জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

কবি বিষ্ণু দে

প্রকাশ : ১৮ জুলাই ২০১৮, ১২:২০

১.
কবি, প্রাবন্ধিক, চিত্রসমালোচক ও শিল্পানুরাগী বিষ্ণু দে । প্রখ্যাত গায়ক মান্না দে’র গান স্মরণ করে বলি ‘কখনো বিষ্ণু দে, কখনো যামিনী রায়, এই নিয়ে আড্ডাটা চলতো।’ একদম খাঁটি কথা, সঠিক মূল্যায়ণ। আড্ডার-আলোচনার সেই কবি বিষ্ণু দে ১৯০৯ সালের ১৮ জুলাই (২ শ্রাবণ, ১২১৬ বঙ্গাব্দ) কলকাতার পটলডাঙ্গায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, ১৯৮২ সালের ৩ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন তিনি। বিষ্ণু দে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের একজন বিখ্যাত কবি। সমালোচকদের মতে, মার্কসীয় তত্ত্বকে জীবনাবেগ ও শিল্পসম্মত করে উপস্থাপনার ক্ষেত্রে তাঁর সাফল্য অপরিসীম। বিষ্ণু দের মধ্যেই প্রথম রাবীন্দ্রিক কাব্যবলয় অতিক্রমণের প্রয়াস লক্ষ করা যায়। রবীন্দ্রনাথের পরে আধুনিক বাংলা কবিতায় নতুন ধারা সৃষ্টিতে তারও ভূমিকা আছে। তিরিশের কাব্যধারায় বাংলা কবিতায় নতুন ভাব ও নতুন ভঙ্গি দেখা দেয় । যারা প্রধানত এই নতুন ভাবভঙ্গি এনেছিলেন, তাদের বলা হয় তিরিশের কবি। বিষ্ণু দে এদেরই একজন। অন্যরা হলেন জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী ও বুদ্ধদেব বসু। বিখ্যাত বাঙালি কবি লেখক এবং চলচ্চিত্র সমালোচক বিষ্ণু দে ১৯৭১ সালে তাঁর ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ’ বইটির জন্য ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার জ্ঞানপীঠ লাভ করেছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় কবি বিষ্ণু দে পালন করেছেন গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা।

২.
বিভিন্ন কবি-লেখক-সাহিত্যিক-শিল্পীর জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে আমি বাংলাপিডিয়ার পাশাপাশি আমাদের বাংলা একাডেমি এবং কলকাতার সাহিত্য একাডেমির (তাদের ভাষায় অকাদেমি) বই-পুস্তকের অকৃপণ সহযোগিতা নিয়ে থাকি। তাছাড়া এদের প্রকাশিত তথ্যগুলোর গ্রহণযোগ্যতা তুলনামূলক বিচারে বেশি সঠিক বলেই অন্য অনেক গবেষকের মতই আমিও বিবেচনা করে থাকি। কবি বিষ্ণু দে কে নিয়ে লিখতে গিয়েও তাই অরুণ সেনের লেখা কবির ছোট্ট কিন্তু তথ্যবহুল সুন্দর জীবনীটির পাঠ নিয়েছি।সেখান থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেও অন্যান্য আরো অনেক লেখার মতই এখানেও স্থান ও পরিসরের স্ফীতাকারের সীমাবদ্ধতার সূত্র মেনে আমাকে রক্ষণশীল হতেই হচ্ছে, লেখার আকার বা আয়তন প্রয়োজন অনুযায়ী বড় করা যাচ্ছে না বলে মনের অস্বস্তি দূর হচ্ছে না।

৩.
কবি বিষ্ণু দে শৈশবেই রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা সংক্রান্ত রচনাগুলো পাঠ করে এতটাই আলোড়িত হলেন যে, তিনি ঠিক করলেন স্কুলের পড়ালেখাই ছেড়ে দেবেন। ‘আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সব ভুল’ বলে মনে করে তিনি স্কুল জীবনেই চরম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বিরোধী হয়ে ওঠেন। যা তাঁর লেখাপড়ার স্বাভাবিক গতিতে ছেদ আনে।বয়ঃসন্ধির এই পর্বে কয়েকজন শিক্ষক অবশ্য তাঁকে ভীষণভাবে সাহায্য ও অনুপ্রাণিত করেন। ফলে পাঠ্য বইয়ের বাইরের বই পড়েও তিনি জীবনের গন্তব্যপথ হারাননি, লক্ষভ্রষ্ট হননি। শিক্ষকদের এবং অসম্ভব দূরদর্শী বাবার পরম সাহচর্য ও সহযোগিতাই তাই তাঁর জীবনে তেমন বিশেষ নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারেনি বলেই জানা যায়।পারিবারিক, ব্যক্তিগত এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগার তাঁর জীবন বিকাশেও বিশেষ ইতিবাচক ভূমিকা রাখে বলে তিনি আজীবন স্বীকার করে গেছেন।

৪.
রবীন্দ্র-উত্তর বাংলা কবিতার অন্যতম প্রাধান স্থপতি কবি বিষ্ণু দে (১৮ জুলাই ১৯০৯ - ৩ ডিসেম্বর ১৯৮২)। মার্কসবাদী চেতনাই ছিল তাঁর কবিপ্রতিভার মৌল ভিত্তি।যদিও জন্মেছিলেন তিনি রক্ষণশীল গোঁড়া হিন্দু পরিবারে।কাব্য জীবনের প্রথম থেকেই তিনি ব্যতিক্রমী মনীষার দীপ্তিতে উজ্জ্বল, মার্কসবাদী চেতনায় ঋদ্ধ। কবিতার বিষয় নির্বাচন এবং প্রকরণ-প্রসাধনে বিষ্ণু দের স্বকীয়তা বাংলা কবিতার এক বিরল সম্পদ। আমরা সবাই জানি, বিষ্ণু দে-র কবিতার একটা মূল ব্যাপারই হল, সেখানে সমকালীন জীবনের, দেশ ও কালের, রাজনীতি ও সমাজের প্রতিধ্বনি। দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝখানের সময়টা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, তেভাগা-আন্দোলন ইত্যাদি থেকে শুরু করে স্বাধীনতার পরের ঘটনাবহুল জীবন ও আন্দোলন তাঁর কবিতায় সরাসরি ছায়া ফেলে। সমালোচক অরুণ সেন লিখছেন, ‘বিষ্ণু দে-র কবিতার ভিন্ন চারিত্র্য যদি একদা বহু পাঠককে স্পর্শ করে থাকে – তাঁর কবিতার বিস্তার ও সমগ্রতা, তাঁর কবিতার ভাষা ও বাচনের স্বরূপকে ভর করে সেই পাঠকের প্রস্তুতি যদি একসময়ে তৈরি হয়ে যায় – আজ সমাজ রাজনীতি বা সংস্কৃতির পরিবেশের নিঃস্বতায় যদি সেই প্রস্তুতি আড়ালে চলে গিয়েও থাকে সাময়িকভাবে – কবিতার সেই উচ্চারণ কি আবার শোনা যাবে না, যদি তার মধ্যে আবহমান ও অবিনাশী সত্য কিছু থেকে থাকে। পাঠকের অপ্রস্তুতি বা অন্যমনস্কতার দায় কেন বহন করতে হবে সেই লেখককে যিনি সমগ্রের সঙ্গে অবিরল সংলগ্নতা ছাড়া বাঁচেন না? কেন অপেক্ষা করতে হবে সীমাবদ্ধ সেই দীক্ষিত পাঠকের জন্যই শুধু? অবশ্য সেই দীক্ষিত পাঠকের পক্ষপাত মানে এই নয় যে, সেই লেখকের সব লেখা সম্পর্কেই তাঁর সমান প্রশ্নাতীত অনুরাগ থাকতেই হবে। কিংবা, উলটো করে বলা যায়, যে-লেখক সম্পর্কে কোনো পাঠক তুলনায় উদাসীন, সেই লেখকের কোনো লেখাই ভালো লাগবে না বা লেখার কোনো গুণই ধরা পড়বে না – তাই বা হবে কেন? বিষ্ণু দে-র কবিতার অনুরাগী পাঠকও তাঁর সব কবিতা সম্পর্কে সমান আগ্রহী হবেন, এমন তো নাও হতে পারে। সমকালীন পাঠক যেমন, তেমনই পরবর্তীকালের পাঠকও – তিনি যখন বিষ্ণু দে-র কাব্যসম্ভাবে উদ্দীপ্ত তখনও কবির কোনো কোনো কবিতায় সাড়া নাও দিতে পারেন।’

৫.
কবি আধুনিক কালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ও চিন্তাশীল ব্যক্তিত্ব| শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর কোনো এক বিদেশি চিত্রকরকে উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, ‘শিল্প আনন্দভ্রমণ নয়, সংগ্রাম।’ কবিতাও সংগ্রাম, সংস্কৃতির সংগ্রাম। বিষ্ণু দের কবিতায় সেই সংগ্রামের ধ্বণি প্রতিধ্বণিত হয়। সাহিত্য সমালোচকগণ বলছেন, বিষ্ণু দে মনীষা ও আবেগের সমন্বয়জাত, দেশজ ঐতিহ্য ও বিশ্ব সাহিত্যের বিচিত্র ঐতিহ্যকে আত্মস্থ করেছেন। তাঁর কাব্যচিন্তার গঠনে যেমন ইউরোপীয় আধুনিক কবিদের দান অতি স্পষ্ট, তেমনই প্রভাবশীল মার্কসীয় দর্শন| যদিও জীবনের কোন এক সময়ে তিনি কমিউনিস্ট নেতৃত্বের প্রতি আস্থাহীনতার দোলাচলের মধ্যেও কাটিয়েছেন, যা তাঁর বেশ কিছু কবিতায় ফুটে উঠেছে | রাজনীতি ও সামাজিক আন্দোলনের প্রতি সচেতনতা, বাংলাদেশের লৌকিক জীবনচর্চার প্রতি অনুরাগ, ব্যঙ্গপ্রিয়তা এবং ইতিহাস বোধ, ছন্দের সুচারু ব্যবহার, অপ্রত্যাশিত মিলের চমকে, শব্দ প্রয়োগের নৈপুণ্যে এবং সর্বোপরি এক বিরাট বিশ্ব ও মানবিকবোধে আধুনিক কবি সমাজে বিষ্ণু দে অপ্রতিদ্বন্দ্বী | তিরিশ কালপর্বে কবিরা প্রচল কাব্যধারার পরিবর্তনের তাগিদ অনুভব করেছিলেন। ফলে তাদের কবিতায় শ্রমজীবী ও জনতাভিত্তিক সমাজচেতনার উন্মেষ দেখা যায়। বাংলা সাহিত্যে একসময় উপেক্ষিত ও বিতর্কিত মার্কসবাদ তিরিশের কবিদের আবেগে মনন যুগিয়েছে একথা নির্দ্ধিধায় বলা যায়। এ পর্বের কবিরা নিজেদের অ্যান্টি-রোমান্টিক আখ্যা দিয়ে রবীন্দ্রদর্শন ত্যাগ করে নৈরাশ্যবাদী ভাবধারায় কবিতা চর্চার প্রাণান্তকর চেষ্টা করেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ফ্যাসিস্টবিরোধী ভূমিকায় দায়বদ্ধতার প্রশ্নে বিষ্ণু দেও এ পথে শামিল হন, এ ধারায় ক্রমশ তার শৈল্পিক অবস্থান স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাংলা সাহিত্যের মহীরুহ রবীন্দ্রবিযুক্তির প্রত্যয়ে বাংলা কবিতায় বিষ্ণু দে যে ভাবাদর্শে তার কাব্যসৌধ নির্মাণ করেছেন, তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য পশ্চিমা জ্ঞান ও দর্শন দ্বারা প্রভাবিত এবং পূর্বসূরি জারিত। তার কবিতার বিমুগ্ধ পাঠে ধরা পড়ে মার্কসীয় মতাদর্শ। সমকালীন যুগযন্ত্রণা এবং আধুনিকতার সঙ্গে ঐতিহ্যের সমন্বয় এবং স্বদেশ চিন্তাও তার কবিতার একটি বিশেষ লক্ষণ। বেঁচে থাকার তাগিদে এ পর্বের কবিরা মানুষের মৌলকাক্সক্ষার দাবিতে প্রতিবাদী চেতনা তুলে আনতে সচেষ্ট থেকেছিলেন তাদের কবিতায়। যা বিশ্বসাহিত্যে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা হিসেবে স্বীকৃত। তবে মার্কসীয় দর্শনতাড়িত হলেও বিষ্ণু দে নিজে কোনো মতবাদ প্রতিষ্ঠিত করেননি। তিনি সচেতনভাবেই কবিতায় দর্শন ও বিজ্ঞানের মিশেল ঘটিয়েছেন। তার কবিতায় যেমন আছে নিসর্গ চেতনা তেমনি আছে ভক্তিবাদ ও যুক্তিবাদের প্রবল উপস্থিতি। আছে মিথ-পুরানের সফল প্রয়োগ। তৎকালীন ভারতবর্ষে সমাজবাদী রাজনৈতিক সংস্কৃতি নির্মাণে সাংস্কৃতিক ধীমানরা বিদেশী সাহিত্যে নিজেদের মুক্তি খুঁজেছিলেন। এ ধারায় অগ্রবর্তী কবি বিষ্ণু দের অধিকাংশ কবিতায় মার্কসীয় আদর্শের তাত্ত্বিক ঘোষণা স্পষ্ট হয়। তিনি মনে করতেন সমাজতান্ত্রিক চেতনা ভিন্ন মানবিক চেতনার বিজয় অসম্ভব। সুতরাং বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে তার কবিতায় মৃত্যুহীন মানুষের জয়গাঁথা রচিত হয় অনায়াসে- অমর দেশের মাটিতে মানুষ অজেয় প্রাণ,/ মুঢ় মৃত্যুর মুখে জাগে তাই কঠিন গান।/ হে বন্ধু জেনো, আজ যবে খোলে মুক্তিদ্বার,/ দেশে আর দশে ভেদাভেদ শুধু ভীরুতা ছার!

৬.
তিরিশি আধুনিকতায় যে স্বল্পসংখ্যক কবি বাংলা কবিতার পালাবদল ঘটিয়েছিলেন, তাদেরই একজন বিষ্ণু দে। রবীন্দ্রোত্তর যুগের অন্যতম প্রধান কবির বিশেষণেও ভূষিত করা হয়ে থাকে এই কবিকে। জীবনানন্দ দাশ, সুধীনদত্ত, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখ তিরিশি কবিকে নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা হলেও বিষ্ণু দে সে তুলনায় খুব কমই আলোচিত। বলা যায় বিষ্ণু দে পাঠকও সীমিত। কিন্তু আধুনিক বাংলা কাব্যের ইতিহাসে অনিবার্য এই নাম। বিষয় বৈচিত্র্যে, ভাষা আর আঙ্গিকের নিরীক্ষায়, দার্শনিক প্রজ্ঞায় আলোকিত তার কবিতা বোধ্যতা আর দুর্বোধ্যতায় কবিতার আলো-আঁধারি পথে চলতে গিয়ে বিষ্ণু দে নিরন্তর নিজেকে ভাংচুর করেছেন। মার্কসবাদী দর্শনের সঙ্গে মিলে-অমিলে বিতর্কিত হয়েছেন প্রবলভাবে। একদিকে প্রাথমিক পর্যায়ে এলিয়টীয় নৈঃসঙ্গ আর হতাশার বোধে প্রবলভাবে আক্রান্ত তার কবিতা; অন্যদিকে পরিণত পর্বে সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বাংলার শোষিত বঞ্চিত মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছে তার প্রত্যয়ী-আশাবাদী কবিতা। মার্কসবাদে বিশ্বাসী সমাজসচেতন একজন কবি বিষ্ণু দে। স্বভাবতই তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে লোকায়ত বিভিন্ন চরিত্র ও অনুষঙ্গ। প্রাচ্য ও প্রতীচ্য পুরাণের নান্দনিক প্রয়োগ তাঁর কবিতায় ভিন্নমাত্রা পেয়েছে। ‘উর্বশী’, ‘আর্টেমিস’, ‘শ্রীকৃষ্ণ’, ‘হেক্টর’, ‘ইউলিসিস’ প্রমুখ তাঁর কবিতায় বিচিত্র রূপ নিয়ে রূপায়িত হয়েছে। সাত ভাই চম্পা কাব্যের নামটিই লোকজ চেতনার স্মারক। আহমদ রফিকের ভাষ্যে পাই, ‘বিষ্ণু দে র কাব্যব্যক্তিত্বে জটিলতা যেমন সত্য তেমনি সত্য প্রাথমিক পর্বের কবিতায় এলিয়ট প্রভাবিত দুর্বোধ্যতার আভাস সেই সঙ্গে আদর্শগত দ্বন্দ্ব।’

৭.
বিষ্ণু দে’র পিতার নাম অবিনাশচন্দ্র দে এবং মায়ের নাম মনোহারিণী দেবী। বাবা ছিলেন অ্যাটর্নি। বিষ্ণু দে কলকাতারই ছেলে এবং কলকাতায় তিনি পুরো জীবন কাটিয়েছেন। কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউট ও সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুলে বিষ্ণু দে অধ্যয়ন করেন। ১৯২৭ সালে তিনি এ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। তারপর বঙ্গবাসী কলেজ থেকে আইএ (১৯৩০), সেন্ট পলস কলেজ থেকে ইংরেজিতে বিএ অনার্স (১৯৩২) ডিগ্রি লাভ করেন। প্রথম থেকেই তিনি ইংরেজিতে খুব ভালো ছিলেন এবং বিএ পরীক্ষায় ইংরেজিতে ভালো করার জন্য পুরস্কারও পান। ১৯৩৪ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এমএ পাস করেন। পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৩৫ সালে কলকাতা রিপন কলেজে ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এখানে তিনি সহকর্মী হিসেবে পেয়েছিলেন কবি বুদ্ধদেব বসুকে। তিনি ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবেই বিভিন্ন সরকারি কলেজে চাকরি করেছেন। ১৯৪৪ থেকে ১৯৪৭ সময়কাল মৌলানা আজাদ কলেজে এবং ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৯ সময়কাল কৃষ্ণনগর কলেজে তিনি অধ্যাপনা করেন। ১৯৬৯ সালে চাকরি থেকে অবসর নেন। ততোদিনে তিনি বাংলা সাহিত্যের এক অতি সম্মানিত কবি। ১৯৮২ সালের ৩ ডিসেম্বর তিনি পরলোকগমন করেন। বিষ্ণু দের স্ত্রীর নাম প্রণতি দে। তাঁদের বিয়ে হয়েছিল ১৯৩৪ সালে।

৮.
তরুণ বয়স থেকেই বিষ্ণু দে একজন উদীয়মান কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। কলকাতায় যেসব নতুন সাহিত্যিকগোষ্ঠী জন্ম নিয়েছিল, তাদের পত্রিকায় বিষ্ণু দে লিখতেন। বিষ্ণু দেই প্রথম স্পষ্টভাবে বলেন, তরুণ কবিদের রবীন্দ্রনাথের প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়া উচিত। ১৯২৩ সালে কল্লোল পত্রিকা প্রকাশের ফলে যে নতুন সাহিত্য উদ্যম ও ব্যতিক্রমী শিল্প চেতনার সৃষ্টি হয়, বিষ্ণু দে ছিলেন তার অন্যতম উদ্যোক্তা। কিন্তু ১৯৩০ সালে কল্লোল পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেলে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয় এবং তিনি সুধীন্দ্রনাথের ‘পরিচয়’ পত্রিকার সঙ্গে দীর্ঘদিন যুক্ত ছিলেন, ১৯৪৭ পর্যন্ত এর সম্পাদক মন্ডলীর অন্যতম সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে তিনি চঞ্চলকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সহযোগিতায় ‘সাহিত্যপত্র’ নামে একটি রুচিশীল পত্রিকা সম্পাদনা করেন (১৯৪৮)। তিনি নিজেও নিরুক্ত নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন। বিষ্ণু দে কলকাতার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ প্রকাশের মাধ্যমে তাঁর সাহিত্য জীবন শুরু করেন। শুধু সাহিত্য বিষয় নয়, শিল্প, সঙ্গীত ও সংস্কৃতির বিবিধ বিষয় নিয়ে তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত রচনা অভিনন্দিত হয়েছে। গদ্য ও পদ্যে তাঁর বহু সংখ্যক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ক্যালকাটা গ্রুপ সেন্টার, সোভিয়েত ফ্রেন্ডশিপ অ্যাসোসিয়েশন, প্রগতি লেখক শিল্পী সংঘ, ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েসন, ভারতীয় গণনাট্য সংঘ প্রভৃতি সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি ছবিও আঁকতেন।

৯.
কবিতার বই ছাড়া বিষ্ণু দের অনেক গদ্য রচনাও আছে। তিনি একজন মননশীল প্রাবন্ধিক ও সমালোচক। তার কয়েকটি ইংরেজি বইও রয়েছে।বিষ্ণু দে’র উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গ্রন্থ: উর্বশী ও আর্টেমিস (১৯৩৩), চোরাবালি (১৯৩৭), সাত ভাই চম্পা (১৯৪৪), রুচি ও প্রগতি (১৯৪৬), সাহিত্যের ভবিষ্যৎ (১৯৫২), নাম রেখেছি কোমল গান্ধার (১৯৫৩), তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ (১৯৫৮), স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত (১৯৬৩), রবীন্দ্রনাথ ও শিল্পসাহিত্যে আধুনিকতার সমস্যা (১৯৬৬), মাইকেল রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য জিজ্ঞাসা (১৯৬৭), 'In the Sun and the Rain' (১৯৭২), জনসাধারণের রুচি (১৯৭৫), যামিনী রায় (১৯৭৭), উত্তরে থাকো মৌন (১৯৭৭), সেকাল থেকে একাল (১৯৮০), আমার হূদয়ে বাঁচো (১৯৮১) প্রভৃতি। In the Sun and the Rain' নামে রচনা সংকলনের প্রাপ্য রয়্যালটি তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে দান করেছিলেন। ছড়ানো এই জীবন নামে তাঁর একটি স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ আছে। এছাড়াও রয়েছে ১০টি কাব্য সংকলন, ৭টি অনুবাদগ্রন্থ এবং ২টি সম্পাদিত গ্রন্থ। তাঁর একটি সম্পাদিত গ্রন্থ হচ্ছে এ কালের কবিতা। 

১০.
বিষ্ণু দে ত্রিশোত্তর বাংলা কবিতার নব্যধারার আন্দোলনের প্রধান পাঁচজন কবির অন্যতম ছিলেন। তিনি মার্কসবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন। কাব্যভাবনা ও প্রকাশরীতিতে বুদ্ধিবৃত্তি ও মননশীলতাকে অঙ্গীকার করেই তিনি কবিতা লেখেন। তাঁর কবিতায় টি.এস এলিয়টের কবিতার প্রভাব রয়েছে। দেশের অতীত ও বর্তমানের নানা বিষয় এবং বিদেশের বিশেষত ইউরোপের শিল্প-সাহিত্যের বিচিত্র প্রসঙ্গ তাঁর কাব্যের শরীর ও চিত্রকল্প নির্মাণ করেছে। এসব কারণে তাঁর কাব্য দুর্বোধ্যতার অভিযোগ থেকে মুক্ত নয়। বিষ্ণু দে একজন সমাজসচেতন কবি ছিলেন। তার কবিতায় মধ্যবিত্ত মানুষের নানা সমস্যা ও সঙ্কটের কথা রূপ পেয়েছে। এ প্রসঙ্গ নিয়ে তার অনেক বিখ্যাত কবিতা আছে। নাগরিক জীবনের শূন্যতার কথা তিনি তার কবিতায় লিখেছেন। বিষ্ণু দে মার্কসবাদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তিনি সমাজের পরিবর্তনে খুব আশাবাদী ছিলেন। সমাজের পরিবর্তন কামনা করে কবি-সাহিত্যিকের ‘প্রগতি লেখক সংঘ’ গড়ে তুলেছিলেন। এ সংঘের একজন কর্মী ছিলেন বিষ্ণু দে। বিষ্ণু দের কবিতা পড়লে বোঝা যায়, লোকসংস্কৃতির প্রতি তার মনের একটা টান ছিল। সে জন্য আদিবাসীদের জীবন সম্পর্কে তার গভীর আগ্রহ ছিল। একবার বেশ কিছুদিন সাঁওতালদের এলাকায় ছিলেন তিনি। সাঁওতাল ও ছত্রিশগড়িদের নিয়ে কবিতাও লিখেছেন। বিষ্ণু দে বিখ্যাত ইংরেজ কবি টিএস এলিয়টের দারুণ ভক্ত ছিলেন। তিনি এলিয়টের কবিতা অনুবাদসহ বেশ কয়েকজন আধুনিক ইউরোপীয় কবির কবিতাও অনুবাদ করেছেন। বিখ্যাত বাঙালি চিত্রশিল্প যামিনী রায়ের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব ছিল এবং যামিনী রায়ের চিত্র নিয়ে তিনি ইংরেজি ও বাংলায় বই লিখেছেন। তিনি একজন মননশীল চিত্রসমালোচক ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের চিত্রশিল্প ও ভারতীয় চিত্রকলা নিয়ে তার ইংরেজি বই আছে।খ্যাতনামা কবি বিষ্ণু দে ছিলেন সঙ্গীতশিল্পী ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের সতীর্থ এবং চিত্রশিল্পী যামিনী রায়ের বন্ধু। যামিনী রায়ের অনুপ্রেরণায়ই তিনি শিল্প-সমালোচনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বেশ কয়েকখানি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। Art of Jamini Ray (১৯৪৪), 'The paintings of Rabindranath Tagore' (১৯৫৮), 'India and Modern Art' (১৯৫৯) প্রভৃতি গ্রন্থ তাঁর এ উদ্যোগের ফল। 

১১.
বিষ্ণু দে একজন দক্ষ কবি ছিলেন। শব্দে ও ছন্দে নৈপুণ্য দেখিয়েছেন তিনি। তার কবিতা পড়লে বোঝা যায়, পুরনো সাহিত্য তার বেশ পড়া ছিল। আধুনিক ইউরোপীয় কবিতার সঙ্গেও তার যোগাযোগ ছিল নিবিড়। বিষ্ণু দের কবিতার বইয়ের সংখ্যা বিশের অধিক। কবিতার জন্য তিনি বহু সম্মান ও পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৫৯ সালে বিষ্ণু দে’কে কবি-সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। সাহিত্য কৃতির জন্য তিনি সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার (১৯৬৬), নেহেরু স্মৃতি পুরস্কার (১৯৬৭) ও রাষ্ট্রীয় জ্ঞানপীঠ পুরস্কার (১৯৭১) লাভ করেন। তিনি ‘রুশতী পঞ্চশতী’র জন্য ‘সোভিয়েত ল্যান্ড পুরস্কার’ পেয়েছেন। ক্যালকাটা গ্রুপ সেন্টারের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। সোভিয়েট সুহূদ সমিতি, প্রগতি লেখক শিল্পী সংঘ, ভারতীয় গণনাট্য সংঘ প্রভৃতি সংগঠনের সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন। 

১২.
শুধু রাজনীতির কবিতা নয়, শুধু দেশ ও কালের কবিতা নয় – তাঁর কবিতা তো ব্যক্তিরও কবিতা – প্রেমের কবিতা, প্রকৃতির কবিতা। তবে এককভাবে বা বিচ্ছিন্নভাবে নয়, সবার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে সবাই। কখনও ব্যক্তিগত কবিতাই স্পর্শ করে নৈর্ব্যক্তিককে , কখনও-বা পুরাণ প্রতিমাতেই পেয়ে যাই ব্যক্তিগতের ইশারা। তা আমরা জেনেছিলাম ‘ওফেলিয়া’ বা ‘ক্রেসিডা’ লেখার সময় থেকেই। ‘ঘোড়সওয়ার’কে যৌন-আকাঙ্ক্ষার রূপক বলা হয়েছিল তা তো আমরা জানি, সে-সময়েই তার ইংরেজি অনুবাদ পড়ে একজন ইংরেজ বিদগ্ধ পাঠকের মনে হয়েছিল, ঘোড়সওয়ার বিপ্লবের বার্তাবহ। কয়েকদিন আগে শুনলাম আজকের কোনো পাঠক প্রশ্ন তুলেছেন, প্রেমের কবিতাই-বা নয় কেন? ‘চাই না তুমি বিনা শান্তিও’ উচ্চারণ করতে-করতে একদা একজন মনে করেছিলেন তাঁর সঙ্গিনীকে শোনাবার যোগ্য এই গান – তিনিও সে-সময়েই কি টের পাননি ভবিষ্যতের জন্য একটা বড়ো স্বপ্নের ইশারা আছে এই শব্দগুলির আড়ালে? তা না হলে শেষ হবে কেন কবিতাটি এইভাবে?- ‘তোমাকে জেনেছে যে শান্তি নেই / জীবনে তার আর, সেই হীরার।’ প্রেমের সমুদ্রে ‘পূর্ণিমার নীলিমা অগাধ’ খুঁজতে-খুঁজতে যদি বলা যায় :‘আমার মেটে না সাধ, তোমার সমুদ্রে যেন মরি /বেঁচে মরি দীর্ঘ বহু আন্দোলিত দিবস-যামিনী,/ দামিনী, সমুদ্রে দীপ্র তোমার শরীরে …’ সেই দামিনীই তো তাঁর কবিতার স্বপ্নসম্ভব। তাই তো এর অনেকদিন পরেও তাঁর কণ্ঠে শুনতে পাই, ‘বহুদিন দেখেছে সে, দেখে শুনে মেটে কি এ-সাধ? / বহুদিন দেখে-দেখে হয়ে গেল মরমী সাধক।’ এরকমই যে-কবিতাগুলি ঘরোয়া উচ্চারণে দৈনন্দিনকে স্পর্শ করে, তা চকিতে ছুঁয়ে যায় একটা বড়ো অভীপ্সাকে, পৌঁছে দেয় ঊর্মিল স্বপ্নবীজের জগতে। এক কিশোরীর লঘুলাবণ্যের ছোটাছুটি দেখতে-দেখতে, তার কোমল শরীরের তরল স্রোতের ছন্দ কবিকে নিয়ে যায় প্রতীক্ষার এই গাঢ় কিন্তু অনায়াস অনুভবে, ‘এই লাবণ্যে এই নিশ্চিত ছন্দে / আমরা সবাই কেনই বা পার হব না / সামনের এই পাহাড়ের খাড়া খন্দ?’ বিষ্ণু দে-র কবিতাই আজও স্বরে ও স্বরান্তরে উচ্চারণ করতে পারেন যদি কোনো পাঠক, বিষ্ণু দে বেঁচে থাকবেন, বেঁচে আছেন সেই পাঠের মধ্যেই।

১৩.
‘বিষ্ণু দে'র কবিসত্তা : দ্বন্দ্ব ও উত্তরণের সমগ্রতায়’ রচনায় অধ্যাপক রফিকউল্লাহ খান সরল ভাষায় লিখছেন, ‘বিশ শতকের বাংলা কবিতার ধারায় বিষ্ণু দে সম্ভবত সর্বাপেক্ষা দ্বান্দ্বিক চেতনার শিল্পী। এই দ্বন্দ্ব তার কবিচৈতন্য ও কবিজীবনে সমানভাবে ক্রিয়াশীল। বাঙালির সহজিয়া কাব্যধারায় এ কারণেই তিনি ব্যতিক্রম। পুরাণ ও ঐতিহ্যের পুনর্মূল্যায়ন প্রবণতা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর ইউরোপীয় সাহিত্যকে যে দিকচিহ্নহীন গতি ও চাঞ্চল্য দান করে, বিগত শতাব্দির তিরিশের দশকের কাব্যধারায় বিষ্ণু দের মধ্যেই তার সার্থক অঙ্গীকার লক্ষ্য করা যায়। যাত্রালগ্ন থেকেই তিনি বিচিত্র শিল্প ও দর্শনের তত্ত্বজ্ঞান শিল্পে যুগান্তর সৃষ্টির অভিপ্রায় থেকে আত্মস্থ করেছিলেন। যে কারণে এলিয়টীয় পোড়ো জমির সাদৃশ্যসূচক 'চোরাবালি'র আগেই তিনি রচনা করেন 'উর্বশী' ও 'আর্টেমিসে'র কবিতাগুলো। ক্ষয়চেতনার আগেই চলেছিল সমন্বয়ের সাধনা- প্রাচ্যের সঙ্গে প্রতীচ্যের, উর্বশীর সঙ্গে আর্টেমিসের এবং আরও অনেক নাম ও অনুষঙ্গ, যেগুলো গ্রিক, রোমান ও ভারতীয় পুরাণের দীর্ঘ সময়-কালের লুপ্ত ইতিহাসের সত্য দৃষ্টান্ত। সভ্যতা ও ইতিহাসের বিবর্তন পরম্পরার অনুভবে উজ্জীবিত ব্যক্তিচৈতন্যে বর্তমানের ক্ষয়, নৈরাজ্য এবং শূন্যতার সর্বময় বিস্তারের মধ্যেও বিষ্ণু দে তার মানসদৃষ্টি প্রসারিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন অতীত ও ভবিষ্যতের বিপুলা পটভূমিতে। এজন্যই কবির চৈতন্যের যুক্তি অন্বেষণা কেবল ব্যক্তিক আত্মবিস্তারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বাংলা কবিতার মুক্তি সম্ভাবনাদীপ্ত অরুণোদয়কেও নির্দেশ করে। তার সভ্যতার আদি উৎসলালিত স্মৃতিসত্তা স্বপি্নল হয়ে ওঠে এ স্বপ্নরঙিন ভবিষ্যতের অনুধ্যানে। পরাক্রান্ত অন্ধকারের সাম্রাজ্যকে খুঁড়ে খুঁড়ে তিনি নির্মাণ করে চলেন আলোকিত সম্ভাবনার সিংহতোরণ- জ্ঞান, বৈদগ্ধ্য ও যুক্তিসিদ্ধ সংহতির অন্তরালে লালন করেন রোমান্টিকতার অন্তর্গত স্রোতস্বিনী। উর্বশী ও আর্টেমিস, বা চোরাবালি কাব্যে তার যে শিল্প নিরীক্ষা টিএস এলিয়টের ছত্রচ্ছায়ায় উপমা, প্রতীক, রূপক ও চিত্রকল্পের সাধর্ম্য সন্ধান করে, সেখানেও কবির অন্যতর অভিনিবেশ প্রযুক্ত হয় এলিয়টের যুগান্তকারী ঐতিহ্যভাবনার মধ্যে। তাই নেতিতে যাত্রা শুরু হলেও তার বিস্তার ঘটে মানস প্রগতিতে, আবিশ্ব চৈতন্যের নিগূঢ় অন্বিষ্ট কামনায়। কিন্তু এলিয়টের খণ্ড চৈতন্যের একাগ্র উপলব্ধিকে সর্বাংশে গ্রহণ করতে পারেননি তিনি। তার কাম্য ছিল অখণ্ড চৈতন্যের সার্বিক মুক্তি।’

১৪.
সমালোচক অধ্যাপক দীপ্তি ত্রিপাঠির যথার্থই বলছেন, তাঁর কথা দিয়েই শেষ করছি- পদধ্বনিতে বিষ্ণু দে অর্জুনের প্রতীকে আসন্ন বিপ্লবের সম্মুখীন বুর্জোয়ার ক্লৈব্যের ছবি এঁকেছেন। পদধ্বনি এখানে তাই শোষিত সমষ্টির সামাজিক বিপ্লবেরই পদধ্বনি।একথা বলা অসঙ্গত হয় না যে, বিষ্ণু দে দীক্ষিত কবি যেমন স্বাদেশিকতায় তেমনি আন্তর্জাতিকতায়। বিষয়ের ব্যাপকতায়, নানা ভাষ্যে এবং একাধিক প্রতীকে। তাঁর কবিতায় মানবিক প্রাণের স্পন্দন প্রভাবসঞ্চারী পাশাপাশি দেশজাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষ মানুষের জয়গানে একাত্ম। মার্কসীয় দর্শনে প্রভাবিত হলেও তিনি বিশ্বাস করতেন সবার ওপরে মানুষ সত্য। যে কারণে ঈশ্বর ভাবনাও তার কবিতার মর্মমূলে সঘন। জীবনকে সত্য করে তুলতে তাঁর যাত্রা অবিশ্রাম ভাঙনের সাগর সঙ্গমে। তবে ভাষাগত সারল্য সংকটে তাঁর কাব্যপ্রাসাদ সাধারণ পাঠকে ব্যাপক সমাদৃত নয়। কিন্তু মনোযোগী ও নির্বিচারী পাঠক কবি চৈতন্যের মেলবন্ধনে।

(তথ্যসূত্র : বাংলাপিডিয়া, বিষ্ণু দে : অরুণ সেন, দৈনিক যুগান্তর, দৈনিক সমকাল, দৈনিক কালের কণ্ঠ, কালি ও কলম, বিষ্ণু দে: কবিতায় ও শিল্পে: সম্পাদনা: আবুল হাসনাত ও বিশ্বজিৎ ঘোষ, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত