প্রয়াণ দিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

আর্নেস্ট হেমিংওয়ে

‘মানুষ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে কিন্তু কখনো পরাজিত হয় না।’ - আর্নেস্ট হেমিংওয়ে

প্রকাশ : ২১ জুলাই ২০১৮, ১১:৩২

১.
বিংশ শতাব্দীর ইংরেজি কথাসাহিত্যে একটি ব্যতিক্রমী, অনন্য নাম আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। তার নানা ভূমিকার জন্য পরবর্তী প্রজন্মর ওপর ভীষণ প্রভাব ফেলেছিলেন মার্কিন এই লেখক ও সাংবাদিক। ‘Man is not made for defeat… A man can be destroyed but not defeated.’ অর্থাৎ ‘মানুষ পরাজিত হওয়ার জন্য জন্মায়নি... মানুষ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে কিন্তু সে কখনো পরাজিত হয় না।’ মার্কিন কথাসাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের এই বহুল উদ্ধৃত উক্তিটি সারা জাগানো উপন্যাস ‘দি ওল্ডম্যান এন্ড দি সি’র আখ্যান থেকে নেওয়া। কালজয়ী কথাশিল্পী আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ১৮৯৮ সালের ২১ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। দুরন্ত এই সাহিত্যিকের স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, ১৯৬১ সালের ২ জুলাই বিশ শতকের সাহিত্যে অন্যতম প্রভাববিস্তারকারী মার্কিন লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে তাঁর বর্ণাঢ্য কিন্তু ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটান আত্মহননের মাধ্যমে। মুখে বন্দুকের নল ঢুকিয়ে ট্রিগার টিপে রোগক্লিষ্ট জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটান, নিজেই নিজের মৃত্যুর পথ বেছে নেন। তার রোমাঞ্চকর জীবনধারণ এবং জনসমক্ষে প্রচারিত প্রতিচ্ছবি বিশ শতকীয় তরুণদের আগ্রহের বিষয়বস্তু হয়েছিল। তিনি তার জীবদ্দশায় মাত্র নয়টি উপন্যাস এবং ছয়টি ছোটগল্পের সংকলন প্রকাশ করেছিলেন। এছাড়াও, অন্যান্য বিষয়ের বই ছিল মাত্র দুটি। এত অল্প লিখেও সাহিত্যে বিশাল ভূমিকা রাখার বিষয়টি অনেকের কাছেই বিস্ময়কর ছিল সে সময়ে। হেমিংওয়ের আরেকটি প্রিয় বচন মানুষের মনে দাগ কাটে সবসময়ই, ‘মানুষকে আবিষ্কার করো, মানুষ সম্পর্কে জ্ঞান, উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতা থেকে’। বিশ্ববিখ্যাত উপন্যাস 'দ্য ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্য সি'তে সংগ্রামী এক জেলের জীবন তুলে ধরার সঙ্গে সমগ্র মানবজাতির চরিত্র নির্মাণ করেছেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যের প্রবাদপ্রতিম এই সাহিত্যিক ১৯৫৪ সালে ওই উপন্যাসের জন্য নোবেল পুরস্কার পান।
 
২.
আর্নেস্ট হেমিংওয়ে আমেরিকার কেবল নন, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের একজন বড় মাপের লেখক ছিলেন। সাহিত্য সমালোচকদের মতে, তাঁর গল্প ও উপন্যাস সহজ ভাষায় লেখা, কিন্তু অসাধারণ। ছিলেন রোমাঞ্চাভিলাষী। দুঃসাহসী ও বিপৎসংকুল কাজকর্ম করতে পছন্দ করতেন। যেমন সমুদ্রে ছোট নৌকা নিয়ে মাছ ধরা, গহন অরণ্যে শিকার, ষাঁড়ের সঙ্গে লড়াইয়ে অংশ নেওয়া, যা তিনি রপ্ত করেছিলেন গৃহযুদ্ধের সময় স্পেনে অবস্থানকালে। তাঁর গল্প-উপন্যাসে তাঁর রোমাঞ্চকর জীবনের ছাপ রয়েছে। শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন বেপরোয়া মানুষ। বারবার তিনি নিজেকে জীবনের ঝুঁকির মধ্যে টেনে নিয়ে গেছেন। হেমিংওয়ে ছিলেন প্রথম মহাযুদ্ধে অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার। যুদ্ধক্ষেত্রে আহত হয়েছিলেন, চোখের দৃষ্টিশক্তির ক্ষতি হয়েছে। সুস্থ হওয়ার পর শুরু করেন সাংবাদিকতা ও লেখালেখি। প্রথম মহাযুদ্ধের পর প্যারিসে অবস্থানকালে তার সাহিত্যচর্চা শুরু হয়। জীবিকার জন্য বেছে নেন সাংবাদিকতা। প্যারিসে টরন্টো স্টার-এর সংবাদদাতা ছিলেন অনেক দিন। স্পেনেও ছিলেন কয়েক বছর। তারপর নিজের দেশে না থেকে কিউবায় বসবাস করতে থাকেন। চার চারটি বিয়ে করেও বহুল আলোচিত হয়েছিলেন। তার উপন্যাসগুলোর মধ্যে দ্য সান অলসো রাইজেস, এ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস এবং দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি সবচেয়ে বিখ্যাত। অনেকগুলো কালজয়ী ছোটগল্পেরও রচয়িতা তিনি। পৃথিবীর প্রথম সারির গুটিকয়েক কথাশিল্পীর মধ্যে তিনি অন্যতম। বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ থেকে অদ্যাবধি তার প্রভাব সর্বব্যাপক। 

৩.
হেমিংওয়ের আত্মহননের আড়ালে রয়েছে অন্য কাহিনি। তাঁর জীবনী লেখকদের ধারণা ছিল বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়ে হেমিংওয়ে আত্মহত্যা করেন। তার মানসিক অবস্থার পতনের জন্য জীবনী লেখকরা হেমিংওয়ের ‘বীরত্বপূর্ণ’ জীবনাচরণকে দায়ী করেছেন। প্রচণ্ড মদ্যপান, মাদকদ্রব্য সেবন, ১৯৫৩-এর প্লেন ক্রাশের পর উপেক্ষিত শারীরিক ক্ষতের যন্ত্রণা, কতিপয় দুঃসহ চাপ সব এসে আক্রমণ করল তার ষাট বছর বয়সী দেহটিকে। ২০১১-১২ সালের দিকে তাঁর কিছু ব্যক্তিগত চিঠি প্রকাশিত হওয়ার পর জানা গেল, তাঁর বিষণ্নতার কারণ তাঁর বিড়ালের সড়ক দুর্ঘটনায় দুটি পা হারানো এবং তাকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা। হেমিংওয়ের একটি পোষা বিড়ালের নাম ছিল ‘আঙ্কেল উইলি’। এক সড়ক দুর্ঘটনায় আঙ্কেল উইলি আহত হয়। তার দুটি পা পঙ্গু হয়ে যায়। সে কাতরাতে কাতরাতে চলাফেরা করত। তখন হেমিংওয়ে কিউবায়। চে গুয়েভারা ও ফিদেল কাস্ত্রোদের বিপ্লবের আগের ঘটনা। প্রিয় বিড়ালের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে একদিন তিনি ওকে ক্রসফায়ারে দেন। অর্থাৎ আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি করে হত্যা করেন। যেদিন তিনি বিড়ালকে ক্রসফায়ার করেন, সেদিনই তাঁর বাগানবাড়িতে সময় কাটাতে যান তাঁর কয়েকজন বন্ধু। তাঁরা গিয়ে দেখেন হেমিংওয়ে কাঁদছেন। বন্দুক হাতে তিনি বন্ধুদের সামনে উপস্থিত হয়ে বলেন, ‘তেমরা খুব একটা খারাপ সময়ে এসেছ। প্লিজ, দোহাই তোমাদের, আজ চলে যাও। আমাকে একটু একা থাকতে দাও।’ ১৯৫০ সালের ওই দিন হেমিংওয়ে তাঁর এক ইতালীয় বন্ধুকে লিখেছিলেন, ‘আমি অনেককে গুলি করেছি, তবে কখনোই এমন কাউকে হত্যা করিনি, যাকে আমি ১১ বছর ধরে চিনতাম ও ভালোবাসতাম।’ কিউবায় ফিডেল কাস্ত্রোর কমিউনিস্ট বিপ্লবী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর হেমিংওয়ে দেশে ফিরে যান। একধরনের হতাশা ও বিষণ্নতা দেখা দেয় তাঁর মধ্যে। ১৯৬১ সালে তিনি নিজেকে নিজে ক্রসফায়ারে দেন। অর্থাৎ বন্দুক মাথায় ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করেন। আঙ্কেল উইলিকে ক্রসফায়ারে হত্যা করার পর থেকেই হেমিংওয়ে বিষণ্নতায় ভুগতে থাকেন। ক্রসফায়ারে বিড়াল নিহত হওয়ার পর, কথাশিল্পীর নিজের বিবেকের সঙ্গে এনকাউন্টার হয়। তিনি বিবেকের মুখোমুখি হন। তিনি উপলব্ধি করেন বিড়ালকে এনকাউন্টারে হত্যা করা এবং একটি নিরস্ত্র প্রাণীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে জয়ী হওয়া মনুষ্যজনোচিত কাজ হয়নি। তার প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে তিনি বন্দুকযুদ্ধে নিজেকে নিজে হত্যা করেন।

৪.
কালজয়ী কথাশিল্পী আর্নেস্ট হেমিংওয়ের জন্ম আমেরিকার ইলিনয়সের ওক পার্কে। বিংশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের লেখার সময়কাল মোটামুটিভাবে ১৯২৫ থেকে ১৯৫৫ পর্যন্ত। এ সময়ে বিচিত্র জীবনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল তার। কর্মজীবন পরিবর্তন করেছেন সময়ে সময়ে, জীবনসঙ্গীও পরিবর্তিত হয়েছে তার জীবনধারায়। তার মৃত্যুর পর তিনটি উপন্যাস, বহু ছোটগল্পের সংকলন এবং অনেক মননশীল লেখার সংকলন প্রকাশিত হয়েছে, যা তার জীবদ্দশায় প্রকাশিত গ্রন্থের চেয়েও অধিক। মার্কিন সাহিত্য তথা বিশ্বসাহিত্যে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের প্রতিটি রচনাই ক্লাসিক হিসেবে খ্যাত হয়ে আছে। অনেকে বলে থাকেন, প্যারিসে বসবাসকালীন সময়ে যেসব লেখা হেমিংওয়ে লিখেছিলেন, সেসব লেখাই তাকে অধিক পরিচিতি দিয়েছে ও খ্যাতিমান করেছে। ১৯২০ সালের প্রেক্ষাপটে হেমিংওয়ে রচনা করেছিলেন ‘দি মুভেবল ফিস্ট’, তার প্যারিস জীবনের কথাকাহিনী নিয়ে রচিত হয়েছে উপন্যাসটি। একে উপন্যাস না বলে আত্মজৈবনিক রচনা বলাই শ্রেয়। এটি তার জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়নি। ১৯৬৪ সালে, তার মৃত্যুর তিন বছর পর, যে সংস্করণটি প্রকাশিত হয় তাও পূর্ণাঙ্গ ছিল না। আড়ালে লুকোনো ছিল এর আরেকটি পাণ্ডুলিপি, যা ২০০৯ সালে প্রকাশিত হলে বিশ্বসাহিত্যে তুমুল আলোড়ন হয়। একটি ক্লাসিক রচনার পুনর্লিখন! তাও আবার হেমিংওয়ের হাতেই! ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত সংস্করণের সঙ্গে যোগ করা হয় আরও নয়টি অনুচ্ছেদ এবং সংযুক্ত হয় নতুনভাবে লিখিত সমাপ্তি।

৫.
হেমিংওয়ে যখন লেখেন না তখন নিরবচ্ছিন্নভাবে পর্যবেক্ষণ করেন, এমন কিছুর সন্ধান করেন, যা কাজে লাগবে।এ প্রসঙ্গে ‘দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দি সি’ রচনার স্মৃতি উল্লেখ করে তিনি বলেছিলেন, ‘কোন লেখক যদি পর্যবেক্ষণ বন্ধ করে দেয় তাহলে সে শেষ হয়ে যাবে। তবে পর্যবেক্ষণ যেন সচেতন না হয় কিংবা যেন না ভাবে যে এটা কাজে লাগবে। বিশেষত শুরুর দিকে এ কথা সত্য। কিন্তু পরে যা কিছু সে দেখে তা-ই তার জানা ও দেখার ভাণ্ডারে গিয়ে জমা হয়। যদি জানা কোন কাজের কাজ হয় তাহলে আমি সবসময় লিখতে চেষ্টা করি আইসবার্গ-নীতির অনুসরণে, যা দেখা যায় তার তুলনায় আট ভাগের সাত ভাগই থাকে পানির নিচে। তুমি যা-কিছু জান তা থেকে বাদ দিতে পারলেই কেবল তোমার আইসবার্গ শক্তিশালী হবে। যেটা দেখা যায় না সেটাই আসল। যখন লেখক কোন কিছু বাদ দেয় সেটা জানে না বলে তখন সেখানেই গল্পের গর্ত তৈরি হয়। ‘দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দি সি’ হাজার পৃষ্ঠা দীর্ঘ হতে পারত এবং গ্রামের প্রত্যেকটা চরিত্র এবং তাদের জীবনযাপনের সব প্রক্রিয়াই এর মধ্যে আসতে পারত- কীভাবে তারা জন্ম নেয়, শিক্ষিত হয়, সন্তান জন্ম দেয় ইত্যাদি। সেটা অন্য সব লেখক চমৎকারভাবে করেছেন। লেখালেখির ক্ষেত্রে অন্যেরা যা ইতিমধ্যে সন্তোষজনকভাবে করেছেন তার দ্বারা তুমি সীমাবদ্ধ। সুতরাং আমি চেষ্টা করেছি অন্য কিছু করতে। প্রথমত, পাঠককে অভিজ্ঞতার অংশভাক করতে গিয়ে, আমি চেষ্টা করেছি যা কিছু অপ্রয়োজনীয় তা ছেঁটে ফেলতে যেন সে পাঠ করার পর সেটা তার অভিজ্ঞতার অংশে পরিণত হয় এবং তার মনে হয় সত্যি-সত্যি সেটা ঘটেছে। এটা করা খুব কঠিন এবং এটার জন্য খুব খেটেছি। যাই হোক, সংক্ষেপ করে বলি, আমার অবিশ্বাস্য সৌভাগ্য যে আমি অভিজ্ঞতাকে পুরোপুরি সঞ্চারিত করতে পেরেছি এবং সেটা এমন এক অভিজ্ঞতা, যা এর আগে কেউ বলেনি। সৌভাগ্যটা এই যে, আমি একটা ভালো মানুষ পেয়েছিলাম, আর একটা চমৎকার বালক এবং লেখকরা ভুলে গিয়েছিল যে সেখানে এমন সব জিনিস রয়েছে। তখন মানুষের মতো সমুদ্রও ছিল লেখার ভালো বিষয়। সুতরাং আমি সেইখানে সৌভাগ্যবান ছিলাম। আমি কাছিওয়ালাদের দেখেছি এবং সে সম্পর্কে আমার জানা ছিল। সুতরাং আমি সেটা পরিত্যাগ করেছি। আমি অর্ধশতাধিক স্পার্ম-তিমির দল দেখেছি এবং একবার প্রায় ষাট ফুট লম্বা একটা তিমিকে হারপুনবিদ্ধ করেছিলাম, তারপর তাকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। সুতরাং আমি সেটাকেও বাদ দিয়েছি। জেলেদের গ্রাম থেকে আমি মাছধরার যত কাহিনী শুনেছি তার সবই বাদ দিয়েছি। কিন্তু জ্ঞান হচ্ছে সেই জিনিস, যা আইসবার্গের পানির নিচের অংশটিকে তৈরি করে।’

৬.
এক বিস্ময়কর জীবনযাপন হেমিংওয়ের। তার স্ত্রী ছিলেন চারজন, যারা তার জীবনের একেক সময়ে প্রবেশ করেছেন এলিজাবেথ রিচার্ডসন (১৯২১-২৭), পলিন ফেইফার (১৯২৭-৪০), মার্থা গেলহর্ন (১৯৪০-৪৫) এবং তার মৃত্যু পর্যন্ত মেরি ওয়েলস (১৯৬৪-৬১)। তিন সন্তান জ্যাক, প্যাট্রিক এবং গ্রেগরি- বেঁচে আছেন শুধু প্যাট্রিক, যিনি ‘দি মুভেবল ফিস্ট’-এর নবতর সংস্করণের ভূমিকা লিখেছেন। এলিজাবেথ এবং পলিন ছিলেন দুই বান্ধবী, হেমিংওয়ে এলিজাবেথকে ত্যাগ করে বিয়ে করেন স্ত্রীর বান্ধবী পলিনকে, যেই পলিন কী-ওয়েস্টে রেখে যাওয়া হেমিংওয়ের বাড়ির ক্রেতা এবং এই বাড়িতে থাকার পুরোটা সময় হেমিংওয়ের সঙ্গেই ছিলেন।

৭.
১৮৯৯ সালে ইলিনয়েসে জন্ম হয়েছিল হেমিংওয়ের, ১৯৬১ সালে নিজের শটগানের গুলিতে আত্মহত্যা করেছিলেন আইডহ’তে। কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিডেল ক্যাস্ট্রো তার বন্ধু ছিলেন, তার সাংবাদিকতা জীবনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, স্পেনের গৃহযুদ্ধ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ গভীর ছায়াপাত করেছিল, তিনি বুর্জোয়া ধনতান্ত্রিক রীতির চেয়ে পছন্দ করেছিলেন সমাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাকে। এ কারণেই জীবনের শেষদিকে এসে তিনি তার অর্থ এবং নিরাপত্তা নিয়ে শংকিত হয়ে পড়েছিলেন, তার ধারণা হয়েছিল মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই তাকে ক্রমাগত অনুসরণ করে চলেছে।

৮.
১৯২৫ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস ‘দি টরেন্টস অব স্প্রিং’ এবং জীবদ্দশায় তার সর্বশেষ প্রকাশিত উপন্যাস ‘দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ (১৯৫২)। এছাড়া, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতা এবং অনুভূতি নিয়ে লেখা উপন্যাস ‘এ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস’ প্রকাশিত হয় ১৯২৯ সালে। জীবনের বিভীষিকাময় এবং অসম্ভব মানসিক বিপর্যয়ের কালে যখন তার লেখক বন্ধুরা একে একে মৃত্যুবরণ করতে থাকেন, ১৯৩৯ সালে ইয়েটস এবং ফোর্ড ম্যাডক্স ফোর্ড, ১৯৪০ সালে স্কট ফিটজিরাল্ড, ১৯৪১ সালে শেরউড অ্যান্ডারসন ও জেমস জয়েস, ১৯৪৬ সালে গ্রার্ট্রুড স্টেইন এবং ১৯৪৭ সালে দীর্ঘদিনের বন্ধু ম্যাক্স পার্কিনস, তখন হেমিংওয়ে গভীর বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এই সময়ে তার প্রচণ্ড মাথাব্যথা, উচ্চরক্তচাপ, ওজনজনিত সমস্যা দেখা দেয় এবং এর পরিণতিতে তিনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন।

৯.
জীবনে বেশ কয়েকবার দুর্ঘটনায় পড়েছিলেন হেমিংওয়ে। স্কুলপড়া শেষ করে তিনি কয়েক মাস ‘দি কানসাস সিটি স্টার’ পত্রিকায় রিপোর্টিংয়ের কাজ করেন এবং এরপর রেডক্রসের মনোনয়ন নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার হিসেবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ইটালি ফ্রন্টে যোগদান করেন (১৮১৮)। এখানে তিনি প্রথম আঘাতপ্রাপ্ত হন এবং যুদ্ধ বাদ দিয়ে ফিরে আসেন বাড়িতে। এই দুর্ঘটনায় তিনি মিলানের রেডক্রস হাসপাতালে ছয় মাস শয্যাশায়ী ছিলেন। ১৯২৮ সালে প্যারিসে বসবাসকালীন সময়ে হেমিংওয়ে বাথরুমে ভীষণভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হন। তিনি কমোডের চেইন ভেবে জানালা ধরে মাথার ওপর টান দিয়েছিলেন, যা ভেঙে পড়েছিল মাথার ওপর। কপালের ওপর ক্ষতটি আমৃত্যু চিহ্ন হয়েছিল তার, এ নিয়ে কেউ প্রশ্ন করলে তিনি এড়িয়ে যেতেন। প্যারিস ত্যাগের সময় আর বড় শহরে বাস করবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। ১৯৩৩ সালের দিকে হেমিংওয়ে সপরিবারে পূর্ব আফ্রিকার কয়েকটি সাফারি ভ্রমণ করেন। মোমবাসা, নাইরোবি, ম্যাকাকোস, তাঙ্গানিকা, লেক মনিয়ারা এবং তারাঙ্গির ন্যাশনাল পার্ক পরিদর্শন করেন। এ সময়ও তিনি দুর্ঘটনায় পড়েন, তার অ্যামিবা ঘটিত আমাশয় হয়, যা তার আন্ত্রিক স্থানচ্যুতি ঘটায় এবং তাকে বিমানে করে নাইরোবিতে স্থানান্তর করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এই অভিজ্ঞতা তার ‘দি স্লোজ অব কিলিমানজারো’ গ্রন্থে প্রতিফলিত হয়েছে। এরপর হেমিংওয়ে যে দুর্ঘটনাটির শিকার হন তা ঘটে ১৯৪৫ সালে। তার গাড়িটি দুর্ঘটনায় পতিত হলে তার হাঁটু ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায় এবং কপালে মারাত্মভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হন। ক্রমে ক্রমে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং নানা বিষাদ তাকে গ্রাস করে ফেলে।

১০.
এর ভেতরেই ১৯৫১ সালে মাত্র আট সপ্তাহে তিনি লিখে ফেলেন তার ক্লাসিক উপন্যাস ‘দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ এবং লেখা শেষ করে বন্ধুদের বলেছিলেন, সারাজীবনে এটিই আমার শ্রেষ্ঠতম লেখা। এই গ্রন্থটির জন্য তিনি ১৯৫২ সালে লাভ করেন পুলিৎজার পুরস্কার। বইটি মাসের পর মাস সেরা গ্রন্থের তালিকায় শ্রেষ্ঠ স্থান দখল করে রেখেছিল। ১৯৫৪ সালে পরপর দুটি বিমান দুর্ঘটনায় পড়েছিলেন হেমিংওয়ে, প্রথমটিতে মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পান তিনি, দ্বিতীয়টিতে তার মগজ থেকে তরল পদার্থ নির্গত হতে থাকে। এ দুটি দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়েছে বলে উড়োখবর প্রচারিত হলেও শেষপর্যন্ত বেঁচে যান তিনি। পরবর্তীতে শারীরিক নানা সমস্যায় জড়িয়ে গেলে মদ্যপান বাড়িয়ে দেন, যা তাকে ক্রমে ক্রমে মৃত্যুর কাছাকাছি নিয়ে যায়। এসবের মধ্যেই ১৯৫৪ সালের অক্টোবর মাসে হেমিংওয়ে লাভ করেন নোবেল পুরস্কার। শারীরিক দুরবস্থা এবং বিমানভ্রমণ আতংকে তিনি স্টকহোমে তার নোবেল পুরস্কার সশরীরে উপস্থিত থেকে গ্রহণ করতে পারেননি। এটাও হেমিংওয়ের জীবনে একটা ট্র্যাজেডি হিসেবেই থাকবে।

১১.
হেমিংওয়ের সব লেখালেখির মূল চালিকাশক্তি ছিল প্রেম, যুদ্ধ, বন্যতা এবং হারানো। একদা মার্কিন সাহিত্য এসবের ওপর ভর দিয়ে অনেকটা চলেছিল, কিন্তু বিচ্ছিন্নভাবে, কিন্তু যুদ্ধে জড়িয়ে যাওয়া রোমান্টিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে’র ভেতর সবকিছু যেন একসঙ্গে মাথা তুলে দাঁড়ায়। হয়তো এ কারণেই মার্কিন সাহিত্যের এই ধারাটির প্রতি পরবর্তী প্রজন্মর আগ্রহ বেড়ে যায়, সমসাময়িক সাহিত্যিকরা থমকে দাঁড়ায় এই বিষয় এবং ভাষার ক্ষিপ্রতা দেখে। হেমিংওয়ের ভাষায় ছিল নতুনত্ব, তার সাহিত্য ও ব্যক্তিগত রচনায় তিনি ‘কমা’র পরিবর্তে ‘অ্যান্ড’ শব্দটি ব্যবহার করতেন, এতে পরবর্তী বাক্যটির অনিবার্যতা নিশ্চিত হয়ে যেত। চরিত্রের ইমেজ তৈরিতে তিনি গ্রহণ করেছিলেন নিজস্ব রীতি। একটি ‘রিয়াল থিং’ সৃষ্টিতে তিনি অনেক চরিত্রের কোলাজ আঁকতেন তার ভাষা দিয়ে, যা ক্রমে পৌঁছে যেত তার গন্তব্যে। এজরা পাউন্ড (১৮৮৫-১৯৭২), টিএস এলিয়ট (১৮৮৮-১৯৬৫), জেমস জয়েস (১৮৮২-১৯৪১) প্রমুখের রচনায় এই ইমেজের একটা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত চরিত্র খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি, তার গবেষকদের মতে, যে কোনো বই অন্তত দু’বার পড়তেন হেমিংওয়ে, খুঁজতেন সেসব বইয়ের ভেতর লুকিয়ে থাকা সৌন্দর্যের আলোক রেখা।

১২.
নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির চার বছর পর ১৯৫৮ সালে দ্য প্যারিস রিভিউ পত্রিকায় আর্নেস্ট হেমিংওয়ের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন জর্জ প্লিম্পটন। সেই সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত কিছু অংশ পাঠ করা যাক।
জর্জ : আপনি কখন কাজ করেন? কড়াকড়ি সিডিউল মেনে চলেন কি?
হেমিংওয়ে : যখন বই কিংবা গল্প লিখি তখন প্রত্যেকদিন সকালে যথাসম্ভব প্রথম আলো ফুটে ওঠার পরপরই লিখতে বসি। তখন কেউ বিরক্ত করার থাকে না, শান্ত, শীতল পরিবেশ; কাজে লেগে পড় এবং লিখতে লিখতে গরম হয়ে যাও। যা লেখা হয়েছে তা পড়, এর পরে কী ঘটবে সেটা যখন তোমার জানা, তখন সেখান থেকে শুরু কর। তুমি লিখতে থাকো যতক্ষণ পর্যন্ত না এমন এক জায়গায় পৌঁছাও যখন তোমার রসদ ফুরোয়নি, তুমি জানো এর পরে কী ঘটবে, তখন থেমে যাও এবং পরের দিন আবার শুরু করা পর্যন্ত সময়টুকু উপভোগ কর। ধরো, তুমি ভোর ৬টায় শুরু করেছ, দুপুর বা তার কিছু আগ পর্যন্ত লিখলে। যখন থামলে তখন তুমি রিক্ত, একই সঙ্গে তুমি কখনও শূন্য নও, বরং পূর্ণ হয়ে উঠছ, ঠিক সেই রকম যখন তুমি কাউকে ভালোবাসো। পরের দিন আবার শুরু না করা পর্যন্ত কোন কিছুই তোমাকে কষ্ট দিতে পারে না, কিছুই ঘটে না, কিছুতেই কিছু বোঝায় না। পরের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করা, সেটা সহ্য করাই কঠিন।
জর্জ : আগের দিন যেখানে শেষ করেছেন সেই জায়গাটায় পড়ার সময় কি আপনি পুনর্লিখন করেন? নাকি সেটা পরে করেন, পুরোটা শেষ করার পর?
হেমিংওয়ে : আমি প্রত্যেকদিন আগের দিনের থামার জায়গা পর্যন্ত পুনর্লিখন করি। যখন পুরো শেষ হয়ে যায় তখন স্বাভাবিকভাবেই আবার পড়তে হয়। তখন আরেকবার সংশোধন ও পুনর্লিখনের সুযোগ পাওয়া যায়, পরিষ্কারভাবে টাইপ করা যায়। শেষ সুযোগটা মেলে প্রুফ দেখার সময়।
জর্জ : আপনি অন্য লেখকদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা ভাবেন?
হেমিংওয়ে : কখনও না। আমি চেষ্টা করি কতিপয় মৃত লেখকের চেয়ে ভালো লিখতে, যাদের সাহিত্য-মূল্য সম্পর্কে আমি নিশ্চিত। দীর্ঘদিন থেকে আমি স্রেফ যতটা সম্ভব ভালো লেখার চেষ্টা করে গিয়েছি। কখনও কখনও আমার সৌভাগ্য যে আমি যতটা ভালো পারি তার চেয়েও ভালো লিখতে পেরেছি।
জর্জ : আপনি কি আপনার বইপাঠ উপভোগ করেন সেগুলোতে কোন রকম পরিবর্তন আনার অনুভব ছাড়াই?
হেমিংওয়ে : যখন আমার কাছে লেখার কাজটা কঠিন হয়ে ওঠে তখন নিজেকে উৎসাহিত করতে আমি আমার বই পাঠ করি। তখন আমার স্মরণ হয় যে সেটা সব সময়ই কঠিন ছিল এবং কখনও কখনও প্রায় অসম্ভব ছিল।
জর্জ : একজন সৃজনশীল লেখক হিসেবে আপনি আপনার শিল্পের কাজ কী বলে মনে করেন? প্রকৃত তথ্যের বদলে তথ্যের প্রতিমূর্তি কেন?
হেমিংওয়ে : এ নিয়ে বিভ্রান্ত হচ্ছ কেন? যা ঘটেছে এবং যা অস্তিত্ববান এবং যা তোমার জ্ঞাত এবং যা তোমার অজ্ঞাত তার থেকে নেয়া জিনিস থেকে তুমি তোমার উদ্ভাবন দিয়ে যা নির্মাণ কর তা প্রতিমূর্তি নয়, বরং সম্পূর্ণ নতুন একটা জিনিস, যা যে কোন সত্য জিনিসের চেয়ে অধিকতর সত্য এবং জীবন্ত, তুমি একে জীবন্ত কর এবং তুমি যদি তাকে যথেষ্ট ভালোভাবে বানাতে পার তাহলে তুমি তাকে অমরতা দান করলে। সেটাই তুমি যে লেখ সেটাই তার কারণ, তোমার জানা অন্য আর কোন কারণে নয়। তাহলে যেসব কারণ সম্বন্ধে কেউ কিছু জানে না সেগুলোর কী হবে?

১৩.
আমার মতোন আরো অনেকেরই প্রিয় উপন্যাস ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’-র লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের স্মৃতির প্রতি আবারো জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

(তথ্যসূত্র : দৈনিক যুগান্তর, প্রথম আলোসহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, দেশ, বইয়ের দেশ, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত