চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ

প্রকাশ : ০৭ ডিসেম্বর ২০১৭, ১১:৫২

চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ১৯৫৬ সালের ৬ ডিসেম্বর ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার নূরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মাদ্রাসায় তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পরে তিনি সাধারণ শিক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিষয়ে অনার্স ডিগ্রি ও মাস্টার্স কোর্স সম্পন্ন করেন। তারেক মাসুদ চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। আশির দশকের মধ্যভাগে শুরু হওয়া স্বাধীনধারা চলচ্চিত্র আন্দোলনের অগ্রগণ্য পরিচালক তিনি। চিত্রশিল্পী এস.এম সুলতানের জীবনভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র আদম সুরত (১৯৮৯) নির্মাণের অংশ হিসেবে প্রায় সাত বছর তিনি শিল্পীর সান্নিধ্যে কাটান এবং সেই সময়েই তাঁর সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই রাজনীতি, শিল্প-সংস্কৃতি ও দর্শনচর্চায় তারেক মাসুদ নিজেকে যুক্ত করেন।

মুক্তিযুদ্ধের ফুটেজনির্ভর প্রামাণ্যচিত্র মুক্তির গান (১৯৯৫)-এর মাধ্যমে চলচ্চিত্রকার হিসেবে তারেক মাসুদ বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বল্পকালীন প্রবাসজীবনে তিনি আবিষ্কার করেন মার্কিন পরিচালক লিয়ার লেভিনের ধারণকৃত ১৯৭১ সালের ফুটেজ যা তাঁর জীবনের ধারা বদলে দেয়। লিয়ার লেভিনের ফুটেজ ও পৃথিবীর নানান প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ফুটেজ মিলে তিনি ও আমেরিকায় জন্মগ্রহণকারী তাঁর স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ মিলে নির্মাণ করেন মুক্তির গান যা জহির রায়হানের স্টপ জেনোসাইড-এর পরে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রামাণ্য দলিল হিসেবে বিবেচিত। মুক্তির গান ‘ফিল্ম সাউথ এশিয়া’ (১৯৯৭) থেকে বিশেষ সম্মাননা অর্জন করে। মুক্তির গান সারা দেশে বিকল্প পরিবেশনায় প্রদর্শিত হয় এবং বহুল জনপ্রিয় এই চলচ্চিত্রটি দেখে সাধারণ মানুষ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন, তার ভিত্তিতে ভিডিও চলচ্চিত্র মুক্তির কথা (১৯৯৯) নির্মিত হয়। মুক্তির কথা প্রাধান্যশীল মধ্যবিত্তের বয়ানের বাইরে মুক্তিযুদ্ধের একটি ভিন্ন ভাষ্য নির্মাণ করে।

মুক্তির গান তারেক মাসুদকে দেশে চলচ্চিত্রকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা এনে দেয়। তাঁর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র মাটির ময়নার (২০০২) মাধ্যমে তারেক মাসুদ আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন। মাটির ময়না ২০০২ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে ফিপ্রেস্কি আন্তর্জাতিক সমালোচক পুরস্কারের আওতায় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কার অর্জন করে এবং বৈশ্বিক পর্যায়ে বাংলাদেশে নির্মিত সবচাইতে আলোচিত চলচ্চিত্রে পরিণত হয়। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনা-পরবর্তী বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে মাটির ময়না পশ্চিমা বিশ্বে ব্যাপক মনোযোগ পায়। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত এটি পরিচালকের আত্মজৈবনিক এক চলচ্চিত্র যাতে মাদ্রাসা পড়ুয়া এক বালকের দৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ঘটনা ছাড়াও বাংলার লোকজ সংস্কৃতি ও দর্শন প্রতিভাত হয়েছে। মাটির ময়না ইউরোপ ও আমেরিকায় বাণিজ্যিকভাবে সিনেমা হলে মুক্তি পায় এবং বাণিজ্যিকভাবে চলচ্চিত্রটির ডিভিডি প্রকাশিত হয়।

তারেক মাসুদের উল্লেখযোগ্য আরও কয়েকটি চলচ্চিত্র হলো অন্তর্যাত্রা (২০০৬), নরসুন্দর (২০০৯) এবং রানওয়ে (২০১০)। অন্তর্যাত্রা চলচ্চিত্রে যুক্তরাজ্যে বসবাসরত অভিবাসী বাংলাদেশিদের আত্মপরিচয় অনুসন্ধানে বার বার শেকড়ের টানে ফিরে আসার কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। স্বল্পদৈর্ঘ্যের নরসুন্দর চলচ্চিত্রে প্রাধান্যশীল মুক্তিযুদ্ধের বয়ানের বিনির্মাণ দেখা যায় যেখানে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের ধাওয়া খেয়ে পলায়নরত এক মুক্তিযোদ্ধাকে তাদের হাত থেকে বাঁচিয়ে দেয় বিহারী নরসুন্দররা, যাদের সম্পর্কে সাধারণ ধারণা আছে যে তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। রানওয়ে চলচ্চিত্রে সমসাময়িক বাংলাদেশের নানান ইস্যুকে মোকাবেলা করা হয়েছে, বিশেষত ২০০৪-০৫ সালের জঙ্গিবাদের সমস্যাকে আলোকপাত করা হয়েছে।

জাতীয় আত্মপরিচয়, লোকজ ধর্ম ও সংস্কৃতি তারেক মাসুদের চলচ্চিত্রে বিশেষ গুরুত্বসহকারে চিত্রিত হয়েছে। যেজন্য তার বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রের বিষয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, যে ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের জাতীয় আত্মপরিচয় সুনির্দিষ্ট হয়েছে। মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে নির্মীয়মান চলচ্চিত্র কাগজের ফুল-এর বিষয়বস্তু ছিল ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগ। তারেক মাসুদ বাংলাদেশের প্রথম ভিডিও চলচ্চিত্র সোনার বেড়ি (১৯৮৫), প্রথম অ্যানিমেশন-চিত্র ইউনিসন (১৯৯৪) ও প্রথম ডিজিটাল চলচ্চিত্র অন্তর্যাত্রা নির্মাণ করেন। স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে তারেক মাসুদের সহ-পরিচালনা ও সম্পাদনার কাজ করেছেন। স্বল্পদৈর্ঘ্য, পূর্ণদৈর্ঘ্য, প্রামাণ্যচিত্র ও অ্যানিমেশন মিলিয়ে তারেক মাসুদ মোট ১৬টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন।

শিক্ষাজীবনের শুরুটা যেভাবে হয়েছিল, তারেক মাসুদ নামের মানুষটা হয়তো কোন মাদ্রাসার শিক্ষক বা মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন হয়ে জীবন কাটিয়ে দিতে পারতেন। ধর্মভীরু এক পরিবারে জন্ম তাঁর, শিক্ষার হাতেখড়ি হয়েছিল মাদ্রাসায়। ফরিদপুরের ভাঙা তাঁর জন্মস্থান, সেখানেই ঈদগাঁ মাদ্রাসায় শিক্ষাজীবনের শুরু। ঢাকার লালবাগ মাদ্রাসা থেকে মৌলানা পাশও করেছিলেন। এরই মধ্যে শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধের পরই মাদ্রাসা ছেড়ে দিলেন, চলে এলেন সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায়। ঢাকার নটরডেম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হলেন, তখন থেকেই সংস্কৃতি বা শিল্পের সঙ্গে বসবাসের শুরু।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে লেখক শিবির বা বাম আন্দোলন কিংবা বাংলাদেশ চলচ্চিত্র আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ছিল তাঁর। তবে নিজে পরিচালক হয়ে যাবেন, সেটা ভাবেননি তখনও। আড্ডায় তানভীর মোকাম্মেল বা মোরশেদুল ইসলামের মতো গুণী পরিচালকদের সঙ্গে দেখা হতো, মুগ্ধ হয়ে শুনতেন ওদের ছবির গল্প। মাথায় ফিল্মের পোকা ঢুকলো, শুরু করলেন এখানে সেখানে ফিল্মের কোর্সে অংশ নেয়া। 

পরিবার থেকে তীব্র বাধার সম্মুখীন হয়েছেন, মওলানার ছেলে মাদ্রাসায় পড়ে এখন সিনেমা বানাবে- এটা বাবা মেনে নিতে পারেননি। কিন্ত নিজের সঙ্গে আপোষ করেননি তারেক মাসুদ, ভালোবাসার জায়গাটাকে আপন করে নিয়েছেন নিঃসঙ্কোচে, নির্ভীক চিত্তে। ১৯৮২ সালে হাত দিলেন স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র নির্মাণে। 'আদম সুরত' শিরোনামের সেই প্রামাণ্যচিত্রটি মুক্তি পায় ১৯৮৯ সালে, প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের জীবনের ওপর নির্মিত হয়েছিল সেটি। ‘আদম সুরত’ বেশ প্রশংসা কুড়ালো সবার মাঝে। এরপর বেশকিছু শর্টফিল্ম আর ডকুমেন্টারী বানিয়েছেন তিনি, ১৯৯৬ সালে এলো ‘মুক্তির গান’। মার্কিন নাগরিক লেয়ার লেভিনের ক্যামেরায় ধারণ করা হয়েছিল রক্তাক্ত একাত্তরের কিছু প্রামাণ্যচিত্র, ভিডিওতে সেসব ধারণ করেছিলেন লেভিন। সেগুলো ব্যবহার করলেন মাসুদ, এরসঙ্গে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংরক্ষণাগার থেকে মুক্তিযুদ্ধের ফুটেজ সংগ্রহ করে মুক্তির গান বানিয়ে ফেললেন তারেক মাসুদ। ১৯তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ প্রামাণ্যচিত্রের পুরস্কার ঘরে তোলে মুক্তির গান।

তারেক মাসুদ তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র মাটির ময়না (২০০২) জন্য তিনি ২০০২-এর কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘ডিরেক্টর ফোর্টনাইট’সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন। এছাড়া এটি বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্রের জন্য একাডেমি পুরস্কারে মনোনীত হয়েছিল। ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট তাঁর পরবর্তী চলচ্চিত্র কাগজের ফুল-এর সুটিংস্পট নির্বাচন করে ফেরার পথে মানিকগঞ্জের ঘিওরে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি নিহত হন।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত