প্রয়াণদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

আমিনুল ইসলাম বাদশা

প্রকাশ : ০৪ আগস্ট ২০১৮, ১৩:২৬

১.
গৌরবময় রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী, ভাষা সংগ্রামী, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, ঐতিহাসিক খাপড়া ওয়ার্ডের বিপ্লবী, পাবনার কৃতি সন্তান আমিনুল ইসলাম বাদশা। ১৯৯৮ সালের ৪ আগস্ট প্রয়াত হন। আমাদের পাবনার এই আলোকিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের জন্মদিনে তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, তিনি জন্মেছিলেন ১৯২৯ সালের ১৪ এপ্রিল, পাবনা শহরের কৃষ্ণপুর মহল্লায়। খাপড়া ওয়ার্ডের বিপ্লবী, এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের উজ্জল নক্ষত্র, গণতন্ত্রী পার্টির প্রেসিডিয়ামের সদস্য ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা কমরেড আমিনুল ইসলাম বাদশা। তাঁর সম্পর্কে স্মরণসভায় জাতীয় নেতৃবৃন্দ যথার্থই বলেছিলেন, ‘কমরেড আমিনুল ইসলাম বাদশা ছিলেন সমাজতান্ত্রিক আদর্শভিত্তিক রাজনীতির উজ্জ্বল নক্ষত্র। সততা, আদর্শবাদিতা, ত্যাগের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। দেশকে আদর্শবাদী ধারায় পরিচালিত করতে তাঁর মতো বিপ্লবীদের জীবন ও সংগ্রাম থেকে নতুন প্রজন্মকে শিক্ষা নিতে হবে।’

২.
আমাদের পাবনা জেলায় ভাষা আন্দোলনের সঠিক ইতিহাস জানতে, ইতিহাসের সন্ধানে গবেষণা, পড়ালেখা করতে গিয়ে আলোকিত যে নামটি ধ্রুবতারার মতো আমার মনের আকাশে জ্বলে ওঠে তিনি আর কেই নন কমরেড আমিনুল ইসলাম বাদশা। কারণ ইতিহাসই সাক্ষ্য দেয়, পাবনাতে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ১৯৪৮ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি একটি মাইল ফলক তারিখ বা স্মরণীয় দিন। যে দিন বা তারিখটি লিপ ইয়ার হিসাবের কারণে প্রতি বছর পালন করতে পারি না আমরা। ভাষা আন্দোলনের আদিপর্বে ১৯৪৮ সালের এই দিনটিতেই ভাষার দাবিতে পাবনায় আহূত হরতালে গ্রেফতার হয়েছিলেন নেতৃবৃন্দ। আর তাদের অন্যতম একজন ছিলেন কমরেড আমিনুল ইসলাম বাদশা। বিভিন্নজনের লেখায় পাকিস্তান পর্বে প্রথম গ্রেফতার ভাষা সৈনিক হিসেবে তাঁকেই জানতে পারি আমি। অথচ বেদনার সাথে খেয়াল করি সেভাবে তাঁকে কেউ উপস্থাপন করেন না। আশাকরি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে তাঁর অবিস্মরণীয় ভূমিকার যথাযথ মূল্যায়ন দেরিতে হলেও হবে।

৩.
আমরা আগেই জেনেছি, ১৯২৯ সালের ১৪ এপ্রিল পাবনা শহরের কৃষ্ণপুর মহল্লায় আমিনুল ইসলাম বাদশার জন্ম। তাঁর পিতার নাম আলহাজ্ব নুরুজ্জামান শেখ। মাতার নাম খবিরন নেছা। আমিনুল ইসলাম বাদশারা ছিলেন পাঁচ ভাই ও এক বোন। তাঁর বিধবা পত্মীর নাম নীলুফা ইসলাম। তাদের তিন সন্তান- একপুত্র ও দুইকন্যা। আমিনুল ইসলাম বাদশা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে আকস্মিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন ১৯৯৮ সালের ৪ আগস্ট সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটে ঢাকার মালিবাগস্থ বাসভবন থেকে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে নেয়ার পথে। পরদিন পাবনার আরিফপুর গোরস্থানে তাঁর মরদেহ দাফন করা হয়। বর্তমানে আমিনুল ইসলাম বাদশার ছোট তিনভাই জীবিত আছেন- আজিজুল ইসলাম মন্টু (ব্যবসায়ী), রবিউল ইসলাম রবি (সাংবাদিক) ও জহুরুল ইসলাম মুকুল (ব্যবসায়ী)। তাঁর মেঝোভাই সিরাজুল ইসলাম আফসার ও ছোট বোন মেরী পরলোকগমন করেছেন। আমিনুল ইসলাম বাদশার বড় মেয়ে নাজমা ইসলাম স্বপ্না, তাঁর ছোট মেয়ে ইসমত আরা কনা এবং একমাত্র পুত্র সাবিরুল ইসলাম বিপ্লব যিনি পেশাগত জীবনে সরকারি চাকুরী করেন (বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের সদস্য, বর্তমানে একজন উপসচিব)। 

৪.
কমরেড আমিনুল ইসলাম বাদশা মাত্র ১৩ বছর বয়সে কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন। আমিনুল ইসলাম বাদশা পাবনা গোপালচন্দ্র ইনস্টিটিউশনের ছাত্র থাকাকালে কৈশোরে ১৯৪৩ সালে প্রয়াত জননেত্রী বেগম সেলিনা বানু ও কমরেড প্রণতিকুমার রায়ের সাথে একই সঙ্গে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন এবং ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দেন। তখন চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম উঠেছে তুঙ্গে-অবিভক্ত বাংলাদেশে তখন ৫০-এর মম্বন্তরের পদধ্বনি। আমিনুল ইসলাম বাদশা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ উৎখাতের জন্যে, ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্যে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ও দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ আন্দোলনে অংশ নেন। অতঃপর পাকিস্তান আন্দোলনের নামে সৃষ্ট উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধ আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। 

৫.
১৯৪৭ সালের ৪ নভেম্বর পাবনার ঈশ্বরদীতে অনুষ্ঠিত যুব সম্মেলনে, রাজশাহীর প্রখ্যাত নেতা আতাউর রহমানের নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠিত হয়, তাতে উপস্থিত ছিলেন আমিনুল ইসলাম বাদশা। ১৯৪৮ সালের গোড়ার দিক থেকেই গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠনে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাংলা ভাষা বিষয়ক প্রস্তাবনা মুসলীম লীগ সরকারের বিরোধিতায় নাকচ হয়ে গেলে পাবনার সচেতন প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। ১৯৪৮-এর ২৬ ফেব্রুয়ারি তারিখে সর্বদলীয় সভায় রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। আমিনুল ইসলাম বাদশা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ এর যুগ্ম আহবায়ক নির্বাচিত হন।

৬.
২৭ ফেব্রুয়ারির সর্বদলীয় বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুসারে ২৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ পাবনা শহরে হরতাল পালিত হয়। প্রশাসনের জারী করা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে পাবনা শহরে ছাত্র জনতার মিছিল নামে। সেই মিছিলে নেতৃত্বদানকারীদের একজন ছিলেন আমিনুল ইসলাম বাদশা। ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করার কারণে পাকিস্তান পুলিশ ঐ দিন তাঁকেসহ ৬৪ জনকে গ্রেপ্তার করলেও আন্দোলনের মুখে ঐ দিনই আদালত মুক্তি দিয়ে দেন সকলকে। এর দুইদিন পর আবারও তিনি গ্রেপ্তার হন। 

৭.
১৯৪৮-এর ১১ মার্চ সারা পাকিস্তানে ডাকা সাধারণ ধর্মঘট বা হরতাল সর্বাত্মকভাবে পালিত হয় পাবনায়। এর পরপরই পুনরায় গ্রেপ্তার করা হয়। উল্লেখ্য ভাষার দাবীতে ২৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮-এর হরতাল স্বাধীন পাকিস্তানের প্রথম হরতাল প্রায় সাড়ে ৪ বছর একটানা বিনা বিচারে আটক থাকার পর ১৯৫৩ সালের, ডিসেম্বরে মুক্তি পান। এই দফায় আটক থাকাকালে ১৯৫০-এর ২৪ এপ্রিল রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের খাপড়াওয়ার্ডে আটক রাজবন্দীদের উপর জেল পুলিশের নির্মম গুলিবর্ষণে ৭জন বিপ্লবী রাজবন্দী শহীদ হন এবং অবশিষ্ট ৩০ জনেরও অধিক গুরুতরভাবে আহত হন- আমিনুল ইসলাম বাদশা তাদের অন্যতম। মৃত্যুর দিন পর্যন্ত বুলেট তাঁর পায়ের ভেতরে থেকে গিয়েছিল। তিনি তাঁর পায়ের চিকিৎসার জন্য কোনপ্রকার রাষ্ট্রীয় বা পার্টিগত সুযোগ সুবিধাও গ্রহণ করেননি।

৮.
কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে ১৯৫৩ সালে বন্দী মুক্তিসহ মুসলিম লীগ বিরোধী নানা আন্দোলনে অংশ নেন। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন পরিচালনার জন্য গঠিত পাবনা জেলা গণতান্ত্রিক কর্মী শিবিরের যুগ্ম আহবায়ক পদে নির্বাচিত হন। নির্বাচনী অভিযান চালানো কালে ৫৪ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি তাঁকে পুনরায় গ্রেপ্তার করা হয়- নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি হলে একমাস পর মুক্তি পান। এর দু’মাস পর ৯২(ক) ধারা জারি করে যুক্তফ্রন্ট নেতা শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের নেতৃত্বে গঠিত পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক সরকারের বাতিল করার সাথে সাথে পুনরায় গ্রেপ্তার হন। দেড় বছরেরও অধিককাল পর ১৯৫৫ সালের শেষ দিকে মুক্তিলাভ করেন। ১৯৫৭ সালে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠনের পর তিনি ন্যাপে যোগ দেন। ১৯৫৮ সালে আইয়ুবের সামরিক শাসন জারির পরপরই গ্রেপ্তার হন এবং প্যারোল মুক্তি পেয়ে তিনি বিবাহ করেন।

৯. 
১৯৬০ সালের শেষের দিকে ‘আপত্তিকর’ পুস্তক রাখার অভিযোগে সামরিক আইনে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। একমাস পর তিনি জামিনে মুক্তি পান। এই সময় কালে পাবনার শহরের বেনিয়াপট্টিতে পাবনাতে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক ধারার বিকাশ ও নিজের আয়ের জন্য বইয়ের দোকান ‘বইঘর’ স্থাপন করেন। পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি প্রগতিশীল চিন্তাচেতনা সমৃদ্ধ চিরায়ত ধারার পুস্তক ও প্রকাশনা প্রাপ্তির একটি মাধ্যম হিসেবে বইঘর হয়ে উঠেছিলো সাংস্কৃতিক বিকাশের কেন্দ্রবিন্দু গুলির একটি।

১০.
১৯৬৪ সালে সার্বজনীন ভোটাধিকারের দাবিতে ন্যাপ-আওয়ামী লীগের যৌথ আন্দোলন চলাকালে পুলিশ আবার তাঁকে গ্রেফতার করে। এক বছর পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান। ১৯৬৭ সালে পাবনার ঐতিহাসিক ভুট্টা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বিষাক্ত আটার রুটি খেয়ে মৃত্যুর কারণে পাবনা হয়ে উঠেছিলো বিক্ষোভের ও বিস্ফোরণের নগরী। এই বিক্ষোভে নেতৃত্ব দানকারীদের একজন ছিলেন তিনি। পুলিশের হাতে যথাযথীতি গ্রেপ্তার হন জননেতা ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, আমজাদ হোসেনসহ অন্যান্য নেতাদের সাথে। ১৫টি মামলা হয় তাঁর বিরুদ্ধে।১৯৬৯-র ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেন এবং একজন সংগঠকের ভূমিকা পালন করার কারণে পুনরায় গ্রেপ্তার হন। দু’সপ্তাহ পর সকলের সাথে মুক্তিলাভ করেন। ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদের, নির্বাচনে ন্যাপ মনোনীত প্রার্থী হিসাবে অংশ নেন। 

১১.
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এক উজ্জ্বলতম অধ্যায় পাবনা। ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছ থেকে পাবনা জেলা সদরকে অবমুক্ত করবার জন্য সরাসরি অনেকবার যুদ্ধে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন। বিশেষ করে ১৯৭১ সালের ২৭,২৮ ও ২৯ মার্চের সশস্ত্র যুদ্ধে তার সাহসী ভূমিকার কথা উল্লেখ করতেই হয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে পাবনা জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে গঠিত হাই কমান্ডের তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট সদস্য। একই বছর ১০ এপ্রিল পাক-বাহিনী কর্তৃক পাবনা পুনঃর্দখলের পর কলিকাতা গমন করে তিনি মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে আত্মনিয়োগ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে প্রবাসী সরকারের সাথে রাজনৈতিক সংযোগের পাশাপাশি বিভিন্ন ক্যাম্প পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার ও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের উচ্চ মহলে তাঁর প্রাক্তন রাজনৈতিক সহকর্মীগণের অনেকে থাকায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার, মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন ক্যাম্প শরণার্থী শিবির প্রভৃতির মাঝে সমন্বয় সাধনে তিনি গুরুত্বর্পূণ ভুমিকা রাখেন । কেন্দ্রীয় মুক্তি সংগ্রাম সহায়ক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটিতে সমন্বয়ক হিসাবে কাজ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগর, করিমপুর, শিকারপুর, কেচুয়াডাঙ্গা, মুর্শিবাদ প্রভৃতি ক্যাম্প পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে খাদ্য ঔষুধ ও রসদ সরবরাহের ব্যবস্থা করেছেন। ভারত সরকারের সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন্ ক্ষেত্রে ত্রাণ সামগ্রী সরবরাহ নিশ্চিত করেছেন।

১২.
১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পাবনা সদর এলাকা ন্যাপ মনোনীত প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গঠিত একমাত্র জাতীয় দল বাকশালের পাবনা জেলা কমিটির অন্যতম যুগ্ম সম্পাদক পদে মনোনীত হন। ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্টে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে মৃত্যুর ঘটনায় তিনি সাংঘাতিকভাবে মর্মাহত ও ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত হন। আত্মগোপনে চলে যান।

১৩.
১৯৭৬ সালের মার্চে জিয়াউর রহমানের বিশেষ ক্ষমতা আইনে গ্রেপ্তার এবং দেড় বছর পর হাইকোর্টে রীট আবেদনের প্রেক্ষিতে তিনি মুক্তি লাভ করেন। ১৯৭৮ সালে জাতীয়ভাবে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি গঠিত হয় তিনি ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং পাবনা জেলা শাখার সভাপতি।১৯৭৮ সালেই তিনি ন্যাপের দায়িত্ব পালন করেন কিন্তু ন্যাপের বিভক্তির পর তিনি দলীয় রাজনীতি হতে দূরে থাকেন। ১৯৭৯-এর পাবনা পৌরসভা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ন্যাপ প্রার্থী হিসাবে অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ’৮২-’৮৩ সালে ন্যাপ পুনরেত্রকত্রীকরণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেন এবং ঐক্য ন্যাপের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও পাবনা জেলা কমিটির সভাপতি পদে দায়িত্ব পালন করেন। 

১৪.
১৯৮৯ সালে ন্যাপ পুনরায় বিভক্ত হলে প্রয়াত জননেতা সৈয়দ আলতাফ হোসেনের নেতৃত্বে গণতন্ত্রী পার্টি গঠন করেন এবং তার সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন। আমৃত্যু তিনি এই পদে অধিষ্ঠিত থেকে জাতীয় রাজনীতিতে অবদান রাখেন। তিনি সামরিক শাসন ও স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী রাজনীতির ঐক্য গড়তে তিনি প্রাণপণ কাজ করে গেছেন। ১৯৯০-এর পর ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটির কার্যক্রমে তিনি আত্মনিয়োগ করেছিলেন। তিনি অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল রাজনীতির ঐক্যের মাধ্যমে এদেশে কল্যাণকামী রাজনৈতিক ধারা সৃষ্টির পক্ষে কাজ করে গেছেন।

১৫.
মনে প্রাণে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আমিনুল ইসলাম বাদশা আজীবন সমাজতন্ত্রের সমর্থক ছিলেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল মার্কসবাদ-লেলিনবাদের প্রতি ব্রিটিশ ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ এই তিন পর্বেই তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হিসাবে কাজ করে গেছেন। সমগ্র বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলায় তিনি অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে তিনি গণফোরাম, গণতন্ত্রী পার্টি, গণ আজাদী লীগ, কমিউনিস্ট কেন্দ্র ও বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের শরীক দলগুলিসহ ১১ দলীয় ঐক্য গঠনের মাধ্যমে দেশের রাজনীতিতে একটি প্রগতিশীল বিকল্প ধারা সৃষ্টিতে আত্মনিয়োগ করেন। কালো টাকা, বেআইনী অস্ত্র ও মাস্তানী প্রভাবিত প্রচলিত রাজনীতির তিনি ছিলেন ঘোর বিরোধী। গাড়ী, বাড়ী, ব্যাংক ব্যালেন্স, ব্যক্তিগত বৈভব ও আরাম আয়েশের প্রতি মোহগ্রস্থ হননি তিনি কখনো। 

১৬.
অবিভক্ত ভারতবর্ষ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ, এই তিন পর্বেই তিনি কমিউনিস্ট পার্টির গোপন সদস্য হিসেবে তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছেন আমিনুল ইসলাম বাদশা। খাপড়া ওয়ার্ডের বিপ্লবী, ভাষা সংগ্রামী, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এবং দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ও গণতন্ত্রী পার্টির সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য আমিনুল ইসলাম বাদশা মানুষের মুক্তি জন্য অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও সাম্যবাদী আদর্শের সমাজ প্রতিষ্ঠায় জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। স্বাধীনতার এত বছর পরও যখন মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তিচিন্তা বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছে, তখন বাদশার জীবন থেকে নতুন প্রজন্ম পাঠ গ্রহণ করলে আজকের অস্থির সময় থেকে দেশকে সুস্থির সময়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে। জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদ মুক্ত বাংলাদেশ গড়তে নতুন প্রজন্মকে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও সাম্যবাদী জীবনাদর্শে গড়ে তুলতে হবে। সততা, আদর্শবাদিতা ও ত্যাগের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী এ নেতার জীবন থেকে সে জীবনাদর্শই গ্রহণ করতে হবে।

১৭.
আমাদের পাবনার কৃতিসন্তান এবং দেশের বাম ভাবধারার একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আমিনুল ইসলাম বাদশা কেবল ভাষা আন্দোলনেই নন, মহান মুক্তিযুদ্ধেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। আমি যতই জানার চেষ্টায় গবেষণায় অগ্রসর হচ্ছি, ততই তাঁর রচনা পাঠ করে, নানাক্ষেত্রে ভূমিকা জেনে বিস্মিত হচ্ছি।তাঁকে নিয়ে স্বতন্ত্রভাবে বড় পরিসরে লেখার আগ্রহ ক্রমাগত বাড়ছেই আমার। তবে জন্মদিনের প্রেক্ষাপটে আমিনুল ইসলাম বাদশা’র লেখা ‘১৯৪৮: পাবনাতে ভাষা আন্দোলন’ অসম্ভব প্রয়োজনীয় রচনাটি সকলের সামনে উপস্থাপনা জরুরি বলেই বিবেচনা করছি। উল্লেখ্য, অসাধারণ এই লেখাটি সর্বপ্রথম ভিন্ন শিরোনামে পাবনা হতে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বিবৃতির ১৩৮৮ বঙ্গাব্দের ১৭ বৈশাখ উদ্বোধনী সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। 

১৮.
১৯৪৮ সালের পাবনাতে ভাষা আন্দোলন নিয়ে আমিনুল ইসলাম বাদশা লিখছেন, ‘যে কোন জাতির পক্ষে স্বাধীনতা হল সবচেয়ে প্রিয় বস্তু । সে স্বাধীনতা ভাষার হোক অর্থনৈতিক বিকাশের হোক, মতামত প্রকাশের হোক আর সংবিধানের অধিকার কায়েমের হোক। স্বাধীনতা ব্যতীত কোন জাতিই বিকাশ লাভ করতে পারে না- তা সে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে হোক, কৃষ্টির ক্ষেত্রেই হোক বা আধ্যাত্মিক বিকাশের ক্ষেত্রেই হোক । জনজীবনে বল্গাহীন অগ্রগতিই স্বাধীনতার মূলে তাই জন সাধারণ নিজ দাবী আদায়ের সংগ্রামে দুর্দমনীর- অকুতোভয়। পাকিস্তান আন্দোলনের পেছনে বাংলার আপামর কৃষকসহ মধ্যবিত্ত নিম্ন বিত্তের সমর্থনের কারণ মূলত: অর্থ নৈতিক শোষণ থেকে মুক্তি ও আর্থ সামাজিক বিকাশের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি।

১৮.২
মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্য চেতনা বরাবরই প্রবল ছিল বলেই সামন্ত নেতৃত্বের প্রাধান্য ছিল অটুট, যার ফলে জাতীয়তাবাদী ভাবধারা চেতনার জন্ম দিতে পারেনি। অবশ্য অর্থনৈতিক অনগ্রসরতাও এস সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। ১৯৪৭ সালের ১৪ ই আগষ্টের পর জমির উপর মূষ্টিমেয় বড় ভূস্বামীদের এক চেটিয়া অধিকার ছিল এবং বিরাট সংখ্যক কৃষক যাদের মেহনতের ফলেই পূর্ববঙ্গের মাঠে মাঠে সোনা ফলতো সেই ব্যাপক কৃষক সমাজ ভুমির অধিকার থেকে ছিল বঞ্চিত। কৃষি ফসলের মূল্য ছিল অতি সামান্য। পাটের তৈরী মূল্যের অর্দ্ধাংশও কৃষকরা পেতনা উপরন্ত নয়া রাষ্ট্র যন্ত্রে অধিষ্ঠিত পাট ব্যবসায়ী অবাঙালী মধ্যস্বত্ত ভোগীরা পেল ব্যাপক মুনাফার সুযোগ। ভুমি সংস্কারের যে ওয়াদা মুসলিম লীগ বাংলার কৃষকদের দিয়েছিল তা পালনেও তারা গরিমসী করছিল। শুধু তাই নয় উপরন্ত দেশ বিভাগের পূর্বে বৃটিশ পুঁজি নিয়োজিত ছিল তাদের স্বার্থও ছিল অলঙ্ঘনীয়। যেমন চা বাগানে, নদী পথে ষ্টিমার সার্ভিসে এবং তৈল শিল্পে। এই বিদেশী পুঁজির লুন্ঠনকে খতম করার জন্য কোন কার্য্যকরী ব্যবস্থা অবলম্বন না করে আরও অধিক সুবিধা দেওয়ার নীতিতে সরকার ছিল উৎসাহী। শিল্পনীতিতে বিদেশী পুঁজিপতিগণকে আহ্বান জানানোর ভূরি ভুরি নজির পাওয়া যায়। বিদেশী শিল্প পতিরা অর্জিত মূনাফা নিজ দেশে পাঠাতেই পারবে না উপরšত্ত জাতীয়করণ না করার নিশ্চয়তা দেওয়ার ঘটনা সমূহের প্রতি প্রগতিশীল রাজনৈতিক, ছাত্র ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের সাথে নব গঠিত গনতান্ত্রিক যুবলীগ নেতৃবৃন্দ ছিলেন হুশিয়ার- ও নয়া ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বিশেষ করে রাষ্ট্র ভাষার প্রশ্নে ষড়যন্ত্র সম্পর্কে যেখানে যেখানে অনুকুল জমায়েত ও কর্মী পেয়েছেন- সেখানে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা গ্রহণের কথাও ব্যক্ত করেছেন। রাজশাহীর আতাউর রহমান সাহেবের উত্তরের জেলা সমূহসহ পাবনা সফর বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। এসময়টা ছিল প্রগতিশীল কর্মী ও মুসলিমলীগের শহীদ হাসেম গ্রুপের সংগঠিত হবার কালে ইতিপূর্বে ভাষার স্বপক্ষে একটি কর্মী সভা অনুষ্ঠিত হয়, সেখানেও কেন্দ্রীয় বাঙালী মন্ত্রী ফজলুর রহমান ও হাবিবুল্লাহ সাহেবের উর্দু প্রীতির তীব্র নিন্দা করা হয়। সেই সভায় গণতান্ত্রিক যুবলীগের সম্পাদক জনাব আতাউর রহমান সাহেব উপস্থিত ছিলেন। ইতিমধ্যেই তমুদ্দুন মজলিস ও পূর্ব পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুব লীগের সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয়েছে। তমুদ্দুন মজলিসের নেতৃত্বে রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদও গঠিত হয়েছিল। এক কথায় ভাষার প্রশ্নে পক্ষে ও বিপক্ষে ব্যাপক আলোচনা ও আলোড়ন শুরু হয়েছিল। কিন্তু ঢাকা ছিল মুসলিম লীগের নাজিমউদ্দিন গ্রুপের শক্ত ঘাটি। তাঁরা প্রতিক্রিয়াশীল নেতৃত্বের বিরোধী কোন শক্তি কে সংগঠিত হবার ব্যাপারে ছিল মরমুখো। তবুও হাঁটি হাঁটি পায়ে সচেতন যুব শক্তি এগিয়ে যাচ্ছিল। পাথর ভাঙার শপথে ছিল বলিয়ান- দুর্বার ছিল ইচ্ছা শক্তি। 

১৮.৩
এমনি সময়ে ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ গন পরিষদের প্রথম অধিবেশনে পূর্ব বাংলার প্রতিনিধি শ্রী ধীরেন দত্ত বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার প্রস্তাব আনেন। সম্ভবতঃ তিনদিন ধরে আলোচনা চলে। এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রধান মন্ত্রী লিয়াকত আলী খান, গজনফর আলী খান ও পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন কটাক্ষ করে বক্তৃতা রেখেছিলেন আর সমস্ত সরকার পক্ষীয় বাঙালী অবাঙালী সদস্য এই প্রস্তাবের বিরোধীতা করেছিলেন।

১৮.৪
এ সংবাদ পাবনার সচেতন প্রগতিশীল রাজনেতিক কর্মী, ছাত্র যুব ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের মধ্যে ত্বরিৎ বিরূপ প্রক্রিয়ার সৃষ্টি করে। ইতোমধ্যেই পাবনায় শহীদ হাসেম গ্রুপের ছাত্রলীগ ও মুসলীম লীগ কর্মী ছাত্র ফেডারেশন কর্মীদের নিয়ে গণতান্ত্রিক যুবলীগের জেলা সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয়েছিল রাজশাহীর আতাউর রহমান সাহেবের উপস্থিতিতে। তাছাড়া জনকৃষ্টি পরিষদ কমুনিষ্ট পার্টি র‌্যাডিক্যাল ডেমোক্রাটিক পার্টি ও ছাত্র কংগ্রেসের সদস্য সহ সদ্য- চাকুরীরত কিছু যুব কর্মীরা ব্যাপক ভাবে ভাষার প্রশ্নে প্রতিবাদ মুখর হয়ে ওঠেন এবং আন্দোলনের পথে অগ্রসর হবার পক্ষে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তৎপরতায় সমর্থন দেন পাবনার জেলা মুসলীগ সম্পাদক এম এল এ দেওয়ান লুৎফর রহমান সাহেব সহ মুসলিম লীগের একটি অংশ। সিরাজগঞ্জ মহকুমা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সম্পাদক তখন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে এসে ভর্তি হয়েছে। তারাও নইমউদ্দিনের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের আহ্বায়ক কমিটির সমর্থক ছিলেন এক কথায় বলতে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সম্পাদক ব্যতীত উল্লেখযোগ্য কেউই শাহ আজিজ গ্রুপের পক্ষে ছিলেন না অপরদিকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হবার পর মুসলিম ছাত্রদের জায়গীর সমস্যা সমাধানের জন্য যে কয়জন ছাত্র শিক্ষক তৎপর ছিলেন তাঁরাও এই ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। অপরদিকে জেলা মুসলীমলীগের অপর সারির নেতা ও প্রাদেশিক গণ পরিষদের সদস্য জনাব এ এম এ হামিদ সাহেবের পুত্ররাসহ মুসলীম লীগের নেতৃস্থানীয় কয়েক জনের পুত্ররাও এই আন্দোলনে সক্রিয় ভাবে সমর্থনের জন্য এগিয়ে আসেন। কলিকাতা থেকে প্রাক্তন ছাত্র হাসেম, শহীদ গ্রুপের মুসলীম লীগ কর্মী আমজাদ হোসেন, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সাবেরা মুর্শেদ, শাজাহান মোহাম্মদ, জেলা স্কুলের শিক্ষক মওলানা কছিমদ্দিন, এডওর্য়াড কলেজের অধ্যাপকদের বৃহৎ অংশ ও আন্দোলনের স্বপক্ষে মতামত ব্যক্তকরে গণ পরিষদের সরকারী অভিমতকে বিপদজনক অগণতান্ত্রিক প্রতিক্রিয়াশীল বলে অভিহিত করেন। সকলেরই বক্তব্য, রুখতে হবে। আতাউর রহমান সাহেবের চিঠি আসে পাবনায়। 

১৮.৫
যে কোন মুল্যে প্রতিবাদ হরতাল ও বরফ ভাঙার দায়িত্ব পালন করতে হবে। ২৬শের রাত্রে গণতান্ত্রিক যুবলীগের ছাত্র ফেডারেশনের পক্ষে থেকে দেওয়ান লুৎফর রহমান সাহেবের বাসভবনে আলোচনা হয়। সেখানেই ঠিক হয় ২৯ ফেব্রুয়ারি সাধারণ হরতাল পালন করা হবে। তবে আগামী কাল সকলকে ডেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েই প্রেসে ছাপিয়ে লিফলেট বিলি হবে এবং প্রচারের হর্ণ (চোঙা) বের করা হবে। এদিকে রাত্রেই প্রেসে কম্পোজ করে রাখা হয়েছিল। 

১৮.৬
২৭ তারিখে তৎকালীন পাবনা টাউন হলের বিরাট গোল টেবিল ঘিরে বৈঠক বসলো। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রবীন উকিল দেওয়ান লুৎফর রহমান এম এল এ সাহেব। সেখানে উপস্থিত ছিল গনতান্ত্রিক যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও ছাত্র ফেডারেশন, কমিউনিষ্ট পার্টির প্রতিনিধি, র‌্যাডিক্যাল ডেমোক্রাটিক পার্টির কর্মী, মুকুল ফৌজ, ছাত্র কংগ্রেসের কর্মীরা, জনকৃষ্টি পরিষদ, মুসলীমলীগ কর্মীও স্বতঃ স্ফুর্ত ভাবে আগত সরকারি চাকুরীরত যুব সমাজ। সর্বসম্মতিক্রমে ২৯ ফেব্রুয়ারি সাধারণ হরতাল সিদ্ধান্ত গ্রহীত হয়। মাহবুবর রহমান খান ও আমিনুল ইসলাম বাদশাকে সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক নিযুক্ত করা হয়। 

১৮.৭
সঙ্গে সঙ্গে খবরের কাগজে লেখা পোষ্টার ও চোঙা নিয়ে প্রচারের জন্য কর্মীরা বেরিয়ে পড়লো গ্রুপে গ্রুপে। অবশ্যই পায়ে হেটে আধঘন্টার মধ্যেই ছাপানো ছোট ছোট লিফলেট বিলি শুরু হয়। ব্যাপক উৎসাহ দেখা যায়। এই হরতালকে সফল করার জন্য স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে কলেজের ছাত্ররা দলে দলে স্কুলে স্কুলে পাড়ায় পাড়ায় লজিং বাড়ীতে বাড়ীতে ঘুরতে থাকে- ঘুরতে থাকে তৎকালীন ক্ষুদ্র শিল্পশহরে পাবনার ফ্যাক্টরী গুলোতে- বিড়ি ও রিকশা। শ্রমিকদের জমায়েত সক্রিয় সমর্থক আদায়ের জন্য। আর অফিস আদালতে সহ শহরতলীর মুসলিম পল্লীতে প্রচারকার্য্য বিশেষ জোরের সঙ্গে শুরু হয়। হঠাৎ এই ব্যাপক সাড়া ও প্রস্ততির ফলে নাজিমউদ্দিন পন্থী গোড়া মুসলিম লীগ মহল ভেতরে ভেতরে গুমড়াতে থাকে- প্রতিশোধ স্পৃহা চরিতার্থের জন্য সক্রিয় হচ্ছে সেটা বোঝা যাচ্ছিল সেই সাথে পরিষদ সদস্য এম এ হামিদ সাহেব ও মাওলানা আবদুল্লাহেল কাফী সাহেব আরবী হরফে বাংরা প্রচলনের কথা জোরেসোরে বলতে থাকেন। ঢাকা থেকে অনবরত সরকারী মহলের খবর আসতে থাকে। ডি এম এমদাদ আলী সাহের ও এম এল এ ও নেতৃস্থানীয় প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দের আগমনে শহর জমজমাট। 

১৮.৮
সন্ধ্যায় জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটের বাসভবনে যুগ্ম আহ্বায়ক মাহবুবর রহমান খান ও আমিনুল ইসলাম বাদশার ডাক পড়লো সেখানে উপস্থিত ছিলেন, এম এল এ মওলানা আঃ রশিদ তর্কবাগীশ, আবদুল হামিদ, দেওয়ান লুৎফর রহমান, জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান এম, এল, এ আবদুর রশিদ মাহমুদ ও জনাব আলমাহমুদসহ আরও কিছু মুসলিম লীগ নেতা, আইনজীবি, এস পি ও এস, ডিও সাহেব।

১৮.৯
হরতাল প্রত্যাহার করার প্রস্তাব আসে ইতিমধ্যে দেওয়ান লুৎফর রহমান সাহেবের পার্টি ম্যান্ডেটে, হরতালের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে বিমর্ষভাবে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকেন। ছাত্র প্রতিনিধিরা অনড়। উক্ত বৈঠকে ভিন্ন আলোচনায় মওলানা তর্কবাগীশ বলেন, হয় আরবী নইলে বাংলা আর হামিদ সাহেব আরবী হরফে বাংলা প্রচলনের জন্য তাঁর লিখিত বক্তব্য দেখান। আলমাহমুদ ও রশিদ মাহমুদ সাহেব প্রত্যাহারের জন্য অনুরোধ করেন। আটটা পর্যন্ত আলোচনায় কোন সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থ হওয়ায় সরকারী প্রশাসন নির্দেশিত ১৪৪ ধারা জারী করার সম্ভাব্যতা প্রকাশ করেন। 
১৮.১০
বাংলো থেকে বেড়িয়ে এলাম সঙ্গে এলেন আবদুর রশিদ মাহমুদ। রাত দুটো পর্যন্ত সঙ্গে থাকলেন । অনুরোধ রাখতে থাকেন প্রত্যাহারের । পাবনার ইজ্জত নাকি নষ্ট হয়ে যাবে- মুখ দেখাতে পারবেন না ঢাকায় ইত্যাদি। হরতালের স্বপক্ষে প্রচার চলছে খন্ড খন্ড মিছিল চলছে এমনি অবস্থায় রাত এগারটায় সরকারী নির্দেশে প্রচার হতে থাকে রাত বারটা থেকে ১৪৪ধারা জারী, সভা শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ ঘোষণায় প্রচারের সঙ্গে সঙ্গেই আগামী কাল হরতাল। ১০ টায় কলেজ থেকে শোভা যাত্রা প্রচারে শহর ও শহরতলীতে নতুন প্রাণ স্পন্দন দেখা দেয়। সে সময়ে এই ঘটনা আশাতীত ও অভুতপূর্ব।

১৮.১১
২৯ শে ফেব্রুয়ারী সকালে লুঙ্গি পরিহিত হামিদ সাহেব আরবী হরফে বাংলা প্রচলনের লিফলেটসহ রিকশায় বেড়িয়ে পড়েছেন হরতালের বিরোধীতায়, তাঁর সমর্থনে মুসলিম লীগ ব্যবসায়ী হাজী আবদুস সোবহান সহ ৩টি দোকান খুলে হরতালের বিরোধীতা করেছিলেন। কল কারখানা দোকান পাট বন্ধ। শহর থমথমে । ছাত্র ও শিক্ষিত যুবকদের সাথে সচেতন শ্রমিকরা ও এগিয়ে আসে প্রচার অভিযানের জোয়ারে। সিদ্ধান্ত ছিল গ্রেপ্তারের পরেও আবার মিছিল-আবার গ্রেপ্তার আবার মিছিল। তবে সুশৃংখল ভাবে।

১৮.১২
১০ টায় এডওয়ার্ড কলেজ থেকে চার জন চার জন করে চার হাত ব্যবধানে মিছিল এগিয়ে চলল- কাচারী এলাকায়। মিছিল এগুচ্ছে- মিছিলের পরিধিও বাড়ছে- সরকারী বিদ্যালয়ের ছাত্ররাও যোগ দিল- মিছিল জেলখানা ও পোষ্ট অফিসের মোড়ে বাধা পায়। সু-শৃঙ্খল মিছিল এগিয়ে যাবার চেষ্টায় অগ্রসর হলে প্রথমে ৪০ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ ব্যারাকের সামনে রাখা হয় এর মধ্যে থেকে যুগ্ম আহ্বায়ক আমিনুল ইসলাম পালিয়ে গিয়ে আর এক মিছিল নিয়ে আসে- তারপর সারাদিন ধরে চলে মিছিল আর গ্রেপ্তার ৬৪ জনকে থানায় রেখে আর সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হয়। বিকাল সাড়ে তিনটা থেকে মুকুল ফৌজের তরফ থেকে মুক্তির দাবীতে মিছিল এস, ডি, ও, অফিস ঘিরে ফেলে- সে আর এক দৃশ্য । মিছিল এলো বিড়ি শ্রমিকদের। মিছিল এলো অভিভাবকদের। এস,ডি ও, কোর্টে হাজির করা হলো ৬৪ জনকে। যুগ্ম আহ্বায়ক দু’জনসহ ৮ জন বাদে সকলকে জামিন দিতে চাওয়ায় বিক্ষুব্ধ ছাত্র-শ্রমিক জনতা কোর্ট থেকে বের করে নিয়ে যায় বন্দীদের। পুলিশকে বাধাদানের হুকুম দেওয়া সত্বেও ঐ মুহূর্তে নিস্ক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। রাত্রে ও সকালে আমিনুল ইসলাম , মাহবুবর বহমান খান, লুৎফর রহমান ও প্রণতি কুমার রায় বাদে আর কাউকেই গ্রেপ্তার করে জেলে নিতে পারেনি। তবুও আন্দোলন থামেনি। ৩রা মার্চ ছাত্র হরতাল শোভাযাত্রা হয়েছে। ১০ই মার্চ সন্ধ্যায় সাধারণ হরতাল ও বন্দী মুক্তির সমর্থনে কর্মরত অবস্থায় (মরহুম) আমজাদ হোসেন, রওশনজান চৌধুরী, মোসলেম উদ্দিন মোক্তার ও প্রদীপ রায়কে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়। ১১ তারিখে ছাত্র হরতাল ও শোভাযাত্রা হয়। 

১৮.১৩
বিকাশের পথ রুদ্ধ হবার আশংকায় আরও যারা ২৯ ফেব্রুয়ারির কর্মসূচীকে সফল করার জন্য সেই মূহূর্তে সরকারি রক্তচক্ষু ও দমননীতি উপেক্ষা করে উল্লেখযোগ্য উদ্যোগী ভুমিকা গ্রহণ করেছিলেন তাদের মধ্যে সৈয়দ ওয়ারেছ আলী, আনছার আলী, হেদায়েতুল ইসলাম, আবুল ফজল, শামছুল ইসলাম, সেলিনা বানু, আতা কোরেশী, মতিয়র রহমান, আবু তাহের, সুনীল চৌধুরী, শ্রীপতি চাকী ও গণতান্ত্রিক যুবলীগের মাহবুব আহমেদ খান (ঈশ্বরদী) প্রমুখ। 

১৮.১৪
আট জন বন্দিই ১৮ মার্চ পর্যন্ত জেলে ছিলেন। ছাত্র প্রতিনিধিদের সঙ্গে ৮ দফা চুক্তির ১ম ও ৭ম দফায় যথাক্রমে ২৯শে ফেব্রুয়ারীর বন্দীদের ও ২৯শে ফেব্রুয়ারী হতে যেখানে ১৪৪ ধাঁরার উল্লেখ আছে- সেই বন্দীরাই হলেন পাবনার ২৯শে ফেব্রুয়ারীতে গ্রেপ্তারকৃত ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী ও প্রথম সাধারণ রাজনৈতিক হরতাল সংগঠনের সংগঠ করা।’

১৯.
আর উপরোক্ত রচনাটির প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বিবৃতির সম্পাদক শফিকুল ইসলাম শিবলী ‘আমিনুল ইসলাম বাদশা : খন্ডিত পোট্রেট’ স্মৃতিচারণায় যা লিখেছেন সেই অংশটুকু প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় এখানে তুলে ধরছি। তিনি লিখছেন, ‘১৯৮২-র দিকে পাবনা থেকে সাপ্তাহিক বিবৃতির সম্পাদক হিসাবে প্রকাশনা জগতে প্রবেশ করেছি। বিবৃতির উদ্বোধনী সংখ্যায় পাবনা-কেন্দ্রিক একটি নিবন্ধ প্রকাশ করতেই হবে- এমন ভাবনা থেকে বাদশা ভাইকে 'ভাষা আন্দোলনে পাবনা' বিষয়ের একটি লেখা চাইলাম। তখনো বুঝি তার নস্যির নেশাটা ছিল। অনেক তেল-খড় পুড়িয়ে তার কাছ থেকে লেখা পেলাম। সমসাময়িক রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রাম নির্ভর বাদশা ভাইয়ের সেই লেখাই বোধ হয় তার সংগ্রামী জীবনের ঘনিষ্ঠ প্রথম লেখা। যথারীতি পাঠক মহলে সে লেখা সাড়া জাগিয়েছিল বিস্তর। উদ্বুদ্ধ করেছিল বাদশা ভাইকেও। লেখা লেখির অভিযাত্রা ব্যক্তিগত ডায়েরি ছেড়ে পান্ডুলিপির খসরায় নিয়োজিত হয়েছিলেন তিনি। তবুও আক্ষেপ আমার মত আর কেউ যদি তার পেছনে লেগে থাকতেন- আরো লেখা, পাবনার আন্দোলন-সংগ্রাম নিয়ে, আমরা পেতে পারতাম। পাওয়া যে যায়নি, এমন নয়। তবে সংখ্যাটি নিতান্তই কম। এ আক্ষেপ আমাদের থেকেই গেলো। থেকেই যাবে।’(উল্লেখ্য যে, আমিনুল ইসলাম বাদশার লেখায় তাঁর নিজস্ব বানানরীতি অক্ষুন্ন রেখেছি।)

(তথ্যসূত্র: বিভিন্ন জাতীয় পত্র-পত্রিকা, আমিনুল ইসলাম বাদশা স্মারকগ্রন্থ: জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত