জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

কাঙাল হরিনাথ মজুমদার

প্রকাশ : ২০ জুলাই ২০১৮, ১১:৩২

কাঙাল হরিনাথ মজুমদার এর বাড়ি ও লেখক

"ওহে (হরি) দিন তো গেল, সন্ধ্যা হল, পার কর আমারে।
তুমি পারের কর্তা, শুনে বার্তা, ডাকছি হে তোমারে।।
আমি আগে এসে, ঘাটে রইলাম বসে
(ওহে, আমায় কি পার করবে নাহে, আমায় অধম বলে)
যারা পাছে এল, আগে গেল, আমি রইলাম পড়ে।।"- কাঙাল হরিনাথ মজুমদার

১.
একালে প্রায়-বিস্মৃত একটি নাম, বাংলার উজ্জ্বল এব মনীষার নাম কাঙাল হরিনাথ। অথচ সেই প্রবল দু:শাসনের বৃটিশ আমলেই সময়ের জাগরণী সুর বাজিয়েছিলেন তিনি তাঁর নানা রচনা ও কাজের মাঝে। কণ্ঠ ও কলম দিয়ে মানুষের সেবা করেছেন আজীবন। সাংবাদিক, সাহিত্যিক, বাউল গান রচয়িতা কাঙাল হরিনাথ মজুমদার জন্মগ্রহণ করেন ১২৪০ বঙ্গাব্দের ৫ শ্রাবণ (১৮৩৩ সালের ২০ জুলাই) বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার (তৎকালীন নদীয়া) অন্তর্গত কুমারখালীতে এক দরিদ্র পরিবারে। মহান এই মানুষটির স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। ‘কাঙাল হরিনাথ’ বিস্মৃত এক মহান মনীষার প্রতিকৃতি। তাঁর প্রকৃত নাম হরিনাথ মজুমদার, কিন্তু কাঙাল হরিনাথ নামেই তিনি সমধিক পরিচিত। কাঙাল ফিকিরচাঁদ বা ফিকিরচাঁদ বাউল নামেও তিনি পরিচিত ছিলেন। উল্লেখ্য যে, কাঙাল হরিনাথ মজুমদার ১৮৯৬ সালের ১৬ এপ্রিল ৬৩ বছর বয়সে নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন। সম্প্রতি কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের স্মৃতিবিজরিত কুমারখালীর ‘কাঙাল কুটির’ ভ্রমণের সুযোগ পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে হয়েছে। সে অভিজ্ঞতা নিয়ে স্বতন্ত্র রচনা লেখার ইচ্ছা আছে।

২.
তাঁর জীবনীতে দেখি, এই মনস্বী মনীষীর জীবনের সকল পর্যায়ের কাজই গ্রাম ও শহরের মানুষকে প্রয়োজনের তাগিদেই আকৃষ্ট করেছে। উনিশ শতকে এই মানুষটি নিস্তরঙ্গ গ্রাম বাংলার সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনে এক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিলেন।নাগরিক নবচেতনার প্রেরণায় দূর মফস্বলেও রচনা করতে পেরেছিলেন জাগৃতির বাতাবরণ। কাঙাল হরিনাথ নিভৃত পল্লীতে বসে সংস্কৃতির চর্চা ও লোক কল্যাণের যে আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছেন তা ব্যতিক্রমধর্মী ও বিস্ময়কর ঘটনা। এই বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব একাধারে ছিলেন সাহিত্যশিল্পী, সংবাদ-সাময়িকপত্র-পরিচালক, শিক্ষাব্রতী, সমাজ-সংস্কারক, নারীকল্যাণকামী, দেশহিতৈষী. রায়ত-কৃষক-প্রজাপ্রেমী, সাধক ও ধর্মবেত্তা এবং নব্য সাহিত্যসেবীদের উদার পৃষ্ঠপোষক। মূলত তাঁর জীবন বিভক্ত হয়ে গেছে সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা, জনহিতৈষণা ও ধর্ম সাধনা- এই তিন ধারায়। গ্রামবার্তা প্রকাশিকা উনিশ শতকের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাসিক পত্রিকা। গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকার মাধ্যমে সুদীর্ঘকাল ধরে বঙ্গদেশে শিক্ষার প্রসার ও সর্ব প্রকার শোষণের বিরুদ্ধে তিনি সংগ্রাম করেছেন। গ্রামবার্তা প্রকাশিকায় সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞানবিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশিত হতো। সমসাময়িক কালের সামাজিক ও রাজনৈতিক অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদ জানিয়ে লেখা নিবন্ধ ও সংবাদ প্রকাশ করে হরিনাথ তখন বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন। ব্রিটিশ নীলকরদের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন আপোষহীন। সব ধরনের বাধা উপেক্ষা করে তিনি কুসীদজীবী ও নীলকর সাহেবদের শোষণ ও নিপীড়নের কাহিনী নির্দ্বিধায় প্রকাশ করেন। ১৮৭৩ সালের পাবনার কৃষক বিদ্রোহের স্বপক্ষেও তিনি সরব ও সোচ্চার কণ্ঠস্বর ছিলেন। 

৩.
প্রখ্যাত লেখক, গবেষক রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘ঠাকুর পরিবারের ‘জমিদারি নির্যাতন’-এর বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন কাঙাল হরিনাথ‚ বিস্মৃত এই সাংবাদিকই লিখেছিলেন ‘দিন তো গেল‚ সন্ধ্যা হল…’। তিনি ক্ষোভের সাথে আরো বলছেন, ‘তাঁর নাম কাঙাল হরিনাথ। তাঁকে আজকের বাঙালি চেনে না। আমাদের লজ্জা যে আমরা তাঁকে মনে রাখিনি। তিনি কিন্তু ভালবাসার মতো মানুষ। আর তিনি আমাদের বুকের কান্নাকে স্পর্শ করার মতো ও মানুষ। তাঁর জন্যে চোখের জল পড়ে বলেই তো গ্রাম বাংলার সেই প্রথম নায়ককে ভালবাসি ।’ গবেষক, অধ্যাপক সুধীর চক্রবর্তী বলছেন, ‘তাঁর ভাগ্যদেবতা তাঁকে সকল রকমে কাঙাল করেছিলেন জীবনের শেষ পর্বে। তাই বোধহয় পারমার্থিক গান রচনা করে তাতে ভণিতা দিয়েছিলেন কাঙাল নামে। আশ্চর্য ও অনবদমিত এক মানবসত্তা এই কাঙাল হরিনাথ।’ রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় আরো লিখছেন,‘কাঙাল হরিনাথ মারা গেলেন ১৮৯৬ – এর ১৬ এপ্রিল। ১৩০৩ বঙ্গাব্দের ৫ বৈশাখ। তাঁর বয়েস তেষট্টি। কুমারখালির কাঙাল কুটিরেই মারা যান তিনি — তখন এক নিঃস্ব সন্ন্যাসী। কেউ তাঁর পাশে নেই। যে মানুষদের ওপর জমিদারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই‚তারাও পাশে দাঁড়ায়নি- ভয়ে ! বন্ধ হয়ে গেছে তাঁর ‘গ্রামবার্তা’ সংবাদপত্র‚অর্থের অভাবে। তিনি নিঃসঙ্গ‚ নির্লিপ্ত‚ উদাসীন এক বাউল‚ তাঁর শেষ জীবনে। আর তখনও ‘কাঙাল’! কিন্তু এক অদ্বিতীয় নায়ক!’
 
৪.
গবেষক, অধ্যাপক সুধীর চক্রবর্তী তাঁকে নিয়ে লিখেছেন, ‘এক মহান ট্র্যাজিক চরিত্র ’। তিনি আরো লিখছেন, ‘উনিশ শতকের গ্রামিক পরিসরে হরিনাথ মজুমদার একজন ব্যতিক্রমী চিন্তক, সমাজকর্মী, সম্পাদক, শিক্ষাব্রতী ও গীতিকার। ১৮৩৩ সালে কুষ্টিয়ার কুমারখালিতে তাঁর জন্ম এবং ১৮৯৬-তে স্বভূমি ও স্বগৃহে মৃত্যু। জীবনকালের পরিধি তেষট্টি বছর, যা ভাগ্যহত, দারিদ্রে জীর্ণ ও টালমাটাল, কিন্তু তার মধ্যেই তিনি স্থির সংকল্পিত, নীতিনিষ্ঠ, আদর্শবাদী, সত্, সৃষ্টিশীল এবং প্রধানত প্রতিবাদী। অথচ তাঁর সমগ্র জীবনকথা অনুধাবন করলে বোঝা যায়, প্রকৃতপক্ষে প্রায় সারা জীবনটাই তাঁর পায়ের তলায় মাটি ছিল না। জন্মগত কৌলীন্য, পিতামাতার আশ্রয়, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগত পরিচয় এবং আর্থিক সচ্ছলতা- কোনওটাই আয়ত্তগত হয়নি তাঁর।’

৫.
কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের (জন্ম : ২০ জুলাই, ১৮৩৩ - মৃত্যু : ১৬ এপ্রিল, ১৮৯৬) পিতা হলধর মজুমদার ও মাতা কমলিনী দেবী। জন্মের পরের বছরেই মায়ের মৃত্যু হয় এবং হরিনাথের ৭ বছর বয়সে পিতা হলধর মজুমদারের মৃত্যু হলে অনাথ অসহায় হরিনাথ মজুমদারের আশ্রয় হয় বৃদ্ধ খুল্লপিতামহীর কাছে। শুরু হয় পরনির্ভর নানাস্থানী জীবন- প্রকৃত অর্থেই নুনভাত খাওয়া অস্তিত্ব তাঁর এবং সেইসঙ্গে অপমান, অর্থাহার আর পারিপার্শ্বিক সমাজ প্রতিরোধবহুল। জীবনযাপনের স্বাচ্ছন্দ্য বা জীবনবিকাশের অনুকূল পরিসর তাঁর মেলেনি। পাঠশালায় বিদ্যার্জনটুকু সাঙ্গ করতে পারেননি, কিন্তু প্রথমেই স্থাপন করেন গ্রামীণ পাঠশালা এবং পরে পরে আরও নানা সমাজ হিতৈষণায় জড়িয়ে রাখেন নিজেকে।

৬.
কাঙাল হরিনাথের জীবন বড় দুঃখ কষ্ট বেদনা বঞ্চনার। ১৮৪১ সালে ভর্তি হয়ে কিছুদিন গ্রামের পাঠশালায় লেখাপড়া করেন। পরবর্তীতে ১৮৪৪ সালে খুল্লতাত নীলকমল মজুমদারের সহায়তা ও আনুকূল্যে কুমারখালিতে কৃষ্ণধন মজুমদার প্রতিষ্ঠিত ইংরেজি স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু নীলকমল মজুমদারের অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে বিদ্যালয়ের লেখাপড়ায় ছেদ পড়ে। এ সময় বাধ্য হয়ে কাঙাল হরিনাথকে কুমারখালি বাজারে দৈনিক দু’পয়সা বেতনে এক কাপড়ের দোকানে চাকরি নিতে হয়। কিন্তু তাঁর নীতিবোধ ও সত্যনিষ্ঠার কারণে অল্পদিন পরেই চাকরি ছেড়ে দেন। ১৮৪৯ সালে হরিনাথ লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে কলকাতায় গেলেও অচিরেই ব্যর্থ হয়ে কুমারখালীতে ফিরে আসেন এবং কুমারখালী নীলকুঠিতে শিক্ষানবীশ হিসেবে কাজে যোগদান করেন। এখানে উল্লেখ্য যে তখনকার সমাজে যে সকল ভদ্রসন্তান লেখাপড়া শিখতে পারতো না তারা নীলকুঠিতে না হয় পুলিশের চাকরিতে যোগদান করতো। সেভাবেই হরিনাথের শুভাকাঙ্খী আত্মীয়গণ কুমারখালী নীলকুঠিতে শিক্ষানবিশ চাকরিটির ব্যবস্থা করেছিলেন এবং তারা ভেবেছিলেন হরিনাথ আমিন বা গোমস্তার পদলাভ করে ভালো অর্থ উপার্জন করবেন। কিন্তু কাঙাল হরিনাথ এই চাকরিটিও ত্যাগ করেন। কারণ নীলকুঠিতে কর্মরত অধিকাংশ কর্মচারীকেই অসচ্চরিত্র ঘুষখোর মিথ্যাবাদী এবং প্রজা নিপীড়ক বলে তাঁর মনে হয়েছিল।

৭.
এ কথা আগেই বলা হয়েছে কাঙাল হরিনাথের জীবন বড় দুঃখ কষ্ট বেদনা আর বঞ্চনার। শৈশবেই বাবা-মার মৃত্যুর পর অপরিসীম দারিদ্র্যেও মধ্যে তাঁর জীবন কাটে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ তিনি সেভাবে কোনদিনই পান নি। তাই হরিনাথ নিজেকেই নিজে গড়ে তুলেছিলেন। আক্ষরিক অর্থেই তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত। তাঁর লেখাপড়ার আগ্রহ ও জানার ইচ্ছা ছিল প্রবল। পরবর্তীতে কুমারখালীতে ব্রাহ্মসমাজের কল্যাণে তাঁর ভাষা শিক্ষার সুযোগ ঘটে, আর সাহিত্যে হাতেখড়ি হয় ‘সংবাদ প্রভাকর’- সম্পাদক-কবি ঈশ্বর গুপ্তে’র (১৮১২-১৮৫৯) সহায়তায়। ১৮৫৭ সালের ২১ অক্টোবর ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় ‘টাকা’ শিরোনামে হরিনাথ মজুমদারের প্রথম রচনা প্রকাশিত হয়। 

৮.
কাঙাল হরিনাথ উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত না হতে পারলেও তিনি ছিলেন হৃদয়বান ও মার্জিত রুচির একজন মানুষ। সেকালের সাধারণ মানুষের মতো গোঁড়ামী তাঁর মধ্যে ছিল না। লোকশিক্ষার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে সেখানে শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি নারী শিক্ষার প্রবল পক্ষপাতী ছিলেন এবং সেই বিরুদ্ধ সময়েও নারী শিক্ষা বিস্তারের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। এ কারণেই ১৮৬০ সালে নিজের বাড়িতেই তিনি একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং শিক্ষকতার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ইতোপূর্বে ১৮৫৪ সালে তিনি কুমারখালীতে একটি বাংলা পাঠশালা প্রতিষ্ঠা করেন এবং বিনা বেতনে শিক্ষকতার দায়িত্ব নেন। অল্পদিনেই এ বিদ্যালয়টি যথেষ্ট সুনাম অর্জন করে এবং ইংরেজ বিদ্যালয় পরিদর্শকের সুপারিশে সরকারি অনুদান পায়। তখন প্রধান শিক্ষক হরিনাথের মাসিক বেতন নির্ধারিত হয় কুড়ি টাকা। কাঙাল হরিনাথের আন্তরিক চেষ্টা ও যত্নে অনেক ছাত্র এ বিদ্যালয় থেকে বৃত্তি পরীক্ষায় সাফল্য অর্জন করে। 

৯.
গ্রামের সাধারণ মানুষের উন্নতির জন্য এবং তাদের শোষণ-পীড়নের বিরুদ্ধে হরিনাথ সারাজীবন আন্দোলন করেছেন। অত্যাচারিত এবং অসহায় কৃষক সম্প্রদায়কে রক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি সাংবাদিকতা পেশা গ্রহণ করেন। কাঙাল হরিনাথ সে সময়ের দরিদ্র প্রজা ও শ্রমজীবি মানুষের অত্যাচারিত অবস্থা দেখে তা নিরসনের জন্যে পত্রিকার মাধ্যমে প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিলেন। প্রথমে তিনি সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় লিখতেন, পরে ১৮৬৩ সালে তিনি নিজেই গ্রামবার্তা প্রকাশিকা নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৮৬৩ সালের এপ্রিল মাসে (১ বৈশাখ ১২৭০) কলকাতার ‘গিরিশ বিদ্যারত্ন’ যন্ত্র (প্রেস) থেকে গ্রামবার্তা প্রকাশিকা মুদ্রণ করেন যা মাসিক পত্রিকা হিসেবে কুমারখালী থেকে প্রকাশিত হতে আরম্ভ করে। দু’বছর পরেই ১৮৬৫ সালে (আষাঢ় ১২৭১) গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা পাক্ষিক পত্রিকা এবং ১৮৭০ (বৈশাখ ১২৭৭) সময় থেকে সাপ্তাহিক পত্রিকা হিসেবে প্রকাশিত হতে থাকে। হরিনাথের জীবনে কখনও সচ্ছলতা ছিল না, কিন্তু তা সত্ত্বেও পত্রিকা প্রকাশের সুবিধার্থে তিনি ১৮৭৩ সালে কুমারখালীতে মথুরানাথ যন্ত্র নামে ছাপাখানার প্রতিষ্ঠা করেন এবং এখান থেকেই গ্রামবার্তার মুদ্রণ কাজ শুরু হয়। এ ছাপাখানাটি প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র পিতা মথুরানাথ মৈত্রেয় হরিনাথকে দান করেন বলে জানা যায়। 

১০.
পত্রিকাটিতে সাহিত্য, দর্শন ও বিজ্ঞানবিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশিত হলেও কৃষকদের প্রতি তখনকার নীলকর ও জমিদারদের শোষণ-অত্যাচারের কথা বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করা হতো। ফলে ব্রিটিশ সরকার এবং স্থানীয় জমিদারদের পক্ষ থেকে তাঁকে ভীতি প্রদর্শন করা হয়। কিন্তু তিনি নির্ভীকভাবে তাঁর দায়িত্ব পালন করে যান। এসব কারণে পত্রিকাটি তখন বিশেষ খ্যাতি অর্জন করে। গ্রামবার্ত্তা পত্রিকা দিয়ে এদেশের অনেক উপকার হয়েছিল। শুধু যে জমিদার মহাজন নীলকুঠির অত্যাচার প্রকাশিত হবার পর তা বন্ধ হয়েছিল তাই নয় বরং জনগণের প্রতি সরকারের যে কর্তব্য সে সম্বন্ধে অনেক প্রবন্ধ ছাপা হতো। নদী খনন, পয়ঃপ্রণালী সংস্কার, জলকষ্ট নিবারণ এমনকি পুলিশ বিভাগের কাজসহ ইত্যাদি প্রয়োজনীয় বিষয় সম্বন্ধে তিনি তাঁর প্রবন্ধ পত্রিকায় প্রকাশ করেছেন। ডাকঘরে মানি অর্ডার প্রচলনের প্রস্তাব এদেশে তিনিই প্রথম উপস্থাপন করেন। সে সময় সোম প্রকাশ এবং গ্রামবার্ত্তায় উচুঁ মাপের পত্রিকা ছিল। গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা মাসিক পাক্ষিক ও সাপ্তাহিক হিসেবে কয়েক পর্যায়ে মোট ২২ বছর চলেছিল। কিন্তু একসময় হরিনাথ মজুমদার কুমারখালীতে প্রেস স্থাপনের পরে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ায় ১৮৭৯ সালে (বৈশাখ ১২৮৬) সাপ্তাহিক গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে কুমারখালী বাংলা পাঠশালার তৎকালীন প্রধান শিক্ষকসহ কয়েকজন শুভানুধ্যায়ীর সহযোগিতায় ১৮৮২ সালে (বৈশাখ ১২৮৯) পুনরায় সাপ্তাহিক গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা প্রকাশ পায়। যা বাংলা ১২৯২ সালের আশ্বিন মাস পর্যন্ত চালু থাকে।রাজশাহীর রাণী স্বর্ণকুমারী দেবীর অর্থানুকূল্যে দীর্ঘদিন পত্রিকা প্রকাশের পর আর্থিক কারণে এবং সরকারের মুদ্রণ শাসনব্যবস্থার কারণে পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ করে দিতে হয়। 

১১.
কাঙাল হরিনাথ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে যে সততা ও সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন তা তাঁকে সে সময়ে কিংবদন্তীতুল্য করেছিল। অনেকাংশে জীবনের ঝুঁকি নিয়েও তিনি নির্ভীক ও সৎ সাংবাদিকতার একটি আদর্শ স্থাপন করতে পেরেছিলেন। অবশ্য শাসক সরকার নীলকর জমিদার মহাজন প্রমুখ কায়েমী স্বার্থের বিরুদ্ধে লেখার কারণে তাঁকে অনেক ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছে। কখনও কখনও তাঁর জীবন সংশয়ের মতো ঘটনাও ঘটেছে। বিশেষ করে প্রজা পীড়নের সংবাদ প্রকাশকে কেন্দ্র করে ঠাকুর জমিদারদের সঙ্গে তাঁর বিরোধ অহরহই ঘটতো। যা তাঁর চরিত্রে আলাদা মর্যাদা আরোপ করেছিল। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের জমিদারী ছিল কুষ্টিয়ার বিরাহিমপুর পরগনায়। সদর দপ্তর ছিল শিলাইদহে। ঠাকুর পরিবারের জমিদারী এলাকায় প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের আমল থেকেই প্রজা পীড়নের অভিযোগ ছিল। মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময় এ অত্যাচার মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। খাজনা বৃদ্ধি, করারোপ, বল প্রয়োগ করে খাজনা আদায় বা প্রজাদের ভিটমাটি থেকে উচ্ছেদ এ সকল ঘটনা কাঙাল হরিনাথ তাঁর পত্রিকা গ্রামবার্ত্তায় লিখতেন। পাশাপাশি প্রজাদের কল্যাণের প্রতি জমিদারের উদাসীনতা অনীহাও প্রকাশ পেত তাঁর লেখায়। ফলে ঠাকুর জমিদার পরিবার কাঙাল হরিনাথকে কিংবা তাঁর পত্রিকা গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকাকে সহজভাবে গ্রহণ করে নি। এবং নানাভাবে তারা তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।

১২.
কাঙাল হরিনাথ বাঙালি সমাজে মূলত বাউল গানের রচয়িতা হিসেবে পরিচিত। গদ্য রচনার মধ্যে নীতিগর্ভ উপাখ্যান ‘বিজয়-বসন্ত’ তাঁর শ্রেষ্ঠ সাহিত্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়। গদ্য-পদ্য মিলিয়ে কাঙাল হরিনাথ প্রায় ৪০টি গ্রন্থ রচনা করেন। যদিও সকল রচনাই গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। কাঙাল হরিনাথের রচনাকে নীতি শিক্ষামূলক শিশুপাঠ্য, ধর্মকথার বিনোদন, ধর্মশ্রাস্ত্র ও সাধনতত্ত্বের ব্যাখ্যা সামাজিক চিন্তামূলক সাহিত্য - এই কয় শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। হরিনাথ অনেক পৌরাণিক নাটক ও পাঁচালী রচনা করেন এবং তা গ্রামের যুবকদেরকে দিয়ে অভিনয় করান।


 
১৩.
হরিনাথ ছিলেন ফকির লালন শাহর শিষ্য। বাউল গানের ক্ষেত্রে হরিনাথের অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়। তিনি বহুসংখ্যক বাউল গান রচনা করেন এবং সেগুলি খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তিনি সহজ ভাষায় ও সহজ সুরে গভীর ভাবোদ্দীপক গান রচনা করতেন এবং সেগুলি সদলে গেয়ে বেড়াতেন। গানে ‘কাঙাল’ নামে ভণিতা করতেন বলে এক সময় কাঙাল শব্দটি তাঁর নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। ‘হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হলো, পার কর আমারে’ তাঁর একটি বিখ্যাত গান। ১২৯০-১৩০০ বঙ্গাব্দের মধ্যে তিনি কাঙাল ফিকিরচাঁদ ফকিরের গীতাবলী নামে ১৬ খন্ডে বাউল সঙ্গীত প্রকাশ করেন। হরিনাথ শুধু গানেই নয়, গদ্য ও পদ্য রচনায়ও পারদর্শী ছিলেন। সাহিত্যচর্চায় হরিনাথের শিষ্যদের মধ্যে অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, দীনেন্দ্রনাথ রায় এবং জলধর সেন পরে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। গ্রামবার্তা প্রকাশিকায় তৎকালীন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের খ্যাতনামা পন্ডিতরা লিখতেন। রবীন্দ্রনাথের বিভিন্নবিষয়ক প্রবন্ধ, ছড়া ইত্যাদিও এতে প্রকাশিত হতো। প্রখ্যাত মুসলিম লেখক মীর মশাররফ হোসেনের সাহিত্যচর্চার হাতেখড়িও হয় এ পত্রিকার মাধ্যমে। তিনি প্রথমে এর একজন মফঃস্বল সাংবাদিক ছিলেন। ছাত্র থাকাকালীন অবস্থায় এ পত্রিকায় তাঁর অনেক লেখা প্রকাশিত হয়। হরিনাথ ছিলেন তাঁর সাহিত্যগুরু। এ পত্রিকার মাধ্যমেই তিনি পরবর্তীকালে মুসলমান রচিত আধুনিক বাংলা সাহিত্যে সমন্বয়ধর্মী ধারার প্রবর্তক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন, যা পরবর্তী সময়ে বহু মুসলিম সাহিত্যিক কর্তৃক অনুসৃত হয়েছে। হিমালয় ভ্রমণকাহিনীখ্যাত লেখক ও সাংবাদিক জলধর সেনের সাহিত্যচর্চাও শুরু হয় এ পত্রিকার মাধ্যমে। 

১৪.
কাঙাল হরিনাথের লোকপ্রিয়তার মূলে আছে তাঁর মরমী সংগীত। তিনি অধ্যাত্মবাদ প্রচারের জন্য ১৮৮০ সালে ‘কাঙাল ফিকির চাঁদের দল’ নামে একটি বাউল দল গঠন করেন। তাঁর ‘ফিকিরচাঁদ ফকিরের গানের দল’ বা কাঙাল ভণিতায় রচিত গান তৎকালীন সমগ্র বাংলাকে অভিভূত করেছিল। সেই সময় থেকেই কাঙাল হরিনাথের রচিত ও গীত গান আমাদের সমাজে ধারাবাহিকভাবে বিরাজমান। হরিনাথের ‘ওহে দিন তো গেল, সন্ধ্যা হলো, পার করো আমারে’- এই মরমী গানটি সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী চলচ্চিত্রে ব্যবহার করা হয়েছে। কাঙাল হরিনাথ বাউল গানের প্রচলিত ধারায় নতুনমাত্রা যোগ করে তাকে শিক্ষিত নাগরিক সমাজে প্রিয় ও গ্রহণযোগ্য করে তোলেন। এ গানের সূত্র ধরেই বাউল সাধক লালন শাহের সাথে কাঙাল হরিনাথের হৃদ্যতা গড়ে ওঠে।

১৫.
হরিনাথের মোট গ্রন্থ ১৮টি। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো: বিজয়বসন্ত (১৮৫৯), চারুচরিত্র (১৮৬৩), কবিতাকৌমুদী (১৮৬৬), বিজয়া (১৮৬৯), কবিকল্প (১৮৭০), অক্রূর সংবাদ (১৮৭৩), সাবিত্রী নাটিকা (১৮৭৪), চিত্তচপলা (১৮৭৬), কাঙালের ব্রহ্মান্ডবেদ (১৮৮৭-৯৫), মাতৃমহিমা (১৮৯৬) ইত্যাদি। মৃত্যুর পর তাঁর রচনাসমগ্র হরিনাথ গ্রন্থাবলী (১৯০১) নামে প্রকাশিত হয়।

১৬.
শেষ বয়সে নানা রোগব্যাধীতে ভুগে এবং এক ধরনের বঞ্চনার শিকার হওয়ার মধ্য দিয়ে অনেকটাই অভিমান করে হতাশ হয়ে ক্ষোভ মনে নিয়ে কাঙাল হরিনাথ ধর্ম চর্চায় মন দেন। প্রায় বাইশ বছর গ্রামবার্তা প্রকাশিকা সম্পাদনা করার পর সাংবাদিকতা ত্যাগ করে হরিনাথ ধর্মসাধনায় মনোনিবেশ করেন। আর তাই তবে কোন কোন সমালোচকের মতে, ‘শেষ বিচারে হরিনাথ একজন স্ববিরোধী মানুষরূপেই প্রতিভাত হন। তাঁর ‘গ্রামীণ মনীষা’ শেষপর্বে বিলুপ্ত হয়ে গেছে ভাবের মাদকে।’ ১৮৯৬ সালের ১৬ এপ্রিল (৫ বৈশাখ ১৩০৩) বৃহস্পতিবার দুপুর ৩-৩০টায় কুমারখালীর কাঙাল কুটিরে ৬৩ বছর বয়সে এ মহান পুরুষের মহাপ্রয়াণ ঘটে। ওইদিনই সন্ধ্যায় কুমারখালী শ্মশানে তাঁর শেষকৃত্যানুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। কালের হিসেবে যে অল্প সময়ে এই মহাসাধক, সমাজ বিপ্লবী তাঁর সমসাময়িক সময়ে সমাজ পরিবর্তনের জন্যে যে ভূমিকা রেখেছেন তা অবিস্মরণীয়। তৎকালীন পশ্চাৎপদ সমাজে তিনি জাগরণের সুর হয়ে বেজে উঠেছিলেন বাংলার সর্বত্র।

১৭.
প্রখ্যাত লেখক, গবেষক রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন,‘বহু বছর আগে তিনি একটি গান লিখেছিলেন। সেই গান কিন্তু বাঙালি ভোলেনি। হরিনাথের সেই গান হরিনাথের থেকে অনেক বিখ্যাত। সেই গান হল‚‘দিন তো গেল‚সন্ধ্যা হল‚ পার কর আমারে’। এই গান সম্ভবত আজকের বাঙালিও জানে। কিন্তু লেখককে চেনে না।সত্যজিৎ রায় তাঁর ‘পথের পাঁচালী’-তে গানটিকে আরও বিখ্যাত করে দিয়েছেন। কিন্তু গানের লেখক যে অন্ধকারে ছিলেন সেই অন্ধকারেই থেকে গেছেন। হরিনাথ প্রায় হাজারখানেক গান বেঁধেছেন ‘ফিকির হরিনাথ’ নামে। তাঁর কিছু গান আজও বাঙালি গায়‚ বিশেষ করে বাউলরা বাঁচিয়ে রেখেছেন সেই গান। আর সেইসব গানের সৌজন্যে ‘ফিকির হরিনাথ’, ‘কাঙাল হরিনাথ’ – এর চেয়ে অনেক বেশি পরিচিত ‘নাম’। একটা কথা প্রথমেই বলি — আমরা কেউ খোঁজ রাখি না‚ গ্রাম বাংলার এই গরিব মানুষটি ৮ খণ্ডে প্রায় দু-হাজার পাতার ডায়েরি লিখেছিলেন ! এই ডায়েরি একেবারে রত্নখনি। আমি শীতের রাত্তিরে মগ্ন হয়ে মুগ্ধ হয়ে বিস্মিত হয়ে পড়লুম সেই দিনলিপি ! কাফকার ডায়েরির চেয়ে কম পাঠযোগ্য নয় কাঙাল হরিনাথের ডায়েরি । … তবে একথা সত্য যে, হরিনাথের সমকালে কুষ্টিয়ার কুমারখালি হয়ে উঠেছিল এক সমৃদ্ধ গ্রামীণ সংস্কৃতির মুক্ত ও সৃষ্টিশীল অঙ্গন। সাংবাদিকতা ও সাহিত্য রচনার অনুকূল বাতাবরণ প্রধানত কাঙাল হরিনাথকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। একটি প্রেস ও সংবাদপত্র (‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’) চালু ছিল, যে-পত্রিকার ছিল এক উন্নত আদর্শ, সমাজ-সংলগ্নতা ও স্পষ্ট অভিমুখ। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, জলধর সেন, মীর মশাররফ হোসেনদের মতো সে সময়ের জাগ্রত তারুণ্যের উদ্যমী সহযোগীদের সক্রিয় সহমর্মিতা হরিনাথ পেয়ে গিয়েছিলেন। যেখানে, অত্যাচার ও শোষণ- সে নীলকরদের দ্বারাই হোক বা স্থানীয় জমিদারদের দ্বারা- সেখানেই হরিনাথের প্রতিবাদ গর্জে উঠত তাঁর লেখনীতে। তাঁর সমর্থ পরিচালনা ও সংগ্রামী চেতনা ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’-কে করে তুলেছিল নিপীড়িত মানুষের অব্যক্ত বেদনার সত্য অভিব্যক্তি। এ ব্যাপারে তাঁর কোনও বা কারও সঙ্গে আপস ছিল না।’ 

১৮.
জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের মাথা এবং সেকালের ব্রাহ্মণেরা ও পরাক্রান্ত জমিদার মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রজাপীড়নের অমানবিকতার বিরুদ্ধে তিনি জ্বালাময়ী প্রতিবেদন ও সম্পাদকীয় মন্তব্য ছাপতে কুণ্ঠিত হননি, ভয় পাননি। জমিদারের অত্যাচার ও প্রতিশোধ সত্ত্বেও চালিয়ে গেছেন নির্ভীক সম্পাদকীয় প্রতিরোধ। নানা কটূক্তি, অপমান, ভীতি প্রদর্শনের প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও মাসিক, পাক্ষিক ও সাপ্তাহিক হিসেবে হরিনাথ বাইশ বছর ধরে ‘গ্রামবার্তা’ প্রেরণ করেছেন সব স্তরের মানুষের বিবেক জাগ্রত করার জন্য। অধ্যাপক আবুল আহসান চৌধুরী যথার্থই লিখেছেন: ‘পত্রিকায় সত্য সংবাদ প্রকাশের দায়ে হরিনাথকে জেলার ম্যাজিস্ট্রেট ও পরগনার জমিদার উভয়েরই বিরাগভাজন হতে হয়।’ শেষ পর্যন্ত কৃষক-প্রজা-রায়ত শ্রমজীবী ও মধ্যশ্রেণির মুখপত্র তাঁর রক্তক্ষরা পত্রিকা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। এ ব্যাপারে হরিনাথ তাঁর সুহৃদকে যে-চিঠি লেখেন, তাতে করুণ ভাষায় এমন কবুলতি করেন যে, ‘জমিদারেরা যখন আমার প্রতি অত্যাচার করে, এবং আমার নামে মিথ্যা মোকদ্দমা উপস্থিত করিতে যত্ন করে, আমি তখন গ্রামবাসী সকলকে ডাকিয়া আনি এবং আত্মাবস্থা জানাই। গ্রামের একটি কুকুর কোন প্রকারে অত্যাচারিত হইলেও গ্রামের লোক তাহার জন্য কিছু করে, কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, ও আমার এতদূরই দুর্ভাগ্য যে, আমার জন্য কেহ কিছু করিবেন, এরূপ একটি কথাও বলিলেন না। যাঁহাদের নিমিত্ত কাঁদিলাম, বিপদ মাথায় করিয়া বহন করিলাম, তাহাদিগের এই ব্যবহার।’

১৯.
এবার তাঁর বিখ্যাত সেই গানের বাণী পাঠ করা যাক।–
ওহে (হরি) দিন তো গেল, সন্ধ্যা হল, পার কর আমারে।
তুমি পারের কর্তা, শুনে বার্তা, ডাকছি হে তোমারে।।
আমি আগে এসে, ঘাটে রইলাম বসে
(ওহে, আমায় কি পার করবে নাহে, আমায় অধম বলে)
যারা পাছে এল, আগে গেল, আমি রইলাম পড়ে।।
যাদের পথ-সম্বল, আছে সাধনার বল,
(তারা পারে গেল আপন বলে হে)
(আমি সাধনহীন তাই রইলেম পড়ে হে)
তারা নিজ বলে গেল চলে, অকুল পারাবারে।।
শুনি, কড়ি নাই যার, তুমি কর তারেও পার,
(আমি সেই কথা শুনে ঘাটে এলাম হে)
( দয়াময় ! নামে ভরসা বেঁধে হে )
আমি দীন ভিখারী, নাইক কড়ি, দেখ ঝুলি ঝেড়ে।।
আমার পারের সম্বল, দয়াল নামটি কেবল,
(তাই দয়াময় বলে ডাকি তোমায় হে)
(তাই অধমতারণ বলে ডাকি হে)
ফিকির কেঁদে আকুল, পড়ে অকূল সাঁতারে পাথারে।।|

(তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া, দেশ, দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত