ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী প্রফুল্ল চাকী

প্রকাশ : ১০ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৬:৩৭

সাহস ডেস্ক

ভারত উপমহাদেশে প্রায় দুইশত বছরের ব্রিটিশ শাসনের শক্তিশালী ভীতকে নিজেদের জীবন বাজি রেখে অকুতোভয় যে সকল তরুণরা লড়াইয়ের মাধ্যমে দুর্বল করে দিয়েছিলেন, প্রফুল্ল চাকী তাদেরই একজন। ঔপনিবেশিক শাসন বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম সর্বকনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তিনি। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ আত্মউৎসর্গকারী এমন তরুণরাই এ দেশ থেকে ব্রিটিশদের শাসন গুটিয়ে নিতে বাধ্য করেছিল। পূর্ববঙ্গে জন্ম নেয়া এই বাঙালি বিপ্লবী তৎকালীন ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন, এবং জীবন বিসর্জন করেন।

প্রফুল্ল চাকী ১৮৮৮ সালের ১০ ডিসেম্বর বগুড়া জেলার বিহার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম রাজ নারায়ণ চাকী। তিনি বগুড়ার নবাব এ্যষ্টেটে কর্মরত ছিলেন। মাতা স্বর্ণময়ী চাকী। প্রফুল্ল চাকী ৪ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে ছিলেন কনিষ্ঠ সন্তান। মাত্র ২ বছর বয়সে প্রফুল্ল চাকীর পিতা মারা যায়।

প্রফুল্ল চাকীর পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে, মায়ের কাছে। প্রাথমিক পড়াশুনা শেষে বগুড়ার নামুজা জ্ঞানদা প্রসাদ ইংরেজী বিদ্যালয়ে তাকে ভর্তি করিয়ে দেয়া হয়। এই স্কুল থেকে তিনি মাইনর পাশ করেন। তারপর ১৯০২ সাল থেকে প্রায় ১৯০৫ সাল পর্যন্ত রংপুর জেলাস্কুলে পড়াশুনা করেন। নবম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় পূর্ব বঙ্গ সরকারের কারলিসল সার্কুলারের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণের দায়ে রংপুর জেলা স্কুল তাঁকে বহিস্কার করে। এরপর তিনি ভর্তি হন রংপুর জাতীয় স্কুলে। সেখানে পড়ার সময় জীতেন্দ্রনারায়ণ রায়, অবিনাশ চক্রবর্তী, ঈশান চন্দ্র চক্রবর্তী সহ অন্যান্য বিপ্লবীর সাথে তাঁর যোগাযোগ হয়, এবং তিনি বিপ্লবী ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত হন।

১৯০৬ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী ও স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন প্রফুল্ল চাকী। এ সময় প্রফুল্ল চাকী জিতেন্দ্রনারায়ণ রায় নেতৃত্বে গুপ্ত সংগঠনে সক্রিয়ভাবে কাজ শুরু করেন। এখানে তাঁর শারীরিক শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক ও রাজনৈতিক শিক্ষা এবং পিস্তল চালনার শিক্ষাও হয়। ওই সময়ে ব্রিটিশ সরকারের সাম্রাজ্যবাদী শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে দেশমাতৃকার মুক্তির লক্ষ্যে সশস্ত্র বিপ্লবী সংগ্রাম শুরু হয়। বাংলার অসংখ্য তরুণ, যুবক এই আন্দোলনে যুক্ত হয়ে ব্রিটিশ সরকারের উৎখাতের লক্ষ্যে বৈপ্লবিক জীবন বেছে নেয়। 

১৯০৭ সালের শেষের দিকে সারাদেশে শুরু হলো ব্রিটিশ শাসক আর সশস্ত্র বিপ্লববাদীদের সংঘর্ষ, ধড়পাকড় আর নির্যাতন। বিপ্লবীরাও সুযোগ বুঝে গুম করে দেয় ব্রিটিশ শকুনদের। ব্রিটিশ হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বাধিয়েঁ দিল। এক্ষেত্রে ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহর যথেষ্ট উস্কানি ছিল। তিনি ছিলেন হিন্দু বিদ্বেষী।

স্বাধীনতাকামী বিপ্লববাদী দলগুলোকো দমন করার জন্য ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী মরিয়া হয়ে উঠে। একের পর এক বিপ্লবীকে ধরে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা রুজু করে শারিরীক নির্যাতন, আন্দামান, আলীপুরসহ বিভিন্ন জেলে যাবতজীবন কারাদণ্ড দিয়ে পাঠানো শুরু করলো। ব্রিটিশ বিচারক কিংসফোর্ট ছিলেন একজন নিষ্ঠুর বিচারক। ১৩ বছরের ছেলে সুশীল সেন। পুলিশ সার্জেন্টকে ঘুসি মেরে নাক ফাঁটিয়ে দেয়। সুশীল সেনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হলে বিচারে  কিংসফোর্ট ১৫ টি বেত্রাঘাত মারার হুকুম দিল। রক্তাক্ত হলো সুশীল সেন। দুঃসহ যন্ত্রণায় কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে পড়লো। খবরটি দ্রুতবেগে ছড়িয়ে পড়লো। সকল তরুণ বিপ্লবী এ ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে ইংরেজকে বিতাড়িত করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করলো।

১৯০৭ সালে স্বদেশী আন্দোলনের সময় প্রফুল্ল চাকী নবম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। ওই বছর বিপ্লবী বারীন্দ্র কুমার ঘোষ রংপুরে আসেন। বারীন্দ্র কুমার ঘোষ রংপুরে পূর্বে গঠিত গুপ্ত সমিতিকে নিয়ে নতুন আঙ্গিকে একটি বিপ্লবী গুপ্ত সমিতি গঠন করেন। এর পূর্বে রংপুরে ঈশানচন্দ্র চক্রবর্তী ও তার ছেলে প্রফুল্ল চক্রবর্তী, সুরেশ চক্রবর্তী ও প্রফুল্ল চাকীর চেষ্ঠায় একটি কুস্তির আখড়া গড়ে উঠেছিল। এই আখড়ায় স্থানীয় ছাত্র-যুবকরা বিপ্লবাত্মক কাজে দীক্ষা নেন। তৎকালীন সময়ে বিপ্লবীদের মানসিক শিক্ষা ও চরিত্র গঠনের জন্য বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ, দেবীচৌধুরাণী উপন্যাস, স্বামী বিবেকানন্দের বাণী এবং সখারাম গনেশ দেউস্কর লিখিত দেশের কথা গ্রন্থ বিপ্লবীদের অবশ্য পাঠ্য ছিল।

প্রফুল্ল চাকী রংপুরের কুস্তির আখড়ার পরিচালক ছিলেন। এ সম্পর্কে প্রফুল্ল চাকীর বৈপ্লবিক সাধনার সহযোদ্ধা শ্রীযুক্ত সুরেশ চক্রবর্তী লিখেছিলেন, রংপুরে আমাদের একটি বৈপ্লবিক দল ছিল। আমরা তিনজনেই (প্রফুল্ল চক্রবর্তী, সুরেশ চক্রবর্তী ও প্রফুল্ল চাকী) অন্তর্ভূক্ত ছিলাম। এই দলে প্রবেশের অনুষ্ঠান ছিল বুক কেটে সেই রক্ত দিয়ে কয়েকটি প্রতিজ্ঞা সম্বলিত একখানি কাগজে স্বাক্ষর করা। এই প্রতিজ্ঞাগুলোর একটি ছিল প্রয়োজন হলে দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে হবে।

এসময় চাকী বিপ্লবীদের ডাকে কলকাতায় চলে যান বারীন ঘোষের সঙ্গে । কলকাতায় এসে তিনি যুগান্তর দলে যোগ দেন। বিপ্লববাদী দলের সুবোধ মল্লিক, হেমচন্দ্র, চারুদত্ত, বারীন ঘোষ ও অরবিন্দ সিদ্বান্ত নিলেন কিংসফোর্টকে হত্যা করার। মিটিংয়ে প্রশ্ন উঠলো একাজের দায়িত্ব কাকে দেব? আড়াল থেকে মিটিংয়ের কথা শুনে প্রফুল্লচাকী বললেন-আমি প্রস্তুত। বলুন কি করতে হবে আমাকে। কিন্তু সবাই ভাবলেন একাজের জন্য আরো একজন দরকার। ভেবেচিন্তে ক্ষুদিরাম বসুর নাম ঠিক হলো।

এর পর প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম বসু কলকাতা প্রেসিডেন্সী ও পরে বিহারের মুজাফফরাবাদের ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।

গোপীমোহন দত্তের ১৫ নম্বর বাড়ি ছিলো বিপ্লবীদের তীর্থক্ষেত্র। এখানে বসেই হেমচন্দ্র ও উল্লাসকর শক্তিশালী book bomb তৈরী করলেন। এ বোম বইয়ের ভাঁজে রাখা যেত। বেশ কৌশলে একটি বই কিংসফোর্টের কাছে পাঠানো হলো। কিন্তু কিংসফোর্ট বই না খোলার কারণে সে যাত্রায় বেঁচে গেলেন।

আবার নতুন প্রস্তুতি। কোলকাতার নবকৃষ্ণ ষ্ট্রীটের ৩৮/৫ এর বাড়ি। এ বাড়ীতে বসে বিপ্লবীরা সিদান্ত নিলো কিংসফোর্টকে হত্যা করার। ১৯০৮ সালে ২৫ এপ্রিল বারীন ঘোষ প্রফুল্লচাকী ও ক্ষুদিরামের কাছে বোমা পৌছে দিলেন রেলস্টেশনে। কিংসফোর্টকে মারার জন্য। রিভলবার কেনার জন্য কিছু টাকা ও মজফ্ফরপুরে যাওয়ার মানচিত্র দেয়া হলো। এই প্রথম দুজন একত্রিত হলো রেলস্টেশনে। এর আগে কেউ কাউকে চিনতো না। তাঁরা ইস্পাত দৃঢ় সিদ্বান্ত নিলেন কিংসফোর্টকে হত্যা করার জন্য। সর্তকতার সাথে চলে যান মজফ্ফরপুরে। মজফ্ফরপুরে প্রফুল্ল চাকীর ছদ্মনাম ছিল ‘দীনেশচন্দ্র রায়’। প্রতিদিন ক্লাব হাউজ থেকে সন্ধার পর সাদা ফিটন গাড়িতে নিয়মিত ফিরে আসেন কিংসফোর্ট। কিংসফোর্টকে হত্যা করা উপযুক্ত সুযোগের অপেক্ষায় পাঁচ পাঁচটা দিন চলে গেল। কিন্তু কিংসফোর্টকে বাগে পাওয়া গেল না। মজফ্ফরপুরের একটি মন্দিরে টানা ৬ দিন অপেক্ষা করার পর তাঁরা ১৯০৮ সালের ৩০ এপ্রিল দিনটিতে কিংসফোর্ডকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেন তারা  ।

মোজাফ্ফরপুরে ইউরোপিয়ান ক্লাবে কিংসফোর্ড প্রতিদিন মদ পান ও আড্ডা দিতে যান। ফিরেন রাত ৮ টায়। এই সুযোগটাকে তাঁরা কাজে লাগাবে বলে স্থির করলেন। ইউরোপিয়ান ক্লাবের প্রবেশদ্বারে তাঁরা কিংসফোর্ডের ঘোড়ার গাড়ির জন্য ওঁত পেতে থাকেন। একটি গাড়ি আসতে দেখে তাঁরা বোমা নিক্ষেপ করেন। দুর্ভাগ্যক্রমে ঐ গাড়িতে কিংসফোর্ড ছিলেন না, হামলায় দুইজন ব্রিটিশ আরোহী মারা যান। তাৎক্ষনিক ওই স্থান থেকে চলে গেলেন উভয়ে।

এই ঘটনার ১ ঘন্টা পর পুলিশ সুপার ঘটনাস্থল পরদর্শন করলেন। সকল রেল ষ্টেশনে খবর পৌঁছে গেলো। আততায়ীকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ৫ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা দিল। কিন্তু পুলিশ সমস্ত শহরে আততায়ীকে খুঁজে পেলো না। 

প্রফুল্ল চাকী প্রফুল্ল ছদ্মবেশে ট্রেনে করে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হন। ট্রেনে নন্দলাল ব্যানার্জী নামে এক পুলিশ দারোগা সমস্তিপুর (মোকামঘাট রেলস্টেশন) রেল স্টেশনের কাছে প্রফুল্লকে দেখে সন্দেহ করেন। ওই পুলিশ দারোগা সন্দেহ করার আচারণ বুঝতে পেরে প্রফুল্ল পালাবার চেষ্টা করেন। ট্রেন থেকে নেমে দৌড়ে অনেকটা দূর গিয়েছিলেন। কিন্তু নন্দলাল তার পিছু ছাড়লো না, বরং ডাকাত ডাকাত বলে চিৎকার করতে থাকলো। তখন স্টেশনের পাহারারত পুলিশ ও জনতাও প্রফুল্লচাকী ধরার জন্য পিছু ছুটতে থাকে। প্রফুল্ল চাকী পুলিশ দারোগা নন্দলালের দিকে তাক করে একটি গুলিও ছুড়েছিল। কিন্তু গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো। বাকী গুলি তিনি আর ছুড়লেন না। কারণ তিনি জানতেন, যে করে হোক পুলিশের হাতে ধরাপড়া যাবে না। কারণ ধরা পড়ার পর যদি পুলিশের মারের মুখে বিপ্লবীদের অনেক গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে যেতে পারে। তাই না পালাতে পারলে বাকীগুলো দিয়ে নিজেকে হত্যা করতে হবে। যার নাম আত্মহত্যা।

দৌড়ানোর এক পর্যায়ে প্রফুল্লচাকী কোণঠাসা হয়ে পড়েন। পুলিশ প্রায় তার কাছাকাছি চলে গেছেন, হয়তো কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ধরে ফেলবেন তাকে। এমন সময় পকেটে রাখা রিভলভার বের করে চিবুকের নীচে পর পর ২টি গুলি নিজ দেহে করে দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আত্মাহুতি দেন। সময়টা ছিলো ১৯০৮ সালের ২ মে বেলা ১২ টায়। 

প্রফুল্ল চাকী আত্মহত্যা করার প্রায় তিন মাস দশ দিন পর ১৯০৮ সালের ১১ আগষ্ট ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী ক্ষুদিরামকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে। এই ঘটনায় পর থেকে মূলত ভারতবাসী জাগতে শুরু করে। আর তখন থেকেই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রাম আরো জঙ্গি রূপ ধারণ করে।

প্রফুল্ল চাকীর এই আত্মদান পরবর্তীতে স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীদের মাঝে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।

সাহস২৪.কম/মশিউর

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত