলে তা চিন্তার শুধু একটি ঘের বা ঘেরাটোপই টানবে, তার ভেতরে প্রবেশ করা সম্ভব হবে না। পিকাসোর অনেক স্কেচে রেখাটি এতই সূক্ষ্ম ও ক্রমাগত এবং অভঙ্গুর যে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে রেখাগুলো একটি সাংগীতিক চরিত্র অর্জন করে। নান্দনিক একটি তৃপ্তি আমরা ওই খুব চিকন টান ও তরল রেখাপাত থেকে পাই। স্কেচকে ততটাই বাড়তে দেওয়া যায়, যতটা এর দ্বিমাত্রিক সার্ফেস একটি ত্রিমাত্রিকতার আভাস দেবে। তারপর যদি তাতে আরও মাত্রা চড়ানো হয়, স্কেচটি তার চরিত্র হারিয়ে ফেলে। কামরুলের স্কেচে দ্বিমাত্রিকতারই একটি বর্ধমান রূপ আছে। যে মুহূর্তে তিনি খুব হালকা রেখার একটি নারী মূর্তি আঁকেন এবং তাকে ওইখানে সীমাবদ্ধ রাখার প্রয়াস পান, দেখা যায় তাঁর নারী মূর্তিটি একটি পরিবেশ তৈরি করে ফেলে।

কামরুল হাসানের চিত্রকলায় লৌকিক ও আধুনিক রীতির মিশ্রণ ঘটায় তিনি ‘পটুয়া কামরুল হাসান’ নামে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার চূড়ান্ত নকশা ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সরকারি মনোগ্রাম তৈরি করার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দেশে-বিদেশে তাঁর চিত্রকলার অনেক একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে, যেমন ঢাকা (১৯৫৫, ১৯৬৪, ১৯৭৩, ১৯৭৫, ১৯৯১, ১৯৯৫), রেঙ্গুন (১৯৭৫), রাওয়ালপিন্ডি (১৯৬৯) ও লন্ডনে (১৯৭৯)। এ ছাড়া বহু যৌথ প্রদর্শনীতেও তিনি অংশগ্রহণ করেন। তাঁর আঁকা বেশ কিছু রাজনৈতিক ছবি বেশ প্রশংসার দাবী রাখে । তার মাঝে উলেখযোগ্য হল 'মুক্তিযোদ্ধা' , 'নারী মুক্তিযোদ্ধা', 'গণহত্যার আগে ও পরে' । তাঁর 'ছবি ৭৪' নামের ধারাবাহিক চিত্রকলা গুলি সমাজের নৈতিক অবক্ষয় কে তুলে ধরেছিল। তাঁর বহুল আলোচিত চিত্র ছিল ইয়াহিয়া খানের কদাকার মুখ।

চিত্রকলায় অসাধারণ অবদানের জন্য কামরুল হাসান বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হন। সেসবের মধ্যে প্রেসিডেন্ট পুরস্কার (১৯৬৫), কুমিল্লা ফাউন্ডেশন স্বর্ণপদক (১৯৭৭), স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (১৯৭৯), চারুশিল্পী সংসদ সম্মান (১৯৮৪), বাংলা একাডেমীর ফেলো (১৯৮৫) এবং কাজী মাহবুবউল্লাহ ফাউন্ডেশন পুরস্কার (১৯৮৫) উল্লেখযোগ্য। তাঁর ‘তিনকন্যা’ ও ‘নাইওর’ চিত্রকর্ম অবলম্বনে যথাক্রমে যুগোশ্লাভীয়া সরকার (১৯৮৫) ও বাংলাদেশ সরকার (১৯৮৬) দুটি স্মারক ডাকটিকেট প্রকাশ করেছে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত