প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার

প্রকাশ : ০৫ মে ২০১৮, ১১:৪৯

 

আজ অগ্নিযুগের অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার-এর জন্মদিন। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার মাস্টারদা সূর্যসেন-এর ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা ছিলেন। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে পরিচালিত সশস্ত্র সংগ্রামে প্রীতিলতাকে প্রথম আত্মোৎসর্গকারী নারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

১৯১১ সালের ৫ মে চট্টগ্রামের পটিয়ায় ধলঘাট গ্রামে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার ছিলেন চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল অফিসের হেডক্লার্ক। মায়ের নাম প্রতিভা দেবী। এই দম্পতির ছয়টি সন্তানের নাম যথাক্রমে মধুসূদন, প্রীতিলতা, কনকলতা, শান্তিলতা, আশালতা ও সন্তোষ। পরিবারের ৬ ভাই-বোনের মধ্যে প্রীতিলতা ছিলেন দ্বিতীয়। এই পরিবারের আদি পদবী ছিল দাশগুপ্ত। পরিবারের কোন এক পূর্বপুরুষ নবাবী আমলে 'ওয়াহেদেদার' উপাধি পেয়েছিলেন, এই ওয়াহেদেদার থেকে ওয়াদ্দেদার বা ওয়াদ্দার। শৈশবে পিতার মৃত্যুর পর জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার সপরিবারে তাঁর পৈত্রিক বাড়ি ডেঙ্গাপাড়া ত্যাগ করেন। তিনি পটিয়া থানার ধলঘাট গ্রামে মামার বাড়িতে বড় হয়েছেন। এই বাড়িতেই প্রীতিলতার জন্ম হয়। আদর করে মা প্রতিভাদেবী তাঁকে 'রাণী' ডাকতেন। পরবর্তীকালে চট্টগ্রাম শহরের আসকার খানের দীঘির দক্ষিণ-পশ্চিম পাড়ে টিনের ছাউনি দেয়া মাটির একটা দোতলা বাড়িতে স্থায়ীভাবে থাকতেন ওয়াদ্দেদার পরিবার।

ছোটবেলা থেকেই প্রীতিলতা ছিলেন অন্তর্মুখী, লাজুক ও কিছুটা মুখচোরা স্বভাবের। কিন্তু বুকের ভেতর তিনি ধারণ করতেন এমনই দ্রোহের আগুন যা আত্মাহুতির পূর্ব পর্যন্ত লালিত তাঁর নম্রতা, বদান্যতা ও রক্ষণশীলতার অাড়ালে কারো পক্ষে অনুমান করা অসম্ভব ছিল। অন্যদিকে কন্যা সন্তান জন্মের খবরে খুশি হন নি তাঁর বাবা। এর ওপর মেয়ের গায়ের রং কালো শুনে আরো বেশি মুখ কালো করেছিলেন। তখন তো আর জানতেন না, তার এই কালো মেয়েটাই দেশের জন্য আত্মাহুতি দিয়ে একদিন ইতিহাসখ্যাত হবেন।

প্রীতিলতার ডাকনাম ছিল রানী। পড়াশোনায় মা-বাবার কাছে হাতেখড়ির পর বাবা জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার প্রীতিলতাকে ড. খাস্তগীর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে সরাসরি তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করিয়ে দেন। পরবর্তীতে অসাধারণ স্মৃতিশক্তির ধারক প্রীতিলতা অষ্টম শ্রেণীতে বৃত্তি পান। একই স্কুল থেকে ১৯১৭ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন তিনি। এরপর তিনি ১৯২৯ সালে ঢাকা ইডেন মহিলা কলেজে ভর্তি হন এবং উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ডে প্রথম স্থান অধিকার করেন। এর দুই বৎসর পর প্রীতিলতা কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে দর্শনশাস্ত্রে ডিস্টিংশনসহ গ্রাজুয়েশন করেন। ইডেন কলেজের ছাত্রী থাকাকালে প্রীতিলতা লীলা নাগের নেতৃত্বাধীন দীপালি সংঘের অন্তর্ভুক্ত শ্রীসংঘের সদস্য এবং কলকাতার বেথুন কলেজের ছাত্রী থাকাকালে কল্যাণী দাসের নেতৃত্বাধীন ছাত্রীসংঘের সদস্য হন। গ্রাজুয়েশন করার পর তিনি চট্টগ্রামের নন্দনকানন অপর্ণাচরণ নামক একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করেন।

১৯৩০ সালে সমগ্র বাংলা জুড়ে অনেক বিপ্লবী দল সংগ্রামরত ছিল। ঐসব দলের সদস্যরা বিশ্বাস করত যে, কেবল সশস্ত্র বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ভারতের স্বাধীনতা অর্জিত হতে পারে। এক্ষেত্রে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের গোপন দলিলপত্র পাঠ থেকে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার বিপ্লবে উদ্বুদ্ধ হন। প্রীতিলতার এক ভাই মাস্টারদাকে তাঁর বিপ্লবী চেতনা সম্পর্কে অবহিত করেন। প্রীতিলতা সূর্যসেনের নেতৃত্বাধীন বিপ্লবী দলের প্রথম মহিলা সদস্য হন।

স্কুলের শিক্ষকতায় যোগদানের পরই মূলত তিনি মূলধারার রাজনীতিতে যুক্ত হন। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল বিপ্লবী নেতা মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রামে অস্ত্র লুট, রেললাইন উপড়ে ফেলা, টেলিগ্রাফ-টেলিফোন বিকল করে দেয়াসহ ব্যাপক আক্রমণ হয়। এ আক্রমণ চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ নামে পরিচিতি পায়। এ আন্দোলন সারাদেশের ছাত্রসমাজকে উদ্দীপ্ত করে। 
চাঁদপুরে হামলার ঘটনায় বিপ্লবী রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ফাঁসির আদেশ হয় এবং তিনি আলীপুর জেলে বন্দি হন। প্রীতিলতা রামকৃষ্ণের বোন পরিচয় দিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতেন। রামকৃষ্ণের প্রেরণায় প্রীতিলতা বিপ্লবী কাজে আরো বেশি সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন।

১৯৩১ সালে ৪ আগস্ট রামকৃষ্ণের ফাঁসি হওয়ার পর প্রীতিলতা আরো বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। ওই সময়ের আরেক বিপ্লবীকন্যা কল্পনা দত্তের সঙ্গে পরিচয় হয় প্রীতিলতার। বিপ্লবী কল্পনা দত্তের সহায়তায় ১৯৩২ সালের মে মাসে প্রীতিলতার দেখা হয় মাস্টারদা ও বিপ্লবী নির্মল সেনের সঙ্গে। তাঁর কাছ থেকে অস্ত্র প্রশিক্ষণ লাভ করেন। জুন মাসে সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে বিপ্লবীদের গোপন বৈঠকের সময় ব্রিটিশ সৈন্যরা তাদের ঘিরে ফেললে বিপ্লবীরা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। প্রাণ দেন নির্মল সেন ও অপূর্ব সেন। পুলিশ সাবিত্রী দেবীর বাড়িটি পুড়িয়ে দেয়। মাস্টারদার নির্দেশে জুলাই মাসে প্রীতিলতা আত্মগোপনে যান। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিলের পর ১৯৩২ সালে আবার ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়। ওই বছর ১০ আগস্ট আক্রমণের দিন ধার্য করা হয়। কল্পনা দত্তের নেতৃতে সেপ্টেম্বর মাসে নারী বিপ্লবীদের দ্বারা আক্রমণের পরিকল্পনা নেয়া হয়। কিন্তু আক্রমণের আগেই পুলিশের হাতে ধরা পড়ে কল্পনা দত্ত। এরপর নেতৃত্ব দেয়া হয় প্রীতিলতাকে।

২৪ সেপ্টেম্বর রাতে ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণে সফল হন বিপ্লবীরা। প্রীতিলতা সেদিন পুরুষের বেশে আক্রমণে যোগ দেন। জয়ী হয়ে ফেরার পথে গুলিবিদ্ধ হন প্রীতিলতা। এ অবস্থায় ধরা পড়ার আগেই সঙ্গে থাকা সায়ানাইড খেয়ে আত্মাহুতি দেন তিনি। মাত্র ২১ বছর বয়সে আত্মদানের ইতিহাস রচনা করে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত