প্রয়াণ দিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

কাননবালা দেবী

প্রকাশ : ১৭ জুলাই ২০১৮, ১২:০০

১.
ভারতীয় চলচ্চিত্রের এক অসামান্য গুণবতী ব্যাক্তিত্বময়ী অভিনেত্রী কানন দেবী। অতি সামান্য অবস্থা থেকে ভারতীয় চলচ্চিত্রে কিংবদন্তি গায়িকা-নায়িকা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। অন্যের বাসায় বাসন মেজে, ঝিগিরি করে যাঁকে একসময়ে বেঁচে থাকতে হয়েছে, কঠিন সংগ্রাম করতে হয়েছে. তিনিই হয়ে উঠেছেন পরবর্তীকালে বাংলা সিনেমার ও সঙ্গীতের সম্রাজ্ঞী কাননদেবী। ভারতীয় চলচ্চিত্রের সর্বকালের সেরা নায়িকাদের মধ্যে অন্যতম কানন দেবী প্রথম বাঙালী অভিনেত্রী হিসেবে তিনিই প্রথম দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার অর্জন করেন। ১৯৯২ সালের ১৭ জুলাই কলকাতায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ভারতীয় চলচ্চিত্রের জ্যোর্তিমণ্ডলের এই উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, বাংলা চলচ্চিত্রের এক মর্যাদাময় ব্যক্তিত্ব কাননবালা দেবী কাননদেবীর আত্মকথার অনুলেখিকা সন্ধ্যা সেনের ভাষ্যমতে, খ্রিস্টীয় ১৯১৬ সালের ২২ মে (বাংলা ৮ জ্যৈষ্ঠ) তাঁর জন্মদিন। সে হিসেবে ২০১৬ সালেই তাঁর জন্ম শতবার্ষিক ছিলো অথচ গোটা চলচ্চিত্র জগতের নীরবতা দেখে ব্যথিত হয়েছি। কারণ কেবল অভিনয় কিংবা সঙ্গীত সাধনাই নয়, সারাটি জীবন তিনি মানব সেবামূলক কাজেও নিজেকে যুক্ত করেছিলেন । বিশেষত: দুঃস্থ ও বয়স্ক শিল্পীদের সাহায্যের জন্য তিনি সব সময়ে সক্রিয় ছিলেন। সেই মানুষটিকে স্মরণ না করাটা মোটেই ভালো কাজ নয়। 

২.
অনন্য কণ্ঠশিল্পী, অভিনেত্রী, চলচ্চিত্র পরিচালক এই শিল্পী বিভিন্ন নামে পরিচিতি পেয়েছিলেন: কানন দাস, কাননবালা, কাননবালা দেবী। তবে সংক্ষেপে কানন দেবী কিংবা তিনি সাধারণে ‘কাননবালা’ নামেই সুপরিচিত ছিলেন। অভিনেত্রী, কণ্ঠশিল্পী কাননবালা দেবী হাওড়ার এক দরিদ্র পরিবারে পশ্চিমবঙ্গের হাওড়াতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম রতন চন্দ্র দাস এবং মায়ের নাম রাজবালা দেবী। তবে জানা যায় রাজবালা ছিলেন রতন চন্দ্র দাসের রক্ষিতা, বিবাহিত পত্নী নন। ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর জনপ্রিয় আত্মজীবনী 'সবারে আমি নমি'। জানা যায় তাঁর জীবনের কঠোর পরিশ্রম, একনিষ্ঠ সাধনা, একাগ্রতার কথা, স্বপ্ন আর প্রবল আশাবাদী সংগ্রামী যোদ্ধার কাহিনি। ছবি করা ছেড়ে দিলেও ‌‌ দুঃস্থ, অবসরপ্রাপ্ত‌ অভিনেত্রীদের জন্যে তাঁর চিন্তাভাবনা কখনও থামেনি।‌ তৈরি করেছিলেন ‘‌মহিলা শিল্পী মহল’‌। সাহায্য করেছেন বহু শিল্পীকে। একসময় নিজে কষ্ট করে বড় হয়েছেন তাই অন্যের কষ্ট দেখলে পাশে দাঁড়াতেন সঙ্গে সঙ্গে। তবে, এসব কথা ঘটা করে বলেননি কখনও। কিন্তু নিজের যাত্রাপথের সত্যকে গোপন করেননি তাঁর আত্মকথা ‘ সবারে আমি নমি’‌তে। এমন এক মহৎ জীবনকে আমাদের সামনে আনার জন্যে আমরা অবশ্যই কৃতজ্ঞ এই বইয়ের অনুলেখিকা সন্ধ্যা সেনের কাছে। 

৩.
‘কে বাবা কে মা দিয়ে কী হবে! আমার কাননবালা পরিচয়ই যথেষ্ট’। এক সময় স্থান ছিল নিষিদ্ধ পাড়ায়? পরিচারিকার কাজও করেছেন। বাবার পরিচয় জানে না কেউ! কাননদেবীর শতবর্ষ স্মরণে সেই শিল্পীকে নিয়ে প্রখ্যাত সাংবাদিক, লেখক শঙ্করলাল ভট্টাচার্য লিখছেন, ‘কাননদেবীকে সুচিত্রা সেনের আগের জমানার ‘সুচিত্রা সেন’ বললে খুব একটা ভুল হয় না। সেই অপরূপ মুখশ্রী! মুহূর্তের পর মুহূর্তের পর মুহূর্ত আলো নেওয়া আর ক্যামেরার লেন্সে উদ্ভাসিত হয়ে থাকার ক্ষমতা! পরের পর ছবি হিট করানো, রুপোলি পর্দা ও পর্দার বাইরেও সমানভাবে নায়িকা থাকা, ইন্ডাস্ট্রির মাথাদের কব্জায় আনা, নিজেকে প্রায় একটা ব্র্যান্ডে গড়ে নেওয়া! এবং সর্বোপরি, কয়েক প্রজন্মের পুরুষের স্বপনচারিণী হয়ে ভেসে থাকা— সুচিত্রার কেরিয়ারের নীল নকশাই যেন তৈরি করে গেছিলেন কানন দেবী। চাইলে সুচিত্রাকেও পরের যুগের কানন বললে সিনেমার মানহানি হয় না।’

৪.
সাংবাদিক শঙ্করলাল ভট্টাচার্য আরো লিখছেন, ‘কানন কিন্তু একাই এক নিখুঁত, অতুলনীয় প্যাকেজ। আর গান বলে গান! কার নয়? আর হায়, কী গান! কী বাংলায়, কী হিন্দিতে। রবীন্দ্রনাথ সিনেমায় তাঁর গানের চিত্ররূপ অনুমোদন করলে সেই প্রথম গানটি ছিল কাননের— ‘আজ সবার রঙে রং মেশাতে হবে’। গান নিয়ে করা প্রমথেশ বড়ুয়ার ‘মুক্তি’ ছবি দুরন্ত হিট হওয়ার পর হিন্দুস্তান রেকর্ডজে কবিকে প্রথম দেখা কাননের। প্রশান্তচন্দ্র মহালানবিশ আলাপ করাতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘‘এ হল কানন, তারকা অভিনেত্রী।’’ কানন প্রণাম করতে রবীন্দ্রনাথ ওঁর ঠোঁট ছুয়ে বলেছিলেন, ‘‘কী সুন্দর মুখ তোমার! গান করো?’’ এ ঘটনা ‘বিদ্যাপতি’ ছবির সময়কার। কবির মনে ছিল না এই মেয়েটিই ‘মুক্তি’-তে ওঁর গান গেয়েছে। প্রশান্তচন্দ্র তখন যোগ করলেন, ‘‘ও তো আপনার গান গেয়েই বিখ্যাত।’’ রবীন্দ্রনাথ তখন বলেছিলেন, ‘‘তাই? তা হলে একবার শান্তিনিকেতনে এসে গান শুনিয়ো আমাকে।’’ সেই সৌভাগ্য কাননের আর হয়নি।’ ১৯৩৮ সালে রবীন্দ্রনাথের স্বাক্ষর করা একখানি ছবি উপহার পান কানন দেবী। এ সংবাদটি কেমন করে যেন পৌঁছেছিল কলকাতার উঁচু মহলে। এ প্রসঙ্গে কানন দেবী বলেন— ‘কে যেন একজন ফোনে জানাল অভিনেত্রীর কবির নাম স্বাক্ষরিত ছবি রাখার অধিকার নেই।’

৫.
মাত্র নয় বছর বয়সে তাঁর পিতা মারা যায়। অসহায় মাতা দুই কন্যাকে নিয়ে এক দূর সম্পর্কের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে ঝিয়ের কাজ করেন। সেখান থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর মা-মেয়েতে মিলে ঝিয়ের কাজ করেন। তাঁর আত্মজীবনী ‘সবারে আমি নমি’ গ্রন্থে তাঁর বড় হয়ে ওঠার এসব কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। ছোটবেলায় পরের বাড়িতে লাথি-ঝাঁটা খেয়ে বাঁচার চেষ্টা করতে হয়েছে। খাবার জুটত না দু’বেলা। বাবা রতনচন্দ্র দাস মার্চেন্ট অফিসে কাজ করতেন। একটা ছোটখাট সোনা-রূপার দোকানও ছিল। কিন্তু নানান কুঅভ্যাসের জন্যে আয়ের চেয়ে ব্যয়ই ছিল বেশি। ফলে, প্রচুর ধারদেনা রেখে যখন অকালে মারা গেলেন রতনচন্দ্র, তখন সেই ঋণ শোধ করতে ছোট্ট কাননের মাকে সর্বস্ব বিক্রি করে পথে নামতে হল। সেই কাননই পরবর্তীকালের বাংলা সিনেমা ও গানের কাননবালা থেকে অদ্বিতীয়া কাননদেবী হয়ে ওঠেন। জীবনের এইসব অভিজ্ঞতাকে অস্বীকার করেননি কাননদেবী। বরং সেই কঠিন অভিজ্ঞতার আগুনে পুড়ে আরও বেশি খাঁটি, আরও বেশি মানুষ হয়ে উঠেছেন তিনি। তবে, সেইসব কথা স্বীকার করার মতো তেজ ও সততা তাঁর ছিল। তাই, এমন কথাও তিনি স্বীকার করেছেন, বড় হয়ে তিনি কারও কারও কাছে শুনেছেন, বাবার বিবাহিতা স্ত্রী ছিলেন না তাঁর মা। এর উল্টো কথাও শুনেছেন। কিন্তু, নিজের আত্মকথায় তিনি বলেছেন, ‘এ নিয়ে আমার কোনও মাথাব্যথা নেই। আমি ‘মানুষ’, সেই পরিচয়টাই আমার কাছে যথেষ্ট। শুধু দেখেছি, বাবার প্রতি তাঁর আনুগত্য ও ভালবাসা কোনও বিবাহিত পত্নীর চেয়ে কোনও অংশে কম ছিল না। হয়ত বা সেই ভালবাসা-জাত কর্তব্যবোধের দায়িত্বেই বাবার সমস্ত ঋণভার অম্লানবদনে মাথায় তুলে নিয়েছিলেন। তাই দরিদ্রের সংসারের যা কিছু সোনা-দানা ও বিনিময়ে অর্থ পাওয়ার মতো জিনিসপত্র ছিল, সব বিক্রি করে বাবার ঋণ শোধ করলেন।’ ‘এরপরই শুরু হল চরম দুরবস্থা। একবেলা আহার সবদিন জুটত না। জীর্ণতম বস্ত্র মায়ের অঙ্গে, আমার অবস্থাও একইরকম।’ এই সবই কাননদেবীর নিজের কথা। 

৬.
তারপর দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাড়িতে কাকুতি-মিনতি করে আশ্রয় জোটানো। কিন্তু, কানন আর তাঁর মা আশ্রয় নেওয়ার পর সেই আশ্রয়দাতা বাড়ির ঝি, রাঁধুনি দুই ছাড়িয়ে ছিলেন। এই সব কাজ করতে হত কানন আর তাঁর মা-কে। এবং প্রতি মুহূর্তে অপমান, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা শুনতে হত তাঁদের। একদিন মায়ের হাত থেকে চায়ের প্লেট পড়ে গিয়ে ভেঙে গেল। তখন বাড়িসুদ্ধ সবাই তেড়ে মারতে গেল মা-কে। দশ বছরের কানন মায়ের হাত ধরে সেদিন আবার রাস্তায় নেমে আসে। এর চেয়ে উপোস করে মরাও ভাল— এটাই মা-কে বলেছিল সেই দশ বছরের মেয়েটা। 

৭.
তারপর বারো ঘর এক উঠোনের এক বাড়িতে ঠাঁই। তখনই পরিচিত এক ভদ্রলোক তুলসী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা। তাঁকে কাকাবাবু বলত ছোট্ট কানন। কাননের মিষ্টি মুখ, মায়াবী চোখ দেখে ছবিতে কাজ করার জন্যে তিনি নিয়ে যান বিখ্যাত পরিচালক জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। বাংলা চলচ্চিত্রের তখন শৈশব অবস্থা। বুলি ফোটেনি। নির্বাক ছবি ‘জয়দেব’-এ সুযোগ হল রাধার চরিত্রে অভিনয় করার। ম্যাডান থিয়েটার্স লিমিটেডের সেই ছবিতেই প্রথম ফুল ফুটল কাননের অভিনয়ের। সেটা ১৯২৬ সাল। এই ছবির পর চার বছর ছিল কাননের প্রস্তুতি পর্ব। ম্যাডান কোম্পানির ব্যানারেই তৈরি হল বাংলার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের কাহিনীচিত্র ‘ঋষির প্রেম’। এই ছবিতে উৎপলার ভূমিকায় অভিনয় করলেন, গানও গাইলেন কাননদেবী। সেটা ১৯৩১ সাল। ওই বছরেই ছোট ছবি ‘জোর বরাত’-এ তিনি নায়িকা এবং ‘প্রহ্লাদ’ ছবিতে তিনি নারদের ভূমিকায়।

৮.
অভিনয় ছাড়াও দশকের পর দশক তিনি সবচেয়ে জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী হিসেবেও বাংলা সঙ্গীতজগতে অসাধারণ অবদান রাখেন। সুকণ্ঠের জন্য তিনি শৈশব থেকেই সুনাম পেয়ে এসেছেন। কিন্তু আর্থিক দুরবস্থার জন্য তাঁর মা তাঁকে ভালো শিক্ষকের কাছে গান শেখানোর ব্যবস্থা করতে পারেন নি। তাঁর সহজাত সঙ্গীতপ্রতিভার বদলে তিনি ছবিতে কণ্ঠদান করতে পেরেছিলেন। পরে অবশ্য কাননদেবী ওস্তাদ আল্লা রাখার কাছে তালিম নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলসঙ্গীত এবং আধুনিক বাংলা গানকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। সেকালের বিখ্যাত গায়ক, সুরকার এবং সঙ্গীত শিক্ষক রাইচাঁদ বড়াল, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, পঙ্কজ মল্লিক, অনাদিকুমার দস্তিদার, ধীরেন্দ্রচন্দ্র মিত্র প্রমুখের কাছে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে গান শিখেছিলেন।

৯.
তাঁর গাওয়া নজরুলসঙ্গীত 'আমি বনফুল গো' এক সময়ে যেমন অসম্ভব জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল, আজো রসিক শ্রোতার মনে সমান দোলা দেয়। তাঁর গাওয়া জনপ্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীতগুলোর মধ্যে রয়েছে- 'আমার হৃদয় তোমার আপন হাতে', 'তার বিদায় বেলার মালা খানি', 'আজ সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে', 'তোমার সুরের ধারা' আমার বেলা যে যায়', 'বারে বারে চেয়েছি, পেয়েছি যে তারে', প্রাণ চায় চক্ষু না চায়', 'সেই ভালো সেই ভালো', 'একদিন চিনে নেবে তারে', 'কাছে যবে ছিল হলোনা যাওয়া', 'সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে', 'এত দিন যে বসে ছিলেম পথ চেয়ে'।

১০.
কানন দেবী অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন। নিজের সৌন্দর্য সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন। কাননদেবী যখন চলচ্চিত্রে আসেন, তখন অভিজাত ঘরের মেয়েরা চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য আসতেন না। এমনিতে কাননবালা ছিলে অভাবী ঘরের, অন্য দিকে ছিলেন রক্ষিতার কন্যা। এই কারণে, তাঁর সামাজিক মূল্য ছিল অতি নিম্ন। চলচ্চিত্রে আসার পর, তাঁর এই অবস্থার আরও অবনতি ঘটে। পরিচালকরা তাঁকে দিয়ে প্রায় নগ্নদশায় পর্দায় উপস্থিত করার চেষ্টা করেন।

১১.
১৯২৬ সালে, তখন তাঁর বয়স বারো/তেরো, তিনি একদিন কলকাতার ম্যাডান চলচ্চিত্র স্টুডিওতে হাজির হন। সৌন্দর্যের জন্য তাঁর বয়স কম হওয়া সত্ত্বেও তিনি অভিনয়ের সুযোগ পান এবং প্রথম চলচ্চিত্র ‘জয়দেব’-এ অভিনয় করে পারিশ্রমিক হিসেবে পাঁচ টাকা উপার্জন করেন। পরের বছর অভিনয় করেন অপর একটি ছবিতে। তবে তাঁর পুরোমাত্রার অভিনয়জীবন শুরু হয় ১৯৩০ সালে। তাঁর প্রথম সবাকচিত্র ‘জোর বরাত’ (১৯৩১)। রাধা ফিল্মসের সবাক ছবি 'জোরবরাত'-এ নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেন। উল্লেখ্য এই ছবির পরিচালক ছিলেন জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায়। এই ছবিতে পরিচালকের নির্দেশে নায়ক জোর করে চুম্বন করেন। এই আচরণে তিনি ক্ষুব্ধ হলেও, মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। উল্লেখ্য তাঁর বিপরীতে নায়কের ভূমিকায় ছিলেন জয়নারায়ণ মুখোপাধ্যায়। এরপর তিনি অভিনয় করেন 'বিষ্ণুপ্রিয়া', 'শঙ্করাচার্য', 'শ্রীগৌরাঙ্গ', মা ছবিতে। ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে সতীশ দাস গুপ্তের 'বাসবদত্তা' ছবিতে তিনি প্রায় নগ্ন হয়ে অভিনয় করতে বাধ্য হন। শোনা যায়, ছবি নির্মাতারা তাঁকে অভিনয়ের সম্মানীও ঠিক মতো দেন না। 

১২.
১৯৩৫ সালে জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর 'মানময়ী গার্লস স্কুল' ছবিতে অভিনয় করে সুখ্যাতি লাভ করেন। এই ছবিতে তিনি নিজের কণ্ঠে গীত গানের সাথে ঠোঁট মেলান। এ সময়ে তিনি কাননবালা থেকে কানন দেবীতে পরিণত হন। অপরূপা কানন এতোই জনপ্রিয়তা অর্জন করেন যে, রাস্তার ধারে তাঁর আলোকচিত্র বিক্রি হতে শুরু করে এবং তাঁর পোশাক, অলঙ্কার, চলাফেরা ইত্যাদি নারীদের জন্যে ফ্যাশনে পরিণত হয়। 

১৩.
১৯৩৬ সালে দেবকী বসুর ‘বিদ্যাপতি’ তাঁকে অসাধারণ জনপ্রিয়তা দেয়। আর, প্রমথেশ বড়ুয়ার ‘মুক্তি’ তো বাংলা ছবির ইতিহাসেই অবিস্মরণীয় সংযোজন। মুক্তি-র সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক। এ ছবিতে কাননদেবীর অভিনয়ও যেমন, তাঁর গলার রবীন্দ্রসঙ্গীতও বিদগ্ধ দর্শক, শ্রোতাদের কানন-অনুরাগী করে তোলে। কাননদেবীর কণ্ঠে ‘আজ সবার রঙে রঙ মেলাতে হবে’ শুধু মুক্তি-র রবীন্দ্রসঙ্গীত হয়ে থাকেনি, ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিটি বাঙালির ঘরে। তবে, তাঁর কণ্ঠে দ্বিভাষিক ‘শেষ উত্তর’ বা ‘জবাব’ ছবির ‘তুফান মেল’ গান মাতিয়েছিল সারা ভারতের মানুষকে। ‘শেষ উত্তর’-এর ‘আমি বনফুল গো’ গানটাও বাঙালি কোনওদিন ভুলবে না। ভোলা যাবে কাননদেবীর গাওয়া ‘যদি ভাল না লাগে তো দিয়ো না মন’? না, ভোলা তো যাবেই না, সেই চল্লিশের দশকে সুশীল মজুমদারের ‘যোগাযোগ’-এ তাঁর কণ্ঠে এ গান শুনে আপামর বাঙালি মন দিয়েছিল তাঁকে।

১৪.
আগেই জেনেছি, দেবকী বসু পরিচালিত 'বিদ্যাপতি' ছবিতে অভিনয় করে কাননবালা খ্যতির শীর্ষে উঠে আসেন। এই বছরেই মুক্তিপ্রাপ্ত 'মুক্তি' ছবির মাধ্যমে তিনি প্রথম সারির নায়িকা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। সেকালের প্রখ্যাত নায়ক প্রমথেশ বড়ুয়ার সঙ্গে ‘মুক্তি’ এবং আরও কয়েকটি ছবিতে নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করে ভূয়সীপ্রশংসা লাভ করেন। এই বছর থেকে দরিদ্র সস্তা অভিনেত্রী কাননবালা থেকে তিনি সম্ভ্রান্ত কাননদেবী হয়ে উঠেন। আর্থিক দুরবস্থার কারণে, এই সময়ে বাছবিচার ছাড়া তিনি বহু ছবিতে অভিনয় করেছেন। 

১৫.
১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর অভিনীত ছবি 'কৃষ্ণ সুদামা', 'কণ্ঠহার', 'বিষবৃক্ষ' খুনি কৌন (হিন্দি) প্রভৃতি ছবিতে অভিনয় করেন। এই বৎসরে তিনি নিউ থিয়েটার্স-এ যোগদান করেন। ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে কানদেবী নিউ থিয়েটার্স ছেড়ে নিজের পছন্দমত বইয়ে অভিনয় শুরু করেন । ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে প্রমথেশ বড়ুয়া পরিচালিত 'শেষ উত্তর' ও তার হিন্দী 'জবাব' ছবিতে তিনি বিশেষ সাফল্য পান। বিশেষ করে তাঁর 'তুফান মেল' গানটি তাঁকে অভিনেত্রীর পাশাপাশি গায়িকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত হিন্দি বাংলা মিলিয়ে বেছে বেছে অনেকগুলো ছবিতে অভিনয় করেন। তাঁর জনপ্রিয় ছবিগুলোর মধ্যে আছে বিদ্যাপতি, সাথী, পরিচয়, শেষ উত্তর, এবং মেজদিদি। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবিগুলো ছিল ‘স্ট্রিট সিংগার সাথী (১৯৩৮), (১৯৩৮), সাপুড়ে (১৯৩৯), জওয়ানি কি রাত (১৯৩৯), পরাজয় (১৯৪০) ইত্যাদি। 

১৬.
১৯৪৮ সালে তিনি চলচ্চিত্র প্রযোজনা শুরু করেন, প্রতিষ্ঠা করেন 'শ্রীমতী পিকচার্স' এবং এই প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে চলচ্চিত্র প্রযোজনার দিকে মন দেন। এই সময় তিনি শরৎচন্দ্রের উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র তৈরিতে মনোযোগী হন। ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি শেষবারের মতো অভিনয় করেন '‘ইন্দ্রনাথ শ্রীকান্ত ও অন্নদা দিদি'।তিনি এ সময়কাল পর্যন্ত বিশেষত মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেন।

১৭.
কানন দেবীর বিয়ে হয় ভিক্টোরীয় শুচিতার প্রতীক হেরম্ব মৈত্রের পুত্রের সঙ্গে। অভিনয়জগৎ থেকে বিদায় নেওয়ার পর তিনি সমাজ কল্যাণে আত্মনিয়োগ করেন। অভিনয়ের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ নায়িকা এবং দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কারসহ বহু সম্মানে ভূষিত হন। ১৯৬৮ সালে তিনি পদ্মশ্রী সম্মাননা পান। ১৯৭৭ সালে তাঁকে দেওয়া হয় দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কার। 

১৮.
জীবনে সম্মান, মর্যাদা কেউ কারো হাতে তুলে দেয় না। অতি সহজ বস্তুও পাবার পথে বহু বিঘ্নতায় ভরা। অনেক পোড় খেয়ে, অনেক বেদনা বয়ে, অনেক রক্ত ঝরা অন্তর্দ্বন্দের বন্ধুর পথে চলে কাননবালা দেবীর মতোন মানুষেরা বোঝেন পৃথিবীটা মোটেই সরল নয়। কঠিন পর্বতের মতো এবড়োখেবড়ো। গাঁইতি দিয়ে কেটে কেটে তাকে সমতল করে নিজের চলার পথ নিজে তৈরী করে নিতে হয়। এই পথের বিবরণ জানাবার তাগিদ পাওয়া যায় তাঁর আত্মজীবনীতে। জীবনে কোনো কাজের সাফল্য লাভই যে কঠিন নয়, সেটা সুষ্পষ্ট হয় তাঁর স্মৃতিচারণ পাঠে। পথের মেয়ে থেকে তিনি জেদ, সংগ্রাম এবং আত্মবিশ্বাসে হয়ে উঠলেন বাংলা ছবির সম্রাজ্ঞী। সত্যিই এমন একটা মহৎ জীবন আমাদের বহু কিছু শিক্ষা দেয় আজও। বাংলা ছবির হার্টথ্রব নায়িকা-গায়িকা, উনিশ শতকের প্রথম মহাতারকা কানন দেবীর মৃত্যুদিনে আবারো জানাই শ্রদ্ধাঞ্জলি।

১৯.
কানন দেবীর প্রেম ও বিবাহিত জীবন নিয়ে শঙ্করলাল ভট্টাচার্য লিখছেন, ‘কানন দেবী তাঁর আত্মজীবনীতে একটি নাম উচ্চারণই করলেন না। তাঁর প্রথম স্বামী অশোক মৈত্রের! এক অতীব অকিঞ্চিৎকর পরিস্থিতি থেকে এই বিয়ে হয়েছিল আভিজাত্যে ওঠার এক স্বর্গীয় সিঁড়ি। কারণ শ্বশুরবাড়ি মৈত্র পরিবার ছিল বাঙালি সমাজের ক্রেম দ্য ল্য ক্রেম। মান্যতার ফিরিস্তিটা একবার শুনুন...

১৯.২
অশোক অক্সফোর্ড ফেরত। দেশে ফিরে কবির বিশ্বভারতীতে পড়ানো শুরু করেছেন। ওঁর পাশাপাশি তখন ওখানে পড়াচ্ছেন বলরাজ সাহনি। অশোকের বোন রানীর বিয়ে হয়েছিল সংখ্যাতত্ত্ববিদ প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের সঙ্গে। আর বাবা? এই এক মহৎ পরিচয় ও বৃহৎ সমস্যা। তিনি ব্রাহ্ম সমাজের দোর্দন্ডপ্রতাপ নেতা ও সিটি কলেজের অধ্যক্ষ হেরম্বচন্দ্র মৈত্র। হেরম্বচন্দ্র সম্পর্কে চমৎকার গল্প আছে শিক্ষিত মহলে। তার একটা হল তিনি শ্যামবাজারের রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছেন। এক ছোকরা ওঁকে সামনে পেয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘স্যার, স্টার থিয়েটারটা কোন দিকে?’’ থিয়েটার হলের খোঁজ চাওয়ায় রাগে গরগর হেরম্বচন্দ্র বললেন, ‘‘জানি না!’’ বলেই হেঁটে চললেন।
খানিক গিয়েই দোটানায় পড়লেন নীতিবাদী অধ্যাপক। সে কী, একটা নির্দেশ দেবেন না বলে মিথ্যে বললেন!
সঙ্গে সঙ্গে পিছনে ফিরে ছোকরাকে গিয়ে ধরলেন আর বললেন, সেই নীতিবাদী টোনে— ‘‘জানি, কিন্তু বলব না!’’
হেরম্বচন্দ্রের অন্য গল্পটাও অদ্ভুত। কলেজে অপূর্ব নিষ্ঠা ও আবেগে ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতা পড়ান অধ্যাপক। হঠাৎ এক দিন কবির জীবনীতে হোঁচট খেলেন একটি তথ্যে, ওয়ার্ডসওয়ার্থ তাঁর সৎ বোন অগাস্টার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে ছিলেন! ব্যস, সে দিন থেকে তাঁর প্রিয় কবির কবিতা পড়ানো বন্ধ করে দিলেন।

১৯.৩
বলা বাহুল্য, জীবনের শেষ দিন অবধি কাননের সঙ্গে পুত্রের বিবাহ মেনে নেননি হেরম্বচন্দ্র। তাই ওঁর জীবিত কালে অশোক, কাননের সম্পর্ক থাকলেও বিয়ে হয়নি। অশোক ও কাননের প্রথম আলাপও যেন বায়োস্কোপ থেকে তোলা। অশোক শান্তিনিকেতনে পড়ান। আর ফুরসত হলেই কলকাতা চলে আসেন ফুর্তির খোঁজে। সাহেবি আমলের কলকাতা বলে কথা! অশোক রাইফেল হাতে পাকা শিকারি। এক সময় ওঁর মন গেল প্রণয়ের শিকারে। ওঁক কল্পনা ও আবেগ জুড়ে তখন একটাই মুখ, একটাই মানুষ। কাননবালা! তো এক বার কলকাতা সফরে অঢেল পান হল্লার পর নেশায় চুর অশোক বলেই দিলেন, ‘‘এখন এই সন্ধ্যায় চাওয়া-পাওয়ার কী-ই বা বাকি রইল, শুধু কাননকে পাশে পাওয়া ছাড়া।’’ সঙ্গীসাথীরা বন্ধুর এই বাসনাটুকুও বাকি রাখতে চায়নি। তাই ওঁকে প্রায় বেহুঁশ অবস্থায় বৌবাজার পল্লির কাপালিতলা লেনে কাননের বাড়ির দোরগোড়ায় ফেলে চম্পট দেয়।

১৯.৪
সুদর্শন, সুবেশ, নিদ্রিত পুরুষটিকে বাড়ির বাইরে ভোরবেলা আবিষ্কার করেন কাননই। ওঁর মাথাটা তুলে নিয়েছিলেন নিজের কোলে। আধো ঘুম ও খোঁয়ারির মধ্যে চোখ মেলে নায়িকাকে দেখে অশোকের মনে হয়েছিল স্বপ্নেই আছেন। কানন জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘আপনি কে? কেমন করে এখানে আসা হল?’’ অশোক তখন নাকি চোখ মুদে বলেছিলেন, ‘‘চলে যান, স্বপ্ন ভাঙবেন না। আমি এখন কানন বালার সঙ্গে আছি।’’ বলা বাহুল্য, এর পর অশোক-কাননের প্রেম দানা বাঁধতে সময়ে নেয়নি। কিন্তু বিয়ে করা যাচ্ছে না, চিনের প্রাচীরের মতো সম্মুখে হেরম্বচন্দ্র। ওঁরা রাজভবনে হাতার মধ্যে এজরা ম্যানসনে মিলিত হতে লাগলেন। এ ছাড়া সিনেমা দেখা ছিল। আর সময় হলেই গাড়ি হাঁকিয়ে লং ড্রাইভ। কত যে ট্রিপ হয়েছে এ ভাবে! শুধুই ফলতা বন্দর! যাওয়া হয়েছে কাশিমবাজার, মুর্শিদাবাদ। হাঁটা হয়েছে নিজামত ইমামবাড়া চত্বরে। কাননদেবী লিখেছেন: ‘‘আমি সামাজিক স্বীকৃতিকেই আমার প্রেমের মুকুট করতে চেয়েছিলাম। সেটা পেলামও। কারণ ও-ও বিয়ে চেয়েছিল।’’ কাননকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন অশোকের মা কুসুমকুমারী দেবী। সুন্দর সম্পর্ক হয়েছিল রানী ও প্রশান্তচন্দ্রের সঙ্গে, তবু অপেক্ষা করতে হয়েছিল হেরম্বচন্দ্রের মৃত্যু অবধি। সে-বিয়ে হল ১৯৪০-এর ডিসেম্বরে। অশোকের বয়স যখন ছত্রিশ, কাননের পঁচিশ। অনুরাগীদের আশঙ্কা ছিল ১৯৩৯-এ গায়িকা-নায়িকা উমাশশী যেমন বিয়ে করে গান ও অভিনয় ছেড়েছেন কাননও হয়তো তাই করবেন। আর কানন সেটা করলেন না বলেই কালো মেঘ জমল সম্পর্কের আকাশে। কানন দেবী স্বীকার করে গেছেন যে, যে-অশোককে তিনি দেবতার মতো পুজো করেছেন, ওঁর সংস্পর্শে এসে জীবনের রূপরসগন্ধের স্পর্শ পেয়েছেন, পাশ্চাত্য উচ্চাঙ্গে দীক্ষা পেয়েছেন, জেনেছেন ভালবাসা কারে কয়, সেই ঘরের মানুষটিই বিবাগী হয়ে গেল স্ত্রী যে-কাজটা ভালবাসে সেটাই করে বলে! তখনকার অভিনেত্রীদের বিবাহিত জীবনে অবিরত যেটা হত, তাই হল কাননের জীবনে। পাঁচ বছরের মধ্যে বিয়ে ভাঙল। অশোকের বরাবর ধারণা ছিল, কানন যে শেষ অবধি ডিভোর্স ফাইল করেছিলেন, সেটা রানী ও প্রশান্তচন্দ্রের পরামর্শে। অশোক মামলা কন্টেন্ট করেননি। এত শ্রদ্ধা ও ভালবাসা যে অশোক মৈত্রর প্রতি, তাঁর নামই কেন করলেন না কানন দেবী তাঁর জীবনীতে? বলা মুশকিল এবং উত্তরও নেই।’

২০.
‘দ্বিতীয় বিয়ে হতেই কেচ্ছা শুরু’ শিরোনামে কানন দেবীর আরেক জীবন নিয়ে শঙ্করলাল ভট্টাচার্য লিখছেন, ‘আমরা কানন দেবীর যে অতি রূপবান, ভারী ভদ্র, উচ্চমনা ও রসময় স্বামীটিকে দেখেছি, তিনি হরিদাস ভট্টাচার্য। সত্তর দশকের শেষ দু’বছর এবং আশির দশকের শুরুর বছর খানেক ওঁকে কয়েক বার দেখেছিলাম আনন্দবাজারের অপিসঘরে। স্নিগ্ধ, সুপুরুষ প্রৌঢ় এসে বসতেন গৌরকিশোর ঘোষের টেবিলে। আমারও একটা জায়গা ছিল সে-ঘরে তখন। প্রথম দিন গৌরদা জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘কী রে, চিনিস এঁকে?’’
বললাম, ‘‘আলাপ হয়নি। তবে চিনি।’’ সঙ্গে সঙ্গে হরিদাসবাবু পিছনে আমার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘কী করে চিনলেন?’’ বলেছিলাম, ‘‘আপনার করা ছবি দেখে।’’ বাড়াবাড়ি করছি না, কিন্তু সে দিন ওই কথায় ওঁর সোনালি ফ্রেমের চশমা ও কাঁচাপাকা চুলের (বেশিটাই পাকা) সুন্দর মুখে যে ভাললাগার ছোঁওয়া দেখেছি, তা ভোলার নয়। গৌরদাও পরে বলেছিলেন, ‘‘তুই যে শুধু কানন দেবীর বর বলে ওঁকে চিনিস না, সেটা ওঁর ভাল লেগেছে।’’ ১৯৪৯-এ কানন দেবীর বর হওয়ার আগে থেকেই কিন্তু হরিদাস ভট্টাচার্য কেউকেটা। যখন বিয়ে হচ্ছে, তখন তিনি ক্যাপ্টেন হরিদাস ভট্টাচার্য। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ড. কৈলাসনাথ কাটজুর এডিসি। কলকাতার মোস্ট এলিজিবল ব্যাচেলারদের এক। মেয়েরা ওঁকে বর আর তাদের মায়েরা ওঁকে জামাই করতে চায়। কিন্তু হঠাৎ একদিন এই যুবকের চোখ পড়ল কাননবালার ওপর।

২০.২
হরিদাস ওঁর স্মৃতিচারণায় লিখেছেন....
‘‘এক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম ড. কাটজুর সঙ্গে। সেখানেই দেখা কানন বালার সঙ্গে। প্রায় বাধ্য হয়েই সেখানে এসেছিল ও। সারাক্ষণ মঞ্চে থেকেও একটি কথাও বলেনি।’’ এর পর দ্বিতীয় দেখা রাজভবনে গান গাইতে এলেন যখন কানন। সেই আমন্ত্রণও হরিদাসই জানিয়েছিলেন। এর পর ফের সাক্ষাৎ যখন নায়িকার ছবির শ্যুটিঙের পারমিশন জোগাড় করে দিলেন রাজ্যপালের এডিসি। কারণ লোকেশন হল সরকারি ঘেরাটোপের ফলতা। কাননের প্রেমের সঙ্গে আবার জুড়ে গেল ফলতা। কানন দেবী বলেছেন যে, একজন জীবনসঙ্গীর কাছে যা কিছু তাঁর চাওয়ার ছিল, সবই পেয়েছিলেন হরিদাসের কাছে। সব চেয়ে বড় পাওয়া হরিদাসের মনের জোর। কাননের অতীত নিয়ে কোনওই প্রশ্ন বা কৌতূহল ছিল না ওঁর। বিয়ের সঙ্গে সঙ্গে সমাজে যা চর্চা লেগে গেল এবং কাগজপত্রে যা লেখালেখি শুরু হল তাতে বিয়ে টেকানো তো তিন দিনের প্র্যাকটিসে ট্র্যাপিজের খেলায় নামার সামিল। কাননের বুকটা দমে যেত হরিদাসের কথা ভেবে। কিন্তু হরিদাসকে টলায় কে! তোয়াক্কাই করলেন না এই সব কেচ্ছার কেত্তনের। বর-বৌয়ের সব ব্যাপারেই যে মতের মিল একই রকম। হরগৌরী যোগ, তাও নয়। কিন্তু ওঁদের সুন্দর ভাবে বেঁধে রাখল তিনটে জিনিস— ভেতরের টান, বাগানের নেশা আর সিনেমার প্রেম।

২০.৩
কানন ও হরিদাসকে নিয়েই একটা স্বতন্ত্র বৃত্তান্ত হয়, এবং সে-জন্য কানাঘুষোর ওপর নির্ভর করতে হয় না। ওঁদের দ্বৈত পরিচালনার শ্রীমতী পিকচার্সের ছবি তো বাংলা সিনেমার ইতিহাসে জায়গা নিয়েছে। প্রযোজিকা হিসেবে কানন দেবী এবং পরিচালক হিসেবে হরিদাস ভট্টাচার্য এক দুরন্ত হিট জুটি। শ্রীমতী পিকচার্সের প্রথম হিট ‘মেজদিদি’-তে হরিদাস সহ পরিচালক। তিনি স্বাধীন ভাবে পরিচালনায় এলেন ‘নববিধান’ ও ‘দেবত্র’-য়। ‘দেবত্র’-য় একবারই মাত্র কানন দেবী, উত্তম ও সুচিত্রা ত্রয়ী এক সঙ্গে পর্দায় এলেন। তবে হরিদাস ভট্টাচার্যকে আমরা ভুলিনি, ভুলব না, ‘আঁধারে আলো’, ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’, ‘ইন্দ্রনাথ, শ্রীকান্ত ও অন্নদাদি’, ‘অভয়া ও শ্রীকান্ত’ এবং থ্রিলার ছবি ‘শেষ অঙ্ক’-র জন্য। আর কানন দেবীকে তো বাঙালি প্রেমে পড়ে, নিন্দে করে, ভালবেসে, গাল পেড়ে, তার পর বুকে ধরে কাটিয়ে দিয়েছে যুগের পর যুগের পর যুগ। ‘আমি বনফুল’ গেয়ে বাঙালিকে এক কালে মাতিয়েছিলেন যে-নায়িকা তাঁকে আর প্রশ্ন করার ছিল না ‘তুমি কোন কাননের ফুল, কোন গগনের তারা’? শেষ দিন অবধি অবশ্য হরিদাস ও কানন একসঙ্গে থাকতে পারেননি। ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল। যদিও তার মাত্র ক’বছর আগে কানন দেবী আত্মকথায় লিখছেন, ‘‘যখন হরিদাস ভট্টাচার্যকে বিয়ে করি তখন লোকের ধারণা ছিল এ বিয়ে পনেরো দিন টিকলে হয়। সেই বিয়েই তো চব্বিশ বছর টিকে গেল।’’ ১৯৭৭-এর জানুয়ারিতে হরিদাস ও কানন জোড়ে গিয়েছিলেন দিল্লির বিজ্ঞান ভবনে। কানন দেবী সে দিন দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার নিলেন। আর ১৯৮৯ সালের এক দিন ওঁর টাকাপয়সা, কাগজপত্র, শখের পিস্তল ও রিভলভার গুছিয়ে হরিদাস ওঁদের ১নং রিজেন্ট গ্রোভের বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন। কিছু দিনের মধ্যে কানন দেবীও ১৭ জুলাই, ১৯৯২-এ বেল ভিউ ক্লিনিকের এক নির্জন কেবিনে প্রায় চুপি চুপি সংসার ছেড়ে চলে গেলেন। সেই কেবিনের আশেপাশের কোনও একটিতে বছর কুড়ি বাদে জীবন শেষ করলেন সুচিত্রা সেনও। ওপর তলায় বসে এ সব স্ক্রিপ্ট কে লেখে কে জানে!
যত দোষ বাংলা বায়োস্কাপের! ’

(তথ্যসূত্র : অনুশীলন, বাংলাপিডিয়া : গোলাম মুরশিদ, দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা, দৈনিক আজকাল, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত