আবদুল গাফফার চৌধুরী

প্রকাশ : ১২ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৭:৪০

বিশিষ্ট সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটির স্রষ্টা আবদুল গাফফার চৌধুরীর জন্মদিন আজ। ১৯৩৪ সালে এই দিনে তিনি বরিশালের জলবেষ্টিত গ্রাম উলানিয়ার চৌধুরী বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। আবদুল গাফফার চৌধুরীর শিক্ষা জীবন শুরু হয় স্থানীয় মাদ্রাসায়। উলানিয়া জুনিয়র মাদ্রাসায় ক্লাস সিক্স পর্যন্ত লেখাপড়া করে তিনি হাইস্কুলে ভর্তি হন। ১৯৫০ সালে এই হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। ১৯৫৩ সালে তিনি ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৮ সালে অনার্স পাস করেন। ১৯৪৬ সালে তাঁর বাবার মৃত্যুর পর তাঁকে চলে আসতে হয় বরিশাল শহরে। ভর্তি হন আসমত আলী খান ইনস্টিটিউটে। ১৯৪৭ সালে তিনি কংগ্রেস নেতা দুর্গা মোহন সেন সম্পাদিত ‘কংগ্রেস হিতৈষী’ পত্রিকায় কাজ শুরু করেন। বরিশাল শহরে তিনি কিছুদিন একটি মার্কসবাদী দল আরএসপি’র সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তাঁর প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ সালে ‘সওগাত’ পত্রিকায়।

১৯৪৭ সাল থেকে স্থানীয় পত্রিকায় কাজ করেন। এরপর ১৯৫০ সালেই তিনি ‘দৈনিক ইনসাফ’ পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৫১ সালে ‘দৈনিক সংবাদ’ প্রকাশিত হলে তিনি অনুবাদকের কাজ নেন। ১৯৫৩ সালে মোহাম্মদ নাসির উদ্দিনের ‘মাসিক সওগাত’ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হন গাফফার চৌধুরী। ১৯৫৬ সালে ‘দৈনিক ইত্তেফাক’-এর সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬২ সালে দৈনিক ‘জেহাদ’-এ বার্তা সম্পাদক পদে যোগ দেন। ১৯৬৩ সালে তিনি সাপ্তাহিক ‘সোনার বাংলা’র সম্পাদক হন। পরের বছর ১৯৬৪ সালে সাংবাদিকতা ছেড়ে দিয়ে ব্যবসায় নামেন এবং ‘অনুপম মুদ্রণ’ নামে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সপরিবারে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আগরতলা হয়ে কলকাতা পৌঁছান। সেখানে মুজিবনগর সরকারের মুখপাত্র ‘সাপ্তাহিক ‘জয়বাংলা’য় লেখালেখি করেন। এসময় তিনি কলকাতায় ‘দৈনিক আনন্দবাজার’ ও ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় কলামিস্ট হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ‘দৈনিক জনপদ’ বের করেন। ১৯৭৩ সালে তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলজিয়ার্সে ৭২ জাতি জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে যান। এরপর ১৯৭৬ সালে তিনি ‘বাংলার ডাক’ নামে এক সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদনা করেন। ১৯৮৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি সাতজন অংশীদার নিয়ে ‘নতুন দিন’ পত্রিকা বের করেন। এরপর ১৯৯০ সালে ‘নতুন দেশ’ এবং ১৯৯১ সালে ‘পূর্বদেশ’বের করেন।

বর্তমানে আবদুল গাফফার চৌধুরী অসুস্থ অবস্থায় যুক্তরাজ্যের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রয়েছেন। ডায়াবেটিস ছাড়াও শ্বাসযন্ত্রের জটিলতায় ভুগছেন আবদুল গাফফার চৌধুরী। আবদুল গাফফার চৌধুরী দীর্ঘদিন ধরেই পরিবার নিয়ে যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পর তাঁর লেখা 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি' গানটি তাঁকে খ্যাতি এনে দেয়। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে পুলিশ ভাষা আন্দোলনকারী ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালায়। এতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার প্রমুখ ছাত্র হতাহত হয়। সেসময় ঢাকা কলেজের ছাত্র আবদুল গাফফার চৌধুরী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান আহত ছাত্রদের দেখতে। ঢাকা মেডিকেলের আউটডোরে তিনি মাথার খুলি উড়ে যাওয়া একটি লাশ দেখতে পান, যেটি ছিল ভাষা সংগ্রামী রফিকের লাশ। লাশটি দেখে তাঁর মনে হয়, এটা যেন তাঁর নিজের ভাইয়েরই রক্তমাখা লাশ। তৎক্ষণাত তাঁর মনে গানের প্রথম দুইটি লাইন জেগে উঠে। পরে কয়েকদিনের মধ্যে ধীরে ধীরে তিনি গানটি লিখেন। ভাষা আন্দোলনের প্রথম প্রকাশিত লিফলেটে এটি ‘একুশের গান’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। ১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত 'একুশে সংকলনে'ও এটি প্রকাশিত হয়। তৎকালীন যুবলীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক কবিতাটি আব্দুল লতিফকে দিলে তিনি এতে সুরারোপ করেন। আব্দুল লতিফ তখন এটি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গাওয়া শুরু করেন। ১৯৫৪ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর মুক্তিযোদ্ধা আলতাফ মাহমুদ গানটিতে পুনরায় সুরারোপ করেন। ১৯৫৪ সালে আলতাফ মাহমুদের সুরে 'প্রভাত ফেরি'তে প্রথম গানটি গাওয়া হয়েছিলো। কিন্তু গান গাওয়ার অপরাধে ঢাকা কলেজ থেকে ১১ জন ছাত্রকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। বর্তমানে এটিই গানটির প্রাতিষ্ঠানিক সুর হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের সব অঞ্চল থেকে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে শত শত মানুষ এই গান গেয়ে শহীদ মিনার অভিমুখে খালি পায়ে হেঁটে যান। ১৯৬৯ সালে জহির রায়হান তাঁর 'জীবন থেকে নেওয়া' চলচ্চিত্রে গানটি ব্যবহার করেন। বর্তমানে এই গানটি হিন্দি, মালয়, ইংরেজি, ফরাসি, সুইডিশ, জাপানিসহ ১২টি ভাষায় গাওয়া হয়। বিবিসি বাংলা বিভাগের দর্শকদের জরিপে এই গান বাংলা গানের ইতিহাসে তৃতীয় সেরা গানের মর্যাদা পেয়েছে।

আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ত্রিশটি। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে নাটক ‘পলাশী থেকে বাংলাদেশ’, ‘একজন তাহমিনা’ ও ‘রক্তাক্ত আগস্ট’ অন্যতম। উল্লেখযোগ্য কথাসাহিত্যের বই চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান (১৯৬০), নাম না জানা ভোর (১৯৬২), নীল যমুনা (১৯৬৪), শেষ রজনীর চাঁদ (১৯৬৭)। সাহিত্যে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি ১৯৬৭ সালে পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। এছাড়া একুশে পদক, ইউনেস্কো পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পুরস্কার, স্বাধীনতা পদকসহ প্রচুর পুরস্কার-পদক লাভ করেন।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত