চিনুয়া আচেবে

প্রকাশ : ২২ মার্চ ২০১৮, ১৮:১১

নাইজেরিয়ার প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও আফ্রিকার আধুনিক সাহিত্যের জনক চিনুয়া আচেবে'র জন্ম ১৯৩০ সালের ১৬ নভেম্বর তারিখে আনাবগ্রা স্টেট, নাইজেরিয়ায়। ইংরেজি: Things Fall Apart উপন্যাসের জন্য তিনি ২০০৭ সালে ম্যান বুকার আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯০ সালে গাড়ি দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করে আসছিলেন চিনুয়া। এরপর তিনি প্রায় ২০ বছরের বেশি সময় কোনো বই লেখেন নি। তাঁর পরবর্তী বছরগুলো বেশিরভাগই কেটেছে যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করে। চাকরি জীবনে তিনি নাইজেরিয়ার ব্রডকাস্ট সার্ভিসে কাজ শুরু করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে তাঁর লেখালেখি শুরু হয়।

ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগে যে সম্রাজ্যবাদ পৃথিবীকে কারাগত করেছিল সে এখনও ভিন্ন মাত্রায় অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে অন্য পৃথিবীকে (the other of Europe) উপনিবেশ বানিয়ে রেখেছে। ঔপনিবেশিক কালে শাসন ও শোষণের স্বার্থে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি উপড়ে ফেলতে সচেষ্ট ছিল গণমানুষের চেতনার শিকড়। ফলে প্রত্যক্ষ শাসন হতে মুক্ত হলেও ঔপনিবেশিক শক্তির রেখে যাওয়া মতাদর্শিক প্রতিষ্ঠানসমূহ ধ্যান-ধারণা পুনরুৎপাদনের মাধ্যমে উপনিবেশ টিকিয়ে রাখে। উপনিবেশবাদ তৈরি করে আধুনিকতায় লালায়িত প্রাশ্চাত্যবাদী এক শ্রেণী, যারা আধুনিকতা ও প্রগতির নামে অব্যাহত রাখে উপনিবেশিক সম্পর্কে জ্ঞানগত অধীনতা। তাকে প্রশ্ন করা যায় না, বরং মেনে নিয়ে চর্চা না করলে আখ্যা পেতে হয় সেকেলে, সংস্কারগ্রস্থ, রক্ষণশীল। ঔপনিবেশিক শক্তি যে শিক্ষাব্যবস্থা দাঁড় করায়, সেখানে সব শিশুদের শেখানো হয় ইওরোপীয়দের আগমন ইতিহাস, সংস্কৃতি ও প্রগতির সূচনা বিন্দু। উপনিবেশীতের অতীতকে অসংলগ্ন বিকৃত সংকীর্ণ বিশ্ববীক্ষা দিয়ে অবমূল্যায়ন করা হয়। গণমানুষের চেতনায় আত্ম ও অতীত হয়ে উঠে পরিত্যাজ্য। আর পশ্চিমের সভ্যতা ও সংস্কৃতি আরাধ্য হয়ে উঠে। উপনিবেশবাদী ইতিহাস আখ্যান হতে তাঁর ইতিহাসকে বিকৃতি ও কালিমা মুক্ত করে পুনর্নির্মাণ করা এবং নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার মধ্য দিয়ে আত্নপরিচয় সন্ধান করা। ইতিহাসের প্রমিত ভাষ্যের সাথে তার বোঝাপড়া তাই অকুতোভয় বিদ্রোহী সৈনিকের মতো। চিনুয়া আচেবে তেমনিভাবে আবির্ভূত হন একজন উত্তর-উপনিবেশী কলম সৈনিকের ভূমিকায়।

একটা সময় ছিল যখন আফ্রিকার গল্প বলতেন ইউরোপিয়ান লেখকরা। ১৯৫০ এর দশকে এসে এই পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে। আফ্রিকান দেশগুলো তখন স্বাধীন হতে থাকে এবং আফ্রিকান লেখকরা নিজেদের গল্প লিখতে আরম্ভ করেন। এই সময়ে একটা উপন্যাস পৃথিবীব্যাপী আলোড়ন তোলে, ‘থিংস ফল অ্যাপার্ট’। ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত হয় উপন্যাসটি। বিশ্বসাহিত্যে ক্ল্যাসিকের মর্যাদা পেয়েছে এই উপন্যাস। ৫০টির বেশি ভাষায় অনূদিত হওয়া এই উপন্যাসের সারা বিশ্বে এক কোটিরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছে। নাইজেরিয়ার একটি গ্রামের গল্প তুলে ধরা হয়েছে উপন্যাসে। সেখানকার ইবো আদিবাসীদের সাথে ইউরোপিয়ান খ্রিস্টান মিশনারিদের সাথে প্রথমবারের মতো সংঘর্ষ বাধে। এরপর এগিয়ে যায় উপন্যাসটির গল্প।

‘থিংস ফল অ্যাপার্ট’ লেখার সময় চিনু ম্যানবুকারপ্রাপ্ত উপন্যাস ‘থিংস ফল অ্যাপার্ট’-এ সে দেশের প্রাচীন সংস্কৃতির গৌরবগাথা, উত্তরাধিকার এবং উপনিবেশ স্থাপনের দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের আখ্যানলিপিকে শিল্পরূপ দিয়েছেন।

থিংস ফল অ্যাপার্ট মূলত প্রাচীন ইবো গোত্রের এক বীর যোদ্ধা ওকোনকোর জীবনাখ্যানকেন্দ্রিক আধুনিক ক্লাসিকধর্মী উপন্যাস; নায়কের জীবনের অনুষঙ্গেই এসেছে আফ্রিকার জীবনঘনিষ্ঠ সংস্কৃতি-ঐতিহ্য-ভাঙন। উপন্যাসটি তিনটি অংশে বিভক্ত: প্রথম অংশে তের, দ্বিতীয় অংশে ছয়, তৃতীয় অংশে ছয় অর্থাৎ মোট পঁচিশটি পরিচ্ছেদে সমগ্র আখ্যানের সূচনা, বিকাশ ও পরিণতি।

প্রথম থেকে পনের পরিচ্ছেদ পর্যন্ত ওকোনকোর জীবনের নানা ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে-সঙ্গে আফ্রিকার প্রাচীন সংস্কৃতির ক্যানভাস দেখা যায়। ওকোনকো সংগ্রামী যোদ্ধা হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেছে; ভাগ্যের ওপর নিজেকে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকেনি। অলস বাবার কাছ থেকে সে কিছুই পায়নি। মাত্র আঠের বছর বয়সে ভয়াবহ মল্লযুদ্ধে ‘অপরাজেয় বিড়াল’ খ্যাত আমালিনজোকে পরাজয়ের মাধ্যমে তার খ্যাতি বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে দাবানলের মতো। সে দীর্ঘ ও বিরাট দেহের অধিকারী, ভুরু ঘন ও নাক চওড়া। পায়ের গোড়ালি মাটি স্পর্শ করে না তার, যেন স্প্রিংয়ের উপর হাঁটছে। যুবক বয়সে সে একাধিক উপাধি ও স্ত্রী গ্রহণ করেছে; সে সম্পদশালী ও গোত্রসমাজে সে একজন জমিদার সমপর্যয়ের সর্বশ্রেষ্ঠ যোদ্ধা ও মল্লবিদ।

বছরে একবার গোত্রবাসী খামার তৈরি করে ফসল ফলায়। বর্ষার শুরুতে বৃষ্টিতে জমিন নরম হয়ে আসলে জঙ্গল-আগাছা পরিষ্কার করে ইয়াম বীজ বোনা হয়— এই ইয়াম ফসলের রাজা, প্রচুর পরিশ্রম করতে হয় এর জন্য। প্রবল বর্ষা শুরু হলে ইয়াম ঢিবির মাঝে যব, তরমুজ ও সিম বোনা হয়; তবে ইয়াম তাদের প্রধান খাদ্য, সারা বছরের খোরাকি; তাছাড়া ইয়াম পৌরুষের প্রতীক। ওকোনকো ইয়াম উৎপাদনে সর্বশক্তি নিয়োগ করে, পরিবারের সবাইকে নিয়ে সে খামারে কাজ করে।

নবান্নের উৎসবকে বলা হয় নব-ইয়াম উৎসব। ফসল কাটার আগে এই উৎসব হয়। আগের রাতে মজুত সমস্ত ইয়াম খেয়ে শেষ করে নতুন ইয়াম দিয়ে শুরু হয় নবান্ন উৎসব ও নতুন বছর। উৎসবের প্রথম দিনে ভোজন উৎসব ও বন্ধুত্ব— সকালে দেবতার উদ্দেশে উৎসর্গ, সন্তানদের জন্য প্রার্থনা; বেলা হলে আশপাশের গ্রাম থেকে আত্মীয়-স্বজনের তালরসের মদপূর্ণ পাত্রসহ আগমন ও পানাহার চলতে থাকে। উৎসবের দ্বিতীয় দিনে ‘ইলোতে’ ওকোনকোর গ্রামের সাথে পাশের গ্রামের মহামল্লযুদ্ধের আয়োজন; ঢাকের বাদ্যের তালে তালে মল্লযুদ্ধ চলে; ছেলে-মেয়ে, শিশু, যুবক, বৃদ্ধা, পুরুষ সবাই দাঁড়িয়ে একটা বৃত্ত তৈরি করে মাঠের মধ্যখানটা ছেড়ে দিয়ে; প্রবীণ ও বয়স্ক লোকেরা তাদের চৌপায়ায় বসে। উচ্ছ্বসিত জনতা করতালি আর মুহুর্মুহু হর্ষধ্বনি, হৈ চৈ আর উত্তেজনায় যুদ্ধ উপভোগ করে। আশপাশের নয় গ্রামের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দুই মল্লবিদ ওকোনকো ও ইকেজুয়ে পরস্পর লড়াই করে কেউ কাউকে হারাতে পারে না। সমর্থকরা যুদ্ধশেষে ওকোনকোকে কাঁধে তুলে নিয়ে গ্রামের দিকে রওয়া দেয় আনন্দ-উল্লাসে।

আফ্রিকার প্রাচীন সংস্কৃতিতে ধর্মবিশ্বাস বিরাট জায়গা জুড়ে রয়েছে। কল্পিত দেব-দেবী তাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করে। যেমন, মৃত্তিকা দেবী আনই, সব উর্বরতার উৎস এই দেবী; নবান্নের উৎসবে বিশেষরীতিতে এই দেবীকে ও পূর্বপুরুষের আত্মাকে সম্মান প্রদর্শন করা হয়। দৈব বাণী আগবালা, পাহাড়ের গুহায় সে থাকে, কোনো বিষয়ে নির্দেশ পেতে বা বিপদে পড়লে মানুষজন এসে এই দেবতার কাছে বাণী গ্রহণ করে ও সেভাবে কাজ করে। এছাড়া তাদের রয়েছে প্রতিটি ক্ষেত্রে ও বিষয়ে আলাদা আলাদা দেবতা। যেমন: ইয়াম দেবতা, গোত্র দেবতা, ব্যক্তিগত দেবতা এবং সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী দেবতা। এইসব দেবতার প্রতিনিধিত্ব করে বিভিন্ন পুরোহিত, যারা সমাজে প্রচণ্ড প্রভাবশালী; যেমন চিয়েলো আগবালার পুরহিত। ওকোনকোরও ব্যক্তিগত দেবতা রয়েছে, যাকে সে সব সময় সন্তুষ্ট রাখে বিভিন্ন জিনিস উৎসর্গ করে। এই দেবতাদের মাধ্যমেই লোকেরা পূর্বপুরুষের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে। তাদের সঙ্গে পূর্বপুরুষের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ; অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠানে-উৎসবে-ব্রতপালনে তারা দেবতার মাধ্যমে পূর্বপুরুষের আত্মার সঙ্গে আত্মীয়তা বজায় রাখে।

চিনুয়া আচেবে'র অধিকাংশ রচনাই রাজনীতিবিদ এবং নাইজেরিয়ার নেতাদের নেতৃত্বের ব্যর্থতার তীব্র সমালোচনা করে লেখা। তাঁর বইগুলোতে দেশটির ঔপনেবেশিক সময়ে ইবো সমাজের ঐতিহ্য, দেশটির সংস্কৃতিতে খ্রিস্টানদের আগ্রাসন এবং আফ্রিকা ও পশ্চিমাদের মধ্যকার প্রথাগত দ্বন্দ্বের বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়ে উঠে এসেছে। এছাড়াও তিনি অনেক ছোট গল্প, শিশু সাহিত্য এবং প্রবন্ধও রচনা করেছেন। প্রথম উপন্যাস 'থিংস ফল অ্যাপার্ট' এর সুবাদে ব্যাপক পরিচিত লাভ করেন আচেবি। উপন্যাসটি অনুবাদ হয়েছে ৫০ টিরও বেশি ভাষায়। তাছাড়া, বিশ্বজুড়ে উপন্যাসটি প্রায় ১ কোটি কপি বিক্রি হয়। তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস 'অ্যান্টহিলস অফ দি সাভানা' প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালে। থিংস ফল অ্যাপার্ট উপন্যাসের জন্য ২০০৭ সালে বুকার পুরস্কার লাভ করেন চিনুয়া আচেবে। আফ্রিকার রাজনীতি ও পশ্চিমাদের চোখে আফ্রিকা যেভাবে চিত্রিত হয় সে প্রসঙ্গটি ঘুরে ফিরে এসেছে চিনুয়া আচেবের রচনায়। আফ্রিকার অনেক লেখকের প্রেরণার উৎস তিনি। চিনুয়া আচেবের লেখা কারাগারের দেয়ালও ভেঙে দেয়-বলে মন্তব্য করেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত