জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

কমরেড প্রসাদ রায়

প্রকাশ : ০৫ আগস্ট ২০১৮, ১২:০৯

১.
খাপড়া ওয়ার্ডের লড়াকু যোদ্ধা, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, শ্রমিক-মেহনতি মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু, আজীবন বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির আলোকিত এক নেতার প্রতিকৃতি কমরেড প্রসাদ রায়। নিজের ভুমিকার কারণেই তিনি জীবিতকালেই হয়ে উঠেছিলেন ‘সাহসের আরেক নাম’ কিংবা ‘দ্রোহের প্রতিশব্দ’। কমরেড প্রসাদ রায়ের জন্ম ১৯২৮ সালের ৫ আগস্ট পাবনা জেলার সুজানগর থানার তাঁতিবন্দের রায় পরিবারের প্রতাপ ভবনে। দেশপ্রেমিক এই বিপ্লবীর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, কমিউনিস্ট পার্টির এই মহান নেতা ১৯৯৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি শোষণমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন অসমাপ্ত রেখেই সবাইকে ছেড়ে অজানালোকে চলে যান। মানবিক সমতায় আস্থা রেখে, সাম্যবাদী দর্শনকে ভালোবেসে ১৯৪৮ সালের নিকষ কালো অন্ধকার যুগে জীবন বাজি রেখে কালের বরফ ভাঙার দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন ঘর থেকে। আমৃত্যু দমন-পীড়ন আর আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজেকে অবিচল রেখেছিলেন কমিউনিস্ট আদর্শে। আবার দীর্ঘ জেলজীবনের ফাঁকে ফাঁকে যুক্ত থেকেছেন পার্টি গড়ার কাজে, শ্রমিক আন্দোলনে। তাঁর জীবনের সর্বমোট ১৯ বছর ৬ মাস কেটেছে জেলে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীর অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি। সব রাজনৈতিক সংকটে পাবনার তাঁদের বাড়িই ছিল সভাস্থল। খাপড়া ওয়ার্ডের মৃত্যুকূপ থেকে বেঁচে যাওয়া, 'বোনাস' পাওয়া জীবন নিয়ে তাঁর সাহসের অন্ত ছিল না। ফলে তাঁর আচরণে ছিল একটা তোয়াক্কা না করা ভাব। কারণ কমরেড প্রসাদ রায় জানতেন জীবন মানেই যুদ্ধ, প্রতিনিয়ত সংগ্রামের অপর নাম। আদর্শের সঙ্গে জীবনাচরণকে মেলানোর আশ্চর্য শক্তি ছিল তার। যাপন করেছেন অতি সাধারণ জীবন। ধারণ করেছেন বহুমাত্রিক গুণাবলি। সে যেন এক জটিল সংগ্রামের নাম। যে আদর্শিক লড়াই সবাই করতে পারেন না; তিনি পেরেছিলেন বলেই শামিল হয়েছিলেন মেহনতি মানুষের যুদ্ধে।

২.
কমরেড প্রসাদ রায়ের আদর্শের সঙ্গে মেলানো জীবনাচরণের সূত্র জানতে খুঁজতে হয় ইতিহাসের আলোয়। এক সময় পাবনা শহরে তাঁদের পরিবারটির পরিচিতি ছিল অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ ও সাংস্কৃতিক আবহের কারণে। পরবর্তী সময়ে অবশ্য প্রতাপ ভবনকে সর্বস্তরের মানুষ চিনত সে সময়ের মডারেট ও লিবারেল আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল হিসেবে। প্রসাদ রায়সহ তাঁরা পাঁচ ভাই যুক্ত ছিলেন সক্রিয় কমিউনিস্ট রাজনীতির সঙ্গে। তাঁর ভাই প্রণতি রায়ের সংগ্রামী ভূমিকার কথা স্মরণ করতে হয়। তবে এই পরিবারে অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ ও সাম্যবাদী চিন্তার পথিকৃৎ ছিলেন তাঁদের জননী শবাসনা দেবী। পিতা কমরেড প্রসাদ রায়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কন্যা বৃত্বা রায় দীপা সুন্দর করে জলছবি এঁকেছেন, বলছেন, ‘প্রাণ থেকে প্রাণে স্বপ্ন ছড়িয়ে দিতে জানতেন তিনি, জানতেন প্রাণে প্রাণ মেলাতে। দোতারা বাজাতে পারতেন নিপুণ হাতে। শাস্ত্রীয় সংগীতে ছিল অনায়াস দখল। দিনব্যাপী পার্টির জটিল তাত্ত্বিক সভার পর মধ্যরাতে তাঁর ঘর থেকে ভেসে আসত ভরাট কণ্ঠে মিঁয়াকি মল্লার বা মালকোষের তান। ডুবে আছেন সুরে, একাকী। বিস্ময় জাগত। আদর্শের সঙ্গে জীবনাচরণকে মেলানোর আশ্চর্য শক্তি ছিল তাঁর। যা বলছেন তা বিশ্বাস করেছেন এবং জীবনে তার চর্চা করেছেন। বাড়িতে যখন দিনব্যাপী মিটিং চলত, তখন দেখেছি, শুনতেন খুব মনোযোগ দিয়ে, যেন প্রথমবার শুনছেন। বোঝাতেন আরও মনোযোগ দিয়ে, আরও সরল করে। বহুমত ধারণ করতে পারতেন। প্রভাবিত করতে পারতেন আরও বেশি। শ্রমিক থেকে শুরু করে বিদগ্ধ বুদ্ধিজীবী, প্রসাদ রায় সবার বোধগম্য করে বলতে পারতেন। পাহাড়ের গায়ে জন্ম নেওয়া গুল্ম যেমন বুঝতে পারে না পাহাড়ের বিশালতা, তেমনই এই বিশাল মানুষটির খুব কাছে থেকেও তাঁকে জানা হয়নি ভালো করে। সেই না জানার বেদনা আজ বড় বেশি আচ্ছন্ন করে।’ 

৩.
উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার খ্যাত আমাদের নগরবাড়ীঘাটসহ, বেড়া, সুজানগর তথা পাবনা জেলা সবসময়ই ছিলো নানা কারণে আলোচিত এবং এ অঞ্চলের একটি ঐতিহ্যবাহী জেলা হিসেবে পাবনা তার গৌরব বজায় রাখার চেষ্টা অব্যাহত রাখতে পারছে বলেই মনে করি। আর তখনই ইতিহাস মুখ তুলে তাকায় কারণ অতীতকে ভুলে থেকে তো আর ইতিহাসের সম্মানের অংশীদারিত্ব আশা করা যায় না। বৃটিশ ভারতে ১৮৭২-৭৩ সালের পাবনার কৃষক-প্রজাদের ‘পলো বিদ্রোহ’ যেমন খুবই আলোচিত ঘটনা, তেমনই পাবনার হেমায়েতপুর এলাকার শক্তি মন্দিরের গোপন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও যে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে, সেটা ভুলে গেলেও চলবে না। অগ্নিযুগের সশস্ত্র ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন-সংগ্রামে পাবনার অবদান রয়েছে। রাজশাহী বিভাগের মধ্যে পাবনাই ছিল বিপ্লববাদীদের প্রধান প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও ঘাটিস্থল। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে তেভাগাসহ সকল লড়াই-সংগ্রামে এই অঞ্চলের বিপ্লবীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যার নেতৃত্বে ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী কমিউনিষ্টরা। তাঁদের মধ্যে কমরেড প্রসাদ রায় অন্যতম। আবার, মুক্তিযুদ্ধসহ মহান ভাষা আন্দোলনের একেবারে সূচনালগ্নে, প্রাথমিক পর্যায়েও পাবনার ইতিহাস আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। কারণ পাবনাতেই ১৯৪৮ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার স্বপক্ষে আন্দোলন করতে গিয়ে প্রথম কারাবরণ করেন সেই সময়ে অস্টম শ্রেণির ছাত্র কমরেড আমিনুল ইসলাম বাদশা।

৪.
পাবনা জেলা রাজশাহী বিভাগের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত। এর উত্তর দিক ঘিরে আছে সিরাজগঞ্জ জেলা আর দক্ষিণে পদ্মা নদী পাবনাকে ফরিদপুর ও কুষ্টিয়া জেলা হতে পৃথক করেছে। পাবনার পূর্ব প্রান্তদিয়ে যমুনা নদী বয়ে গেছে। পশ্চিমে নাটোর জেলা। পাবনার কাজীরহাট নামক স্থানে পদ্মা ও যমুনা নদী পরস্পর মিলিত হয়েছে। পাবনা জেলার সুজানগর থানায় ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন-সংগ্রামের বহু নেতা-কর্মী ও সংগঠকের জন্ম। আবার এই এলাকাতেই জন্মগ্রহণ করেছেন ‘হারামণি’খ্যাত অধ্যাপক মুহাম্মদ মনসুরউদ্দীন, বাংলাদেশে জ্যোর্তিবিদ্যার জনক,বুয়েটের প্রতিষ্ঠাকালীন কন্ট্রোলারের দায়িত্বপালনকারী অধ্যাপক ড. আব্দুল জব্বারসহ প্রমুখ উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। এ মাটিরই আরেক কৃতি সন্তান কমরেড প্রসাদ রায়। কমরেড প্রসাদ রায়, খাপড়াওয়ার্ডে ৯টি গুলিবিদ্ধ হয়েও যিনি বেঁচেছিলেন, খাপড়াওয়ার্ডখ্যাত আরেক কমরেড আমিনুল ইসলাম বাদশার নাম এখন অনেকেই জানি।

৫.
বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সারা ভারতবর্ষ যখন আন্দোলন-সংগ্রামে উত্তাল, পাশাপাশি অসহযোগ ও স্বদেশী আন্দোলনের আঘাতে বৃটিশ সাম্রাজ্যের তখতে তাউস যখন কেঁপে উঠেছে তেমনই এক যুগ সন্ধিক্ষণে প্রসাদ রায়ের জন্ম। অমূল্য লাহিড়ী, প্রসাদ রায়, সেলিনা বানু, বাবর আলী, আমিনুল ইসলাম বাদশা, জসিম উদ্দিন মন্ডল, রনেশ মৈত্র, ভাষা সংগ্রামী আব্দুল মতিন, মুজিবর রহমান ভবঘুরে, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কামাল লোহানীসহ এক ঝাঁক বিপ্লবী, পাবনায় জন্মগ্রহণ করে পাবনা জেলাকে পূত পবিত্র করেছেন। পাবনা জেলাকে গৌরবান্বিত করেছেন, করেছেন মহিমান্বিত। 

৬.
কমরেড প্রসাদ রায় (জন্ম: ৫ আগস্ট ১৯২৮- প্রয়াণ: ৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৬) পাবনা জেলার সুজানগর থানার তাঁতিবন্দের যে রায় পরিবারের জন্মগ্রহণ করেন, সেই পরিবারের প্রতাপ ভবন ছিল এই অঞ্চলের মডারেট ও লিবারেল আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল। রাজনৈতিক কারণে নির্যাতিত, অবহেলিত ও বিতাড়িতদের শেষ ভরসা ও আশ্রয়স্থল ছিল এই বাড়ির ছোটতরফ ও শবাসনা দেবী, যিনি ছিলেন ছিলেন সকল প্রকার ছুৎমার্গের ঊর্ধ্বে। ঐতিহ্যবাহী এ ভবনের সুনাম আজো মানুষের মুখে মুখে। প্রসাদ রায়ের বাবা প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, মা শবাসনা দেবী। তাদের ঘরে ৭ টি সন্তানের জন্ম হয়। পাঁচ ভাই, প্রবীর রায় (সঙ্গীত প্রেমিক), প্রদীপ রায় (কমিউনিষ্ট নেতা), প্রণব রায় (প্রখ্যাত সেতার বাদক ও সঙ্গীত শিক্ষক), প্রণতি রায় (রাজনৈতিক কর্মী ও ছাত্রনেতা) ও তিন বোন। প্রসাদ রায় সর্বকনিষ্ঠ। পাঁচ ভাই রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। চার ভাই কারা নির্যাতন ভোগ করেছেন।

৭.
একটি অসাম্প্রদায়িক, সঙ্গীত পিয়াসী ও বাম রাজনীতি প্রভাবিত পরিবারের আবহাওয়ায় প্রসাদ রায় বেড়ে উঠতে থাকেন। সঙ্গীতে তাঁর দরাজ কণ্ঠ সবাইকে বিমোহিত করতো। তিনি যখন আন্তর্জাতিক গাইতেন সকলে বিমুদ্ধচিত্তে তা শুনতো। প্রসাদ রায় দরাজ কণ্ঠে গাইতেন- "ইসবার লড়াই লানেওয়ালে বাঁচকে না জানে পায়েগা।/যো চাল চলেগী হিটলারকী ওহ হিটলারকী তরহ মিট জায়েগা।" প্রসাদ রায়ের গাওয়া ভরাট গলার এসব গান সবাইকে অনুপ্রাণিত করতো। সঙ্গীত পিপাসু প্রসাদ রায় রাজনৈতিক পরিবারের প্রভাবেই ধীরে ধীরে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের আদর্শের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন। শ্রমিক আন্দোলনে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। 

৮.
তাঁর লেখাপড়ার হাতেখড়ি পরিবারেই। তারপর পাঠশালা ও প্রাইমারী স্কুলে। তিনি ১৯৪২ সালে ভর্তি হন আর এম একাডেমীতে। স্কুল জীবনে ১৯৪৫ সালে তিনি সর্বভারতীয় ছাত্র ফেডারেশনের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। স্কুলে শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তোলেন। ১৯৪৭ সালে স্কুলে পড়াশুনাকালীন সময়ে সুজানগর থানায়ও সংগঠন গড়ে তোলার দায়িত্ব নেন। পাঠ্যবই পড়াশুনার পাশাপাশি তিনি প্রচুর অন্যান্য বই পড়তেন। সেই অল্প বয়সেই পড়ে ছিলেন মার্ক্সবাদী বই। সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গণে তাঁর পদচারণা ছিল সমান। খেলাধুলায়ও পারদর্শী ছিলেন। এছাড়া তিনি গান, কবিতা আবৃত্তি ও অভিনয়েও ছিলেন পটু। মাঝে মাঝে কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ লিখতেন। সহপাঠীদের নিয়ে নানারকম গল্প, উপন্যাস ও কবিতা আবৃত্তির আড্ডা জমাতেন। স্কুলের সকল ছাত্র তাঁকে পছন্দ করতো। নানাগুণের কারণে শিক্ষকরা তাকে খুব পছন্দ করতেন।

৯.
১৯৪৮ সালে তিনি আর এম একাডেমি থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ওই বছর তিনি এডওয়ার্ড কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন। কলেজে ছাত্র ফেডারেশন গড়ে তোলার কাজে যুক্ত হন। অক্লান্ত শ্রম আর মনন দিয়ে গড়ে তোলেন শক্তিশালী সাংগঠনিক ভিত্তি। তিনি এডওয়ার্ড কলেজে লেখাপড়ার সময়ই ১৯৪৯ সালের আগস্ট মাসে ছাত্র ফেডারেশনের পক্ষ থেকে পাবনা হোসিয়ারী শ্রমিকদের সাথে ‘বন্দী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মুক্তির’ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। এই বন্দীমুক্তি আন্দোলন চলাকালে বন্দীদের মুক্তির দাবি সম্বলিত পোস্টার লাগানোর সময় পাকিস্তান পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে।

১০.
আমরা জানি, ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল রাজশাহী খাপড়া ওয়ার্ডে রাজবন্দীরা বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে যখন আন্দোলনরত তখন জেল সুপার মিঃ বিল হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পড়েছিল রাজবন্দীদের উপর। ঘরের দরজা বন্ধ করে জানালা দিয়ে রাইফেল তাক করে নির্বিচারে রাজবন্দিদের উপর গুলি চালিয়েছিল তারা। ইতিহাসের জঘন্য ও নৃশংস এ গুলি বর্ষণে নিহত হন সাতজন বিপ্লবী। শহীদ বিপ্লবীরা হলেন- কম্পরাম সিং, বিজন সেন, সুখেন্দ ভট্টাচার্য, দেলোয়ার, আনোয়ার, সুধীন ও হানিফ। সেই নারকীয় হত্যাকাণ্ডে প্রাণ বিসর্জন দেওয়া সপ্তরথীর সবাই ছিলেন সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামের অকুতোভয় যোদ্ধা। এদের সবার পক্ষ থেকেই যেন দিনাজপুরের তেভাগা আন্দোলনের বীর সৈনিক কম্পরাম সিং মৃত্যুর আগে বলে যান- ‘যারা বেঁচে থাকবে তাদেরকে বলো লাল ঝাণ্ডার সম্মান রেখেই আমরা মারা গেলাম’। সেই গুলি বর্ষণে মারাত্মক আহত হয়ে যারা বেঁচে গিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে কমরেড প্রসাদ রায় একজন। অন্যান্যরা হলেন আমিনুল ইসলাম বাদশা, বাবর আলী, আব্দুল হক, আব্দুস শহীদ, নূরুন্নবী, মনসুর হাবিবসহ আরো অনেকে। এই কারাবিদ্রোহের সময় কমরেড প্রসাদ রায় গুলিবিদ্ধ হন। তাঁর শরীরে ৯ টি গুলি বিদ্ধ হয়। এরপর তিনি বেঁচে গেলেন। আস্বাভাবিক বিস্ময়কর বিষয়। সেই ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী হিসেবে কমরেড প্রসাদ রায় নয়টি বুলেট শরীরে নিয়ে সারা জীবন বয়ে বেড়িয়েছেন। বুলেটগুলো তাঁর শরীরের মাংসপিণ্ড, অস্থিমজ্জায় এমনভাবে সম্পৃক্ত হয়ে গিয়েছিল যে, সেগুলোকে শরীর থেকে আলাদা করা যায়নি। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এই গুলি বহন করে বেঁচেছিলেন। ওই বছর তিনি কমিউনিষ্ট পার্টির রাজশাহী সেন্ট্রাল জেল কনসোলিডেশন কর্তৃক পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন। এ সময় তিনি আন্ডারগ্রাউন্ডে কাজ করার অনুমতি পান। সেই বুলেট শরীরে নিয়ে ১৯৫৩ সালে জেল থেকে মুক্ত হন প্রসাদ রায়। ১৯৪৯-৫৩ সাল পর্যন্ত তিনি জেলে ছিলেন। জেল থেকে মুক্তি লাভের পর তিনি পার্টির একজন সক্রিয় রাজনৈতিক সংগঠক হিসেবে কাজে যুক্ত হন।

১১.
১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাহী কাজে এবং নির্বাচনে পার্টি মনোনিত প্রার্থীর পক্ষে শত শত ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে নিয়ে কাজ করেন। এ নির্বাচনে তিনি অক্লান্ত শ্রম দেন। এই কারণে ওই বছর ২বার তাকে পাকিস্তান পুলিশ গ্রেফতার করে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলীম লীগের ভরাডুবি হয়। ১৯৫৫ সালে তিনি মুক্তি পান। মুক্তির কিছুদিন পর ওই বছর ২৫ নভেম্বর স্ট্রাইকের (ধর্মঘট) মামলায় পুলিশ আবার তাঁকে গ্রেফতার করে। ১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মুক্তি পান। এ সময় তিনি নিজ জন্মভূমি পাবনায় হোসিয়ারী শ্রমিক ইউনিয়নে যুক্ত হন। গড়ে তোনেন তুমুল শ্রমিক আন্দোলন। পুলিশ রাস্ট্রবিদ্রোহীর অভিযোগ দেখিয়ে প্রসাদ রায়কে গ্রেফতার করে। কারা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ১৯৫৭ সালে তিনি প্রকাশ্যে ন্যাপের (ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি) সাথে যুক্ত হয়ে শোষণ-বৈষম্যহীন সমাজ প্রগতির আন্দোলনকে বেগবান করেন। এ সময় তিনি গোপনে কমিউনিস্ট পার্টির কাজ করেন। দুই দিকের কাজে তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। অনেকে প্রশ্নও করতো প্রসাদ দা আপনি রেস্ট নেন কখন? তিনি হেসে উত্তর দিতেন কমিউনিস্টদের কি খুব বেশি বিশ্রামের প্রয়োজন আছে!

১২.
১৯৫৮ সালে স্বৈরাচার আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারী করে। এ সময় আইয়ুব খানের নির্দেশে পুলিশ পূর্বপাকিস্তানের কমিউনিস্ট নেতা-কর্মীকে ঢালাউভাবে গ্রেপ্তার করে। এই গ্রেপ্তারের মধ্যে কমরেড প্রসাদ রায় বাদ পড়েননি। ১৯৬২ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পান। কারগারে তিনি কারাবন্দীদেরকে মার্ক্সবাদ সম্পর্কে ধারণা দিয়ে এক নতুন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন। তারা জেল থেকে মুক্তি লাভের পর অনেকেই কমিউনিস্ট পার্টির কাজের সাথে যুক্ত হন। ১৯৬৫ সাল। পাক-ভারত যুদ্ধ চলছে। কমিউনিস্টরা এই যুদ্ধের ক্ষয়-ক্ষতি সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করতে থাকে। এ সময় পাকিস্তান পুলিশ কমরেড প্রসাদ রায়কে আবার গ্রেপ্তার করে। ১৯৬৮ সালে মুক্তি পান। কারাগার থেকে মুক্তি পেতে দেরি হলে পার্টির কাজে যুক্ত হতে তাঁর আর দেরী হয় না। একবার কমরেড জ্ঞান চক্রবর্তী বলেছিলেন_জেল থেকে মুক্তি পেলেন, এখন কয়েকটা দিন বিশ্রাম নিন, পড়ে পার্টির কাজ করা যাবে। তিনি প্রত্যুত্তরে বলেন, কারাগারেই তো সময়টা চলে যায়, তারপর বের হয়ে বিশ্রাম নিলে পার্টির জন্য কাজ করবো কখন? অবিরাম গতিতে চলতে থাকে পার্টির কাজ এবং চলতে থাকেন কমরেড প্রসাদ রায়।

১৩.
১৯৬৯ সাল। গণঅভ্যুত্থানের বছর। এই সময় তিনি আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে জনগণকে সংঘবদ্ধ করেন। গণঅভ্যুত্থানের কিছুদিন পূর্বে প্রসাদ রায়কে পাকিস্তান পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এ বার তিনি অল্পদিনের ব্যবধানে মুক্তি পান। মুক্তি পেয়ে যুক্ত হন সেই উত্তাল দিনের অগ্নিঝরা রাজনীতিতে। কখনো পাবনায় কখনো ঢাকায়। এভাবে চলতে থাকে ৭১’র ২৫ মার্চ পর্যন্ত।
১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি উজ্জ্বল নাম কমরেড প্রসাদ রায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রথম সারির সংগঠক। তরুণ ছাত্র-ছাত্রী, শ্রমিক ও কৃষকদের রিক্রুট, ট্রেনিং, অস্ত্রশস্ত্র ও রসদের ব্যবস্থা করা প্রভৃতি এবং কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনার যোদ্ধাদের মধ্যে অন্যতম পরিচালক ও সংগঠক ছিলেন তিনি। তিনি নদিয়া জেলার করিমপুরে দায়িত্ব পালন করেন।

১৪.
কমরেড প্রসাদ রায় এতো নির্যাতন-নিপীড়ন সব সহ্য করেছেন এদেশের মেহনতী মানুষের মুক্তির সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে এদেশে শ্রেণিহীন, শোষণহীন একটি সমাজ নির্মাণের লক্ষ্যে। অনেকের মতো তিনি দেশত্যাগ করে ভারতে পাড়ি জমিয়ে আয়াসে জীবন কাটাতে পারতেন। কিন্তু প্রসাদ রায় দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা, রাজনৈতিক আদর্শ ও লক্ষ্যের প্রতি প্রবল নিষ্ঠা, একাগ্রতা, সর্বোপরি বাম রাজনীতির প্রতি তাঁর যে দায়বদ্ধতা তার প্রতি দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ছিলেন বলেই এতো নির্যাতন-নিপীড়নের মাঝেও তিনি ছিলেন অকুতোভয়। প্রসাদ রায় দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন- লড়াই-সংগ্রাম ছাড়া এদেশের মেহনতী মানুষের মুক্তি নেই- আর যেহেতু মেহনতী মানুষের মুক্তির লড়াইকে এগিয়ে নিতেই হবে- সেহেতু জেল-জুলাম-নিপীড়ন-নির্যাতনের বিকল্প নেই। এটা সচেতনভাবে জেনে বুঝেই তিনি তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন বলেই তিনি এতো নির্যাতন সইতে পেরেছিলেন।

১৫. 
বিশাল সম্পদের অধিকারী হয়েও কমরেড প্রসাদ রায় অত্যন্ত সাদাসিধে জীবন যাপনে অভ্যস্থ ছিলেন। কমরেড প্রসাদ রায় দীর্ঘ কারাভোগের পর যতটুকু সময় মুক্ত থেকেছেন সে সময়টুকুই ব্যয় করেছেন-শ্রমিক আন্দোলনে, বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাঝে। প্রসাদ রায় পাবনা অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরির কার্যকরী পরিষদের সদস্য ছিলেন। রাজনীতির পাশাপাশি তিনি সাংবাদিকতাও করতেন। দৈনিক পূর্বদেশ, দৈনিক সংগ্রাম, ডেইলী মর্নিং পোস্ট, দৈনিক লাল সবুজ প্রভৃতি পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি পাবনা প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। কমরেড প্রসাদ রায় যেমন দরাজ গলার অধিকারী ছিলেন, তেমনি দরাজ দিলেরও মানুষ ছিলেন। তাঁর রাশগম্ভীর মুখে ভারী গোঁফের মাঝে লুকিয়ে থাকতো শিশুসুলভ উচ্ছ্বল হাসি। কোন একটি কর্মসূচিকে সফলভাবে সমাপ্ত করতে পারলে কর্মীদের প্রতি উচ্ছ্বল হাসি দিয়ে ভরিয়ে দিতেন তাদের মন। 

১৬.
ভাষা সংগ্রামী, মুক্তিযোদ্ধা কমরেড আমিনুল ইসলাম বাদশা ‘প্রয়াত বন্ধু প্রসাদ রায় স্মরণে’ স্মৃতিচারণমূলক রচনায় লিখেছেন, ‘আজীবন আদর্শের প্রতি আস্থা রেখেই রাজনীতিতে আমৃত্যু সক্রিয় থেকেছেন। শ্রেণি শোষিত সাম্প্রদায়িক প্রভাব বলয়ের মধ্যে বসবাস করেও, আজন্ম বিপ্লবী আপসহীন সমাজতন্ত্রী-অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক আধুনিকতায় আস্থাবান মুক্তমনা ছিলেন কমরেড প্রসাদ রায়। অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পতাকা কখনও অর্ধনমিত করেননি।’

১৭.
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি দেশ গড়ার কাজে যুক্ত হন। এ সময় তিনি তার শারীরিক অসুস্থতা দূর করার নিমিত্তে সুচিকিৎসার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নে যান। সেখানকার চিকিৎসকরা তাঁকে বলেন তার শরীরে ৮ টি গুলি রয়েছে। যে গুলিগুলো আর বের করা সম্ভব হয়নি। জীবনের বাকী দিনগুলো এই গুলিগুলো বহন করেই বাঁচতে হয় তাঁকে। ১৯৯৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি তিনি প্রয়াত হন কিন্তু আপন কর্মে আর জীবনাদর্শের আলোয় তিনি আজো আমাদের মাঝে অস্তিত্ব ঘোষণা করেই বেঁচে আছেন। মহান এই মানবিক মানুষটির স্মৃতির প্রতি আবারো বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। মানবতাবাদী তাঁর জীবন ও আদর্শ থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে, জানার আছে। সর্বোপরি উত্তর প্রজন্মের জন্যে তিনি রেখে গেছেন মানব প্রেমের ব্যক্তি স্বার্থহীন এক অনন্য উদাহরণ। যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে মানবিক সমাজের উত্তরাধিকার বহন করে নিয়ে যেতে শক্তি যোগাবে।

(তথ্যসূত্র: বিপ্লবীদের কথা, দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক সমকাল, আমিনুল ইসলাম বাদশা স্মারকগ্রন্থ, মিজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত