সুধীন্দ্রনাথ দত্ত

প্রকাশ : ২৬ জুন ২০১৮, ১০:৫৮

রবীন্দ্র পরবর্তী আধুনিক কাব্যধারার অন্যতম পথিকৃত সুধীন্দ্রনাথ দত্ত যেন এক নিরাশাকরোজ্জ্বল চেতনা। ব্যক্তিগত অনুভূতি তাঁর কবিতায় বিশ্ববেদনায় স্তম্ভিত হয়ে গেছে। যদিও তিনি ‘জনতার জঘন্য মিতালি’তে চিরকাল জুগুপ্সা বোধ করেছেন, তবু তিনি জীবনানন্দের মতো আত্মনিমগ্ন নির্জনতার কবি ছিলেন না, কারণ তিনি জানতেন, সভ্যতার বাইরে ব্যক্তিসত্ত্বার কোনো অস্তিত্ব বা মুক্তি নেই। তাঁর কাব্যসম্ভার যেন এক হতাশ বন্ধ্য নায়কের হাহাকার। সভ্যতার মর্মস্থলেই সেই হাহাকারের উৎস। গ্যেটের মানবতাবাদ ও মঙ্গলধর্মে বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যেমন বোদলেয়রের নারকীয় আবির্ভাব, তেমনি রবীন্দ্রনাথের নন্দনতত্ত্ব ও শুভবাদের বিরুদ্ধে সুধীন্দ্রনাথের নেতিবাদ ও শূন্যবাদী ঘোষণা:

জন্মাবধি যুদ্ধে যুদ্ধে, বিপ্লবে বিপ্লবে
বিনষ্টির চক্রবৃদ্ধি দেখে, মনুষ্যধর্মের স্তবে
নিরুত্তর, অভিব্যক্তিবাদে অবিশ্বাসী …

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ – এই সময়কালেই সুধীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থগুলি রচিত হয়েছিল: ‘তন্বী’ (১৯৩০), ‘অর্কেস্ট্রা’ (১৯৩৫), ‘ক্রন্দসী’ (১৯৩৯), ‘উত্তর ফাল্গুনী’ (১৯৪০), ‘সংবর্ত’ (১৯৫৩), ‘প্রতিধ্বনি’ (ফরাসি ও জার্মান কবিতার অনুবাদ, ১৯৫৪) ও ‘দশমী’ (১৯৫৬)।

কবি, প্রাবন্ধিক ও সম্পাদক সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ১৯০১ সালের ৩০ অক্টোবর কলকাতার হাতীবাগানে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা হীরেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন একজন বিশিষ্ট দার্শনিক। বিংশ শতকের ত্রিশ দশকের যে পাঁচজন কবি বাংলা কবিতায় রবীন্দ্রপ্রভাব কাটিয়ে আধুনিকতার সূচনা ঘটান তাঁদের মধ্যে অন্যতম সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। তাকে বাংলা কবিতায় 'ধ্রুপদী রীতির প্রবর্তক' বলা হয়ে থাকে। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের মায়ের নাম ইন্দুমতি বসুমল্লিক। সুধীন্দ্রনাথের বাল্যকাল কেটেছে কাশীতে। সুধীন্দ্রনাথ ১৯১৪ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত কাশীর থিয়সফিক্যাল হাইস্কুলে শিক্ষাগ্রহণ করেন। পরে কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারি স্কুল থেকে এন্ট্রান্স (১৯১৮) এবং স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে আইএ (১৯২০) ও বিএ (১৯২২) পাস করে তিনি কিছুদিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে এমএ শ্রেণিতে অধ্যয়ন করেন। এখানকার পাঠ অসমাপ্ত রেখেই তিনি ল’ কলেজে আইনশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন, কিন্তু তাও সমাপ্ত করেননি।

পিতার ল’ফার্মে শিক্ষানবিস হিসেবে সুধীন্দ্রনাথ কর্মজীবন শুরু করেন; পরে কিছুদিন ইন্সুরেন্স কোম্পানিতেও চাকরি করেন। ১৯৩১ সাল থেকে দীর্ঘ বারো বছর তিনি পরিচয় পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। ১৯৪৫-৪৯ সময়কালে তিনি স্টেটসম্যান পত্রিকায় কর্মরত ছিলেন। প্রমথ চৌধুরীর সবুজপত্রের সঙ্গেও তাঁর সম্পৃক্ততা ছিল। ১৯৫৭-১৯৫৯ সময়কালে তিনি আমেরিকার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন এবং পরে কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক নিযুক্ত হন।

সুধীন্দ্রনাথ কর্মজীবনের পাশাপাশি সাহিত্যচর্চাও করেছেন। আধুনিক মনন ও বৈশ্বিক চেতনার কারণে তিনি বাংলা কাব্যে স্বতন্ত্র স্থান লাভ করেন। সুধীন্দ্রনাথ ছিলেন ত্রিশের দশকের রবীন্দ্রকাব্যধারার বিরোধী খ্যাতিমান কবিদের অন্যতম। ফরাসি কবি মালার্মের প্রতীকী কাব্যাদর্শ তিনি অনুসরণ করেন। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, মননশীলতা ও নাগরিক বৈদগ্ধ্য তাঁর কাব্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য। বাংলা কবিতায় তিনি দর্শনচিন্তার নান্দনিক প্রকাশ ঘটান। তিনি বাংলা গদ্যের আধুনিক রূপেরও প্রবর্তক।

১৯২৪ সালে ছবি বসুর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। কিন্তু এক বছরের ভেতরেই বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়। ১৯৪৩ সালের ২৯ মে রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পী রাজেশ্বরী বসুর সঙ্গে দ্বিতীয়বার বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৬০ সালের ২৫ জুন কলকাতায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত