জন্মদিনের শুভেচ্ছাঞ্জলি

সরকার আবদুল মান্নান

প্রকাশ : ২১ জুলাই ২০১৮, ১১:১৮

১.
আজ তাঁর জন্মদিন। তিনি অধ্যাপক ড. সরকার আবদুল মান্নান (Sharkar Abdul Mannan), আমার প্রিয় ও পরম শ্রদ্ধেয় গবেষক, শিক্ষক মান্নান ভাই। তিনি ১৯৬৪ সালের ২১ জুলাই চাঁদপুর জেলার মতলব উপজেলার জহিরাবাদ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সাহিত্যের স্বজন, নন্দন শিল্পের পরম আত্মীয় মান্নান ভাইকে জন্মদিনে জানাই শুভেচ্ছা, সশ্রদ্ধ অভিবাদন, অতল ভালোবাসা। আপনার জন্মদিন শুভ হোক, প্রিয় মান্নান ভাই। আপনি ভালো থাকুন, জীবনানন্দে বাঁচুন, সুস্থ ও সুন্দর থাকুন। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিরন্তর। প্রিয় গবেষক, লেখক সরকার আবদুল মান্নান রচিত আলোচিত গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো: ‘উপন্যাসে তমসাবৃত জীবন নরেশচন্দ্র সেন গুপ্ত, জগদীশ গুপ্ত, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়’, ‘জগদীশ গুপ্তের রচনা ও জগৎ’, ‘শিক্ষা ও স্বদেশচিন্তা’, ‘কবিতার রূপকল্প ও আত্মার অনুষঙ্গ’, ‘গল্পের আল্পনা’, ‘কবিতার স্থাপত্যরীতি ও অন্যান্য প্রবন্ধ’, ‘বাংলা কথাসাহিত্য আধুনিকতার কুশীলব’ অন্যতম। শিশুসাহিত্যের প্রতি রয়েছে তাঁর বিশেষ দুর্বলতা। তাঁর লেখা শিশুতোষ গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে : দুষ্টু রাজকুমার ও অন্যান্য গল্প, জলের সঙ্গে শৈশব, কাক ও পুতুলের গল্প, ইঁদুর শিকারি ডুরি, পালতোলা নৌকা, জ্যোছনা রাতে ভূত, গল্পগুলো চিরকালের (সম্পাদিত), চিল ও মুরগীর ছানা।

২.
তাঁর পিতার নাম মো: আবদুল হাকিম সরকার এবং মায়ের নাম মিসেস মমতাজ বেগম। স্ত্রী ফেরদৌসী মমতাজ এবং কন্যা সেঁজুতি ও পুত্র সাকিবকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। অধ্যাপক ড. সরকার আবদুল মান্নান আমাদের প্রাণের শিক্ষাঙ্গন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ থেকে ১৯৮৫ সালে সম্মানসহ স্নাতক এবং ১৯৮৬ সালে স্নাতকোত্তর, ১৯৯৫ সালে এম.ফিল এবং ২০০২ সালে পি.এইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেন। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক পদে বর্তমানে দায়িত্বপালনকারী অধ্যাপক ড. মোঃ আবদুল মান্নান বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের একজন সম্মানিত সদস্য। তিনি ইতিপূর্বে বিভিন্ন সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করেছেন, দায়িত্ব পালন করেছেন শিক্ষা সংক্রান্ত নানান সরকারি দপ্তরেও। তবে আমার ব্যক্তিগত অভিমত তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মাঝে থাকলে প্রজ্ঞাবান শিক্ষকের সান্নিধ্য লাভ করে তারা ঋদ্ধ, আলোকিত ও আলোড়িত হতো যেমনটি, তেমনই গবেষক-লেখক হিসেবে মান্নান ভাই নিজের সৃজনীশক্তির, লেখক সত্ত্বার প্রতি আরো বেশি সুবিচার করতেন বলেই গভীরভাবে বিশ্বাস করি। জীবনের অভিজ্ঞতায় জেনেছি, সহায়ক পরিবেশের অভাবে আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো সৃজনশীল শিল্প-সাহিত্য বিকাশ শক্তিতে নিদারুণভাবে ব্যাহত করে, বিনষ্ট করে, ক্ষয় হয় সাধকের আরাধনা নিমগ্নতার মনোসংযোগ ভাব-অনুভবের। এর ফলে অনেক অপ্রয়োজনীয় কাজ করে জীবনীশক্তি-স্বপ্নের অপচয়, অবক্ষয় করতে হয়, ‘সময় খেয়ে ফেলে’ ‘সবারে আমি নমি’র নামতা জপের মোহে, আসক্তি রোগ ভোগে।

৩.
তাঁর পরম স্নেহাশীষ প্রীতির অবিরল ধারা সবসময়ই আমার জন্য অবারিত ছিলো, আজো আছে তেমনই। তাঁর সাথে দেখা হওয়া মানেই শিল্পকথনে মেতে উঠার না থামা আনন্দময় অভিযাত্রা, জম্পেস বিতর্কের ঝড় তুলে অভিজ্ঞান লাভের অভিজ্ঞতা। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই তাঁকে চিনি তাঁর মনস্বীতার কারণে, পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন আমার আরেক প্রিয়জন অনি’দা (অধ্যাপক অনিরুদ্ধ কাহালী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষক-গবেষক), বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে। পরে ভাস্কর্য ‘সংশপ্তক’-এর নিচে বসে বিশ্বসাহিত্যের দিকশূন্যপুরে পরিভ্রমণ করেছিলাম আমরা। মনে পড়ে সেই রাতের কথা, আমি তখন মানিকগঞ্জে সোনালী ব্যাংকে চাকুরি করি। বন্ধুবর মামুনের (মানিকগঞ্জের তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা জজ) কাছে আমার খোঁজ পেয়ে মান্নান ভাই হাজির হয়েছিলেন আমাদের আস্তানায়, জমেছিলো আলোকিত আলাপন। এরকম আরো অজস্র সম্প্রীতির স্মৃতির রেখাচিত্র আঁকা আছে আমাদের জীবনে, আছে কথায় কথায় রাত হয়ে যাওয়া ক্ষণের দিবারাত্রির কাহিনিও।

৪.
অধ্যাপক ড. সরকার আবদুল মান্নান আমাদের সাহিত্য-আলোচনার জগতে এক উল্লেখযোগ্য নাম। রচনার মনস্বীতার কারণেই মননশীল পাঠকসমাজে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা অনস্বীকার্য। তাঁর ভাবনার বিচরণ ক্ষেত্র জুড়ে রয়েছে সাহিত্যের প্রতি একনিষ্ঠ মমত্ত্ববোধ ও নিজস্ব সাহিত্য-চিন্তন। ভাষা, সাহিত্য, রবীন্দ্ররচনা, আধুনিক গদ্যসাহিত্য ইত্যাদি নানাবিধ বিষয়ের উপরে তাঁর রয়েছে অগাধ পাণ্ডিত্য। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত তাঁর রচিত ‘জগদীশ গুপ্তের রচনা ও জগৎ’ গবেষণা গ্রন্থটি যেমন আমার চিন্তাজগতকে নাড়া দেয় তেমনি তাঁর পি.এইচ.ডি অভিসন্দর্ভের পরিমার্জিত রূপে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘উপন্যাসে তমসাবৃত জীবন : নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, জগদীশ গুপ্ত ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়’ গ্রন্থটিও আমার প্রিয় একটি গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করি। স্বীকার করতে সংশয় নেই, অনেকের পি.এইচ.ডি অভিসন্দর্ভ রচনা পাঠের সুযোগ হয়েছে কিন্তু সেগুলোর মান এতটাই নিম্নস্তরের যে আমার মতোন অনেকেরই পি.এইচ.ডি-র প্রতি ভীতি জন্মে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। এক্ষেত্রে আক্ষরিক অর্থেই মনস্বীতায়, আপন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণী ও মৌলিক ভাবনার বৈভবে মান্নান ভাইয়ের ‘উপন্যাসে তমসাবৃত জীবন : নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, জগদীশ গুপ্ত ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়’ গবেষণা গ্রন্থটি অনন্যতা দাবি করে। গ্রন্থটি পাঠের পর গবেষক হিসেবে মান্নান ভাই পাঠকের সমীহ আদায় না করে ছাড়েন না। কারণ তাঁর গভীর পাঠ অভিজ্ঞান প্রসূত মূল্যায়ন বহুমাত্রিকতা লাভ করে শব্দঘর সৃষ্টি করে, নিজস্ব ভাষা স্বাক্ষর তৈরি করেন। এখানেই গবেষক হিসেবে তাঁর কৃতিত্ব, সাফল্য অন্যদের চেয়ে আলাদাই নন, স্বতন্ত্র। বাংলা কথাসাহিত্যে রবীন্দ্রযুগের অন্তিমপর্বের সমকালীন কিছু সাহিত্য সাধকের হাতে যে জটিল মানব প্রকৃতির বঙ্কিম ও বহুরৈখিক চরিত্র ক্রমশ উন্মোলিত হয়েছিলো, সেই ধারাবাহিকতার যাত্রাবিন্দু নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, মধ্যপথে জগদীশ গুপ্তের সাক্ষাৎ মেলে এবং একই পথে অনেক দূর হেঁটে যান মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। উল্লেখযোগ্য এই তিনজন কথাশিল্পীর উপন্যাসে বাঙালি সমাজের অস্বাভাবিক মনস্তত্ত্বের যে চরিত্রচিত্রণ উঠে এসেছে তার গভীর চিন্তাশ্রয়ী ও বিশ্লেষণ নির্ভর গবেষণাগ্রন্থ ‘উপন্যাসে তমসাবৃত জীবন : নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, জগদীশ গুপ্ত ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়’। গ্রন্থের ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় : মনোদৈহিক অসুস্থতার চালচিত্র’ প্রবন্ধটিও মানিককে বোঝার জন্য মানিকপ্রেমীদের জন্য অবশ্যপাঠ্য রচনা বলে বিবেচনা করি।

৫.
অচেনা জগদীশ গুপ্তকে নতুন করে চেনা-জানার সুযোগ হয় তাঁর ‘জগদীশ গুপ্তের রচনা ও জগৎ’ গবেষণাগ্রন্থটি পাঠের মধ্য দিয়ে। আমরা জানি, কথাসাহিত্যিক জগদীশ গুপ্ত (জন্মঃ ২২ আষাঢ়, ১৮৮৬ - মৃত্যুঃ ১৫ এপ্রিল, ১৯৫৭) কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও ছোটগল্পকার হিসেবেই বাংলা সাহিত্যে তিনি স্থায়ী আসন লাভ করেন। তিনি গল্প ও উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে স্বাতন্ত্র ধারা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। অনেকেই তাঁকে বাংলা ছোটগল্পের জনক বলে থাকেন। ১৩৩৪ বঙ্গাব্দে তাঁর গল্পের বই ‘বিনোদিনী’ প্রকাশিত হলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রংশসা করেছিলেন “ছোটগল্পের বিশেষ রূপ ও রস তোমার লেখায় পরিস্ফুট দেখিয়া সুখী হইলাম” এই বলে। যদিও বাংলঅ সাহিত্যে পতিতা-প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথও যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশ অসহিষ্ণু ও সমালোচনামুখর হয়ে উঠেছিলেন, তার প্রমাণ মেলে জগদীশ গুপ্তের ‘লঘু-গুরু’ উপন্যাসের আলোচনায়। তবে রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র বাংলা কথাসাহিত্যের যে আদর্শ নির্মাণ করেছিলেন, উত্তরপর্বে সেই রুচি, রূপ, রীতি ও বিশ্বাসকে অগ্রাহ্য ও বিচূর্ণ করে কথাসাহিত্যে যে পালাবদল এসেছিল, এক ভিন্ন অর্থে জগদীশ গুপ্ত ছিলেন তার প্রধান ঋত্বিক। মনে করতে পারি, রবীন্দ্রনাথের প্রতিক্রিয়া প্রকাশের প্রায় অর্ধ-শতক পরে এই ‘লঘু-গুরু’ উপন্যাস সম্পর্কে একালের সমালোচক মূল্যায়ন করেছেন : “কাম্য বিষয়ের স্পষ্টতায় এবং স্পষ্ট কামনার সঙ্গে প্রাক্তনের কর্মফলের সংঘাতে ব্যক্তির চূর্ণীকৃত রূপরচনায় লঘুগুরু অনুপম। লঘুগুরু তাঁর প্রথম দিকের উপন্যাস হলেও সার্থকতায় বোধ করি জগদীশ গুপ্তের সর্বোত্তম রচনা” (‘বাংলা উপন্যাসের কালান্তর’, সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা, ১৯৭১; পৃ. ২৬৪)। স্বতন্ত্র স্বাক্ষরে কথাশিল্পী জগদীশ গুপ্ত 'বিজলী', 'কালিকলম', 'কল্লোল' প্রভৃতি সেকালের নূতন ধরনের সকল পত্রিকাতেই গল্প প্রকাশ করেছেন। গল্প ও উপন্যাসের ক্ষেত্রে প্রকাশভঙ্গীর স্বাতন্ত্র্যের জন্য সাহিত্যিক মহলে বিশিষ্ট স্থান পেয়েছিলেন। ছোটগল্পের বিশিষ্ট শিল্পী ছিলেন জগদীশ গুপ্ত। গভীর জীবনবোধ, সুঠাম কাহিনীবিন্যাস ও চরিত্রচিত্রণের নৈপুণ্যে তাঁর ছোটগল্প সমৃদ্ধ হয়েছে। মনোবৈকল্য ও মনোবিশ্লেষণ এবং দুঃখময়তার নিপুণ বর্ণনায় তাঁর শিল্পকর্ম এক অসাধারণ সৃষ্টি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। সামাজিক অন্যায়-অবিচারের চেয়ে অদৃষ্টলিপিই দুঃখময়তার কারণ বলে তাঁর গল্পে বিশ্লেষিত। জগদীশ গুপ্ত জন্মেছিলেন সেকালের নদীয়া জেলার মহকুমা-শহর কুষ্টিয়ার গড়াই নদীর তীরে আমলাপাড়ায়। অবশ্য তাদের আদি আবাস ছিলো ফরিদপুর জেলার খোর্দ মেঘচারমি গ্রামে। পিতা কৈলাশচন্দ্র গুপ্ত কুষ্টিয়া আদালতের বিশিষ্ট আইনজীবী ছিলেন। পিতার কর্মসূত্রে জগদীশ গুপ্ত কুষ্টিয়া জেলার আমলাপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯০৫ সালে কলকাতা সিটি কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। অতঃপর কলকাতা রিপন কলেজে ভর্তি হন। ১৯০৭ সালে এফ. এ পরীক্ষা দিয়ে কলেজের পাঠ ত্যাগ করেন। পরবর্তীতে কলকাতা কমার্শিয়াল ইন্সটিটিউট থেকে শর্টহ্যান্ড ও টাইপরাইটিং শিক্ষা গ্রহণ করেন। বীরভূম জেলার সিউড়ি জজকোর্টে টাইপিস্টের চাকুরী লাভ করেন ১৯০৮ সালে। সেখানে ৪/৫ বছর চাকুরীর করার পর উড়িষ্যার সম্বলপুরে একজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ারের অফিসে পুণরায় টাইপিস্টের চাকুরী গ্রহণ করেন ১৯১৩ সালে। কিন্তু কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মনোমালিন্য ঘটায় চাকুরী থেকে ইস্তফা দেন তিনি। অতঃপর কলকাতার "জাগো'স ইঙ্ক" নামের ফাউন্টেনপেনের কালি তৈরীর একটি কারখানা খোলেন। এ ব্যবসায় উন্নতি করতে না পেরে ১৯২৭ সালে বোলপুরের চৌকি আদালতে আবারো টাইপিস্টের চাকুরীতে যোগদান করেন। সেখানে একটানা ১৭ বছর চাকুরীর করার পর ১৯৪৪ সালে অবসর গ্রহণ করেন। এরপর কুষ্টিয়ায় বাস করতে থাকেন। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর কুষ্টিয়া ত্যাগ করে কলকাতায় গমন করেন ও সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। জগদীশ গুপ্ত রচিত গল্পগ্রন্থঃ বিনোদিনী (১৩৩৪); রূপের বাহিরে (১৩৩৬); শ্রীমতি (১৩৩৭); উদয়লেখা (১৩৩৯); শশাঙ্ক কবিরাজের স্ত্রী (১৩৪১); মেঘাবৃত অশনি (১৩৫৪); স্বনির্বাচিত গল্প (১৩৫৭) উপন্যাসঃ অসাধু সিদ্ধার্থ (১৩৩৬); লঘুগুরু; দুলালের দোলা (১৩৩৮); নিষেধের পটভূমিকায় (১৩৫৯); কলঙ্কিত তীর্থ (১৩৬৭), কবিতা-সঙ্কলনঃ অক্ষরা। স্মরণ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরীর ‘জগদীশ গুপ্তের গল্প : পঙ্গ ও পঙ্গজ’ গবেষণা গ্রন্থটির পাঠও আমার জগদীশ গুপ্ত প্রীতির ক্ষুধা নিবৃত্তিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিলো। আমার জগদীশ প্রেম সৃষ্টি হয় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পাঠচক্রে, সেই জগদীশ গুপ্ত পাঠ আগ্রহ তীব্রতায় সবিশেষ সহায়ক ভূমিকা পালন করে মান্নান ভাইয়ের ‘জগদীশ গুপ্তের রচনা ও জগৎ’ গবেষণাগ্রন্থটি। আমার একান্ত অবোধ বিবেচনায় অনেক গ্রন্থ রচনা করলেও এই গবেষণাগ্রন্থ দু’টির কারণেই অধ্যাপক ড. সরকার আবদুল মান্নান বাংলা ভাষা ও সাহিত্য জগতে আলোচিত গবেষক হিসেবে শ্রদ্ধার সাথে উল্লেখিত হবেন।

৬.
আবার একনিষ্ঠ শিক্ষা গবেষক হিসেবে অধ্যাপক ড. সরকার আবদুল মান্নান-এর শিক্ষা ভাবনা আমাকে বিশেষভাবে প্রাণিত করে। তিনি যেন আমার চিন্তাকেই সার্বৃজনীন করে তোলেন তাঁর রচনা দক্ষতায়। তাঁর ভাষ্যকে গুরুত্ব দিতেই হয় যখন তিনি লেখেন, ‘শিক্ষক বিপুল পান্ডিত্যের অধিকারী। কিন্তু তিনি সকল শিক্ষার্থীর সঙ্গে কার্যকর যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেন না। তিনি কিছুতেই ভালো শিক্ষক হতে পারেন না। তাকে অবশ্যই শিক্ষার লক্ষ্য (aims of education), শিক্ষার বিষয়বস্তু (subject matter of education), শিক্ষার পদ্ধতি (methods of teaching) এবং শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন পদ্ধতি (assessment strategy) সম্পর্কে পরিচ্ছন্ন ধারণা থাকতে হবে। তা হলে তিনি চমৎকারভাবে একটি ফলপ্রসু শ্রেণিকার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবেন এবং সকল শিক্ষার্থী উপকৃত হবে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, আমাদের অধিকাংশ শিক্ষক শিক্ষকতার জন্য প্রতিনিয়ত প্রস্তুতির কথা একেবারেই ভুলে বসে আছেন। তারা মনে করেন, শিক্ষকতার জন্য কিছুই করতে হয় না। ফলে তারা শিক্ষক ছাড়া আর সবই হন অথবা কিছুই হন না। অনেকে মাতাব্বর হন, মোড়ল হন, পলিটিশিয়ান হন, ব্যবসায়ী হন, কৃষক হন, চাকরিজীবী হন কিন্তু কিছুতেই শিক্ষক হতে পারেন না এবং কোনো রকম মর্যাদার আসনও লাভ করেন না। অথচ এরা সারাক্ষণ বলে বেড়ান যে, শিক্ষকদের কোনো মর্যাদা নেই এবং শিক্ষকতা হলো একটি বাজে পেশা।’ (দৈনিক সংবাদ, ১৭ জুলাই, ২০১৮)

৭.
তাঁর বিশেষ কিছু রচনা রয়েছে- বিশেষ করে কবিতা, যা তাত্ত্বিক স্তরের অর্থাৎ সাহিত্য-দর্শনের প্রেক্ষাপটে, এবং কিছু আছে নির্দিষ্ট সাহিত্য-স্রষ্টার বিচার ও মূল্যায়নের নিরীখে। কবিতা নিয়ে তাঁর ভাবনার অভিনবত্ব যে কোনো পাঠককেই মুগ্ধ করবে নিঃসন্দেহে। কেবল কবি হয়ে ওঠাই নয়, কবিতা ভাষ্যকার হিসেবে, কবির শিল্পকলার ছবি আঁকার ক্ষেত্রে সরকার আবদুল মান্নানের সদা তৎপরতা দৃশ্যমান হয়। ফলে ‘কবিতার স্থাপত্যরীতি’র মতোন প্রবন্ধ যেমন রচনা করেন, তেমনি দেখা মেলে কবিতা প্রসব যন্ত্রণা অভিজ্ঞতাসঞ্জাত লেখারও। কবিতা রচনার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি অকপটে বলছেন, ‘‘অধিকাংশ সময়ই বিষয়টি অত সহজ নয়। কবি তাঁর ভাবনার চিত্রটিকে শব্দের মধ্যে সংস্থাপিত করতে চান। সুতরাং শব্দই তাঁর প্রথম এবং প্রধান হাতিয়ার। আর শব্দকে যে তিনি কতভাবে পরিবর্তন করেন, পরিমার্জন করেন, অদল-বদল করেন, প্রতিস্থাপন করেন, স্থান পরিবর্তন করেন তার ইয়ত্তা নেই। এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে তিনি ভাবনার সর্বোত্তম ভাষিক পরিস্থিতি তৈরি করেন। একই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তিনি পদ/ অতিপর্ব/ পর্ব/ পঙ্ক্তি সুস্থিত করে নেন। এর জন্যও তিনি আশ্রয় নেন পর্ব ছোট-বড় করার, স্থান পরিবর্তন করার, পঙ্ক্তি ছোট-বড় করার, ভাঙা-গড়ার। এছাড়া যতিচিহ্ন দিয়ে বা না-দিয়ে তিনি তাঁর নিজস্ব অর্থময়তাকে সন্তুষ্ট করতে চান। ভাবনার উল্লম্ফন কিংবা দূরান্বয়ের মধ্যেও তিনি কবিতাটির মধ্যে একটি ভেতরগত ঐক্য ও সংস্থাপনা রক্ষা করতে চান কিংবা ঐক্য ও সংস্থাপনার প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো প্রত্যয় প্রবল করে তুলতে চান। এভাবে যখন পুরো কবিতাটি সৃষ্টি হয়ে যায় তখন তিনি কবিতাটি পড়েন - মনে মনে পড়েন, কখনো কখনো সশব্দে পড়ে নিজেকে শোনান। কবিতাটির ধ্বনিগত সাম্য ও প্রকটিত ছন্দ কিংবা অন্তর্গত ছন্দের যথার্থতা অনুভব করে নেন। পরিশেষে একটি কবিতা সৃষ্টি হয় এবং কবি একটি কবিতা সৃষ্টির আনন্দ উপভোগ করেন।’

৮.
‘কবিতা : কথার ভিতরে অনেক কথার শিল্প’ প্রবন্ধটিতে তিনি কবিতা নিয়ে বলেছেন মনে রাখবার মতোন অনুভবশ্লোক, ‘রহস্যময়তা কবিতার প্রাণ। এই রহস্যময়তার সৌন্দর্য ও শক্তির বলেই কবিতা আলাদা হয়ে যায় গল্প-উপন্যাস থেকে, গদ্যসাহিত্য থেকে, ছড়াসাহিত্য থেকে। কবিতার এই অনন্য স্বরূপের জন্যই তার নিকট আত্মীয়তা চিত্রশিল্পের সঙ্গে, ভাস্কর্যের সঙ্গে, কখনো কখনো সংগীতের সঙ্গেও। এবং এই একই শক্তিতে কবিতা তার ক্ষীণ তনু অবয়বে ধারণ করতে পারে মহাকাব্যিক জীবনতৃষ্ণাকে। ধ্বনি মাত্রের মধ্যে, শব্দের মধ্যে, পঙ্‌ক্তির মধ্যে একজন শক্তিমান কবিকে ফলিয়ে তুলতে হয় অনেকান্ত জীবনের আখ্যান। কেননা অনেক কথা বলার স্বাধীনতা তার নেই, গদ্যশিল্পীর মতো পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখে যাওয়ার সুযোগ সে পায় না, ছড়াকারের মতো অর্থহীন বা প্রত্যক্ষ কিছু বলাও তার অন্বিষ্ট নয়। সুতরাং কবির স্বাধীনতাহীনতার জায়গাতেই তাঁকে তৈরি করে নিতে হয় অফুরন্ত স্বাধীনতার গোপন এক ফল্গুধারা। আর এখানেই কবি সৃষ্টি করেন রহস্যময় এক জগৎ, যেখানে বহুতর ভাবনার আনন্দিত বিহার মুক্তির আস্বাদ লাভ করে, কথার মধ্যে লুকিয়ে থাকে অনেক কথা। কবিতার এই রহস্যময়তার উদ্ভব ভাবনার জটিলতা থেকে ঘটে না এবং বিষয়টি এমন নয় যে, নিরন্তর অধ্যবসায়ের মাধ্যমে জট উন্মোচন করে একটি সুনিশ্চিত সমাধানে উপনীত হওয়া যায়। বিজ্ঞানে, গণিতে, দর্শনে এবং জ্ঞানতত্ত্বের অন্যান্য শাখায় সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায়, সমাধান লাভ করা যায়। এই সিদ্ধান্ত বা সমাধান চিরকালীন নাও হতে পারে, তবে সময়ের চাহিদা বেশ ভালোভাবেই মেটানো যেতে পারে। কিন্তু কবিতার রহস্য জ্ঞানকাণ্ডের পরিধির মধ্যে পড়ে না। ব্যক্তি তার বিচারবোধ দিয়ে, চিন্তাশক্তি, আবেগ ও কল্পনার সাহচর্যে কবিতার রহস্যময়তার নিজস্ব ব্যাখ্যা প্রদান করতে পারে; কিন্তু সেই ব্যাখ্যা অন্যের কাছে তো নয়ই, কখনো কখনো নিজের কাছেও অগ্রহণযোগ্য হতে পারে। কবিতার এই যে মীমাংসাহীন রহস্য, এর মধ্যে নিহিত থাকে কবিতার চিরকালীনতার শক্তি। কবিতা থেকে যদি রহস্য ফুরিয়ে যায় তাহলে কবিতার মৃত্যু ঘটে। রহস্যহীন কবিতা কবিতা নয় – পদ্য, ছড়া। পদ্য বা ছড়ার সামাজিক মূল্য থাকে, এক ধরনের সাহিত্যমূল্যও নিশ্চয়ই থাকে। কিন্তু কবিতা অনন্য এক শিল্প, অফুরন্ত এর মাহাত্ম্য। রহস্যময়তা কবিতাকে এই অনন্য মাহাত্ম্য দান করে। একটি কবিতা শত শত বছর ধরে পাঠকের আনন্দিত অভিজ্ঞতার বিষয় হয়ে ওঠে এ-রহস্যকে আশ্রয় করে। এ হচ্ছে কবিতার এমন এক শক্তি যা পাঠককে আনন্দিত ভাবনায় নিমজ্জিত করে, নতুন বোধের উদ্বোধন ঘটায়, চেতনার জগতে শুদ্ধতার সৃষ্টি করে, নতুন জীবন-তৃষ্ণায় উদ্বুদ্ধ করে।’

৯.
সরকার আবদুল মান্নানকে আমার প্রবন্ধকার হিসেবেই বেশি ভালো লাগে, কারণ তাঁর রচনাভাষ্য মনে দাগ কেটে যায়, ভাবনারা আমার মতোন পাঠকের মনের আকাশে মেঘমালা হয়ে খেলা করে। আসলে কথাশিল্পী কিংবা কবি- সকলেই তো শব্দ নিয়ে খেলা করতে ভালোবাসেন, শব্দের জাল বুনতে বুনতে স্বপ্নকে ধরে ফেলেন। আর এমনই ভাবনার দেখা পাওয়া তাঁর ‘শব্দের সীমানা’ প্রবন্ধটি আমার ভালো লাগা একটি অন্যতম রচনা। যেখানে তিনি বলেছেন, ‘অনেক দিন চলতে চলতে টাকা একসময় অচল হয়ে যায়। লোকে বলে অচল টাকা। শুধু টাকা নয়, অনেক কিছুই অচল হয়। মানুষ, হাটবাজার, শহর-বন্দর, রাস্তাঘাট অচল হয়। আবার অচল হয় না। এমন কিছু বিষয়-আশয়ও আছে। এই পৃথিবী, এই চাঁদ-সূর্য কতদিন ধরে চলছে - আমরা তা জানি না। মাথার ওপরে আছে বিপুল আকাশ, আছে রহস্যময় রাতের তারা। লক্ষ-কোটি বছর ধরে আছে। এসব কখনো হারিয়ে যাবে কি-না আমরা তার কিছুই জানি না। আর আমাদের চারপাশে এই যে রঙের খেলা, গন্ধের বিস্তার, প্রাণের কোলাহল - এসবও যে কত সহস্র বছর ধরে আছে তার কোনো হিসাব নেই। এসব কি কখনো অচল হবে, হারিয়ে যাবে? আমরা জানি না; কিন্তু কিছু শব্দ চলতে চলতে এক সময় আর চলতে পারে না। অচল হয়ে যায়। হৃদয়ের আনন্দ আর আর্তিতে ভরপুর এবং মমতারসে সিক্ত শব্দগুলো এক সময় হারিয়ে ফেলে তার সব ঐশ্বর্য, সব আবেদন। কখন থেকে যেন শব্দগুলো কেউ আর ব্যবহার করে না। কোন জাদুমন্ত্রে কবিগণ জেনে যান যে, এসব শব্দ ব্যবহার-উপযোগী নয় আর। পাঠকের ভাষাবোধে বোধ করি হোঁচট খায়। সময়ের সঙ্গে শব্দগুলো আর যায় না, সময়ের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। ফলে কবিগণ সহজাত ও সচেতন এক ভাষিক সদস্য হিসেবে বুঝে যান, কোন শব্দ কবিতায় আর ব্যবহৃত হতে পারে না। ব্যবহার করেন না বটে, কিন্তু কখনো ব্যবহৃত হতো; অসাধারণ শক্তি, সৌন্দর্য আর বিস্ময়কর রহস্য নিয়ে যখন শব্দগুলো কবির ভাবের জগৎকে আলোকোজ্জ্বল করে তুলত, সেই কবিতাগুলো তো আবেদন হারায় না কখনো। কবিভাষার কিছু কিছু উপাদান পুরনো হয়ে গেলেও কবিতাগুলো কখনো পুরনো হয় না। তার মানে, শব্দ পুরনো হয়ে যেতে পারে; কিন্তু কিছু কবিতা কখনোই পুরনো হয় না। বিস্ময়কর আবেদন আর ব্যঞ্জনা নিয়ে বেঁচে থাকে বহুকাল। এই চিরকালীনতার রহস্য কোথায়? কবিতার মধ্যে, নাকি পাঠকের মধ্যে, নাকি কবিতা ও পাঠক - এই উভয়ের মধ্যে। কবিতার আপন স্বভাবে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠার বিষয়টি সব কালেই ছিল সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। চিরকালীনতার রহস্য কবিতারই অন্বিষ্ট। আর পাঠক-অবচেতনে শব্দ-সংস্কৃতির ঐতিহ্য লুকিয়ে থাকেই। শত শত বছরের আগের শব্দ, যে-শব্দে এখন আর কেউ বলেন না, যে-শব্দে কেউ আর লেখেন না, যে-শব্দ সেই সময়ের কবিতার দেহে আসীন হয়ে আছে, সেই শব্দ কবিতার দেহ থেকে পাঠকমনে আলোড়ন তোলে শব্দ-সংস্কৃতির অবচেতন ঐতিহ্যের জন্যই। যে-ভাষায় একজন পাঠক কোনোদিন লেখেননি, লিখবেনও না - মাতৃভাষার সেই রূপের কবিতা তাকে কেন মোহাবিষ্ট করে, কেন তার চিরকালীন এক ভালোলাগার জগতের দরজা-জানালাগুলো খুলে দেয়, তার রহস্যও লুকিয়ে থাকে তার ভাষা-সংস্কৃতির ঐতিহ্যের মধ্যে, ভাষা-পুরানের প্রত্ন-ইতিহাসের মধ্যে।

১০.
বর্তমান বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা, তার মেরুকরণ ও তার সার্বিক ফলাফল আমাদের মনে নানা অতৃপ্তি জন্ম দিচ্ছে; সে-কারণে শিক্ষা, বাচনকলা ইত্যাদি নিয়েও তাঁর চিন্তাশীলতা পাঠককে চিন্তায় উদ্বুদ্ধ করে প্রতিনিয়ত। ‘মানসম্মত শিক্ষা’ নিয়ে ভাবনা তাঁর আগ্রহের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। যেমনটি পরিচয় পাই ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষায় পঠন-পাঠন’ প্রবন্ধে। সরকার আবদুল মান্নান লিখছেন, ‘সবার জন্য শিক্ষা’- এই স্লোগানের দিন শেষ হয়েছে। এখন শ্লোগান হলো ‘সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা’। আর মানসম্মত শিক্ষার প্রশ্নটি যখন উত্থাপিত হয় তখনই বিবেচনায় নিতে হয় একটি দেশের সকল অধিবাসীকে, সকল নাগরিককে। আর এই অধিবাসীদের মধ্যে আছে সংস্কৃতিগত ভিন্নতা ও ভাষাগত ভিন্নতা। এই ভিন্নতাকে যদি মানসম্মত শিক্ষার বলয়ে নিয়ে আসা যায় তা হলেই মানসম্মত শিক্ষা একটি সার্বজনীন রূপ পরিগ্রহ করবে। মানসম্মত শিক্ষার এই সার্বজনীনতা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজন প্রত্যেক শিশুকে তার মাতৃভাষায় শেখার অধিকার নিশ্চিত করা। কেননা, একজন শিশু যতটা স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে এবং আনন্দের সঙ্গে মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভ করতে পারে অন্য কোনো ভাষায় তা কখনই সম্ভব নয়। একই মতামত প্রকাশ করেছে ইউনেস্কো। ‘Education in a multilangual world’ নামে একটি প্রতিবেদনে সংস্থাটি জানিয়েছে [ … ] research has shown that learners learn best in their mother tongue as a prelude to and complement of bilingual education approaches.’ মাতৃভাষায় শিখন-শেখানোর সঙ্গে শিক্ষার্থীদের আত্মপরিচয় (identity), জাতীয়তাবোধ ও ক্ষমতার বিষয় জড়িত। কোনো শিশুর পড়াশোনা যদি শুরুই হয় অন্য ভাষায় তা হলে তার মধ্যে পরিচয়ের, জাতীয়তাবোধের ও ক্ষমতায়নের সঙ্কট দেখা দেয় এবং শিক্ষার্থীরা সহজাত এক শিখনপ্রক্রিয়ায় শিক্ষালাভ থেকে বঞ্চিত হয়।’

১১.
একজন অনুবাদ হিসেবেও সরকার আবদুল মান্নান আমার কাছে সম্মানিতজন। বিশেষ করে তাঁর অনূদিত ডিক গেগরির আত্মজীবনী থেকে ‘আমি কখনো ঘৃণা করতে শিখিনি’ রচনাটি আমার ভীষণই প্রিয় বলে অনেকের কাছেই উল্লেখ করে থাকি এবং সেটি পাঠ করতে উদ্দীপ্ত করি। আমার মতে রচনাটি প্রতিটি শিক্ষকের জন্য পাঠ আবশ্যিক, বাধ্যতামূলক করা উচিত। আমরা শিক্ষকগণ শিক্ষার্থীর মানসিক ও অর্থনৈতিক অবস্থাকে অনেকসময়ই দারুণ অবহেলা করি, শিশু শিক্ষার্থীর মনোজগতকে জানার চেষ্টা না করেই নিয়মের অক্টোপাসে আটকে ‘জিপিএ’র ‘বনসাই’ বানাতে সদা তৎপর থাকি আর সেটাকেই সাফল্য বলে ধন্য ধন্য বলি নিজেদের। এক্ষেত্রে ডিক গেগরির আত্মজীবনীটি আমাদের শিক্ষকদের আত্মপরিচয় উন্মোচনে সবিশেষ সহায়ক হতে পারে বলেই বিবেচনা করি। আমেরিকায় জন্মগ্রহণকারী পিতৃপরিচয়হীন এক কৃষ্ণাঙ্গ ডিক গেগরি। উল্লেখ্য, এই মানুষটি ধনী আমেরিকায় দরিদ্রতম শৈশব অতিবাহিত করেন। অসাধারণ এক সংগ্রামমুখর জীবনে তিনি শেষপর্যন্ত প্রতিষ্ঠা লাভ করেন কৌতুকাভিনেতা হিসেবে, সামাজিক ন্যায়পরায়ণতার একজন ভাষ্যকার হিসেবে এবং লেখক ও ব্যবসায়ী হিসেবে। বিশেষ করে কালো মানুষদের বঞ্চনার বিরুদ্ধে তিনি সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। এই অসাধারণ মানুষটির শৈশবের এক যন্ত্রণাদায়ক অধ্যায়ের পরিচয় পাওয়া যায় আমি ‘কখনো ঘৃণা করতে শিখিনি’ নামক ক্ষুদ্র আত্মজীবনীতে। সেটিরই সফল অনুবাদ করেছেন মান্নান ভাই। তাঁরই অনুবাদে রচনার কিছু উল্লেখযোগ্য অংশ পাঠ করা সময়ের দাবির কারণেই জরুরি। ডিক গেগরি অকপটে লিখেছেন, ‘আমার ঘরে এবং আমার পরিবারে আমি কখনো ঘৃণা করতে শিখিনি। লজ্জিত বা অপমানিত হওয়ার কারণও কখনো ঘটেনি। স্কুলে যাওয়ার পর আমি প্রথম ঘৃণার মুখোমুখি হই, অপমান ও লজ্জার মুখোমুখি হই। তখন কত হবে আমার বয়স? সাত। সাতের বেশি নয়। … শিক্ষক ভেবেছেন আমি বোকা আর বেয়াদপ আর অপদার্থ। বানান করতে পারি না। পড়তে পারি না। অঙ্ক পারি না। বোকার হদ্দ। শিক্ষক কখনোই বুঝতে চাইবেন না যে তুমি খুব ক্ষুধার্ত। সকালে নাস্তা খেতে পাওনি। খিদের জ্বালায় তুমি পড়ায় মনোনিবেশ করতে পারছ না। তোমরা হয়তো দুপুরের খাবারের কথা ভাবছ। দুপুরের খাবার তো হবেই। কিন্তু সেই খাবার কি সত্যি সবার আসে? আসে না। সে ক্ষেত্রে একজন ক্ষুধার্ত শিশু হিসেবে তুমি অন্য শিশুদের খাবারে কামড় বসাতে পারো। … আমার জীবনে সবকিছুই ছিল অভূতপূর্ব, দুর্লভ। বিস্ময়কর দারিদ্র্য নিয়ে আমার ছিল নিত্য বসবাস। ধুলো আর দুর্গন্ধময় জীবন, কনকনে ঠাণ্ডায় হাড় কাঁপানো জীবন, এক বস্ত্রে নিত্যদিন কাটানোর জীবন এবং বাধাহীন এতিম জীবন—এই সব নিয়ে আমার যে জীবন—অখাদ্য পেস্টির স্বাদ সেখানে মন্দ নয়। শিক্ষক ভেবেছিলেন, আমি গোলমাল পাকানোর ছেলে। রুমের সামনে থেকে তিনি সবাইকে দেখছিলেন। আর দেখছিলেন পেছনের চক দিয়ে গোল দাগ দেওয়া সিটে বসে আছে একটি কালো ছেলে। বদমাইশ ছেলে। গণ্ডগোল পাকানোর ছেলে। কাছে-পিঠের সবাইকে সে খোঁচাচ্ছে, উত্যক্ত করছে। আর আমার মনে হলো তিনি সত্যিকারের দুষ্ট ছেলেটাকে দেখছেন না।… 
শিক্ষক আমার দিকে তাকালেন। তিনি ক্ষিপ্ত। পাগল প্রায়।
‘রিচার্ড, আমরা অর্থ সংগ্রহ করছি তোমার জন্য। তোমার প্রতি দয়া দেখানোর জন্য আমাদের এই আয়োজন। তোমার বাবা যদি পনের ডলার দিতে পারেন তা হলে তো রিলিফ নিয়ে তোমার কোনো কাজ নেই। তা-ই না?’
‘জি, মেম। টাকাগুলো আমি এখনই পেয়েছি। এই কিছুক্ষণ আগে। বাবা আমাকে দিয়েছেন। বলেছেন আমি যেন।’
‘আরও কিছু?’
আমার কথা শেষ করতে না দিয়েই শিক্ষক অবজ্ঞা আর কৌতুকের সঙ্গে জানতে চাইলেন। তখন তার নাসারন্ধ ফোলা, ঠোঁট কম্পমান পাতার মতো হালকা এবং চোখ বিস্ফোরিত। বললেন তিনি,
‘আমরা জানি, তোমার কোনো বাবা নেই। তুমি এতিম।’
হেলেন আমার দিকে তাকাল। তার চোখ জলে ভরা। আমার অসহায়ত্ব তাকে বেদনা-ভারাক্রান্ত করেছে। কিন্তু আমি আর তার দিকে তাকাতে পারলাম না। আসলে আমিও তখন কাঁদছিলাম।’

১২.
সম্প্রতি দৈনিক সংবাদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যায় (১৭ জুলাই, ২০১৮) প্রকাশিত তাঁর অত্যন্ত যুগোপযুগী শিক্ষাচিন্তা ‘শিক্ষকের মর্যাদা প্রসঙ্গ প্রসঙ্গান্তর’ রচনাটিও মনে দাগ কাটে। শিক্ষা গবেষক হিসেবে অধ্যাপক ড. সরকার আবদুল মান্নান উল্লেখ করতে দ্বিধা করেন না, ‘শিক্ষকের মর্যাদার বিষয়টি আমাদের দেশে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রসঙ্গ। বিশেষ করে গড়পড়তা মানুষের আর্থিক সক্ষমতা যখন বাড়ছে তখন এই প্রসঙ্গটি জোরালো হয়ে উঠছে। মানুষের আর্থিক সক্ষমতা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিপুল উত্থানের এই ক্রান্তিলগ্নে সামাজিক যে পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে এবং সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের যে সঙ্কট তৈরি হচ্ছে তার সঙ্গে বিচিত্র অনুষঙ্গে শিক্ষকের মর্যাদার প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আলোচনার এই পটভূমিতে যাওয়ার পূর্বে আমাদের বিবেচনা করতে হচ্ছে যে, ‘শিক্ষক’ কাকে বলে, আর তার পরিপূর্ণ অবয়বটি-বা কেমন।’ তিনি আরো উল্লেক করছেন, ‘একজন শিক্ষককে প্রথমেই ভালো শিক্ষক হতে হবে। একসময় মনে করা হতো যে, একজন ভালো শিক্ষক মানে অসাধারণ পান্ডিত্যের অধিকারী গুরুগম্ভীর একজন মানুষ। শিক্ষার্থীরা কী বুঝল বা না বুঝল তাকে কিছুমাত্র বিবেচনায় না নিয়ে তিনি মনের আনন্দে বক্তৃতা দিবেন এবং শিক্ষার্থীদের প্রচন্ড শাসনের মধ্যে রেখে ক্লাসের কাজ শেষ করবেন। শিখন-শেখানোর এই সনাতন পদ্ধতি এখনো বর্তমান আছে। এই পদ্ধতিতে যারা শিখন-শেখানো কার্যক্রম পরিচালনা করেন তারা কোনো অবস্থাতেই ভালো শিক্ষক নন। অ্যাডাম স্মিথ (১৭২৩-১৭৯০) একটি চমৎকার কথা বলেছেন : ‘the teacher teaches John Latin’। এর মানে হলো শিক্ষককে শুধু ল্যাটিন জানলেই হবে না, তাকে ‘জন’কেও জানতে হবে। জনের সম্পর্কে জ্ঞান থাকা মানে হচ্ছে তার মনের গড়ন, প্রকৃতি, ক্ষমতা, তার আবেগ, ভালো লাগা-মন্দ লাগা ইত্যাকার বিচিত্র বিষয় সম্পর্কে শিক্ষকের পরিচ্ছন্ন ধারণা থাকা অপরিহার্য। খুব ছোট একটি বাক্যের মধ্যে অ্যাডামস আধুনিক শিক্ষামনস্তত্ত্বের পুরো জগৎটিকে ধরতে চেষ্টা করেছেন। এক পরিমাপকে সকল শিক্ষার্থীকে মূল্যায়ন করার যুগ শেষ হয়েছে অনেক আগেই। এখন প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে এক একজন স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব (individual personality) হিসেবে বিবেচনা করতে হয় এবং প্রত্যেকের স্বতন্ত্র শিখনচাহিদাকে সন্তুষ্ট করতে হয়।’

১৩.
প্রাবন্ধিক, গবেষক অধ্যাপক ড. সরকার আবদুল মান্নান সমাজের অসুখ জানেন বলেই লিখছেন, ‘শিক্ষার্থীকে শারীরিক ও মানসিকভাবে হেনস্তা করার যুগও শেষ হয়েছে। কেননা শিক্ষাবিজ্ঞানিগণ স্পষ্টভাবেই প্রমাণ করতে পেরেছেন যে, শারীরিক ও মানসিক শাস্তির ভিতর দিয়ে শিক্ষার্থীকে শিক্ষিত ও সুনাগরিক করে তোলা যায় না। উপরন্তু এ ধরনের শাস্তি তার মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে এবং তার বিকাশের পথ রুদ্ধ করে দেয় । সুতরাং একজন ভালো শিক্ষক অবশ্যই বিবেচনায় রাখবেন যে, তার ক্লাসে কোনো শিক্ষার্থী যেন তার আচরণে বিব্রত না হয়, অপমানিত না হয়, মনোকষ্ট না পায়। বরং তার ক্লাসটি সকল শিক্ষার্থীর জন্য হবে আনন্দদায়ক। ক্লাসে সকল শিক্ষার্থী শিক্ষকের নির্দেশনা মতো কথা বলবে, কাজ করবে, আঁকবে, দেখবে, পড়বে। অর্থাৎ শিক্ষকের কাজ হলো ক্লাসে শিখন-শেখানো কার্যক্রমে সকল শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। তিনি কোনো অবস্থাতেই বিবেচনায় রাখবেন যে, কোন শিক্ষার্থী দুর্বল, কোন শিক্ষার্থীর ধর্মীয় পরিচয় কী, কোন শিক্ষার্থীর আর্থিক ও সামাজিক অবস্থান কী, কোন শিক্ষার্থী দেখতে কেমন, কোন শিক্ষার্থীর সঙ্গে তার সম্পর্ক কী। তিনি শুধু বিবেচনায় রাখবেন যে, সকল শিক্ষার্থী তার ছাত্র বা ছাত্রী। এমনকি শিক্ষার্থীর লৈঙ্গিক পরিচও গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। তিনি সকলকে সমান চোখে দেখবেন এবং শিখনচাহিদার ভিন্নতা অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের পাঠদান করবেন। শিক্ষককে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, তার মনোযোগ ও স্নেহ থেকে কোনো শিক্ষার্থী যেন বঞ্চিত না হয়। তিনি যেন কিছুতেই বৈষম্যমূলক আচরণ না করেন। ক্লাসরুমে তিনি এমন একটি বন্ধুর পরিবেশ তৈরি করবেন যেখানে সকল শিক্ষার্থী নিজেদের সবচেয়ে নিরাপদ মনে করবে। একজন শিক্ষক সর্বদাই আশাবাদী মানুষ। তার চিন্তায়, কর্মে ও কথায় এবং তার সামগ্রিক জীবনাচরণে একজন আশাবাদী মানুষের পরিচয় মূর্ত হয়ে উঠবে। শিক্ষার্থীদেরও তিনি আশাবাদী মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবেন। সুতরাং তার দায়িত্ব হলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে জীবনের প্রতি কৌতূহল ও মমত্ববোধ তৈরি করা। প্রত্যেক শিক্ষার্থী যেন তার অফুরন্ত সামর্থ্যরে সঙ্গে পরিচিত হতে পারে, অফুরন্ত সম্ভাবনার সঙ্গে পরিচিত হতে পারে- শিক্ষক তার সেই সম্ভাবনার দরজা-জানালাগুলো খুলে দেবেন। শিক্ষক শিক্ষার্থীকে চিন্তার চর্চা করতে শেখাবেন আর সৃষ্টিশীল ভাবনার বিকাশ ঘটানোর পথ করে দেবেন। এইভাবে তিনি মর্যাদাবান মানুষ হয়ে উঠবেন।’

১৪.
শিক্ষা গবেষক অধ্যাপক ড. সরকার আবদুল মান্নান-এর মতামতকে গুরুত্ব না দিয়ে উপায় নেই যখন তিনি শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের জ্ঞানে ও জীবন বাস্ততার নিরিখে উল্লেখ করেন, ‘সকল শিক্ষার্থী পড়াশোনায় ভালো হবে এমনটা আশা করা নিশ্চয় যৌক্তিক নয়, বাস্তবও নয়। মেধার দিক থেকে কিছু শিক্ষার্থী দুর্বল (slow learner), বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী মাঝারি (mediocre learner) এবং কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী উত্তম (first learner)। আমাদের দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অধিকাংশ সময় সবচেয়ে বেশি যত্ন নেওয়া হয় উত্তম শিক্ষার্থীদের প্রতি। এটা অনেকাংশে তেলা মাথায় তেল দেওয়ার মতো। আর দুর্বল শিক্ষার্থীরা শুধু অবহেলিতই থাকে না তারা নানাভাবে লাঞ্ছিতও হয়। পরিবার-পরিজনেরে মধ্যে যেমন তারা অত্যাচারিত হয় তেমনি স্কুলেও তারা শিক্ষকদের মনোযোগ ও স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়। এমনকি তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে লাঞ্ছিতও করা হয়। বিষয়টি যেন এমন যে, প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় ভালো না করতে পারলে মানবজীবন বৃথা। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যারা শিক্ষার্থীদের বিবেচনা করেন তারা কখনই ভালো শিক্ষক হতে পারেন না। প্রত্যেক শিক্ষার্থী যে মর্যাদাসম্পন্ন মানুষ, সম্মানের পাত্র- শিক্ষকগণ কিছুতেই তা বুঝতে চান না। বরং তারা শিক্ষার্থীদের নানাভাবে লাঞ্ছিত করেন, অপমান করেন, মানসিক ও শারীরিক সাস্তি দিয়ে অস্তিত্বহীন করে তোলেন।’ 

১৫.
ড. সরকার আবদুল মান্নান স্বীকার করতে মোটেই কসুর করেন না, ‘শিক্ষকদের সবচেয়ে বড় সম্মানের স্থান হলো তাদের শিক্ষার্থী। সেই শিক্ষার্থীরাই যদি তাদের ঘৃণা করে তা হলে সমাজের আর কোথাও তাদের মর্যাদা পাওয়ার সুযোগ নেই। সুতরাং শিক্ষকগণ যদি মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হতে চান তা হলে প্রথমেই মনোযোগ দিতে হবে শিক্ষার্থীদের মনোজগতের দিকে। আবার অনেক শিক্ষক আছেন যারা শিক্ষার্থীদের কাছে খুবই প্রিয়। তাদের এই বিপুল জনপ্রিয়তার মূলে আছে শিক্ষার্থীদের প্রতি তাদের মমত্ববোধ। তারা প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে তাদের বিবেচনায় রাখেন এবং শিক্ষার্থীদের সকল সম্ভাবনাকে চিহ্নিত করে প্রশংসা করেন। তারা সব ধরনের শিক্ষার্থীকে ক্লাসে অংশগ্রহণ করার পরিবেশ তৈরি করেন। এবং ক্লাসরুমটিকে আনন্দঘন করে তোলার চেষ্টা করেন। ফলে শিক্ষার্থীরা অনুপ্রাণিত হয় এবং আনন্দের সঙ্গে শিখন-শেখানো কর্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার শক্তি লাভ করে। ফলে এই ধরনের শিক্ষকগণ সর্বদা সম্মান ও মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত থাকেন।’

১৬.
নিবিড় পাঠ ও পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার পরিচয় পাই ড. সরকার আবদুল মান্নান-এর বিভিন্ন প্রবন্ধে। যেমনটি আলোচিত রচনাতেই দেখি। তিনি শেষ করছেন এভাবে, ‘অমর্ত্য সেন তাঁর জীবনযাত্রা ও অর্থনীতি গ্রন্থে ‘commodity fetishism’ বা পণ্যমোহবদ্ধতা বলে একটি অভিধা ব্যবহার করেছেন। এই অভিধাটি তিনি নিয়েছেন কালমার্কস-এর দর্শন থেকে। এর মানে হলো ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় পণ্যের প্রতি মানুষের লোভাতুরতা যা অনেক সময় অসুস্থতার পর্যায়ে উপনীত হয়। একবিংশ শতকে এসে আমরা লক্ষ্য করছি যে, পণ্যের কাছে এখন মানবিক মূল্যবোধগুলো পরাস্ত হচ্ছে। আমাদের দেশের অধিকাংশ শিক্ষকও এখন পণ্যমোহাবদ্ধ হয়ে উঠেছেন। ফলে কতভাবে টাকা উপার্জন করা যায় এবং আর দশজন অশিক্ষক মানুষের মতো বিলাসবহুল জীবন যাপন করা যায় তার চেষ্টায় তারা প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। ফলে তারা শিক্ষকের মর্যাদার আসন থেকে নেমে আর দশজন মানুষের কাতারে কিংবা তারও নিচে নেমে গেছেন। তাদের এই পণ্যমোহবদ্ধতার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো, তারা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আর্থিক সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। একটি সেবার পেশাকে তারা ব্যবসার পর্যায়ে নামিয়ে এনেছেন। শিক্ষার্থীরা টাকার বিনিময়ে তাদের সময় কিনে নিচ্ছে এবং সেই কিনে নেওয়া সময় যথাযথভাবে দেওয়ার জন্য শিক্ষকগণ দৌড়ের উপর থাকছেন- কোচিং থেকে দৌড় দিচ্ছেন ক্লাসে আর ক্লাস থেকে দৌড় দিচ্ছেন কোচিং-এ। এই জীবন সম্মানের হতে পারে না- না শিক্ষার্থীদের কাছে, না সমাজের অন্য সদস্যদের কাছে। অথচ কথা ছিল তাদের দরজা সকল শিক্ষার্থীর জন্য সব সময় খোলা থাকবে এবং সন্তান-সন্ততির মতো তারা শিক্ষার্থীদের, বিশেষ করে দুর্বল শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা করবেন। কিন্তু কিছুতেই কোনো রকম আর্থিক সম্পর্ক স্থাপন করবেন না। তারা সংসার চালাবেন বেতনের টাকা দিয়ে- তাতে যত সমস্যাই হোক না কেন। এবং পোশাক-পরিচ্ছদে, আচার-আচরণে, নিষ্ঠায়, সততায় ও ন্যায়পরায়ণতায় তিনি হবেন আদর্শস্থানীয়। শিক্ষকের ঘর আসবাবপত্র ও নানা রকম পণ্যে ঠাসা থাকবে না। তার ঘরে থাকবে বই আর বই। তা হলেই তিনি শিক্ষার্থীদের কাছে এবং সমাজের কাছে সম্মানিত মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারতেন, সম্মানিত হতে পারতেন। এবং এই পথে আমাদের সম্মান আমাদেরই ফিরিয়ে আনতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।’

১৭.
লেখক হিসেবে ড. সরকার আবদুল মান্নান-এর আরেকটি প্রয়োজনীয় ও প্রিয় রচনা ‘ নারীর ভাষিক জগৎ’। রাজনীতির ছাত্র হিসেবে জেন্ডার ইস্যুটি পাঠ থাকায় ভাষার রাজনীতির পাঠ নিতে হয়েছিলো একসময়। সেই পাঠেরই প্রয়োজনীয় ও সহায়ক পাঠ্য হিসেবে মান্নান ভাইয়ের এই রচনাটি গুরুত্বর্ণৃ বিবেচিত হলেও কিছুটা অসম্পূর্ণ বলেই মনে হয়েছে। রচনায় ভাষার ইতিহাসে নারীর ভূমিকা এবং ভাষার রাজনীতিতে নারীর উপস্থিতি-অনুপস্থিতি কিছুটা হলেও উল্লেখ থাকা জরুরি ছিলো বলেই মনে করি। তারপরও রচনাটি সবিশেষ গুরুত্ব বহন করে যখন তিনি নানা পাঠের অভিজ্ঞতায় উল্লেখ করেন, ‘মানুষ ভাষিক প্রাণী। মূকপ্রতিবন্ধী না-হলে জন্মের অব্যবহিত পর থেকে মানুষ ভাষা ব্যবহার করে বস্ত্ত ও ভাবময় বিশ্বকে প্রকাশ করে। আর এই ভাষিক জগৎ হলো কোডিং, ডিকোডিং ও এনকোডিংয়ের জগৎ। মানুষ প্রতিনিয়ত প্রতীক, প্রতীকের অর্থময়তা ও সেই অর্থময়তাকে বুদ্ধিমত্তার মধ্যে ধারণ করে ভাষিক জগৎ তৈরি করে। মানবীয় বিশ্ব বলতে মূলত এই ভাষিক জগৎকে বোঝায়। ভাষা ছাড়া চিন্তার কোনো রূপ তৈরি হতে পারে না। সুতরাং চিন্তার বাহন হলো ভাষা। উচ্চারিত-অনুচ্চারিত যাই হোক না কেন, ভাষা ছাড়া মানুষ ভাবতে পারে না, চিন্তা করতে পারে না। তাই ভাষার মধ্যে মূর্ত হয়ে ওঠে মানুষের মানবীয় অসিন্তত্বের রকমফের। মানুষের অর্থনৈতিক পরিচয়, সামাজিক মর্যাদার পরিচয়, সংস্কৃতিগত অবস্থার পরিচয় এবং বিশেষ করে লৈঙ্গিক পরিচয়ের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয় ভাষিক জগৎ। সুতরাং নারী ও পুরুষের ভাষিক জগৎ যে এক হতে পারে না, এ-বিষয়ে কোনো সংশয় নেই। বিশেষ করে যে-সমাজে জেন্ডার-বৈষম্য চরম, যেখানে ক্ষমতায়নের পাল্লা পুরুষমুখী, সে-সমাজে ভাষিক জগতেও তাৎপর্যপূর্ণ পার্থক্য লক্ষ করা যায়। সুপ্রাচীন কাল থেকে নারীরা প্রামিন্তক জনগোষ্ঠী এবং ন্যূনতম ক্ষমতা থেকেও বঞ্চিত। ফলে তাদের ভাবনা ও ভাবনা-প্রকাশ চিরকালই দ্বৈরথে নিমজ্জিত। গভীর অনুভব ও তীব্র স্পর্শকাতরতার যে-জগৎ তারা লালন করে তা চিরকালই অবহেলিত এবং তাদের অনিশ্চয়তার ভাষা গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে একটি স্থায়ী কাঠামো লাভ করেছে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক রবিন লেকফ ‘Language and woman’s place’ নামক প্রবন্ধে লিখেছেন : In appropriate women’s speech, strong expression of feeling is avoided, expression of uncertainty is favored, and means of expression in regard to subject-matter deemed ‘trivial’ to the ‘real’ world are elaborated. Speech about women implies an object, whose sexual nature requires euphemism, and whose social roles are derivative and dependent in relation to men. The personal identity of women thus is linguistically submerged; the language works against treatment of women, as serious persons with individual views. তার মানে প্রতিটি ভাষারই একটি লৈঙ্গিক পরিচয় আছে এবং এই পরিচয় নির্ধারিত হয় আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংসৃকতিক পটভূমির আলোকে এবং এই পটভূমিতে পুরুষগণ চিরকালই অসামান্য প্রাধিকারপ্রাপ্ত। শুধু তাই নয়, ভাষা সংগঠনের যে নিরবচ্ছিন্ন ধারাক্রম সেই ধারা পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত। অতি সাম্প্রতিককালে ভাষাতাত্ত্বিক ডেবোরা টানেন (Deborah Tannen), একেই জেন্ডারলেক্ট (Genderlect) বলে অবহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, নারী-পুরুষের ভাষা শুদ্ধ কি অশুদ্ধ, ঊর্ধ্বতন কি অধস্তন সেটা বিবেচ্য নয়। বিবেচ্য বিষয় হলো, তাদের ভাষা আলাদা। এই স্বাতন্ত্র্যের স্বরূপ এতটাই যে, একজন ব্রিটিশ ও একজন জাপানির সংস্কৃতিগত ভিন্নতার জন্য বাচনে যে ভিন্নতা দেখা যায় নারী ও পুরুষের বাচনে সেরূপ ভিন্নতা পরিলক্ষেত হয়। এই ভিন্নতার পরিচয় উল্লেখ করা যায়।’ আমার রচনার পরিসর বৃদ্ধির আশংকায় আরও বেশি অংশ সংযোজন থেকে নিবৃত থাকতে হলো।

১৮.
সবশেষে আবারো প্রিয় লেখক-গবেষক-শিক্ষক, অধ্যাপক ড. সরকার আবদুল মান্নান, আমার প্রিয় ও পরম শ্রদ্ধেয় মান্নান ভাইকে জনাই জন্মদিনের নিরন্তর শুভেচ্ছাঞ্জলি। আপনার সকল শুভ কামনার, প্রচেষ্টার জয় হোক।

(তথ্যসূত্র : বিভিন্ন বই, পত্র-পত্রিকা)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত