প্রয়াণ দিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী

প্রকাশ : ০২ আগস্ট ২০১৮, ১১:৪১

১.
বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী আমাদের ইতিহাসের এক ক্ষণজন্মা মহান মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, বিচারপতি ও সাবেক রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর আজ মৃত্যুবার্ষিকী। ৬৬ বছর রয়সে ১৯৮৭ সালের ২ আগস্ট তিনি লন্ডনে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ১৯২১ সালের ৩১ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে জেনেভায় অবস্থানকালে পূর্ব পাকিস্তানে পাক বাহিনীর গণহত্যার প্রতিবাদে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদ থেকে ইস্তফা দেন। একই সঙ্গে মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এবং বাংলাদেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি ছিলেন। ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি থেকে ১৯৭৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সদস্যও ছিলেন। মুজিবনগরে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত হিসেবে জেনেভা থেকে তিনি লন্ডন যান এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে কাজ করেন। এ কাজে তিনি বিশেষ সাফল্য অর্জন করেন। তাঁর রচিত ‘প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’ (১৯৯০) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত একটি মূল্যবান গ্রন্থ। বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত সংগঠনে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে লন্ডনে তাঁর সদর দফতর স্থাপন করে পৃথিবীর দেশে দেশে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিরূপে ছুটে বেড়িয়েছেন, সম্পন্ন করেছেন এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। মুক্ত স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর বাংলাদেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার অর্পণ করা হয় তাঁকে। ‘প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’ গ্রন্থে তিনি বিবৃত করেছেন প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলির স্মৃতি।

২.
বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এক দিকে ছিলেন আপাদমস্তক ভদ্র, নমনীয় এবং স্বহৃদয়ী; অন্য দিকে তিনি ছিলেন ইস্পাতের মতো কঠিন। এমনকি মৃত্যুভয়ও তাঁকে তাঁর অভীষ্ট যাত্রা ও চূড়ান্ত লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করেনি। প্রবাসে বিশেষত: বৃটেনে তাঁর নিরাপত্তার ওপর নজর রেখেছিল খোদ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড। তাঁর এই একান্ত অভিলাষকে তিনি ব্যক্ত করেছিলেন সুদৃঢ় ভাষায়, “লণ্ডনের রাস্তায় আমার শবদেহ পড়ে থাকবে, তবু পাকিস্তানের সঙ্গে আপোস করে দেশে ফিরবো না।” উজ্জ্বলতম এই মানুষটির নিমগ্ন ব্রত মূল্যায়ন করে প্রকাশক মহিউদ্দীন আহমেদ লিখেছেন, “ব্যক্তিগত জীবনে এই নিরীহ, নির্বিবাদী, নিরহংকারী সজ্জন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে একজন অমিতবিক্রম আপোসহীন যোদ্ধায় রূপান্তরিত হয়েছিলেন। অত্যন্ত প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ব্যক্তিগত সুখ স্বাচ্ছন্দের তোয়াক্কা না করে তিনি বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের দুর্মর শপথ অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে তুলে ধরেছিলেন।”

৩.
বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী (জন্ম: ৩১ জানুয়ারি, ১৯২১–প্রয়াণ: ২ আগস্ট, ১৯৮৭) টাঙ্গাইল জেলার নাগবাড়ীতে সম্ভ্রান্ত এক জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আবদুল হামিদ চৌধুরী পূর্বপাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের স্পিকার ছিলেন। তাঁর মায়ের নাম শামসুন নেছা চৌধুরী। তিনি পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান ছিলেন। আবু সাঈদ চৌধুরী কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতক (১৯৪০) এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ও আইন বিষয়ে ডিগ্রি লাভের পর ইংল্যান্ডের লিংকন্স ইন থেকে ব্যারিস্টারি পাস করেন। ১৯৪৭ সালে তিনি কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন, এবং ভারত বিভাগের পর ঢাকায় এসে ১৯৪৮ সালে ঢাকা হাইকোর্টে আইন ব্যবসায়ে যোগ দেন। ১৯৬০ সালে আবু সাঈদ চৌধুরী পূর্বপাকিস্তানের অ্যাডভোকেট জেনারেল এবং ১৯৬১ সালে হাইকোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হন। তিনি পাকিস্তানের সাংবিধানিক কমিশনের সদস্য (১৯৬০-৬১) এবং বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের (১৯৬৩-৬৮) চেয়ারম্যান ছিলেন।
 
৪.
বিচারপতি চৌধুরী ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হন। ১৯৭১ সালে জেনেভায় অবস্থানকালে পূর্ব পাকিস্তানে পাকবাহিনীর গণহত্যার প্রতিবাদে তিনি উপাচার্য পদে ইস্তফা দেন। মুজিবনগরে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত হিসেবে জেনেভা থেকে তিনি লন্ডন যান এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে সচেষ্ট হন। একাজে তিনি বিশেষ সাফল্য অর্জন করেন। স্বাধীনতার পর বিচারপতি চৌধুরী ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭৩ সালের ১০ এপ্রিল পুনরায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ওই বছর ডিসেম্বর মাসে তিনি রাষ্ট্রপতির পদ থেকে ইস্তফা দেন এবং একজন মন্ত্রীর পদমর্যাদায় বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক বিশেষ দূত নিযুক্ত হন। ১৯৭৫ সালের ৮ আগষ্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্রিসভায় তিনি বন্দর ও নৌপরিবহন মন্ত্রী ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হলে বিচারপতি চৌধুরী নতুন রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মোশতাক আহমদের মন্ত্রিসভায় পররাষ্ট্র মন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর পর্যন্ত তিনি এ পদে বহাল ছিলেন। 

৫.
বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ১৯৭৮ সালে জাতিসংঘে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি বৈষম্যের অবসান এবং তাদের নিরাপত্তা বিষয়ক উপকমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৫ সালে তিনি জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের সভাপতি নির্বাচিত হন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘দেশিকোত্তম’ উপাধিতে ভূষিত করে এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টর অব ল’ ডিগ্রি প্রদান করে। তাঁর রচিত প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি (১৯৯০) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত একটি মূল্যবান গ্রন্থ। আবু সাঈদ চৌধুরী ১৯৮৭ সালের ২ আগস্ট লন্ডনে মৃত্যুবরণ করেন। 

৬.
‘প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এক অসামান্য প্রামাণ্য দলিল। বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত সংগঠনে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। বাঙালি জাতির মহান সন্তান বিচারপতি চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের সময়ে লন্ডনে তাঁর সদর দফতর স্থাপন করে পৃথিবীর দেশে দেশে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিরূপে ছুটে বেড়িয়েছেন - সম্পন্ন করেছেন এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। শত্রুরা তাঁর প্রাণের প্রতি হুমকি প্রদর্শন করেছে - তাঁর প্রাণহানির আশঙ্কায় স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড সর্বক্ষণ তাঁকে প্রহরা দিয়েছে। কিন্তু এই অবিচলিত শান্ত ও সাহসী মানুষটির ছিল একটিই কথা: ‘লন্ডনের রাস্তায় আমার শবদেহ পড়ে থাকবে তবু পাকিস্তানের সঙ্গে আপোস করে দেশে ফিরব না।’ মুক্ত স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর বাংলাদেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার অর্পণ করা হয় তাঁকে। প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি গ্রন্থে তিনি বিবৃত করেছেন প্রবাসে একাত্তরের দিনগুলির স্মৃতিকথা। তাঁর অকপটতা ও সারল্য দিয়ে নির্মিত এই স্মৃতিকথা।

৭.
মুক্তিযোদ্ধাদের শৌর্য এবং বাংলাদেশে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিদ্যুৎগতিসদৃশ অভিযান সম্পর্কে আমরা অবহিত। মুজিবনগরে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের কর্মকাণ্ড এবং ত্রাণশিবিরে উদ্বাস্তুদের চরম দুর্দশা সম্পর্কেও আমরা জানি। কিন্তু যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস লন্ডনে ও ইংল্যান্ডের অন্যান্য শহরে থেকে একটির পর একটি দেশে ছুটে বেড়িয়েছিলেন বাংলাদেশের ঘোষিত অবস্থান প্রচার করার জন্য, যারা মুক্তিযুদ্ধকে প্রদান করেছিলেন একটি আন্তর্জাতিক মাত্রা, তাঁদের বিরাট অবদান সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি। তাঁদের দৃপ্ত অঙ্গীকার এবং একনিষ্ঠ কর্ম ‘প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’ বইটির উপজীব্য। যিনি এই বইটি লিখেছেন, সেই প্রসিদ্ধ আইনজ্ঞ-বিচারক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিনয়ী ও সজ্জন আবু সাঈদ চৌধুরী, তাঁর নেতৃত্বেই এই গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম সম্পূর্ণ করা হয়। ফলে তাঁর লেখা বইটি পড়েই আমরা জানতে পারি, বুঝতে পারি প্রবাসীদের অবদান কতটা দিকনির্ণয়ী ছিল। গ্রন্থটির ভূমিকায় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান যা লিখেছেন তা অক্ষরে অক্ষরে সত্য: “শুধু দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে, কর্তব্যবোধে পরিচালিত হয়ে, পাকিস্তানের অমানুষিক বর্বরতায় ক্ষুব্ধ হয়ে এই দায়িত্ব তিনি স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেছিলেন। বিদেশ-বিভূঁইয়ে সেদিন তাঁর কোনো সহায় সম্বল ছিলনা, ছিল প্রখর আত্মমর্যাদাবোধ ও গভীর প্রত্যয়। প্রবাসী বাঙালিদের সংগঠিত করেছিলেন তিনি, বিদেশে জনমত গঠন করেছিলেন, প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন প্রবাসে গঠিত বাংলাদেশ সরকারের। তাঁর সেই ভূমিকাই তাঁকে ইতিহাসে স্থায়ী আসন দিয়েছে।” আর ‘প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’র প্রকাশক দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড-এর কর্ণধার মহিউদ্দীন আহমেদ ঠিকই বলেছেন, “সর্বত্র নিজের ভূমিকার বর্ণনায় তিনি সংক্ষিপ্ত, নির্মোহ ও নির্লিপ্ত। আত্মজীবনীমূলক রচনায় এই নিরাসক্তি দুষ্প্রাপ্য।”

৮.
বিশাল ভূ-সম্পত্তির অধিকারী তাদের পরিবারের রয়েছে সামাজিক ও শিক্ষা বিস্তারে সবিশেষ ভূমিকা। বিশেষ করে টাঙ্গাইল জেলার বিভিন্ন উপজেলায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে অনেক জমি-জমা দান করেছেন। আমরা এ প্রজন্ম হয়তো জানিনা, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী টাঙ্গাইল জেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কি পরিমাণ সম্পত্তি দান করেছেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতী, মধুপুর, ঘাটাইল এবং সখিপুর এই ৪ টি উপজেলায় বিভিন্ন ধর্মীয় ও শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠানে প্রচুর সম্পত্তি দান করে গেছেন। কিন্তু বিষয়টি এখনো অনেকেরই অজানা। কালিহাতীতে নাগবাড়ী হাসিনা চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়, চারান উচ্চ বিদ্যালয়, হাজী এবদাত উদ্দীন চৌধুরী দাতব্য চিকিৎসালয়, ঘাটাইলের হামিদপুরে ফাজিল ডিগ্রী মাদ্রাসা, মধুপুরের আলোকদিয়া উচ্চ বিদ্যালয় এবং মালাউড়ি বেগম শামসুন্নেছা চৌধুরী প্রাথমিক বিদ্যালয়, সখিপুরের সুরিরচালা যার বর্তমান নাম হাজী এবাদতনগর, সেখানে অবস্থিত আবদুল হামিদ চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়, ডাবাইল গোহাইলবাড়ি জামেয়া আশরাফিয়া মাদরাসা প্রমুখ প্রতিষ্ঠানে তিনি প্রচুর জমি দান করেছেন। এরমধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কালিহাতির রতনগঞ্জে হাজী এবাদতউদ্দিন চৌধুরী দাতব্য চিকিৎসালয় এবং সখিপুরে সুরিরচালা আবদুল হামিদ চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রভূত জমি দান করেছেন। হাজী এবাদতউদ্দিন চৌধুরী দাতব্য চিকিৎসালয়ে তিনি ৮০ বিঘা জমি দান করেছেন। বর্তমানে এখানে জনাব আবুল হাসান চৌধুরীর সভাপতিত্বে গঠিত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ফাউন্ডেশন কর্তৃক একটি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এছাড়া সখিপুরের সুরিরচালা আব্দুল হামিদ চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়ে তিনি ৪০ বিঘা জমি দান করেছেন। কোন দানকেই অর্থের মূল্যমানে বিচার করা সমীচিন নয়। তথাপি এখানে উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক নয় তাঁর দানকৃত জমির বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ৩০ কোটি টাকার অধিক। টাঙ্গাইল জেলায় দানবীর হিসেবে খ্যাত ওয়াজেদ আলী খান পন্নী চাঁদ মিয়া, দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা, জমিদার নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী অগনিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। সেই ধারাবাহিকতায় বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী শিক্ষা বিস্তারে অনবদ্য ভূমিকা রেখে গেছেন। আশা করি আগামী প্রজন্ম এই ইতিহাস নিশ্চয়ই স্মরণ রাখবে। মহান দাতা, শিক্ষাবিদ বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী প্রয়াণের পর নাগবাড়ির পূণ্যভূমিতে শায়িত রয়েছেন।

৯.
বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে নিয়ে লিখতে গেলে প্রাসঙ্গিকভাবেই চলে আসে তাঁর জীবনের বাঁক বদল করা একটি ঘটনাকে, সময়কালকে। রাজনীতির অনুসন্ধিৎসু একজন শিক্ষার্থী হিসেবে জানি, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করেছিলেন তারই সরকারের মন্ত্রী ও বাকশালের কার্যকরী কমিটির ১৫ সদস্যের ৪ নম্বর সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমেদ। দেশ স্বাধীন হবার পর শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারে তিনি বিদ্যুত, সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রন মন্ত্রনালয়ের দ্বায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালে তাকে অর্থমন্ত্রীর দ্বায়িত্ব দেওয়া হয়। কতিপয় সেনা সদস্যদের হাতে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর মোশতাক আহমেদ নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেন। আশ্চর্য্যজনক বিষয় হল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্তাক্ত লাশ সিঁড়িতে রেখেই তার দীর্ঘকালের সহচররা খন্দকার মোশতাক আহমদের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন। আর যারা মন্ত্রী না হয়ে হত্যার প্রতিবাদ করে কারাগারকে বেছে নিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে তাজউদ্দীন আহমদসহ বেশ কয়েকজন বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের মাঝামাঝি সময়ে মন্ত্রিসভা থেকে বরখাস্ত হয়েছিলেন। মোশতাকের মন্ত্রিসভা বহাল থাকা অবস্থাই ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতাকে। বঙ্গবন্ধু হত্যার ১২ ঘণ্টার ব্যবধানে তারই ঘনিষ্ঠ সহচরদের মন্ত্রী হওয়ার ঘটনা খন্দকার মোশতাক সরকারের ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী কারারুদ্ধ আওয়ামী লীগ নেতা আমীর হোসেন আমু ও তোফায়েল আহমেদ মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগদানকারী সদস্যগণ সেদিন যদি জাতীয় চার নেতার মতো অন্য মন্ত্রীরা মোশতাকের মন্ত্রিত্ব গ্রহণ না করতেন তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস ভিন্ন হতে পারতো। খন্দকার মোশতাকের ৮১ দিনের শাসনামলে সঙ্গী ছিলেন বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভার ২১ সদস্য। মোশতাকের উপরাষ্ট্রপতি হলেন মোহাম্মদউল্লাহ। আর মন্ত্রিসভার সদস্যরা হলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। আর এভাবেই বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী নিজের সারাজীবনের অর্জিত স্বচ্ছ ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন, ক্ষতিগ্রস্তও করেন। কারণ খন্দকার মোশতাক সরকারের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের পথ উন্মুক্ত করে দেন সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও মহিউদ্দীন আহমদ বিশেষ দূত হয়ে।

১০.
বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর মৃত্যুর কিছুকাল আগে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের কথ্য ইতিহাস প্রকল্পের আওতায় (৮, ৯ ও ১০ জুন ১৯৮৭—এই তিন দিন) তাঁর একটি দীর্ঘ সাক্ষাত্কার নেওয়া হয়েছিল। সাক্ষাত্কার নিয়েছিলেন অধ্যাপক সালাহউদ্দীন আহমদ, অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম ও ড. এনামুল হক। সেই সাক্ষাত্কারের নির্বাচিত কিছু অংশ তুলে ধরছি। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তাঁর জন্ম, বাল্যকাল ইত্যাদি বিষয়ে বলেছিলেন এভাবে, ‘আমার জন্ম হয়েছিল একেবারে পদ্মা নদীর পাশঘেঁষা এলাচিপুর গ্রামে। তাই এই পৃথিবীতে আসামাত্রই সম্ভবত আমার কানে আছড়ে পড়েছিল পদ্মা নদীর কুলুকুলু ধ্বনি। সেটা ছিল ১৯২১ সালের ৩১ জানুয়ারি। এলাচিপুর তখন বৃহত্তর ঢাকা জেলার অন্তর্গত ছিল, আরিচা থেকে মাইল তিনেক দূরে। এখানে বসবাস করত বেশ কিছু মুসলিম পরিবার। বর্তমানে গ্রামটা পুরোপুরি পদ্মা নদীর গর্ভে চলে গেছে। পরিবারগুলো পরে সরে এসে পাশের যে গ্রামে বসতি স্থাপন করে, তারও নাম এলাচিপুর। আমার মামা বা নানার বাড়ি, যা-ই বলুন, সেখানেই আমার জন্ম। ২১ দিন পর বাবা মাকে আর আমাকে নিয়ে আসেন আমাদের বাড়িতে, নাগবাড়ীর আমাদের পৈতৃক ভিটায়। এখানেই আমার শৈশব কাটে। এলাচিপুর গ্রামে অনেক সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবারের বাসস্থান। মনে করা হয়, হজরত শাহ ছিলেন এসব পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁকে নিয়ে একটা কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। তাঁর মৃত্যুর বহু বছর পর পদ্মা প্রথম ভাঙতে ভাঙতে যেদিন একেবারে এলাচিপুর গ্রামের কাছে চলে এল, তখন কেউ কেউ বলল যে মাজার শরিফের কাছে এসে পদ্মা ঠিক ঘুরে যাবে। কিন্তু সবাই সেটা ঠিক বিশ্বাস করল না। তারা তাঁর কবর খুঁড়তে শুরু করল। কবর খুঁড়ে কিছু পাওয়া গেল না। তাঁর দেহাবশেষ অন্যত্র সরিয়ে নিতেই কবর খুঁড়েছিল। কিন্তু কিছুই পাওয়া যায়নি। অবশ্য সেদিন রাতেই (আমি অনেকের মুখেই শুনেছি) আলোর এক রশ্মি পদ্মার ওপর দিয়ে ভেসে যেতে দেখতে পায় লোকজন; এবং পুরো এলাচিপুর গ্রাম নদীগর্ভে চলে যায়। আধুনিককালে বা বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি অনেক জায়গা থেকে অনেক মুসলমান পরিবার আধুনিকতার অনুসারী হয়েছে বা সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে নেতৃত্ব দিয়েছে। এলাচিপুর হলো আশরাফউজ্জামান খান, আমানুজ্জামান খান, আনিসুজ্জামান খান, আদালত খানদের পৈতৃক ভিটা। তাঁদেরই পূর্বপুরুষদের একজন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে লেখাপড়া করেছেন। এলাচিপুরের সঙ্গে এ কে ফজলুল হক সাহেবেরও সম্বন্ধ ছিল। নওয়াব স্যার সৈয়দ শামসুল হুদাও বিয়ে করেছিলেন এই এলাচিপুরে। আমার পূর্বপুরুষদের মধ্যে হজরত শফিউদ্দিন নামের আরেকজন আধ্যাত্মিক সাধনার দিক দিয়ে এখানে খুব খ্যাতি লাভ করেছিলেন। তিনি আমার নানার বাবা। শিল্পী রশিদ চৌধুরীর বাবাও আমাদের আত্মীয় ছিলেন। আমার নানি ইন্তেকাল করার পর আমার নানা তাঁর আপন ফুফুকে বিয়ে করেন। আর রশিদ চৌধুরীর চাচা হারোয়ার খান বাহাদুর আলিমুজ্জামান চৌধুরী সেই ব্রিটিশ আমলেই কেন্দ্রীয় আইনসভায় একনাগাড়ে পঁচিশ বছর মেম্বার ছিলেন। ফরিদপুরে তাঁর নামে অনেক কিছুই আছে। ফরিদপুর জেলা বোর্ড স্থাপিত হওয়ার পর থেকে তিনি চেয়ারম্যান ছিলেন। জেলায় তিনিই প্রথম বিএ পাস করেন। তাঁর কাছে শুনেছি যে বিএ পাস করার পর লোকজন তাঁকে অনেক দূরদূরান্তের গ্রাম থেকে দেখতে এসেছিল। অত্যন্ত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ছিলেন তিনি।’

১১.
বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিত্ রায় ছিলেন তাঁর ক্লাসমেটি। সেই স্মৃতিচারণ করে জানান, ‘সত্যজিত্ রায় আমার ক্লাসমেট। তারপর ভাবুন সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের কথা। তিনি তাঁর মায়ের কাছ থেকে গল্প শুনেছেন যে তাঁর নানা, অর্থাত্ তাঁর মাতামহ এ দেশে হিন্দু-মুসলমানের মিলন সৃষ্টির লক্ষ্যে জীবন উত্সর্গ করেছিলেন। হঠাত্ ইংরেজরা তাঁকে কী জানি কী বিষ খাইয়েছিল আর তার প্রতিক্রিয়ায় উনি আস্তে আস্তে নিস্তেজ হতে হতে দার্জিলিংয়ে মারা গেলেন। এখন ওই হিন্দু-মুসলমানের মিলন স্থাপনের কাজের ভার তাঁর নানা তাঁর ওপরেই দিয়ে গেছেন। একটু রসিকতার সুরেই কথাটা আমি বলছি; কিন্তু কথাটা সত্যি। সিদ্ধার্থ শংকর রায়, আমার সামনে, আমাদের সামনেই আমাদের সহপাঠী করিমকে—পরে পুলিশ অফিসার হয়েছিলেন, কিছুকাল আগে মারা গেছেন—বলেছিলেন, ‘এই দ্যাখ, প্রত্যেক ক্লাস থেকে রিপ্রেজেন্টেটিভ হিন্দু হবে নাকি রে? তুই দাঁড়া। আমি তোর হয়ে ক্যানভাস করব।’ এসব কথা এ কারণেই বলা।’

১২.
নিজের পরিবার সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার পরিবার সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। সে কথা বলতে গেলে আমাকে একটি কথা বলতে হবে যে আমি আমার মা-বাবার একমাত্র সন্তান হওয়ায় তাঁরা তাঁদের মনের মতো করে আমাকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। আমি কী হয়েছি, সেটা একদম অবান্তর কথা। যেটা বাস্তব, সেটা হলো তাঁদের চেষ্টায় কোনো ত্রুটি ছিল না। বিশেষ করে, আমার মাকে আমি দেখেছি কোন রূপে, সেটাই বোধ হয় বলা দরকার। আমি রবীন্দ্রনাথের কবিতাটির বর্ণনামতো আমার মাকে আমার জন্মের পর থেকে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত লক্ষ্মী আর কল্যাণী—এই রূপে দেখেছি এবং এ কথা আমি তাঁকে বিলেত থেকে একটি চিঠিতে লিখেছিলাম যে রবীন্দ্রনাথ তো কল্পনায় দেখেছিলেন মায়ের এই রূপ; তো, আমি তোমাতে সেটা দেখছি। উনি আমার মনটিকে গড়ে তোলার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। উনি হিন্দু-মুসলমান—এ প্রশ্ন তো দূরের কথা, কোনো মানুষের মনে ব্যথা দেওয়ার কথা বলতে গিয়ে আমাকে বারবার বলেছেন, মসজিদ ভেঙে দেওয়া আর মানুষের মনে ব্যথা দেওয়া একরকমের অপরাধ। আরেকটি কথা বলেছেন, জীবনে কখনো সত্য থেকে বিচ্যুত হতে নেই। তাঁর নিজের জীবনেও আমি সেটা দেখেছি। তিনি এলাচিপুরের এক সম্ভ্রান্ত বংশের মেয়ে। সম্ভ্রান্ত এ কারণে যে ওই গ্রামের প্রতিটি বাড়ির প্রত্যেকেই শিক্ষিত ছিলেন এবং সেই নবাব-বাদশাদের আমল থেকেই তাঁদের অনেকে চাকরি-বাকরিও করতেন। তাঁদের মধ্যে ছিল আরবি-ফারসির চর্চা। তা ছাড়া আমার মা বঙ্কিমচন্দ্রের নভেল-টভেল পড়তেন। আমাকে তিনি গল্পচ্ছলে একবার বলছিলেন যে তাঁর মুরব্বিরা তাঁকে ওই সব বাংলা নভেল-টভেল পড়তে দেখলে অসন্তুষ্ট হতেন। তাই তিনি সেগুলো লুকিয়ে লুকিয়েই পড়তেন। তো, তাতে করে আপনারা বুঝতে পারেন যে আমার শৈশবকালে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে বাংলা নভেল ইত্যাদি পড়া সহজ ছিল না। আরেকটি কারণে আমার মনে কখনো হিন্দু-মুসলিম—এ প্রশ্নটা ওঠেনি। কেননা, আমাদের বাড়িতে সে সময় অন্তত কুড়ি-পঁচিশজন হিন্দু কর্মচারী ছিলেন। কর্মচারীদের বেশির ভাগই ছিলেন হিন্দু। আর ম্যানেজার তো হিন্দু ছিলেনই। কারণ, আমার পিতামহ একাদউদ্দিন সাহেব বুঝতে পেরেছিলেন যে এঁদের সবাই জমিটমির কাজ ভালো বোঝেন। এর সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি ধার্মিক লোক ছিলেন। প্রতিদিন শেষ রাতে উঠে তাহাজ্জতের নামাজ পড়তেন; কিন্তু তাঁর ম্যানেজার ছিলেন হিন্দু। এবং এ রকমের পরিবেশেই আমার শৈশব কেটেছে। তা ছাড়া সবাইকে সমান চোখে দেখার ব্যাপারটা আমার স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে।’

১৩.
মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, সাবেক রাষ্ট্রপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, তদানীন্তন হাইকোর্টের সাবেক বিচারপতি এবং সাবেক অ্যাডভোকেট জেনারেল আবু সাঈদ চৌধুরীর স্মৃতির প্রতি আবারো জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

(তথ্যসূত্র : বাংলাপিডিয়া, প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত