জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

বিজন ভট্টাচার্য

প্রকাশ : ১৭ জুলাই ২০১৮, ১৩:১৪

১.
‘আবেগ না হলে বোধহয় কবিতার জন্ম হয় না- অনুভূতি না থাকলে, জীবনযন্ত্রণা না থাকলে কোনো সৃষ্টিই বোধহয় সম্ভব নয়।’ বলেছিলেন মানবিক দলিল রচনাকারী অমর নাট্যস্রষ্টা বিজন ভট্টাচার্য। জন্মদিন বা তারিখ নিয়ে মতান্তর থাকলেও দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার তথ্যমতে তিনি ১৯১৭ সালের ১৬ জুলাই জন্মগ্রহণ বলে জানা যায়। জীবন যন্ত্রণার কথাকার, বাঙালি নাট্যমঞ্চের খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব ও সুঅভিনেতা বিজন ভট্টাচার্যের স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, তিনি ১৯৭৮ সালের ১৯ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন। স্মৃতি-বিস্মৃতির এই বিচিত্র সময়ে এখনও যখন অন্য সুরের বাঁশি বেজে ওঠে, তখনই যেন জীবনের নিজস্ব জয়গান শোনা যায়৷ সেই জয়গানের আনন্দ বাঁশরীর সুরের আবাহনে ভেসে আসে যে স্রষ্টার প্রতিচ্ছবি, তিনিই বিজন ভট্টাচার্য। কারণ বিজন ভট্টাচার্যের প্রতিভা অনস্বীকার্য। তাঁর নাটকও আজ আলোকিত ইতিহাস।

২.
মহান এই বাঙালি মনীষাকে স্মরণ করতে গিয়ে ভূমিকায় বদলে আগেই বলে নেওয়া নিরাপদ মনে করছি যে, অন্য আরো অনেক মনীষীর মতোনই বিজন ভট্টাচার্যের জন্মদিন ও জন্মসাল নিয়ে চরম বিভ্রান্তির দু:সহ অনুসন্ধানকালের মহা গ্যাঁড়াকলে পড়তে হয়েছে আমাকে। নানান প্রশ্ন, দ্বিধা আর সংশয় নিয়েই বিজন ভট্টাচার্যের জন্মদিন ১৬ জুলাই মনে নিয়ে, মেনে নিয়েই তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাচ্ছি আমার অন্তরের গভীর বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। এখানে উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, কলকাতার বহুল প্রচারিত বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদনার মান নিয়ে প্রশ্ন মনে অনেকদিন ধরেই ঘুরপাক খাচ্ছিলো। নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্যকে নিয়ে লিখতে গিয়ে তথ্যাদি সংগ্রহকালে আবারো তাদের সম্পাদনার মানের প্রশ্নটা, সংশয়টা মনে বদ্ধমূলই থাকলো। দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা ১৬ জুলাই, ২০১৫ তারিখের ‘আজকের দিন’ শিরোনামে বিজন ভট্টাচার্যের সংক্ষিপ্ত সচিত্র পরিচিতিতে লিখেছে, তাঁর জন্মদিন, ’১৬ জুলাই, ১৯১৭’। আবার মজার ব্যাপার হলো পত্রিকাটির একই দিনের (১৬ জুলাই, ২০১৫) প্রবন্ধ -২, উপসম্পাদকীয়তে, অধ্যাপক পবিত্র সরকারের ‘তবু তিনি ইতিহাসের শিকার হয়ে গেলেন’ শিরোনামের লেখার ভূমিকায় লেখা হয়েছে, ‘আগামী কাল তাঁর জন্মদিন।’ আরো শুনবেন দৈনিক আনন্দবাজারের কীর্তি ? বিজন ভট্টাচার্যের জন্মদিন নিয়েই কেবল বিভ্রান্তি নয়, জন্মসাল নিয়েও এলোমেলো তথ্য ‘১৯১৭’ বলে তুলে ধরা হয়েছে। এখানেই শেষ নয়, মজা আরো বাকি আছে কিছুটা। দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার ২৭ মে, ২০১৫ তারিখের ‘দক্ষিণের কড়চা’ বিভাগের ‘ফের মরা চাঁদ আজ বিজনে’ শিরোনামের লেখায় বলা হয়েছে, ‘এ বছর তাঁর জন্মশতবর্ষ৷’ যদিও বাংলাপিডিয়ায় তাঁর জন্মসাল উল্লেখ করা হয়েছে ১৯০৬ খ্রীস্টাব্দকে, আবার ইন্টারনেটে উইকিপিডিয়ায় ১৯১৭ খ্রীস্টাব্দকে। সুতরাং সব সংশয়, বিতর্ক মাথায় রেখেই বিজন ভট্টাচার্যের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই আর গবেষণার বিভ্রান্তি ভুলতে ‘বসিয়া বিজনে’ জ্বিব কাটি লজ্জায়! 

৩.
বিজন ভট্টাচার্য (জুলাই ১৭, ১৯১৭ ফরিদপুর, বাংলাদেশ - ১৯ জানুয়ারি, ১৯৭৮) ফরিদপুর জেলার খানখানাপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ক্ষীরোদবিহারী ভট্টাচার্য ছিলেন একজন স্কুলশিক্ষক। পিতার কর্মসূত্রে বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস করার সুবাদে তিনি সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হন; ফলে তাদের সংগ্রামী জীবন ও আঞ্চলিক কথ্য ভাষার ছাপ তাঁর রচিত নাটকে পরিলক্ষিত হয়। বিজন ভট্টাচার্যের অভিনয় সম্পর্কে উৎপল দত্ত বলেছেন, ‘একজন অভিনেতা, যিনি আবেগে কম্পিত থাকতেন। এবং সে সঞ্চারিত হতো অন্য অভিনেতাদের মধ্যে। এবং তারপর সে আবেগটা রঙ্গমঞ্চ থেকে প্রেক্ষাগৃহে সঞ্চারিত হতো। কিন্তু সেই সঙ্গে আমার বক্তব্য হচ্ছে একজন অভিনেতার এতো আবেগ প্রবণ হওয়া উচিত নয়। এই সঙ্গে আরেকটা জিনিসের দরকার হয়- ডিসিপ্লিন। যেটা হচ্ছে অবজেক্টিভ আই। বাইরে থেকে নিজেকে দেখার ক্ষমতা, যেটা ব্রেখট আজ চূড়ান্ত রূপ দিয়ে বলেছেন এলিয়েনেশন। অভিনেতার এলিয়েনেশন ফ্রম দি পার্ট, দূরত্ব স্থাপন। অভিনেতা এবং পার্টটার মধ্যে একটা দূরত্ব থাকা উচিত। অভিনেতা তো শুধু ব্যাখ্যা করবেন না। শুধু পার্টটা তুলে ধরবেন না। পার্টটার উপর মন্তব্যও করছেন। এদিকটা আমি বলবো বিজনবাবুর কম ছিল। ফলে পার্ট ভুলে যাওয়া থেকে শুরু করে যা যা অপরাধ, বৈজ্ঞানিক থিয়েটারে, সবই ঘটতো তাঁর জীবনে। কিছুই মনে রাখতে পারেন না।’

৪.
বিজন ভট্টাচার্য অসহযোগ আন্দোলনে (১৯২০-২২) যোগ দিয়ে কারাবরণ করেন। পরে কলকাতার আশুতোষ কলেজ ও রিপন কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি জাতীয় আন্দোলনে (১৯৩১-৩২) যোগ দেন এবং মহিষবাথানে লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন। ফলে লেখাপড়ায় (বিএ) ছেদ পড়ে এবং ১৯৩৪-৩৫ সালের ছাত্র আন্দোলনের কর্মী হিসেবে তিনি বিভিন্ন কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করেন। বিজন ভট্টাচার্য কিছুদিন (১৯৩১-১৯৩২) আনন্দবাজার পত্রিকায় চাকরি করেন এবং ১৯৩৮-৩৯ সালে তিনি আলোচনা, ফিচার ও স্কেচ লেখার কাজ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রথমদিকে তিনি মাতুল সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদারের অরণি পত্রিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হন এবং বিভিন্ন বিষয়ে লেখালেখি করতে থাকেন। ১৯৪২ সালে সক্রিয় কর্মী হিসেবে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। এছাড়া তিনি ভারত ছাড় আন্দোলন, জনযুদ্ধ-নীতি প্রচার, ফ্যাসিবাদ বিরোধী লেখক ও শিল্পিসঙ্ঘ স্থাপন এবং প্রগতি লেখক সঙ্ঘ এবং ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন।

৫.
বিজন ভট্টাচার্যের নাট্যজীবনের শুরু হয় ১৯৪০ এর দশকে। প্রচলিত বাণিজ্যিক থিয়েটারের ধারার বাইরে স্বতন্ত্র নাট্য আন্দোলনের সূচনা করেন কিছু ফ্যাসিবাদ বিরোধী লেখক শিল্পী গোষ্ঠী । এঁদেরই সাংস্কৃতিক শাখা ছিল ভারতীয় গণনাট্য সংঘ বা ইণ্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েসন যা আইপিটিএ নামে বেশি পরিচিত। বিজন ভট্টাচার্য ছিলেন এই গণনাট্য সঙ্ঘের প্রথম সারির নাট্যকর্মী। চিন্তা, চেতনা এবং সংগ্রামের প্রগতিশীল চিন্তা ভাবনার দিশারী ছিল ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ। বিজন ভট্টাচার্যের নাটক রচনা, অভিনয় এবং নির্দেশনা সাফল্য লাভ করেছিল এই গণনাট্য আন্দোলনের মধ্য দিয়ে।

৬.
নবনাট্য আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক বিজন ভট্টাচার্য গণজীবনের সংগ্রাম ও দুঃখ-দুর্দশা, শোষণ-বঞ্চনা, প্রগতিশীল চিন্তা ও সমাজবোধ নিয়ে নাটক রচনা করে এবং এ ক্ষেত্রে তিনি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন। তবে তাঁর শেষজীবনে রচিত নাটকে মার্কসীয় দর্শন, হিন্দু ধর্ম ও দর্শন সংমিশ্রিত হয়েছে। তিনিই প্রথম বাংলা রঙ্গমঞ্চকে পুরাণ ও ইতিহাসের রোম্যান্টিক প্রভাব থেকে মুক্ত করেন। তাঁর প্রথম নাটক আগুন (১৯৪৩) নাট্যভারতীতে অভিনীত হয়। পরে তিনি রচনা করেন জবানবন্দী (১৯৪৩); এটি কৃষকজীবনের আলেখ্য। তাঁর প্রতিভার সার্থকতম নিদর্শন হলো নবান্ন (১৯৪৪) নাটক; বন্যা, দুর্ভিক্ষ ও মহামারীর পটভূমিকায় রচিত এই নাটকে দুঃস্থ-নিপীড়িত কৃষকজীবন প্রতিফলিত হয়েছে। গণনাট্য সংঘের প্রযোজনায় নবান্ন নাটকে তিনি নিজে অভিনয় করেন এবং অন্য অভিনেতা-অভিনেত্রীরা ছিলেন তৃপ্তি মিত্র, শম্ভু মিত্র, গঙ্গাপদ বসু, শোভা সেন, গোপাল হালদার প্রমুখ। 

৭.
১৯৪৬ সালের দাঙ্গার পটভূমিকায় তিনি রচনা করেন জীয়নকন্যা নাটক। এছাড়া তাঁর আরও দুটি নাটক হলো মরাচাঁদ ও কলঙ্ক। মরাচাঁদ চবিবশ পরগনার এক অন্ধ গায়কের জীবনকাহিনী, আর কলঙ্ক বাঁকুড়ার সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর জীবনালেখ্য। তাঁর গোত্রান্তর (১৯৬০) নাটকের বিষয়বস্ত্ত ছিন্নমূল পূর্ববঙ্গবাসীর ভাগ্যবিপর্যয়। পরে তিনি লেখেন মুনাফাখোর মিল-মালিক ও শোষিত শ্রমিকদের নিয়ে অবরোধ (১৯৪৭)। ১৯৬৬-তে লেখেন দেবীগর্জন ও বেদেদের জীবন নিয়ে গর্ভবতী জননী। এছাড়া তাঁর উল্লেখযোগ্য দুটি গল্প হচ্ছে তেভাগা আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত ‘জনপদ’ এবং দেশবিভাগের প্রেক্ষাপটে রচিত ‘রাণী পালঙ্ক’। 

৮.
বিজন ভট্টাচার্য স্বপ্রতিষ্ঠিত ক্যালকাটা থিয়েটার গ্রুপে (১৯৫০) ইস্তফা দিয়ে ১৯৭০ সালে ‘কবচকুন্ডল’ নাট্যপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন এবং শেষাবধি এর সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন। তিনি চলচ্চিত্রেও দক্ষতার সঙ্গে অভিনয় করেন। তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রগুলি হলো: বাড়ি থেকে পালিয়ে, মেঘে ঢাকা তারা, সুবর্ণরেখা, পদাতিক, যুক্তি তক্কো গপ্পো ইত্যাদি। এছাড়া তিনি নাগিন, সাড়ে চুয়াত্তর, বসু পরিবার, তৃষ্ণা, ডাক্তারবাবু প্রভৃতি ছবির স্ক্রিপ্ট তৈরি করেন। 

৯.
১৯৪৮-৫০ সময়ে বিজন ভট্টাচার্য বোম্বাই চলচ্চিত্রে অভিনয় ও ফিল্মস্ক্রিপ্ট লেখার কাজও করেন। গায়ন ও সুরযোজনায়ও তিনি পারদর্শী ছিলেন। বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক, জ্ঞানপীঠ পুরস্কার বিজয়ী মহাশ্বেতা দেবীর সঙ্গে তিনি পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন, যদিও তাঁদের দাম্পত্য জীবন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তাঁদের এক সন্তান নবারুণ ভট্টাচার্য যিনি ১৯৪৮ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। নবারুণ ভট্টাচার্য একজন সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্ত লেখক এবং কবি ছিলেন। নাট্যজগতে বিশেষ অবদানের মূল্যায়ণস্বরূপ কেন্দ্রীয় সঙ্গীত নাটক আকাদেমি, পশ্চিমবঙ্গ সঙ্গীত নাটক আকাদেমি এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে পুরস্কৃত করে। 

১০.
‘নবান্ন’র বিজন ভট্টাচার্য ১৯৭৮ সালের ১৯ জানুয়ারি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। নাট্যকারের ঘনিষ্ঠজন অশোক মুখোপাধ্যায় এক আলোচনায় বিজন ভট্টাচার্যের সাথে টুকরো টুকরো স্মৃতি তুলে ধরে বলেছিলেন, ‘বিজন ভট্টাচার্য মরনচাঁদ নাটকের অভিনয় করতে গিয়ে পায়ে পেরেক ঢুকে যায়, তাই নিয়ে তিনি অভিনয় চালিয়ে যান। পরের দিন তাঁর মৃত্যু হয়। জেতা ছাড়াও ব্যর্থতাকে পুজি করে তিনি এগিয়ে গেছেন। শিল্পী বিজন ভট্টাচার্যের জয় এখানেই।’ সেই বিজন ভট্টাচার্য ১৯৭৬ সালে বলেছিলেন, ‘আমার নাটক যেমন হাজার, হাজার দর্শককে আকৃষ্ট করেছে তেমনই কমিউনিস্ট আন্দোলনে না এলে নাট্যকার হতাম না। আমার পক্ষে নাটক লেখা সম্ভব হতো না।’ ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ-র নানা দায়িত্বপালনের সঙ্গে-সঙ্গে নাটক লিখে, অভিনয় করে এবং সর্বোপরি আরও বহু মানুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিজন ভট্টাচার্য মানবিকতার আদর্শকে বরণ করে নিয়েছিলেন। পাশে বন্ধু হিসেবে পেয়েছিলেন ঋত্বিক ঘটক, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, শম্ভু মিত্র প্রমুখ ব্যক্তিত্বকে। বিজন ভট্টাচার্য মার্কসীয় দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন। কৃষক শ্রমিক মেহনতী মানুষের জীবন সংগ্রামের কথা ও বাঁচবার কথা তাঁর নাটকগুলির মুখ্য বিষয় হয়ে উঠেছিল। কিন্তু আস্তে আস্তে তিনি এই ভাবনা থেকে সরে যান। গণনাট্য সঙ্ঘ ত্যাগ এবং নিজের নাটকের দল একাধিক বার ভেঙে গড়ে তিনি তৈরি করেন। ক্রমে মার্কসীয় দর্শনের পরিবর্তে বা সঙ্গে তাঁর রচনায় লোকায়ত ধর্ম দর্শন, হিন্দু ধর্মের সমন্বয় প্রয়াসী মানসিকতা কাজ করেছিল। চিরকালীন মাতৃকা ভাবনা তাঁর নাটকে প্রায়ই লক্ষ্য করা যায়। আর তাই সেই মানবিক শিল্পী মানুষ, কমিউনিস্ট নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্যকে কুর্নিশ জানাতে যেন ভুলে না যাই।

১১.
অধ্যাপক পবিত্র সরকার ‘তবু তিনি ইতিহাসের শিকার হয়ে গেলেন’ স্মৃতিচারণে লিখছেন,‘বিশ শতকের বাংলা নাট্যকলার ইতিহাসে ট্র্যাজিক নায়কের বিপজ্জনক প্রথম শিরোপা যদি শিশিরকুমার ভাদুড়ির প্রাপ্য হয়, তা হলে ওই শিরোপার দ্বিতীয় দাবিদার সম্ভবত বিজন ভট্টাচার্য। তাঁর যে ছবিগুলি আমাদের সামনে আসে, তার মধ্যে থেকে একটি বিষাদের ছায়া যেন কিছুতেই সরে যেতে চায় না। তাঁর এই ম্লান মূর্তিটি কে এমন চিরস্থায়ী করে নির্মাণ করেছে? তিনি নিজে, না তাঁর জীবন ও সময়— সেটাই প্রশ্ন। অথচ এমন নয় যে, তিনি খুব বিষণ্ণ ও মুষড়ে-পড়া মানুষ ছিলেন। মাঝে মাঝেই তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে, তাঁর পারিবারিক জীবনের বৃত্তান্ত জানা সত্ত্বেও তখন এ কথা খুব একটা মনে হয়নি, আবার খুব কাছে থেকে সংক্ষেপে যতটুকু দেখার সুযোগ হয়েছে, তাতে দেখেছি তিনি বেদম মজাদার লোক ছিলেন। বন্ধুদের সঙ্গে, এমনকী আমাদের সঙ্গেও, প্রচুর অকথা-কুকথা বলতেন, মনের কথা খোলাখুলি বলতেও তাঁর দ্বিধাসংকোচের বালাই ছিল না। যাঁদের গুরুগম্ভীর মহত্ত্বের চেহারা ছিল, সে চেহারা যতই সংগত ও বৈধ হোক, তার প্রতি হুল্লোড়পূর্ণ অসম্ভ্রম প্রকাশে তিনি বিশেষ উল্লাস বোধ করতেন। কখনও গানে, কখনও ছড়ায়, কখনও নিতান্ত লৌকিক রসালাপে তিনি নিজেকে বিচ্ছুরিত করতেন, ফলে তাঁর সঙ্গ সব সময় আনন্দময় ছিল— সে আনন্দ ততটা ‘বিশুদ্ধ’ না হলেও।’

১২.
এক অস্থির সময়ের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন বিজন ভট্টাচার্য। সেই সময় মহাযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষের ছায়া পড়েছিলো তাঁর লেখা নাটকে ‘নবান্ন’এ। ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের প্রযোজনায় বিজন ভট্টাচার্য ও শম্ভু মিত্রের যৌথ পরিচালনায় নবান্ন প্রথম মঞ্চস্থ হয়েছিলো ১৯৪৫সালের ২৪শে অক্টোবর। সেই নাটকের গান, ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম মিথ্যা সে বয়ান। হিন্দু মুসলমান যতেক চাষী দোস্তালি পাতান।। এছাড়া আর উপায় নেই সার বুঝ সবে। আজও যদি শিক্ষা না হয় শিক্ষা হবে কবে।। বুঝে শুনে যে বা জন পৃথক হয়ে রয়। ছয় মাসের মধ্যে এন্তেকাল ফরমায়।’ এই সময়েও কী তাঁর এ বক্তব্য প্রাসঙ্গিক নয়? তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত নাটক নবান্ন’র প্লট সম্পর্কে নাট্যকার নিজেই বলেছেন, ‘একদিন ফেরার পথে কানে এলো, পার্কের রেলিঙের ধারে বসে এক পুরুষ আর এক নারী তাদের ছেড়ে আসা গ্রামের গল্প করছে, নবান্নের গল্প, পুজো-পার্বণের গল্প। ভাববার চেষ্টা করছে তাদের অবর্তমানে গ্রামে তখন কী হচ্ছে?’ তাঁর আর এক বিখ্যাত নাটক ‘মরাচাঁদ’ দিনাজপুরের এক দৃষ্টিহীন দোতারাবাদক টগর অধিকারীর জীবনের ছায়ায় লেখা৷ সে নাটকের ভূমিকায় বিজন নিজেই জানিয়েছেন সে কথা, ‘একদিন ভাওয়াইয়া ও চটকা গানের রূপ ও চলন নিয়ে কথা হচ্ছে— হঠাৎ বিষণ্ণ ভাওয়াইয়ার একটি মূর্ছনা দোতারায় তুলে টগর অধিকারী সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক ভাবে বললেন, বিজনবাবু আমার যে তা এট্টা বিয়া করা লাগে... টগর বিয়েও একটা করেছিল৷ উত্তরবঙ্গেরই পল্লিগ্রামের একটি সুন্দরী মেয়ে৷ সংসারও একটা পেতেছিল দোতারা সম্বল করে৷ কিন্তু টগর অধিকারীর সুখের সংসার বেশিদিন টেঁকেনি৷ ...সেই দোতারা নাকি চিরকালের জন্য থেমে গেছে৷ মারা গেছে টগর অধিকারী৷’ মন্বন্তর পর্ব পার করে ৭০’এর দশক সময় নিয়ে লিখেছিলেন নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য, ‘শিল্প সাহিত্য এমন কোনো জায়গা নয় যে যেখানে তুমি মাস্তানি করবে। এখন যা দরকার তা হলো কনশাস ইনভলবমেন্ট।...১৯৭০সেই ভয়ঙ্কর সময়টা। আগামী ১০বছর নাটকের ক্ষেত্রে এক মারাত্মক জীবনযুদ্ধে তোমাকে লড়াইটা ক্রমাগত চালিয়ে যেতে হবে।’ 

১৩.
বিজন ভট্টাচার্য নিজেই বলেছেন, ‘রাজনৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিল্পীর দায়ভার আজ গোটা দেশের মানুষের জীবনজিজ্ঞাসা। রাজনীতিক দেখবেন এক চোখে। কেননা দু-চোখ খুলে দেখবার ব্যাপারটা তাঁর ধর্মে বারণ আছে। কিন্তু শিল্পী দেখবেন তাঁর খোলা দু-চোখে। সাধারণ মানুষের জান-এর লড়াইয়ের সঙ্গে প্রাণের লড়াইও তাঁকে চালিয়ে যেতে হবে। শিল্পী হিসেবে এই দায় আমি আজ সমধিক বলেই বিশ্বাস করি। প্রবচন আছে– চুরিবিদ্যা মহাবিদ্যা যদি না-পড়ো ধরা। রাজনীতিক্ষেত্রে এই কারচুপির রেওয়াজ আছে। অর্থাৎ যুগপৎ গৃহস্থকে সজাগ থাকতে বলে গৃহস্থের ঘরেই সিঁধকাঠি দাও; যত দিন না গৃহস্থের চৈতন্য হয়। শিল্পকর্মে এই কারচুপি কিন্তু শিল্পেরই গলা টিপে মারে। সঙ্গীত, নাটক, কি কাব্য– কোনটাই শিল্প হিসেবে ওতরায় না।’

১৪.
ঋত্বিক ঘটক এবং বিজন ভট্টাচার্যের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে এক আলোচনায় রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরী সুন্দর করে বলেছিলেন, ‘ঋত্বিক ঘটক বিজন ভট্টাচার্যের থেকে ১০ বছরের ছোট ছিলেন। কিন্তু দু'জনের মধ্যে গভীর সম্পর্ক ছিল। ঋত্বিকের ছবিতে বিজন ভট্টাচার্য অভিনয় করে অন্যমাত্রা এনে দিয়েছেন। যুক্তি-তক্ক-গপ্প, মেঘে ঢাকা তারা ছোট্ট ভূমিকায় অভিনয় করলেও কাহিনীর আসল সার কথা তিনিই বলেছেন। শিল্পের জগত থেকে ঋত্বিক-বিজন-মানিককে সরিয়ে রাখা হত। নবান্নের আগে ডোমেস্টিক ট্র্যাজেডি ছিল, বিজন ভট্টাচার্য সেখানে প্রথম এপিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নাটক লেখা শুরু করলেন। ঋত্বিক চলচ্চিত্রে এপিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিচায় করালেন। ভায়লেন্সকে ব্যবহার করেছেন ঋত্বিক। বিজন ভট্টাচার্যও নাটকে তাই করেছেন। দেবীর ক্রোধকে জন চিত্তে ধারণ করে দেখিয়েছেন। বিজনবাবুর নাটকে উচ্ছ্বাস আছে, অবদমনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আছে। 'সারে চুয়াত্তোর' সিনেমার চিত্রনাট্য লিখেছিলেন বিজন ভট্টাচার্য। তাই সেখানে মেশবাড়ির চরিত্রগুলিকে সমান গুরুত্ব দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। 'মেঘে ঢাকা তারা'-এ নীতার বাবার ভূমিকায় অভিনয় করতে গিয়ে বিজন ভট্টাচার্য় নিজেকে অভিযুক্ত করেন। একদিকে তাঁর সন্তান স্নেহ, অন্যদিকে পরিবার-দেশ-রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে। 'যুক্তি তক্ক গপ্প' ভগ্ন স্তুপ থেকে রেসকোর্সের মাঠ, সেখান থেকে বার সব জায়গায় গেছেন বিজন-ঋত্বিক দু'জনে। সেখানে দেখিয়েছেন শহরের মানুষ গড্ডলিকা প্রবাহে কেমন চলেছে। সেখানে বসে বিজন ভট্টাচার্য উপনিষদ থেকে মন্ত্র আউড়েছেন। ইতিহাসবোধের কাছে বারবার ফিরে ফিরে আসছেন দুই ব্যক্তিত্ব। দু'জনেই ব্যর্থ মানুষের কাহিনী লিখে গেছেন তাদের শিল্পকর্মের মধ্যে দিয়ে। ঋত্বিক-বিজনকে বাদ দিলে কলকাতার কিছুই থাকে না।’

১৫.
বাংলার নাট্য ইতিহাসে বিজন ভট্টাচার্য আর তাঁর নাটক ‘নবান্ন’ যেন একাকার হয়ে মিশে আছে, থাকে।এই নাটক সময়ের জীবন্ত মানবিক দলিল।তাই এই নাটক নিয়ে একটু বড় পরিসরে আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক নয়। কারণ নবান্ন সম্পর্কে নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য নিজেই বলেছেন - ‘আবেগ না হলে বোধহয় কবিতার জন্ম হয় না - অনুভূতি না থাকলে জীবনযন্ত্রণা না থাকলে কোনো সৃষ্টিই বোধহয় সম্ভব নয়।’ আর তাই নবান্ন নাটক নিয়ে আলোচনার শুরুতেই ফিরে তাকাতে হয় ইতিহাসের দিকে, যে-ইতিহাসের আয়নায় ধরা পড়ে দেশকাল পরিপ্রেক্ষিতের চিত্র। ইতিহাস জন্ম দেয় নতুন কাল নতুন সময় ও নতুন ঘটনার। একেকটা যুগ পার হয় আর মানুষের চিন্তায় ও মননে সময়ের প্রতিচ্ছবির ছাপ সুস্পষ্ট হয় এবং তা থেকেই জন্ম নেয় নব-নব দৃষ্টিভঙ্গির। সেই দৃষ্টিভঙ্গির ক্রোড় থেকে বেরিয়ে আসে যুগান্তকারী কোনো বিশেষ সৃষ্টি যা কিনা আবহমান নদীর মতো ধাবিত হয় সময়ের হাত ধরে, অবশ্য সেটা দেশকাল ও রাজনীতির আঙিনায়। যা কিনা মানুষের চেতনার দরজায় আঘাত করে। নবান্ন এমনই এক সৃষ্টি। নবান্ন নাটক নিয়ে আলোচনায় আমরা ফিরে তাকাব নবান্ন রচনার ঠিক আগে বিশ্বের রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে। ১৯৪০ থেকে ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার রাজনৈতিক জীবনে শুরু হয়েছিল ঘন ঘন পরিবর্তন। আর তারই ফলে জাতির জীবনে নিদারুণ দুর্যোগ নেমে এসেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা বিপর্যস্ত করে তুলেছিল মানুষের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডকে এবং স্বাভাবিক বেঁচে থাকা ব্যাহত হতে শুরু করেছিল সমগ্র বিশ্বে। নাৎসিবাদের অভ্যুত্থানের পর থেকেই চলছিল গণতন্ত্রের নিধন, প্রগতিমান সংস্কৃতির নিষ্ঠুরতম অবদমন। আর তখনই ফ্যাসিবাদ ও যুদ্ধের প্রতিরোধে সংগঠিত হয়েছিল আন্তর্জাতিক বুদ্ধিজীবীদের আন্দোলন। বিশ্ববন্দিত বুদ্ধিজীবীদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়েছিলেন ভারতীয় লেখক-শিল্পীবৃন্দ। আর তার পৌরোহিত্য করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। স্পেনের গণতন্ত্র রক্ষার সপক্ষে, আবিসিনিয়ার স্বাধীনতা হরণের প্রতিবাদে, মিউনিখে মুক্তিফৌজের মৃত্যুঞ্জয়ী সংগ্রামের সমর্থনে রবীন্দ্রনাথ ভারতীয়দের উদ্দীপ্ত করেছিলেন। বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলো। ১৯৪১-এ হিটলার বাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হলো সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন। ভারতীয় প্রগতিবাদীরা বিশ্বাস করলেন, বিশ্বমানবতা বিপন্ন কেননা সোভিয়েত দেশ বিশ্বমানবতার দুর্গ। এ যুদ্ধ জনযুদ্ধ। গঠিত হলো সোভিয়েত সুহৃদ সমিতি। ফ্যাসিবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ, ভারতীয় গণনাট্য সংঘ। ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী স্বাধীনতা গণতন্ত্র সমাজতন্ত্রের সপক্ষে সংগ্রামের এক দৃপ্ত সৈনিক বিজন ভট্টাচার্যের লেখনী ক্ষুরধার হয়ে উঠল। ১৯৪৩ সালে অবিভক্ত বাংলায় দেখা দিলো এক ভয়ঙ্কর মন্বন্তর। লাখ-লাখ লোকের মৃত্যু হলো। মুখিয়ে উঠল চারিদিকে সামাজিক অবক্ষয়। অবিভক্ত বাংলার যন্ত্রণা নিঙড়ে জন্ম নিল বলিষ্ঠ সাংস্কৃতিক সংগ্রাম। আর এই সংগ্রামের গভীর থেকে বিজন ভট্টাচার্য আত্মপ্রকাশ করলেন নাট্যকার রূপে। অস্থির রাজনীতির ভেতর নবান্ন নাটকের জন্ম। নবান্ন নাট্যকারের ‘সাফল্যের মাইলস্টোন’। নবান্ন অভিনীত হয় ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের ২৪ অক্টোবর। শ্রীরঙ্গম রঙ্গালয়ে (বর্তমান বিশ্বরূপা)। চার অঙ্ক ও পনের দৃশ্যে বিভক্ত নবান্ন। চরিত্র সাঁইত্রিশটি, এছাড়া অন্নহীনের দল ও জনতাও রয়েছে। নাটকটির পটভূমি আগস্ট বিপ্লব (১৯৪২ সালের)। আমিনপুরের একটি চাষী পরিবার প্রধান, প্রধান সমাদ্দার। আগস্ট বিপ্লবে দুই পুত্র হারায়। তারপর শুরু হয় খাদ্যাভাব। দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাসে নিপতিত হয় আমিনপুর গ্রামের চাষীরা। দু’মুঠো অন্নের আশায় অসহায় চাষীরা একত্রিত হলো শহরে। কিন্তু অভিজ্ঞতা হলো বেদনাদায়ক। অনেক দুঃখ কষ্ট সহ্য করে একে একে সবাই আমিনপুরে ফিরে আসে। সঙ্ঘবদ্ধভাবে চাষ করে সবাই, মিলিত ভাবে বাঁচার শপথ গ্রহণ করে। শুরু হয় নবান্ন উৎসব। প্রতিরোধের তীব্র উচ্চারণের মধ্য দিয়ে শেষ হয় নাটকটি। লক্ষণীয়, নাটকে প্রধান হয়ে উঠেছে কৃষক তথা শ্রমজীবী শ্রেণী। একজন নায়কের প্রথাসিদ্ধ ব্যবহার নয়, সমগ্র জনতাই এখানে নায়ক-এই প্রচেষ্টা নতুন। বক্তব্য ও আঙ্গিকে নবান্ন এক নতুন নির্মাণ। এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয়, গণনাট্যের মূল বৈশিষ্ট্যসমূহের দিকে দৃষ্টি দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। (ক) গণনাট্যের নাটকের কাহিনী আবর্তিত হবে জীবনের বাস্তব সমস্যাকে কেন্দ্র করে। (খ) এখানে থাকবে সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ। (গ) প্রেমানুগ নাটকের নায়কের মহিমার পরিবর্তে এখানে স্বীকৃত হলো গোষ্ঠীর মূল্য। ব্যক্তির পরিচয় এখানে শ্রেণী প্রতিনিধি হিসাবে। (ঘ) সাধারণ দর্শক, বিশেষ করে কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষের মনোরঞ্জনের ও তাদের চেতনার জাগরণ ঘটাবে এ নাটক। (ঙ) গণ-সঙ্গীতের তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা থাকবে এ ধরনের নাটকে। উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহের প্রতিফলন এ নাটকে আমরা দেখতে পাই। বিজন ভট্টাচার্য এভাবেই শিল্পী হিসেবে কলম তুলিতে, নাটকের ক্যানভাসে সমাজের ‘কনশাস ইনভলবমেন্ট’কে নান্দনিকতায় এঁকেছেন, সফলভাবে চিত্রায়িত করেছেন।

(তথ্যসূত্র : বাংলাপিডিয়া, কালি ও কলম, নতুন দিগন্ত, দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা, দেশ, দৈনিক গণশক্তি, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত