সের্জিও লেওনে

প্রকাশ : ০২ মে ২০১৮, ১২:০৯

কলেজে পড়ার সময় সেই প্রথম ওয়েস্টার্ন চলচ্চিত্রের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয় চলচ্চিত্রকার সের্জিও লেওনে পরিচালিত ফিস্টফুল অফ ডলার্‌স, ফর আ ফিউ ডলার্‌স মোর এবং দ্য গুড, দ্য ব্যাড অ্যান্ড দ্য আগলি- এই তিনটি চলচ্চিত্র দেখার মাধ্যমে। পৃথিবীব্যাপী এই তিনটি চলচ্চিত্রকে একত্রে 'ডলার্‌স ত্রয়ী' চলচ্চিত্র বলা হয়ে থাকে।

সের্জিও লেওনে পরিচালিত ইতালীয় ওয়েস্টার্ন চলচ্চিত্র দ্য গুড, দ্য ব্যাড অ্যান্ড দ্য আগলি ১৯৬৬ সালে মুক্তি পায়। ছবির প্রধান চরিত্র গুলোতে অভিনয় করেছেন ক্লিন্ট ইস্টউড, লি ভেন ক্লীফ এবং এলি ওয়ালেস। এটি সের্জিও লেওনে পরিচালিত 'ডলার্‌স ত্রয়ী' নামে পরিচিত তৃতীয় চলচ্চিত্র।

এঞ্জেল আই (ব্যাড) হন্যে হয়ে খুঁজছে বিল কারসেন ওরফে জ্যাকসনকে, যে জানে বহুমূল্য কনফেডারেট সোনার মুদ্রা কোথায় লুকানো আছে। নিষ্ঠুর এঞ্জেল আই সোনার জন্যে একাধিক নরহত্যা করেছে। আসলে যারা তাকে ভয়ে বা সোনার লোভে সাহায্য করছে তাদেরই সে হত্যা করেছে অসহায়ভাবে। অন্যদিকে তাড়া খাওয়া আউট ল টুকো (আগলি) কে নামহীন আগন্তুক ব্লণ্ডি (গুড) বাঁচায় বাউন্টি হান্টারদের থেকে। যদিও তাদের বন্ধুত্ব হয় সাময়িক। টুকোকে ধরিয়ে দিয়ে পুরষ্কারের টাকা নিয়ে ব্লন্ডি নিখুঁত লক্ষ্যে গুলি করে টুকোর ফাঁসির দড়ি কাটতে থাকে বারবার। এভাবেই চলে তাদের রোজকার রোজগার। কিন্তু একবার মতবিরোধের ফলে ব্লন্ডি টুকোকে শহর থেকে অনেক দূরে নির্জন এলাকায় ফেলে চলে আসে। টুকো কুৎসিত গালাগালি করে ও প্রতিশোধ নেওয়ার হুমকি দেয়। কোনোরকমে সেখান থেকে ফিরে সে একটি অস্ত্রের দোকান থেকে অস্ত্র ছিনতাই করে। বহুবার চেষ্টার পরে ব্লন্ডিকে বেকায়দায় পেয়ে টুকো তাকে বন্দী করে হাঁটিয়ে নিয়ে যায় মরুভূমির ভেতর তীব্র রোদে। আগলি ওরফে টুকো একসময় নির্জন মরুভূমির ভেতর ব্লন্ডিকে হত্যা করতে যাওয়ার মুহুর্তেই নাটকীয় ভাবে সন্ধান পায় কারসেনের। একটি সেজগাড়ির ভেতরে আহত কারসেনকে পাওয়া যায়। কারসেন মৃত্যুর আগের মুহুর্তে ব্লন্ডিকে জানিয়ে যায় ঠিক কোন্ কবরের নিচে লুকানো আছে সেই গুপ্তধন। গুপ্তধন উদ্ধারের লোভে মৃতপ্রায় ব্লণ্ডিকে আবার শুশ্রূষা করতে থাকে টুকো। দুজনে আবার গুপ্তধনের সোনার খোঁজে বের হলে এঞ্জেল আই-এর সেনাদের হাতে তারা অর্থাৎ টুকো ও ব্লন্ডি ধরা পড়ে। টুকোকে অত্যাচার করে কবরখানার সন্ধান পেলেও কবরের নাম বা নাম্বার জানতে পারেনা কারন সেটা জানে একমাত্র ব্লন্ডিই। অগত্যা এঞ্জেল আই ব্লন্ডিকে সাথে নিয়ে অভিযানে বেরোয়। টুকো সেনাদের হাত ফসকে পালিয়ে যোগ দেয় ব্লন্ডির সাথে। এবং যখন নির্দিষ্ট কবরের সামনে দুজনে মুখোমুখি হয় তখন তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে উপস্থিত হয়েছে এঞ্জেল আই। শুরু হয় থ্রি মেন ডুয়েল।

টেকনিস্কোপ নামের নতুন একটি পদ্ধতিতে এ চলচ্চিত্রের শুটিং করা হয়। কোন রকম এনামোরফিক লেন্স ছাড়াই এই শুটিং করা যেতো। স্বাভাবিকের চেয়ে অর্ধেক ফিল্ম খরচ করে এই ছবি বানানো যেতো। টেকনিস্কোপ পদ্ধতিতে ৩৫ মিমি’র একটি একক ফ্রেমে দুটি ওয়াইড স্ক্রিণ ফ্রেম বসানো যেতো।

বন্দুকের দোকান ছিনতাইয়ের সময় এলি ওয়ালেচ যা কিছু করে তার পুরোটাই ছিলো তাৎক্ষণিক উদ্ভাবন। তিনি বিভিন্ন ধরণের অাগ্নেয়াস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞান রাখতেন, তাই এই দৃশ্যের সময় পরিচালক লেওনে তাঁকে চিত্রনাট্যের বাইরেও কাজ করার পরিপূর্ণ স্বাধীনতা সুযোগ দেন।

এ চলচ্চিত্রের জন্যে যে সমাধিক্ষেত্রটি বানানো হয়েছিলো তা আজও পর্যটকদের জন্য অন্যতম আকর্ষণীয় দর্শনীয় স্থান হয়ে আছে। টুকো আর ব্লন্ডি যে সেতুটি উড়িয়ে দিয়েছিলো সেটি সত্যিকারের সেতুই ছিলো। স্প্যানিশ মিলিটারি ইঞ্জিনিয়াররা এই ব্রিজ বানিয়েছিলো। তারা এই শর্তে সেতুটি ওড়াতে রাজী হয়েছিলেন যে, কাজটি তাদের ক্যাপ্টেনকে দিয়ে করানো হবে। ক্যাপ্টেন সেতুটি উড়িয়ে দেয়, কিন্তু তখনও ক্যামেরায় রোলিং শুরু হয়নি। আর্মিরা অপ্রত্যাশিত ব্যাপারটির কারণে দুঃখ প্রকাশ করে এবং তারা আবার সেতুটি বানিয়ে দেয়। এবার অবশ্য ঠিকমতোই সেতুটি ওড়ানো হয়। তবে এই দৃশ্যের সময় ক্লিন্ট ইস্টউড মারাও যেতে পারতেন। স্লো মোশন করে দেখলে বোঝা যায় সেতুটি ওড়ানোর পর একটা পাথর ঠিক তার মাথা ঘেষে বেরিয়ে যায়, এটি তার মাথায় লাগলেই বিপদ ঘটতো।

ইতালীয় চলচ্চিত্র পরিচালক সের্জিও লেওনে ছিলেন স্প্যাগেটি ওয়েস্টার্ন চলচ্চিত্র পরিচালনার জন্য সুবিখ্যাত। তাঁর ছবিতে প্রগাঢ় ক্লোজ-আপ দৃশ্য এবং দীর্ঘ ও ধীর দৃশ্যের সুন্দর উপস্থাপন ছিল লক্ষ্য করার মত। ইউরোপিয়ান ওয়েস্টার্ন চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য বিশ্বখ্যাত হয়ে অাছেন এই ইতালিয়ান চলচ্চিত্রকার। সিনেমার এই বিশেষ ধারাটিতে তাঁর অবদান নিয়ে আমেরিকান চলচ্চিত্র-সমালোচকদের মধ্যে হয়তো দ্বিধা কাজ করে। কিংবা বলা যেতে পারে, একেবারেই অবজ্ঞা রয়েছে। তাই হয়তো, চলচ্চিকার হিসেবে, মহানদের সারিতে যেন খানিকটা অস্বস্তি নিয়েই অবস্থান করেন সের্জিও লেওনে। অন্যদিকে, লেওনে একটু বেশিই জনপ্রিয় ছিলেন, অন্তত ইংরেজিভাষী দেশগুলোতে। তবুও একজন ‘আর্ট হাউস’ ব্যক্তিত্ব হিসেবে তাঁকে পরিপূর্ণভাবে মেনে নেওয়া হয়নি।

পশ্চিমা চলচ্চিত্রের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে শুরুর দিকে বেশ সংস্কারমনাই ছিলেন নির্মাতারা। তবে সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সংস্কার ভাঙা শুরু করেন তারা। যে কোনো সংস্কার ভাঙার প্রথম ঘটনাটি অনেক সমালোচনা ও বাধার মুখে পড়লেও, পরে ঠিকই গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। মূলত বিভিন্ন সংস্কার ভাঙতে ভাঙতেই আজকের পর্যায়ে এসেছে পশ্চিমা চলচ্চিত্র জগৎ। ১৯৩৪ সালের নীতিমালা অনুযায়ী হলিউডের ছবিতে দু’টি আলাদা দৃশ্যের মাধ্যমে গোলাগুলিতে মৃত্যুর দৃশ্য দেখানো হতো। প্রথমটিতে থাকত গুলি করার দৃশ্য এবং দ্বিতীয়টিতে আক্রান্ত ব্যক্তির মাটিতে পড়ে যাওয়ার দৃশ্য। ১৯৬৪ সালে ‘এ ফিস্টফুল অব ডলার’ সিনেমায় এই নিয়ম ভাঙেন ইতালীয় নির্মাতা সের্জিও লেওনে। সিনেমাটিতে মৃত্যুর পুরো দৃশ্যই দেখানো হয়। ক্যামেরার কাজটি এমনভাবে করা হয়েছিল যাতে মনে হবে দর্শক নিজেই বন্দুকের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। আর তার সামনে গুলি খেয়ে একেকজন মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে।

মাত্র সাতটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন সের্জিও লেওনে। সেগুলোর মধ্যে ছয়টিকে গণ্য করা হয় ‘ফিল্মস বাই সের্জিও লেওনে’ বা ‘সের্জিও লেওনে সিনেমা’ হিসেবে। কারণ হিসেবে বলা যায়, তাঁর অভিষিক্ত সিনেমাটি ছিল ‘সিনেসিত্তা’ প্রোডাকশন লাইনের একটি সরাসরি স্টুডিও প্রোডাক্ট।

সের্জিও লেওনের জন্ম ও বেড়ে ওঠা ইতালিতে। বাবা এবং মা চলচ্চিত্র নির্মাণ শিল্পের সাথে জড়িত ছিলেন। সেই পথ ধরে মাত্র আঠারো বছর বয়সে তিনিও এই শিল্পের সাথে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৫৯ সালে ‘দ্য লাস্ট ডেজ অব পম্পেই’ চলচ্চিত্রের সাথে তাঁর নাম বেশ ভালোভাবে জড়িত থাকলেও তিনি এর পরিচালক নন এবং এটি তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে গন্য করাও হয় না। এ চলচ্চিত্রে পরিচালক মারিও বনার্ড এর সহকারী হিসেবে কাজ করছিলেন তিনি। কিন্তু নির্মাণাধীন সময়ে পরিচালক গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে লেওনে হাল ধরেন এবং চলচ্চিত্রটি শেষ করেন। পরিচালক হিসেবে মারিও বনার্ডের নাম প্রচারিত হলেও এই চলচ্চিত্র থেকে লব্ধ অভিজ্ঞতা সের্জিও লেওনেকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে অনেক সহায়তা করে। ১৯৬১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত তার প্রথম চলচ্চিত্র ‘দ্য কলোসাস অব রোডস’ এ অভিজ্ঞতারই ফসল। লাস্ট ডেজ অব পম্পেই থেকে তিনি শিখেছিলেন কিভাবে অল্প বাজেটে হলিউডের মত চলচ্চিত্র তৈরি করতে হয়। পরবর্তীতে ১৯৬৪, ১৯৬৫ এবং ১৯৬৬ সালে তিনি পরপর নির্মাণ করেন ডলার ট্রিলজির তিনটি পর্ব, যথাক্রমে, ‘আ ফিস্টফুল অব ডলারস’, ‘ফর আ ফিউ ডলারস মোর’ এবং ‘দ্য গুড, দ্য ব্যাড অ্যান্ড দ্য আগলি’। চরম ভায়োলেন্ট এই তিনটি চলচ্চিত্রেরই কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন ক্লিন্ট ইস্টউড। বক্স-অফিসে ব্যাপক সাফল্য লাভ করে চলচ্চিত্রগুলো।

অন্যদিকে, সের্জিও লেওনের শেষ তিনটি চলচ্চিত্র বলতে গেলে বাণিজ্যিক সাফল্য তেমন পায়নি; আর তাঁর সর্বশেষ চলচ্চিত্র ‘ওয়ানস আপোন অা টাইম ইন আমেরিকা’ যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তি পাওয়ার পর সেটির আমেরিকান প্রমোটরদের কাছে লেওনে অত্যন্ত বিরাগভাজন ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। তাঁর স্টাইলিস্টিক সৃষ্টিগুলো এখন সংক্ষেপে ‘দ্য ওয়েস্ট’ পরিচয়ে অগুনতি টেলিভিশন বিজ্ঞাপন ও হলিউডি চলচ্চিত্রে চর্চা করা হচ্ছে। তার পরও ওয়েস্টার্ন ধারার ওপর তাঁর বিপুল প্রভাবকে আমেরিকায় কখনোই পরিপূর্ণভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। এখনকার সময়ে, ইউরোপিয়ান ওয়েস্টার্নকে ধারাটির [ওয়েস্টার্ন ধারার] ইংরেজিভাষী অংশ হিসেবে বলতে গেলে স্বীকার করাই হয় না। এর কারণ জানতে গেলে, লেওনের ব্যাকগ্রাউন্ড উপলব্ধি করতে পারাই শুধু নয়, বরং আমেরিকান ওয়েস্টার্ন ধারার গঠনশৈলীতে এই ব্যাকগ্রাউন্ড কী নির্যাস ছড়িয়ে রেখেছে, সেটি সুনির্দিষ্ট করে জানাটাও জরুরি।

তিনি ৩০ এপ্রিল, ১৯৮৯ সালে ইতালির রোমে মৃত্যুবরণ করেন।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত