আর্নেস্ট হেমিংওয়ে

প্রকাশ : ২২ জুলাই ২০১৮, ১১:৫৩

সময়টি ১৯১৮ সাল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে। আমেরিকা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে সাংবাদিকতায় ব্যস্ত। হঠাৎ রেডক্রসের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেলেন ইতালির মিলানে। অ্যাম্বুলেন্স চালক হিসেবে শুরু করলেন মানবতার সেবা। যুদ্ধরত অবস্থায় ইতালির এক সৈনিক মারাত্মক আহত হলেন। আহত সৈনিককে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নিয়ে যাবার জন্য হেমিংওয়ে দ্রুত ছুটে গেলেন। কিন্তু মর্টারের আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হলেন হেমিংওয়ে নিজেও। তাঁর এই সাহসিকতার জন্য ইতালির সরকার 'ইতালিয়ান সিলভার মেডেল অব ব্রেভারী' পুরস্কারে ভূষিত করে তাঁকে। ইতালির সেই স্মৃতি স্মরণ করে হেমিংওয়ে বলেছিলেন, "যখন বালক হিসেবে যুদ্ধে যাও তখন অমরত্ব লাভের জন্য একটা মোহ কাজ করে। অন্য যোদ্ধারা মারা যাবে, আমি মরবো না… এমন মনোভাব থাকে। কিন্তু যখনি প্রথম বারের মত মারাত্মকভাবে আহত হবে তখনই সেই মোহ কেটে যাবে এবং ভাবতে শুরু করবে, আমিও মরে যেতে পারি"।

আহত হয়ে হেমিংওয়ে যখন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তখন তাঁর সেবায় নিয়োজিত ছিল রেড ক্রসের নার্স এগনেস ভন কোরস্কি। হেমিংওয়ে এগনেসের প্রেমে পড়েন এবং সরাসরি তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। দুজনে সিদ্ধান্ত হলো আমেরিকায় গিয়ে বিয়ে করবেন। জানুয়ারিতে আমেরিকায় ফিরে গেলেন হেমিংওয়ে। অপেক্ষা করতে থাকেন এগনেসের আমেরিকায় পৌঁছার জন্য। হঠাৎ একদিন একটি চিঠি এলো ইতালি থেকে। প্রেম প্রত্যাখ্যানের চিঠি পাঠিয়েছে এগনেস। ইতালির এক সরকারি কর্মকর্তার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে বলে চিঠিতে জানিয়েছে এগনেস। মাত্র ২০ বছর বয়সে প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন হেমিংওয়ে।

সাংবাদিকতাকে পরিপূর্ণ পেশা হিসেবে গ্রহণ করার পাশাপাশি চালিয়ে যেতে লাগলেন তাঁর লেখালেখি। 'টরেন্টো স্টার' পত্রিকায় রিপোর্টার হিসেবে যোগ দিলেন তিনি। ১৯২১ সালে তিনি এলিজাবেথ হ্যাডলি রিচার্ডসন কে বিয়ে করলেন। তাঁদের মধ্যে অল্প কিছু দিনের প্রেম ছিল, তারপর সরাসরি বিয়ে। শুরু করলেন নতুন সংসার। নতুন সংসার শুরু করে হেমিংওয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন আগের মত। টরেন্টো পত্রিকার কল্যাণে হেমিংওয়ে ফ্রান্সের প্যারিস শহরে স্থানান্তরিত হলেন। ১৯২৩ সালে প্যারিস থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গ্রন্থ 'থ্রি স্টোরিজ অ্যান্ড টেন পোয়েমজ'। একই বছর হেমিংওয়ে হ্যাডলি দম্পতির প্রথম সন্তান জন জন্মগ্রহণ করে। সন্তানকে দেখতে হেমিংওয়ে টরেন্টোতে চলে যান। এ সময় তিনি সংসার জীবন নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সংসারের দায়িত্ব পালন করতে তিনি সাংবাদিকতা ছেড়ে দিয়ে উপন্যাসের জগতে প্রবেশ করেন। তিনি লিখলেন 'ইন আওয়ার টাইম' (১৯২৫) নামে ছোট গল্পগ্রন্থ। প্যারিসে এসেই তার পরিচয় ঘটেছিল স্কট ফিটজেরাল্ড, জেমস জয়েস, পাবলো পিকাসো, এজরা পাউন্ডের মতো বিখ্যাত লেখকদের সাথে। ১৯২৬ সালে প্রকাশিত হয় তার অন্যতম বিখ্যাত উপন্যাস, 'দ্য সান অলসো রাইজেস'।

হেমিংওয়ে আবারো প্রেমে পড়লেন আমেরিকান সাংবাদিক পলিন পাইফারের। ফাটল ধরলো তাঁর সংসারে। ১৯২৭ সালে তিনি ডিভোর্স দেন প্রথম স্ত্রী হ্যাডলি রিচার্ডসনকে। পলিন পাইফারকে হেমিংওয়ে বিয়ে করে ঘরে তুললেন। বিবাহ পরবর্তী সময়ে তিনি সৃষ্টি করলেন তাঁর অন্যতম সাহিত্য কর্ম 'মেন উইদাউট উওমেন'।

হেমিংওয়ের জীবনে এক করুন অধ্যায় ১৯২৮ সাল। এবছর তাঁর বাবা ক্লারেন্স হেমিংওয়ে আত্মহত্যা করেন। ডায়াবেটিস ও আর্থিক অনটন থেকে মুক্তি পেতে তিনি আত্মহননের পথ বেছে নেন। বাবার মৃত্যুর পর হেমিংওয়ের জীবন যাপন অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে। তিনি প্রচুর পরিমাণে মদ্যপানে আসক্ত হয়ে পড়েন। কয়েকবার প্লেন ক্রাশ ও সড়ক দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পান। তারপরও তিনি লেখালেখি চালিয়ে যেতে থাকেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি লিখলেন তাঁর সবচাইতে জনপ্রিয় উপন্যাস 'এ ফেয়ার ওয়েল টু আর্মস'। ১৯২৯ সালে প্রকাশিত বেস্ট সেলার এই উপন্যাসটির কারণে বিশ্বজুড়ে হেমিংওয়ের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।

আবার সাংবাদিকতা পেশায় ফিরে এলেন হেমিংওয়ে। ১৯৩৭ সালে তিনি স্পেনের গৃহ যুদ্ধের খবর সংগ্রহ করতে স্পেনে যান। স্পেনে গিয়ে তিনি নারী সাংবাদিক মার্থা গেলহর্নের সাথে পরিচিত হন। তিনি আবারো প্রেমে পড়েন। মার্থা তাঁকে লেখালেখিতে অনুপ্রেরণা যোগাতেন। মার্থা গেলহর্নের অনুপ্রেরণাতেই হেমিংওয়ে সিভিল ওয়ারের ভয়াবহতা নিয়ে রচনা করলেন তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস 'For Whom The Bell Tolls'। এই উপন্যাসটির জন্য তিনি পুলিৎজার পুরস্কারের জন্য মনোনিত হন। মার্থার সাথে অবৈধ প্রেম তাঁকে আবারো ডিভোর্সের দিকে নিয়ে যায়। পাইফারকে ডিভোর্স দিয়ে তিনি তৃতীয় বারের মত বিয়ের পিড়িতে বসেন। বিয়ে করেন মার্থা গেলহর্নকে।

১৯৪০ সালে হেমিংওয়ে কিউবাতে ফিরে আসেন। এখানেই তিনি সমুদ্রের কাছাকাছি একটি বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। নিয়মিত মাছ শিকারে যেতেন। এ সময় তিনি জেলেদের সাথে গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এই বিচিত্র অভিজ্ঞতা থেকেই কালজয়ী উপন্যাস 'দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী' রচনা করেন হেমিংওয়ে। ১৯৫২ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসটি দিয়েই তিনি পাঠক মনে চিরস্থায়ী আসন গড়ে নেন। তাঁর এই বিখ্যাত উপন্যাসের জন্য তিনি ১৯৫৩ সালে সাথে পুলিৎজার ও ১৯৫৪ সালে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন।

এদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। সংবাদ সংগ্রহ করার জন্য হেমিংওয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন। এ সময় তাঁর সাথে পরিচয় হয় টাইম ম্যাগাজিনের সাংবাদিক ম্যারি ওয়েলসের সাথে। আবারো প্রেমে পড়েন হেমিংওয়ে। দুই বছর প্রেম করার পর ১৯৪৫ সালে বিয়ে করেন তারা। ওদিকে মার্থা গেলহর্নকে ডিভোর্স দেন হেমিংওয়ে। এটি ছিল তাঁর চতুর্থ ও শেষ বিয়ে। এক সাক্ষাতকারে একাধিক বিয়ে নিয়ে হেমিংওয়ে বলেছিলেন, "Funny how it should take one war to start a woman in your damn heart and another to finish her. Bad luck"।

যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোর ইলিনয়ের, ওক পার্কে ১৮৯৯ সালের ২১ জুলাই তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ছিলেন পেশায় ডাক্তার আর মা ছিলেন সঙ্গীত শিল্পী। হেমিংওয়ে নামটি তাঁর মাতামহের নামানুসারে রাখা হয়। ব্যক্তিগত ভাবে তিনি নামটি পছন্দ করতেন না কারণ, 'The importance of being Ernest' নাটকের প্রধান চরিত্র, আর্নেস্ট ছিল বোকা ও সাদাসিধে টাইপের মানুষ। হেমিংওয়ে তাঁর মায়ের অনুপ্রেরণাতে সেলো বাজানো শিখেছিলেন। পরবর্তীতে তা আর ধরে রাখতে পারেন নি। তিনি স্বীকার করেছেন যে, গান শেখার কারণেই 'ফর হোম দি বেল টোলস' বইটি লিখতে সহজবোধ্য হয়েছিল। বাল্যকাল থেকেই তিনি মাছ ধরা, শিকার করা, ক্যাম্প করা রপ্ত করেছিলেন। এই শখগুলো তাঁর পরবর্তী জীবনকে প্রভাবিত করেছিল।

১৯১৩ সালে স্কুল জীবন শুরু হয় ওক পার্ক এন্ড রিভার ফরেস্ট হাই স্কুলে, অংশগ্রহণ করতে শুরু করেন বিভিন্ন খেলাধুলায়। এখানে পড়ার সময়েই সাহিত্যের প্রতি অনুরাগী হয়ে উঠেন। স্কুলে থাকতেই জড়িয়ে পড়েন সাংবাদিকতায়। যা পরবর্তীতে তার লেখক জীবনের ভীত গড়ে দিয়েছিল। ট্রাপেজি এন্ড টাবুলা ম্যাগাজিনে খেলাধুলা নিয়ে নিয়মিত লেখা শুরু করেন। স্কুল জীবন শেষে যুক্ত হন 'দি ক্যানসাস সিটি স্টার' পত্রিকায়।

আর্নেস্ট হেমিংওয়ের সমগ্র জীবন জুড়ে ছিল রোমাঞ্চ আর রহস্যের খেলা। শিকার করার বড্ড নেশা ছিল তাঁর, ছিল প্রিয় একটা শিকারি বন্দুক। সেই বন্দুক দিয়েই কিনা পরাজয় বরন করেছেন! বিশ্বাস করতে পারেনি কেউই, বিশ্বাস করে নি তাঁর স্ত্রী মেরি হেমিংওয়ে। ১৯৫৪ সালে পেয়েছেন নোবেল পুরস্কার। ঝুলিতে রয়েছে পুলিৎজারের মত বিখ্যাত পুরস্কারও। অসুস্থতার কারণে যেতে পারেন নি নোবেল প্রাপ্তির অনুষ্ঠানে। তবে কি নশ্বর দেহকে আর বয়ে নেবার মনের শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি?

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত