রাজা রামমোহন রায়

প্রকাশ : ২৩ মে ২০১৮, ১২:৩৫

তিনি কখনো কোনও রাজ্য শাসন করেন নি। তবুও তাঁর সারা জীবন কেটেছে যুদ্ধ করে। তাঁর যুদ্ধ ছিল সমাজের কলুষতার বিরুদ্ধে, মাতৃরূপী নারী জাতির মুক্তির তরে যুদ্ধ। তিনি রাজা রামমোহন রায়। তাঁর বিপক্ষে ছিল পাহাড়সমান কুপ্রথার জাল। বানের জলের মতো ধেয়ে এসেছিল কুৎসা। তাঁকে নিয়ে লেখা হয়েছিল কদর্য গান। এক পর্যায়ে জীবন সংশয় পর্যন্ত দেখা দিয়েছিল তাঁর জীবনে। বাধ‍্য হয়ে বেতন দিয়ে রাখতে হয়েছিল নিরাপত্তা কর্মী। ঈশ্বরের নামে ধর্মের নামে মানুষে মানুষে বিভেদ দূর করতে তিনি লড়েছেন এবং জয়ী হয়েছেন। সেই পরম তেজস্বী রাজা রামমোহন রায়ের আজ জন্মদিন।

রাজা রামমোহন রায়ের জন্ম পশ্চিম বাংলার রাধানগর গ্রামে এক রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ পরিবারে। তিনি আঠারো শতকের ভারতের গতানুগতিক সনাতনী শিক্ষা লাভ করেন। তাঁর বাল্যাকালে ও প্রথম যৌবনে তিনি হিন্দি ও তাঁর মাতৃভাষা বাংলা ছাড়াও বেশ কয়েকটি প্রাচ্যভাষা, যেমন সংস্কৃত, আরবি ও ফারসিতে উল্লেখযোগ্য ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। তিনি হিন্দু ধর্মগ্রন্থসমূহ ভালভাবে আয়ত্ত করেন এবং মুসলমান পণ্ডিত ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সরকারের রাজস্ব ও বিচার বিভাগের কর্মকর্তাদের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের মাধ্যমে তিনি ইসলামি ধর্মতত্ত্ব ও আইনশাস্ত্রে যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করেন। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ১৮৩৭ সাল পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সরকারের রাজস্ব আদায় ও বিচারকার্য পরিচালনায় সরকারি কার্যনির্বাহের ভাষা হিসেবে ফারসি প্রচলিত ছিল। আরবি ভাষার মাধ্যমে প্রাচীন গ্রিক দর্শনশাস্ত্র ও বিজ্ঞান যেমন এরিস্টটলের যুক্তিবিদ্যা ও ইউক্লিডের মূলনীতিসমূহের প্রাথমিক পর্যায়ের সাথে রামমোহনের পরিচয় ঘটে। ফলে তিনি কিছুটা সমালোচনামূলক ও যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি আত্মস্থ করেন। ইসলাম ও হিন্দুধর্মের শাস্ত্রসম্মত বিধানসমূহের তুলনামূলক অধ্যয়ন এবং পারস্যের সুফি মরমিয়াবাদী কবিদের কাব্যসমূহের সাথে তাঁর পরিচিতি ও সেই সাথে এরিস্টটলীয় যুক্তিবিদ্যা অল্প বয়সে তাঁকে সনাতন ধর্মসমূহের ব্যাপারে কিছুটা বিপ্লবী মনোভাবাপন্ন করে তোলে।

জানা যায়, বাবার নির্দেশে কাশীতে সংস্কৃত পণ্ডিতের আখড়ায় অধ্যয়ন করেন। কয়েক বছরের মধ্যেই পণ্ডিত হয়ে বাড়ি ফিরলেন রামমোহন। বাবা ফের পাঠিয়ে দিলেন পাটনায় ফার্সি শেখাতে। এত ভাল ফার্সি শিখলেন যে লোকে তাকে মৌলভি বলে ডাকত। বাড়িতে নিষ্প্রাণ মাটির দেব-দেবীর পূজার বিরুদ্ধে সবসময় তর্ক জুড়ে দিতেন। সেই তর্ক গ্রামের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ত। ফলে পরিবারের সন্মানে ঘা লাগতে শুরু করল। ১৫ বছর বয়সে রামমোহনের প্রতি অতিষ্ঠ হয়ে তাঁর বাবা তাঁকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলেন। শুরু হল অনিশ্চিত ভবঘুরে জীবন। বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ানোর সময় তিনি উপলব্ধি করলেন ধর্মের নামে চলছে অনাচার, কুসংস্কার, মানুষে মানুষে বৈষম্য আর হানাহানি। সবথেকে মর্মান্তিক বিষয় দেখলেন নারীর প্রতি চরম অবিচার। যে নারীর গর্ভে সবার জন্ম, যে নারীর সেবা-যত্নে সংসার সচল সেই নারীকেই স্বামীর চিতায় জোর করে পুড়িয়ে হত্যা করা! রামমোহন কিছুতেই এসব অনাচার মেনে নিতে পারেন না।

পথে পথে ঘুরে বেড়ানোর সময় একদিন ইংরেজ সিভিলিয়ান ডিগবি সাহেবের সাথে পরিচয় ঘটে তাঁর। রামমোহনের সপ্রতিভ আচরণ ভাল লেগে যায় সাহেবের। নিয়োগ করলেন দেওয়ান পদে। নিজেই তাঁকে শেখালেন ইংরেজি ভাষা। উপার্জনও ভাল। ওদিকে তাদের পরিবারের অবস্থা শোচনীয়। বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে বাড়িতে এসে হাজির হলেন। বিধর্মী নাস্তিক বলে বাবার শ্রাদ্ধকর্ম দূরের কথা, মা-ও পর্যন্ত শাপ-শাপান্ত করে তাড়িয়ে দিলেন ঐ শোকের দিনে। পরিবারের সাথে চিরদিনের মত ছিন্ন হল সম্পর্ক। লোকমুখে একদিন শুনতে পেলেন বড়দা মারা গেছেন। খবরটা চাপা থাকল না। কারন তাঁর বড় বৌঠানকে স্বামীর চিতায় বেঁধে সহমরণে পাঠানো হবে। গ্রামকে গ্রাম ছড়িয়ে পড়ল সেই খবর। হাজার হাজার মানুষ খোল করতাল কাঁসর ঘন্টা নিয়ে ছুটতে লাগলো তাদের বাড়ির অভিমুখে। মমতাময়ী বৌদির অসহায় মুখটি মনে করে অস্থির হয়ে ছুটে গেলেন তিনি। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। বৌদির চিতার সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিজ্ঞা করলেন এই বর্বরতা তিনি বন্ধ করেই ছাড়বেন।

রামমোহনের প্রথম দিকের রচনাসমূহ ছিল আরবি ও ফারসি ভাষায়। মনযারাতুল্ আদিয়ান শীর্ষক তাঁর প্রথম গবেষণামূলক গ্রন্থটি বিভিন্ন ধর্মের আলোচনায় নিবেদিত। এটি কখনও ছাপা হয়নি, পরে হারিয়ে যায়। আরবি ভাষায় শিরোনাম ও মুখবন্ধ সম্বলিত ফারসি ভাষায় লিখিত তাঁর গবেষণামূলক পুস্তিকা তুহফাত-উল-মুওয়াহিদ্দীন গ্রন্থে রামমোহন শুধু পূর্বোক্ত গ্রন্থটির কথা উল্লেখ করেছেন। গ্রন্থটি ১৮০৩-০৪ সালে মুর্শিদাবাদে প্রকাশিত হয়, তখন তিনি মুর্শিদাবাদে বাস করতেন। এ উল্লেখযোগ্য পুস্তিকায় রামমোহন ঘোষণা করেন, "কোন রকম পার্থক্য ব্যতিরেকে সকল ধর্মেই সচরাচর ভ্রান্ত মত পরিদৃষ্ট হয়,’ এবং মত পোষণ করেন যে, কোন নবী, ধর্মীয় কর্তৃত্ব ও প্রত্যাদেশের সাহায্য ছাড়াই নিজস্ব কর্মক্ষমতার মাধ্যমে সর্বজনীন সর্বোৎকৃষ্ট সত্তাকে অনুধাবন করা সম্ভব। বস্ত্তত, তুহফাত প্রকাশিত হওয়ার কয়েক বছর পূর্বে রামমোহন হিন্দুদের সনাতন প্রতিমা পূজা মেনে নিতে অস্বীকার করেন এবং প্রায়শ যুগ যুগ ধরে চলে আসা হিন্দু প্রথা ও আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি সমালোচনামুখর ছিলেন।

অল্প বয়সে রামমোহন তাঁর নিজস্ব স্বাধীন সম্পত্তির মালিক হন এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে জড়িয়ে পড়েন। তাঁর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বুদ্ধিগত বন্ধন-মুক্ত অর্জনের সহায়ক হয়। রামমোহন ঐ সময়কার কলকাতা ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ ও সদর দেওয়ানি আদালতের সাথে যুক্ত নেতৃস্থানীয় ভারতীয় পণ্ডিতদের সাথে পরিচিত হন। তিনি ইউরোপীয় কর্মকর্তা ও বণিকদের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসেন, যাঁদের অনেকেই উদারবাদী চিন্তা ও ফরাসি বিপ্লবের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। রামমোহন ইতিপূর্বেই ইংরেজি শিখেছিলেন এবং তাঁর ইংরেজ বন্ধুদের সান্নিধ্যে এসে সমকালীন ইউরোপীয় চিন্তাধারার সাথে পরিচিত হন।

১৮১৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে তিনি কলকাতায় বসতি স্থাপন করেন এবং তাঁর জীবনের নতুন এক পর্ব শুরু হয়। তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, তিনি তাঁর জীবনকে সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কারের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করবেন। তাঁর কলকাতা পৌঁছার এক বছরের মধ্যেই সমমনা ব্যক্তিদের নিয়ে তিনি আত্মীয় সভা (বন্ধুদের সমিতি) নামে একটি একান্ত সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এর সদস্যবৃন্দ ওই সময়কার ধর্মীয় ও সামাজিক সমস্যাবলি নিয়ে আলোচনার জন্য তাঁর বাসায় নিয়মিত মিলিত হতেন। শীঘ্রই রামমোহন তাঁর চার পাশে ছোট কিন্তু প্রভাবশালী একটি বন্ধু-মহল গড়ে তুলতে সমর্থ হন, যাঁদের মধ্যে ছিলেন ভারতীয় ও ইউরোপীয় উভয়ই। তাঁর ঘনিষ্ঠ ভারতীয় বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর ও প্রসন্নকুমার ঠাকুর। তাঁরা দুজন ছিলেন নেতৃস্থানীয় ও সম্পদশালী জমিদার, যাঁদের ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের সাথে ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্বন্ধ ছিল। যদিও তাঁরা ধর্মবিষয়ে রামমোহনের আমূল সংস্কারের ধারণাসমূহের সাথে পুরোপুরি একমত হননি, তবুও তারা সামাজিক সংস্কার সাধন ও পাশ্চত্য শিক্ষা বিস্তারের জন্য তাঁর সকল প্রচেষ্টাকে মনেপ্রাণে সমর্থন করেন।

রামমোহন হিন্দু সংস্কারের এক মহান যুগের সূত্রপাত করেন। তিনি সতীদাহের মতো কুপ্রথার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে সক্ষম হন, যা ১৮২৯ সালে বিশেষ আইনের মাধ্যমে এ প্রথা বন্ধ করতে সরকারকে প্রভাবিত করে। রামমোহন প্রতিমা পূজাকেও দৃঢ়ভাবে বর্জন করেন এবং তিনি বিশ্বাস করতেন যে, হিন্দুধর্ম এক সর্বজনীন ঈশ্বরের পূজা করতে নির্দেশ দেয়।

১৮২৮ সালে রামমোহন ব্রাহ্মসভা (পরবর্তীসময়ে ব্রাহ্মসমাজ) প্রতিষ্ঠা করেন। এই সভা অাসলে হিন্দুধর্মেরই নতুন একটি শাখা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। রামমোহনের ধর্মীয় ধ্যান-ধারণা মৌলিক হলেও তা ইসলাম ও খ্রিস্টধর্ম দ্বারা খানিকটা প্রভাবিত হয়েছিল। তাঁর সংস্কারমূলক ও উদারবাদী ধারণাসমূহের প্রচারের জন্য ১৮২১ সালে রামমোহন সম্বাদ কৌমুদী নামে বাংলা সংবাদপত্র ও ১৮২২ সালে মিরাত-উল-আখবার নামে ফারসি সংবাদপত্র প্রকাশ করেন।

উপমহাদেশে জাতীয় চেতনার উন্মেষেও রামমোহন রায়ের প্রভূত অবদান ছিল। তাঁর রাজনৈতিক ধারণা গড়ে তুলতে তিনি জেরেমী বেন্থামের দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। রামমোহন ও তাঁর অনুসারী বাংলার অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ব্রিটিশ রাজ-এর অনুগত সমর্থক ছিলেন। তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে, কালাক্রমে ব্রিটিশ জনগণ তাদের নিজের দেশে যে রাজনৈতিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে তা’ দূর সমুদ্রের পরপারে অবস্থিত ব্রিটিশ ভূখন্ডসমূহের জনগণের জন্যও প্রসারিত হবে। ভারতীয় জনগণের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন বৈষম্যমূলক আচরণে তাঁরা ক্ষুব্ধ ছিলেন। ১৮২৩ সালে গভর্নর জেনারেল জন অ্যাডাম যখন ভারতীয় প্রেসের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করেন, তখন রামমোহন ও তাঁর বন্ধুগণ প্রিভি কাউন্সিলে স্মারকলিপি পেশ করে বলিষ্ঠভাবে এর প্রতিবাদ করেন। স্মারকলিপিটি এ যুক্তিতে প্রত্যাখ্যান করা হয় যে, যে দেশ রাজনৈতিক স্বাধীনতা ভোগ করে না সেখানে প্রেসের স্বাধীনতা থাকতে পারে না। আবার, রামমোহন ও তাঁর বন্ধু দ্বারকানাথ ঠাকুর উদ্যোগ গ্রহণ করে ১৮২৬ সালের ভারতীয় জুরি আইনের নির্দিষ্ট কিছুসংখ্যক বৈষম্যমূলক ধারার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে কলকাতার হিন্দু ও মুসলমান নাগরিকদের পক্ষে একটি স্বাক্ষরিত আবেদন-পত্র ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাঠান। বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার জমিদারদের স্বার্থ বিরোধী সরকারের রাজস্ব নীতির বিরুদ্ধে রামমোহন ও তাঁর বন্ধুগণ গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্কের নিকট ১৮২৯ সালে আরেকটি আবেদন-পত্র পেশ করেন। প্রধানত রামমোহন রায়ের উদ্যোগে বিদেশী সরকারের নীতির বিরুদ্ধে জনসাধারণের প্রতিবাদসমূহের মধ্যেই জাতীয় চেতনাবোধের প্রাথমিক প্রকাশ পরিদৃষ্ট হয়। তাঁর সময়ে সংঘটিত ইংল্যান্ডের সংস্কার আন্দোলন এবং ইউরোপের উদারবাদী ও জাতীয়তাবাদী বিপ্লবসমূহের অগ্রগতি রামমোহন গভীর আগ্রহের সাথে পর্যবেক্ষণ করতেন। তিনি নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করতেন যে ‘স্বাধীনতার শত্রুরা ও স্বৈরতন্ত্রের বন্ধুরা কখনও সাফল্যমন্ডিত হয়নি এবং কখনও হবেও না’। জেমস সিল্ক বাকিংহামের নিকট লেখা তাঁর ১৮২২ সালের ১১ আগস্টের চিঠিতে এ বিশ্বাসের প্রকাশ দেখা যায়।

১৮৩০ সালে খেতাবসর্বস্ব মুগল সম্রাট দ্বিতীয় আকবর (১৮০৬-১৮৩৭) রামমোহন রায়কে ‘রাজা’ উপাধিতে ভূষিত করেন এবং তাঁর পক্ষে ব্রিটিশ রাজ ও পার্লামেন্টে ওকালতি করার জন্য ইংল্যান্ডে পাঠান। ইংল্যান্ডে ব্রিটিশ সমাজের নেতৃবৃন্দ কর্তৃক তিনি বিপুলভাবে সংবর্ধিত হন। ১৮৩২ সালে তিনি ফ্রান্সও সফর করেন। ১৮৩৩ সালে ব্রিস্টল ভ্রমণকালে তিনি রোগাক্রান্ত হন এবং ২৭ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত