প্রয়াণ দিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

হুমায়ুন আজাদ

‘সৎ মানুষ মাত্রই নিঃসঙ্গ, আর সকলের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু’- হুমায়ুন আজাদ

প্রকাশ : ১১ আগস্ট ২০১৮, ১১:১১

১.
কবি, সমালোচক, ভাষাবিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, শিক্ষক, মনস্বী প্রাবন্ধিক সর্বোপরি বহুমাত্রিক জ্যোর্তিময়ী মানুষ, সব্যসাচী লেখক হুমায়ুন আজাদ। বহুমাত্রিক জ্যোর্তিময় লেখক হিসেবেও শিল্পবোদ্ধাগণ, অনেক সমালোচক তাঁকে অভিহিত করে থাকেন। জার্মানির মিউনিখে ২০০৪ সালের ১১ আগস্ট তিনি রহস্যজনকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। বহুমাত্রিক এই বাঙালি প্রতিভার স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, ড. হুমায়ুন আজাদের জন্ম ১৯৪৭ সালের ২৮ এপ্রিল (১৪ বৈশাখ, ১৩৫৪ বঙ্গাব্দ), বিক্রমপুরের রাড়িখালে। সমকালের এই অন্ধ পাথর সময়ে তাঁর মতোন স্পষ্টভাষী প্রজ্ঞাবানের খুব বেশি অভাব অনুভব করছি। ধর্ম, প্রথা, প্রতিষ্ঠান ও সংস্কারবিরোধিতা, নারীবাদিতা, রাজনৈতিক বক্তব্য, প্রখর মানবিক যুক্তিবাদিতা এবং নির্মম সমালোচনামূলক বক্তব্যের জন্য তিনি ১৯৮০’র দশক থেকে আমৃত্যু ব্যাপক পাঠকগোষ্ঠীর দৃষ্টি আর্কষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ছিলেন অন্যের চিন্তাকে আলোড়িত করার, উসকে দেওয়ার মতোন ক্ষুরধার একজন শিক্ষকও। বিতর্কিত এবং বহুল সমালোচিত অনেক বক্তব্যই তাঁকে আলোচনার পাদপ্রদীপে রেখেছে বেশিরভাগ সময়। তবে তাঁর মতোন তর্কপ্রিয় জ্ঞানী শিক্ষকের তীব্র অভাব সমকালে ভীষণভাবে অনুভব করি।

২.
‘গাধা একশো বছর বাঁচলেও সিংহ হয় না’- হুমায়ুন আজাদ
হুমায়ুন আজাদ স্যারের সাথে বিভিন্ন সময়ে, নানা উপলক্ষ্যে অনেকবার কথা বলার, বিতর্ক করবার, সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ হয়েছে আমার। বিশেষত বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে স্যার কখনো এলে আমাদের অনেকেরই দীর্ঘ সময় কাটতো তাঁর সাথে নানা জটিল বিষয়ে বিতর্কে, কুতর্কে, কথোপকথনে। সেটা কখনো আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের দেড়তলার কক্ষে, ইস্ফেন্দিয়ার জাহেদ হাসান মিলনায়তনে কিংবা আমতলায় অথবা অন্যত্র দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই চলতো সমকালের ‘সক্রেটিস’এর সাথে সংলাপ। যদিও আমি কথা কম বলতাম কিন্তু আমি আমার চিরায়ত অভ্যাসবশে নোটবুকে আলোচনার মূল কথাগুলো ধরে রাখার চেষ্টা করতাম প্রতিনিয়ত। মনে পড়ে, বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মাসুদুজ্জামান স্যারের সহযোগিতায় দৈনিক জনকণ্ঠের জন্য দীর্ঘ সাক্ষাৎকারও নিয়েছিলাম একবার। ১৯৯৮ সালে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ২০ বছর পূর্তি উৎসবের অনুষ্ঠানে আগত অতিথিদের সাক্ষাৎকার ধারনের ব্যবস্থা করেছিলো ইমপ্রেস টেলিফিল্ম লিমিটেড (তখন চ্যানেল আই-এর জন্ম হবো হবো করছে মাত্র)। আমি তখন সেখানেও চাকুরি করি আবার কেন্দ্রেরও কর্মী। সেই অনুষ্ঠানেও হুমায়ুন আজাদের ভিডিও সাক্ষাৎকার গ্রহণের সুযোগ হয়েছিলো আমার। সেই টেপ এখনো সংরক্ষিত আছে কিনা জানি না। খুঁজে পাওয়া গেলে আমাদের শিক্ষা, শিক্ষক এবং শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে হুমায়ুন আজাদের অনেক মূল্যবান মতামত পাওয়া যাবে বলে মনে করি।

৩.
‘বুদ্ধিজীবীরা এখন বিভক্ত তিন গোত্রে : ভণ্ড, ভণ্ডতর, ভণ্ডতম’- হুমায়ুন আজাদ
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের মাসিক পাঠচক্রে হুমায়ুন আজাদের ‘লালনীল দীপাবলী’ এবং ‘শুভব্রত : তার সম্পর্কিত সুসমাচার’ আমরা পাঠ করেছি। তাঁর জন্মদিনকেও পালন, স্মরণ করেছি আমরা ‘শুভব্রত : তার সম্পর্কিত সুসমাচার’ পাঠ পর্যালোচনা করে। দু’টোই হুমায়ুন আজাদের বেশ গুরুত্বপূর্ণ রচনা বলে আমার ধারনা। এই বইদু’টি নিয়ে আমার আলাদা আলাদা লেখা রয়েছে তাই এখানে এই বই দু’টি নিয়ে কোন কিছু লিখছি না। আরেকটি বইয়ের কথা আমি প্রিয়জনদের বিশেষত গণমাধ্যম বন্ধুদের সবসময়েই পড়তে উৎসাহিত করি, সেটি তাঁর নেওয়া চার মহান বাঙালির ‘সাক্ষাৎকার’। ‘সাক্ষাৎকার’ গ্রন্থটি আমাদের প্রশ্ন করার জন্য যে ব্যাপক প্রস্তুতি ও পাঠ প্রয়োজন তারই চমৎকার দৃষ্টান্ত। হুমায়ুন আজাদের কাছ থেকে আমাদের সংবাদকর্মীগণ অনেক কিছুই শিখতে পাবেন বলে আমি মনে করি।বিশেষ করে যারা শিল্পসাহিত্য নিয়ে সৃজনশীল মানুষের সাক্ষাৎকার নিতে যান, তাদের জন্য বইটি অবশ্যপাঠ বলেই আমার দৃঢ় আস্থা জন্মেছে।

৪.
‘মানুষ সিংহের প্রশংসা করে, কিন্তু আসলে গাধাকেই পছন্দ করে।’- হুমায়ুন আজাদ
হুমায়ুন আজাদ ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে নারীবাদী গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘নারী’ প্রকাশ করে গোটা দেশে তুমুল সাড়া ফেলে দেন। আর এই বইয়ের প্রকাশের পর তিনি মৌলবাদীদের তীব্র রোষানলে পড়েন। মৌলবাদীদের চেষ্টার ফলে ১৯৯৫ সালে ‘নারী’ বইটি নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হয় তৎকালীন সরকার। অবশ্য ৪ বছর পর ২০০০ খ্রিস্টাব্দে বইটি আবার পুনর্মূদ্রিত হয়। এ গ্রন্থ তাঁর বহুল আলোচিত গবেষণামূলক কাজ হিসেবে স্বীকৃত। হুমায়ুন আজাদের ‘নারী’ আমার একটি বিশেষ পছন্দের বই। নানা কারণেই আমার এই দূর্বলতায় ‘নারী’। সরকার ও রাজনীতির একজন ছাত্র হিসেবে ‘নারী ও রাজনীতি’ কোর্স আমাকে পড়তে হয়েছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীদের এখন পড়াতেও হয়। এক্ষেত্রে ‘নারী’ একটি গুরুত্বপূর্ণ রেফারেন্স গ্রন্থ। হুমায়ুন আজাদের মতো আমিও মনে করি যে, এটি বাংলা ভাষায়, প্রথম, পূর্ণাঙ্গ, নারী বিষয়ক, নারীবাদী গ্রন্থ। নারী সম্পর্কে বই আগেই লেখা হয়েছে। কিন্তু সেটা হয়তো ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বা আমাদের প্রথাগত সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা হয়েছে যে, প্রথাগতভাবে আমরা নারীকে যেভাবে দেখে আসছি, সেভাবেই থাকবে। নারী কতোটা পর্দা করবে, নারী কী করে তার সন্তানদের লালনপালন করবে, স্বামীর সেবা করবে- এ ধরনের বই আগেও লেখা হয়েছে। কিন্তু এই প্রথম একটি পূর্ণাঙ্গ বই লেখা হলো, যে, ‘নারী কী’? কারন হিসেবে তিনি বলছেন, ‘নারী কি তথাকথিত জন্মসূত্রে নারী, না এই সমাজব্যবস্থাই তাকে ক্রমশ নারী করে তোলে। এবং এ-বইটি তো আয়তনে খুবই বড়। নারীবাদী তত্ত্বের সঙ্গে কিন্তু আমাদের এখানে যারা নারীর উন্নতি সম্পর্কে কিছু কাজ করছিলেন বা বিভিন্ন সংস্থা স্থাপন করেছিলেন তারা পরিচিত ছিলেন না। যে-কোনো কিছুকে ব্যাখ্যা করতে হলে একটি তাত্ত্বিক কাঠামো দরকার হয়, সে তাত্ত্বিক কাঠামো এখানে কখনোই ছিলো না।...আসলে তত্ত্ব যেটি এর মধ্যে রয়েছে, বলা যাক, বাংলা ভাষায় একজন পুরুষই প্রথম প্রস্তাব করেছে। কিন্তু এই তত্ত্বটি কিন্তু নতুন নয়। নারীবাদের যে তত্ত্বটি আমার এই বইয়ের মধ্যে আমি ব্যবহার করেছি, সেটা মোটামুটি ওলস্টোনক্রাফট, সিমন দ্য বভোয়া এবং কেইট মিলেটের যে তত্ত্ব তার মধ্যে একটা, বলা যাক, সমন্বয় সাধন করে এই সম্পূর্ণ ব্যাপারটা উপস্থাপন করেছি। কেইট মিলেটের তত্ত্বটি আমার বইয়ের মধ্যে কিন্তু একটু প্রবলভাবে রয়েছে। আমি ওর যে তত্ত্বের তীব্রতা এটি খুবই পছন্দ করি। কেইট মিলেটের একটি গ্রন্থ রয়েছে এবং সেটি তার পিএইচডি অভিসন্দর্ভও বটে। এত অ-প্রথাগত অভিসন্দর্ভও আর হয় না। অভিসন্দর্ভে অনেক সম্মান শ্রদ্ধা রেখে লিখতে হয়। তিনি এখানে বড় বড় লেখকদের সহজেই বাতিল করেছেন এবং একটি তত্ত্ব তিনি প্রস্তাব করেছেন যে — যেটাকে বলা হচ্ছে ‘সেকশুয়্যাল পলিটিক্স’: লৈঙ্গিক রাজনীতি। তার কাছে নারী এবং পুরুষের যে-সম্পর্ক, যাকে আমরা কত আধ্যাত্মিক পরিভাষায় চিহ্নিত করে থাকি, তার কাছে এটা আসলেই হচ্ছে একটি লৈঙ্গিক-রাজনীতিক সম্পর্ক। যেমন রাজনীতির কাজ হচ্ছে ক্ষমতা অধিকার করা, বা ক্ষমতা অধিকারে ব্যর্থ হওয়া। যারা ক্ষমতা অধিকার করে তারা যারা ব্যর্থ হয় তাদের উপর শাসন করে থাকে। তাদের কেন, অন্যদের ওপরও শাসন করে থাকে। ক্ষমতা কখনো কখনো সকলের সম্মতির সাহায্যেও অধিকার করা যায়। বা কখনো শক্তিপ্রয়োগে অধিকার করা যায়। আমাদের রাজনীতির ক্ষেত্রে যেমন হয়। ঠিক এখানেও পুরুষ কী করেছে, বলা যাক শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে এই ক্ষমতা অধিকার করেছে এবং সেটি আজ থেকে প্রায় ৬, ৭, ৮, ১০ হাজার বছর আগে থেকে এই অধিকার অর্জন করেছে। তারপর শক্তিমান পুরুষ দুর্বল পরাভূত নারীর ওপর, বলা যাক, শাসন করেছে। শাসক কিন্তু নিজের মনের আনন্দে অত্যাচার করে না। শাসক তখনই অত্যাচার করে যখন দেখে যে তার আধিপত্য বিঘ্নিত হচ্ছে। যখন দেখে যে তাকে আর মান্য করা হচ্ছে না তখনই সে অত্যাচার করে। নইলে অত্যাচার কিন্তু শখে করে না। মানে, শাসকমাত্রই স্যাডিস্ট না। কিন্তু যখন দেখা যায় যে আমার রাজত্বকে, আমার সিংহাসনকে, আমার রাজদণ্ডকে স্বীকার করা হচ্ছে না। …পুরুষ মাত্রই তো রাজা। তার রাজদণ্ড। এবং সভ্যতা তো পুরুষেরই সভ্যতা। এ-সংস্কৃতি পুরুষের সংস্কৃতি। এবং কেইট মিলেট খুবই চমৎকার। কেইট মিলেট দেখাচ্ছে যে নারী-পুরুষের যে স্বাভাবিক মিলন এটিও একটি রাজনীতির অন্তর্ভুক্ত। এবং সিমন দ্য বভোয়া কিন্তু এ-ব্যাপারটি খুব চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। যে, নারী এবং পুরুষের যে মিলন, বলা যাক সঙ্গম, সেখানে পুরুষ প্রভুর ভূমিকা পালন করে। সে উপরে থাকে। বিদ্ধ করে। এবং নারী বিদ্ধ হয়, এমনকি একদিকে পরাজিত হওয়ার গ্লানিও বোধ করে থাকে। পরাজয়ই তার নিয়তি যেহেতু সে সেটি মেনে নেয়। কেইট মিলেট আরো তীব্র, আরো তীক্ষ্ণ, আরো আক্রমণাত্মক। সিমন দ্য বভোয়া হচ্ছে খুবই কাব্যিক, আরো বিশ্লেষণাত্মক এবং বোধে পরিপূর্ণ। …ওই সময়ে তিনি তো- আধুনিক নারীবাদের জননীই তাকে বলবো। কেইট মিলেট একেবারে যে আমাদের একান্ত অন্তরঙ্গ গোপন মানবিক সম্পর্ক একেও তিনি রাজনৈতিক মানদণ্ডে বিচার করছেন। ফলে যে পরিবার হয়েছে, সমাজ হয়েছে, সংস্থা হয়েছে, রাষ্ট্র হয়েছে, সভ্যতা হয়েছে- সবকিছুই হচ্ছে রাজনৈতিক সম্পর্ক।’ পরিবার, সমাজ, সংস্থা, রাষ্ট্র, সভ্যতা সবকিছুই হচ্ছে রাজনৈতিক সম্পর্ক এবং ক্ষমতার ব্যাপার এসব বিষয়ের বাইরেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জবাব নিয়েই ‘নারী’ বইটি প্রয়োজনীয় পাঠ্যবই হিসেবে স্থান দখল করে।

৫.
‘আমাদের অঞ্চলে সৌন্দর্য অশ্লীল, অসৌন্দর্য শ্লীল। রূপসীর একটু নগ্ন বাহু দেখে ওরা হৈচৈ করে, কিন্তু পথে ভিখিরিনির উলঙ্গ দেহ দেখে ওরা একটুও বিচলিত হয় না।’- হুমায়ুন আজাদ
বহুমাত্রিক জ্যোর্তিময় কবি, ঔপন্যাসিক, সমালোচক, ভাষাবিজ্ঞানী, প্রাবন্ধিক, রাজনীতিক বিশ্লেষক ও কিশোর সাহিত্যিক অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ চেয়েছিলেন সমাজের কূপমণ্ডুক মানুষগুলোকে বুদ্ধির বন্দিত্ব থেকে মুক্তির দিকনির্দশনা দিতে। আর এ কারণেই চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তিনি। আক্ষরিক অর্থেই প্রথাবিরোধী ও বহুমাত্রিক মননশীল লেখক ছিলেন অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থগুলোই এর পরিচয় দেয়। হুমায়ুন আজাদের ১০টি কাব্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ২২টি সমালোচনা গ্রন্থ, ৮টি কিশোরসাহিত্য, ৭টি ভাষাবিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ তাঁর জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর অব্যবহিত পরে প্রকাশিত হয়। তিনি ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলা একাডেমী পুরস্কার এবং ২০১২ খ্রিস্টাব্দে সামগ্রিক সাহিত্যকর্ম এবং ভাষাবিজ্ঞানে বিশেষ অবদানের জন্যে মরণোত্তর একুশে পদক লাভ করেন। আরও অনেক পুস্কারও তিনি পেয়েছেন কিন্তু পুরস্কারের নাম ও সংখ্যা দিয়ে হুমায়ুন আজাদকে বিচারক করা যাবে না। তাঁকে পাঠ করেই তাঁর মূল্যায়ন সম্ভব। 

৬.
‘শিক্ষকের জীবনের থেকে চোর, চোরাচালানি, দারোগার জীবন অনেক আকর্ষণীয়। এ-সমাজ শিক্ষক চায় না, চোর-চোরাচালানি-দারোগা চায়।’- হুমায়ুন আজাদ
হুমায়ুন আজাদ রচনা করতে চেয়েছিলেন বাঙালির জীবন ও স্বপ্নের ব্যাকরণ। তিনি সত্যনিষ্ঠ, নির্মোহ, নির্ভীক ও অনুসন্ধিৎসু লেখক। অন্য অনেক বিষয়ের সাথে তিনি বাঙালির স্বভাব চরিত্র নিয়েও লিখেছেন বেশ। তাঁর লেখাতে প্রকাশ পেয়েছে বাঙালিত্বের প্রতি অশেষ শ্লেষ। তবে তা কোন ভিনদেশীর অন্ধ সমালোচনার মতো নয়, বরং যুক্তিনিষ্ঠ ও গঠনমূলক। তিনি মনে করেছেন বঙ্গভূমি, বাঙালির জীবনযাপন ও ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। তাই তিনি চেয়েছিলেন এসকল প্রচলিত ও জনপ্রিয় মিথকে সরিয়ে সত্য-হোক তা যতই রূঢ়, তা তুলে আনতে। বাঙালির প্রতি দরদ ও দায়বদ্ধতা থেকেই তিনি কাজটি করেছেন। বাঙালির চিকিৎসার জন্য তিনি বাঙালির আসল রোগটা ধরতে চেয়েছেন। আর তাই বাঙালিকে তিনি বলেছেন একটি "রুগ্ন জনগোষ্ঠী", কারণও উল্লেখ করেছেন অসংখ্য। তিনি বলেছেন, বাঙালি অনেক শতাব্দী ধরে মানসিক সংকীর্ণতা ও কূপমূন্ডকতায় ভুগছে। এর কারণ ক্ষুদ্র আয়তনের মধ্যে বসবাস এবং একটি বৃহৎ দেশের এক প্রান্তে অবস্থান। এটাকে তিনি বলেছেন প্রান্তিক মানসিকতা। প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর থাকে একটি বিশেষ চরিত্র অথবা প্রশংসনীয় কোন বৈশিষ্ট্য। যেমন কোন জাতি সরল, কোন জাতি পরোপকারী, কেউবা পরিশ্রমী, কোনটা আবার বিনয়ী, কোন জনগোষ্ঠী উচ্চাভিলাষী কিংবা স্বল্পভাষী প্রভৃতি। কিন্তু হুমায়ুন আজাদ বাঙালির মধ্যে এমন কোন গুণ দেখতে পারছেন না যার সংস্পর্শে এসে মনুষ্যত্বের প্রসার ঘটতে পারে। বাঙালির চরিত্রে গুণের চাইতে দোষই বেশি দেখছেন তিনি। তিনি লিখছেন "জাতি হিসাবে বাঙালি বাচাল ও বাকসর্বস্ব; অপ্রয়োজনেও প্রচুর কথা বলে", বাঙালি যুক্তি মানে না এবং মিথ্যা কথাও বলে অনেক। তিনি দক্ষিণ ভারতের এক উপজাতির উদাহরণ দিয়ে বলেন তারা নাকি চলি্লশ বছর বয়স হওয়ার পর কথা বলা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু বাঙালির বয়স বাড়ার সাথে কথা বলার পরিমাণও বাড়ে। এতো বেশি কথা বলার কারণ হিশাবে তিনি দেখছেন বাঙালির অপ্রাপ্তি, হতাশা ও ব্যর্থতাকে। এরা কথা দিয়ে জীবনের না পাওয়ার শূন্যতাকে পূরণ করতে চায়। এদের ভাষা অতিশয়োক্তিতে জীর্ণ। এটা বাঙালির লঘুতা ও পরিমাপবোধহীনতার প্রকাশ। আজাদের কথা অনুযায়ী বাঙালি ভদ্র নয়, কিন্তু সুবিধা আদায়ের জন্য সে চরম বিনয়ী হতে পারে। এরা ক্ষমতার পূজারী, অপচয় ও অপব্যয়প্রবণ এবং সময়ের মূল্যবোধহীন। পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে পিতা স্বৈরাচারী। বাঙালি লোভী ও শক্তিমানের ক্রীতদাস। তবে "অন্যরা বানরের বংশধর হতে পারে, বাঙালি প্রভুভক্ত জীবের বংশধর, কিন্তু প্রভুভক্ত নয়"। কারণটা বলছেন আজাদ "বাঙালি জানে প্রভু শাশ্বত, কিন্তু কোন বিশেষ প্রভু নশ্বর। এক প্রভু নিঃশেষ হলে আর এক প্রভু ধরে'' বাঙালি যৌন আলোচনায় সুখ পায় কিন্তু তা করে গোপনে এবং ভাব ধরে যে সে যৌন বিষয়ে কিছুই জানে না। "বাঙালির যৌবনমাত্রই ব্যর্থ ও যন্ত্রণাপীড়িত" বাঙালির আর একটা বড় দোষ তিনি দেখছেন; পরশ্রীকাতরতা। তবে শত্রুর উন্নতির চাইতে বন্ধুর উন্নতিতে বাঙালি বেশি কাতর হয়। বাঙালি খুব বড় হতে চায় না। 

৭.
তিনি ভালবাসতেন বাঙালিকে। আবার সবচেয়ে বেশি আক্রমণ করেছেন সেই বাঙালিকেই। এর সপক্ষে তাঁর জবাব ছিল, তিনি এই গোত্রের মানুষ, তাই এই জাতির কাছে তাঁর প্রত্যাশা অনেক বেশি। কিন্তু যখন দেখেন বাঙালি অনিবার্যভাবে পতনের পথকেই বেছে নিচ্ছে তখন তিনি তার সমালোচনা করেছেন। একটি পবিত্র বিশুদ্ধ বাংলাদেশ তিনি চেয়েছিলেন, যেখানে কোনো স্বাধীনতা বিরোধী থাকবে না। ধর্ম ব্যবসায়ীরা ফতোয়া দেবে না। এমন একটি দেশ হুমায়ুন আজাদ চেয়েছিলেন যেখানে 'ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না' (কিশোরসাহিত্য, প্রকাশকাল : ১৯৮৫)। গণতান্ত্রিক, মুক্তচিন্তাযুক্ত, ব্যক্তির অধিকারপূর্ণ, বদ্ধ মতাদর্শহীন, সচ্ছল, সৃষ্টিশীল, ভবিষ্যৎমুখি, সৎ, সুস্থ সমাজ ও রাষ্ট্র হুমায়ুন আজাদ চেয়েছিলেন। সেখানে কেউ প্রভু, কেউ দাস থাকবে না। সকলের সচ্ছলতার ব্যবস্থা থাকবে, সেখানে কোনো মতাদর্শ জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়া হবে না। কিন্তু তাঁর সেই স্বপ্নকে তাড়া করে ফিরেছে এদেশের স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি। বারবার তাঁকে আহত করেছে নানাভাবে। শেষ পর্যন্ত হুমায়ুন আজাদকে হত্যার মধ্য দিয়ে এদেশে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি তাদের সেই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করল।

৮.
বাঙালি ও বাঙালিত্ব নিয়ে হুমায়ুন আজাদের ভাবনা আলোচিত হয়ে থাকে। তিনি এ বিষয়ে তাঁর মতামত প্রকাশ করেন নি:সংকোচে। আমরা জানি, বাঙালি জাতীয়তাবাদ বাংলাদেশের ভিত্তি এবং এটি একটি ঐতিহাসিক সত্য। যে কোন জাতীয়তাবাদ বিকাশের প্রথম শর্ত একটি গোষ্ঠীর মধ্যে একাত্মবোধ এবং দ্বিতীয়ত এই গোষ্ঠীটি নিজেদেরকে অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র বলে মনে করে। এই একাত্মবোধ কিংবা স্বনন্ত্র্যবোধ অনেকগুলো বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে পারে। যেমন ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য, ভৌগোলিক অবস্থান, ধর্ম, অর্থনীতি ও রাজনীতি প্রভৃতি। যে কোন নির্দিষ্ট জাতীয়তাবাদের বিকাশে এগুলোর একটি বা একসাথে একাধিক বিষয় ক্রিয়াশীল থাকতে পারে। যেমন গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়কে কেন্দ্র করে জাতীয়তাবাদ বিকাশ লাভ করে। ভারতীয় উপমহাদেশ দু'ভাগে বিভক্ত হয়েছিল ধর্ম ভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে কেন্দ্র করে। বাঙালি প্রথমে ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদকেই সমর্থন দেয়। তবে অচিরেই তার ভুল বুঝতে পেরে প্রথমত মুসলমান থেকে প্রধানত বাঙালি হওয়ার জন্য সোচ্চার হয়ে ওঠে। আবার পাকিস্তান ভেঙ্গে অভ্যুদয় ঘটলো বাংলাদেশের যার মূলে ছিল ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ। জার্মানি, ইটালি ও স্লাভ অঞ্চলের মানুষদের মধ্যেও আমরা দেখি মাতৃভাষা, লোক সংস্কৃতি ও প্রাচীন ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের প্রতি প্রবল আকর্ষণ থেকে বিকশিত হয় সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ শক্তিগুলো তাঁদের নিজেদের নির্ধারিত পন্থায় রাষ্ট্র গঠন করতে চায়। ভাষা ভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদই মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বি-জাতি তত্ত্বকে ভুল প্রমাণ করে বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে অনিবার্য করে তোলে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের সাংস্কৃতিক ঐক্যকে উপেক্ষা করে ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ গড়ে তুলতে চেয়েছিল। তাদের এই অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ বাংলাদেশীদের কাছে চরমভাবে মার খায়। ফলাফল হিশাবে প্রথমে বাংলা ভাষা রাষ্ট্র ভাষার স্বীকৃতি পায় এবং পরবর্তীতে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। বলাই বাহুল্য এসবের পিছনের শক্তিটি হচ্ছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ। আমরা ভাষার পরিচয়ে পরিচিত হতে ভালবাসি। বাঙালি বলে গর্ব বোধ করি। কিন্তু এই বাঙালিত্বের স্বরূপ কী? গর্ব করার মতো এমন কী কী আছে আমাদের? এরকম নানা প্রশ্নেই দৃষ্টি রেখেছিলেন তিনি আমাদের ইতিহাসের পানে তাকিয়েই। প্রথাবিরুদ্ধ এই লেখকের দৃষ্টিতে দেখতে পাই বাঙালির বাঙ্গালিত্বের বিভিন্ন রূপ ও ব্যাখ্যা।

৯.
তিনি আমাদের সমাজদেহের নানান অসুখের কথা বলেছেন, চিনতে পেরেছিলেন বলে বলেছেনও বাঙালির "সীমাবদ্ধতার সূত্র"সমূহকে, আবার কারণ অন্বেষণও করেছেন তিনি এই সীমাবদ্ধতার। তাঁর মতে প্রথাবদ্ধতাই আমাদের সীমাবদ্ধতার মূল কারণ। তিনি বলেন, "আমাদের সমাজ মৌলিকতা বিরোধী, সৃষ্টিবিমুখ, পুনরাবৃত্তিপরায়ণ ও নিয়ন্ত্রণবাদী।" সীমাবদ্ধতার জন্য আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকেও দায়ী মনে করেন তিনি। তার ভাষায়, "আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রশ্নের কোন স্থান নেই", ফলে তা মননশীলতাকে বিকশিত হতে দেয় না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বাধীন নয়, সৃষ্টিশীলও নয়।

১০.
ভাষাবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা তাঁর জীবনের একটি বিশেষ দিক হিসেবে আলোচিত হয়ে থাকে। ১৯৬০-এর দশকে হুমায়ুন আজাদ যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের ছাত্র তখন পশ্চিমের ভাষাবিজ্ঞানী চম্‌স্কি-উদ্ভাবিত 'সৃষ্টিশীল রূপান্তরমূলক ব্যাকরণ' (transformational-generative grammar (TGG)) তত্ত্বটি আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রীর জন্য হুমায়ুন আজাদ এই তত্ত্বের কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে বাংলা ভাষার বাক্যতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করেন। এর মাধ্যমে বাংলার ভাষাবিষয়ক গবেষণায় আধুনিক ভাষাবৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সূত্রপাত করেন। তাঁর পিএইচডি অভিসন্দর্ভের নাম ছিল Pronominalization in Bengali (অর্থাৎ বাংলা সর্বনামীয়করণ)। পরবর্তীতে এটি একই শিরোনামের ইংরেজি বই আকারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। এর পর ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাংলা ভাষার বাক্যতত্ত্বের ওপর বাক্যতত্ত্ব নামে একটি বাংলা বই প্রকাশ করেন। একই সালে তিনি বাঙলা ভাষা শিরোনামে দুই খণ্ডের একটি দালীলিক সঙ্কলন প্রকাশ করেন, যাতে বাংলা ভাষার বিভিন্ন ক্ষেত্রের ওপর বিগত শতাধিক বছরের বিভিন্ন ভাষাবিদ ও সাহিত্যিকের লেখা গুরুত্বপূর্ণ ভাষাতাত্ত্বিক রচনা সংকলিত হয়। এই তিনটি গ্রন্থ বাংলা ভাষাবিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হিসাবে বিবেচিত হয়। তিনি পরবর্তী কালে তুলনামূলক-ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান ও অর্থবিজ্ঞানের উপর দু'টি সংক্ষিপ্ত প্রাথমিক পাঠ্যপুস্তক লেখেন। ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে তিনি বাংলা ভাষার একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাকরণ রচনার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তবে দুর্ভাগ্যবশত অকাল মৃত্যুর কারণে তাঁর এই আগ্রহ বাস্তবায়িত হতে পারেনি।

১১.
হুমায়ুন আজাদের জন্ম বাংলা ১৩৫৪ সালের ১৪ বৈশাখ, ইংরেজি ১৯৪৭ সালের ২৮ এপ্রিল।মুন্সিগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরে তাঁর নানাবাড়ি কামাড়গাঁওয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বাবা আবদুর রাশেদ প্রথম জীবনে শিক্ষকতা ও পোস্টমাস্টারির চাকরি করতেন পরে ব্যবসায়ী হন। মা জোবেদা খাতুন গৃহিনী। তিনি পৈত্রিক সূত্রে প্রচুর জমিজমা পেয়েছিলেন। যে গ্রামে তাঁর বাস ছিল সেটি অনেক আগে থেকেই বিখ্যাত একটি গ্রাম ছিল। কারণ এখানে জন্মেছিলেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু। গ্রামের নাম রাঢ়িখাল। মুন্সিগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরে অবস্থিত এটি। যদিও হুমায়ুন আজাদের জন্ম তাঁর নানাবাড়ি কামারগাঁও কিন্তু রাঢ়িখালকে হুমায়ুন আজাদ মনে করতেন তাঁর জন্মগ্রাম। গ্রামটি পানির গ্রাম নামে পরিচিত ছিল। কারণ গ্রামে অনেকগুলো পুকুর ছিল। যা বর্ষাকালে পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠত। আর গ্রামটিকে সেই পানির ওপর ভাসতে থাকা কচুরিপানার মনে হতো। 

১২.
তিন ভাই এবং দই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন পিতামাতার প্রথম পুত্রসন্তান। তিনি ছেলেবেলায় রাড়িখালের প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। ছেলেবেলা থেকেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। পড়াশোনার শুরু নিজ গ্রামেই। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ার পর আর তৃতীয় শ্রেণীতে পড়েননি। সরাসরি চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন স্যার জে. সি. বোস ইন্সস্টিটিউশন-এ। এটিই তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় বলে মনে করতেন হুমায়ুন আজাদ। তাঁর বাবা ছিলেন একাধারে গ্রামের স্কুলের শিক্ষক এবং অন্যদিকে পোস্টমাস্টার। বাবা তাঁকে সব সময়ই বলতেন, পড়, পড়। সেই পড়াই হুমায়ুন আজাদের সারা জীবনের সঙ্গী হয়ে উঠেছিল। সৃষ্টিশীল কোনো বিষয়ই তাঁর অপ্রিয় ছিল না। হুমায়ুন আজাদ নবম শ্রেণীতে পড়াকালীন সময়ই কবিতাচর্চা শুরু করেন। তবে তাঁর প্রথম লেখা ছাপা হয়েছিল দৈনিক ইত্তেফাকের শিশুপাতা কচিকাচার আসরে, গদ্য। ১৯৭৫ সালে বের হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'অলৌকিক ইস্টিমার'। বই ছিল তাঁর প্রাণের চেয়েও প্রিয়। লেখা ছিল তাঁর আনন্দ। এই নিয়েই সারাটা দিন ব্যস্ত থাকতেন তিনি। তিনি ছিলেন খুব পরিশ্রমী। কখনও তিনি অবসর সময় কাটাননি। যার ফলে পাঠকদের জন্য প্রায় ৭৫টির মতো বই রেখে গেছেন। তাঁর লিখিত সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় ছিল সমান গুরুত্বের স্বীকৃতি। জীবনের শেষার্দ্ধে অকুতোভয়ে ধর্ম বিরোধিতা, সামরিক শাসনের বিরোধিতা, নারীবাদী বক্তব্য এবং সেই সঙ্গে নি:সংকোচ যৌনবাদিতার জন্য তিনি ব্যাপক পাঠকগোষ্ঠির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

১৩.
হুমায়ুন আজাদ যে ঘরে পড়তেন তার সামনে ছিল একটা কদম ফুলের গাছ। প্রতি বর্ষায় ফুল ফুটে এটি রূপসী হয়ে উঠত। ক্লাস এইট-নাইনে পড়ার সময় এই কদম গাছকে নিয়েই তিনি একটি উপন্যাস লেখা শুরু করেন। যার কোনো কাহিনী ছিল না। ছিল শুধু রূপের বর্ননা। ছেলেবেলা থেকেই তিনি ছিলেন প্রচণ্ড প্রকৃতিপ্রেমী। তিনি বিভিন্ন সময়ের প্রকৃতির স্বাদ উপভোগ করতে পারতেন। হুমায়ুন আজাদের নিজের কথায়, "শীতের শিশির, কুয়াশা, ঠান্ডা বাতাস, গ্রীষ্মের প্রচন্ড রোদ, বর্ষার প্লাবন, ঝড় মেঘ, শরতের সোনা আর কার্তিকের কুয়াশা, ফাল্গুনের সবুজ পাতা আমার ভিতরে ঢুকে গেছে। আমার যেমন ভালো লাগতো বোশেখের রোদ তেমনি ভাল লাগতো মাঘের ঠান্ডা। আমাদের গ্রামে আমার বয়সের অন্যরা অনেকটা বড়ো হয়েছে অন্যভাবে, প্রকৃতির রূপ দেখে তারা মুগ্ধ হয়েছে কি না জানি না, তারা থেকেছে ওরই মধ্যে নানা কাজে। আমার বিশেষ কোনো কাজ করতে হয়নি, আমি যেমন বই পড়েছি তেমনি চারপাশকে পড়েছি। তবে আমি লোকজ হয়ে উঠিনি।"

১৪.
সেই ছেলেবেলা থেকেই হুমায়ুন আজাদের আগ্রহের বিষয় ছিল রবীন্দ্রনাথ। চয়নিকা থেকে তখন অজস্র কবিতা মুখস্থ বলতেন। নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় কবিতা লেখার শুরু। তবে প্রথম ছাপা হয়েছিল গদ্য। কচিকাঁচার আসরে। জে. সি. বোস ইন্সস্টিটিউশন থেকেই ১৯৬২ সালে এস.এস.সি. পাশ করেন হুমায়ুন আজাদ। সমস্ত পূর্ব পাকিস্তানে তিনি একুশতম স্থান অধিকার করেছিলেন। তারপর অনিচ্ছাসত্ত্বেও ঢাকা কলেজে ভর্তি হন বিজ্ঞান বিভাগে। সেখানেই পরিচয় প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমানের সাথে। সেখান থেকে দ্বিতীয় বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। তারপর ১৯৬৪ সালে পারিবারিক প্রতিকূলতা পেরিয়ে তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। অনার্সে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। ১৯৬৯ সালে সেখান থেকেই বাংলায় আবারো প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে এম.এ. ডিগ্রী লাভ করেন। একই বছর তিনি শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন চট্টগ্রাম সরকারী মহাবিদ্যালয়ে। তারপর ১৯৭০ সালে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে প্রায় এগার মাস কাজ করেন। ১৯৭০ সালের ১২ ডিসেম্বর চলে আসেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক পদে। হুমায়ুন আজাদ ১৯৭৩ সালে কমনওয়েলথ বৃত্তি পেয়ে পিএইচ.ডি. ডিগ্রীর জন্য চলে যান এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেসময় প্রায় তিন বছর তিনি সৃষ্টিশীল লেখালেখি থেকে দূরে ছিলেন। তবে অন্তরঙ্গ বন্ধু রবার্টের সাথে অনুবাদ করেন জীবনানন্দ দাশের কবিতা। ১৯৭৬ সালে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাবিজ্ঞনে অর্জন করেন পিএইচ.ডি. ডিগ্রী। ১৯৭৭ সাল থেকে তিনি পুরোপুরিই লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন। ১৯৭৮ সালের ১লা নভেম্বর সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চলে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে।

১৫.
হুমায়ুন আজাদের আসল নাম 'হুমায়ুন কবীর'। লেখার জন্য নাম বদল করে শপথপত্রের মাধ্যমে তা স্থায়ী করে নেন। ১৯৭৫ সালে হুমায়ুন আজাদ বিয়ে করেন তাঁর সহপাঠী লতিফা কহিনূরকে। টেলিফোনে। আজাদ-লতিফা দম্পতির দুই মেয়ে মৌলি আজাদ, স্মিতা আজাদ এবং এক পুত্র অনন্য আজাদ। 

১৬.
গদ্যের জন্য বেশী জনপ্রিয় হলেও হুমায়ুন আজাদ আমৃত্যু কাব্যচর্চা করে গেছেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ – কবিতা : অলৌকিক ইস্টিমার (১৯৭৩), জ্বলো চিতাবাঘ (১৯৮০), সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে (১৯৮৫), আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে (১৯৯০), হুমায়ুন আজাদের শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৯৩), কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু (১৯৯৮), কাব্য সমগ্র (১৯৯৮)। এছাড়া তাঁর আরও কাব্যগ্রন্থ রয়েছে। উপন্যাস : ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল (১৯৯৪), সব কিছু ভেঙ্গে পড়ে (১৯৯৫), মানুষ হিসাবে আমার অপরাধসমূহ (১৯৯৬), যাদুকরের মৃত্যু (১৯৯৬), শুভব্রত, তাঁর সম্পর্কিত সুসমাচার (১৯৯৭), রাজনীতিবিগণ (১৯৯৮), কবি অথবা দন্ডিত অপুরুষ (১৯৯৯), নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু (২০০০), দশ হাজার এবং আরো একটি ধর্ষণ (২০০৩), উপন্যাস সমগ্র-২ (২০০১), পাক সার জমিন সাদ বাদ (২০০৩), একটি খুনের স্বপ্ন (২০০৪)। এছাড়া তাঁর আরও উপন্যাস রয়েছে। সমালোচনাগ্রন্থ : রবীন্দ্রপ্রবন্ধ: রাষ্ট্র ও সমাজনীতি (১৯৭৩), শাসসুর রাহমান: নিসঙ্গ শেরপা (১৯৮৩), শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ ও অন্যান্য প্রবন্ধ (১৯৮৮), নারী (১৯৯২), প্রতিক্রিয়াশীলতার দীর্ঘ ছায়ার নীচে (১৯৯২), জলপাই রঙের অন্ধকার (১৯৯২), আমার নতুন জীবন (২০০৫), অনুবাদ গ্রন্থ 'দ্বিতীয় লিঙ্গ' (২০০১)। এছাড়া তাঁর আরও সমালোচনাগ্রন্থ রয়েছে । ভাষাবিজ্ঞান : বাংলা ভাষা- প্রথম খন্ড (সম্পাদিত) (১৯৮৪), বাংলা ভাষা- দ্বিতীয় খন্ড (সম্পাদিত) (১৯৮৫), প্রনোমিলাইজেশান ইন বেঙ্গলি (১৯৮৩), বাংলা ভাষার শত্রুমিত্র (১৯৮৩), বাক্যতত্ত্ব (১৯৯৪), তুলনামূলক ও ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান (১৯৮৮), অর্থবিজ্ঞান (১৯৯৯)। এছাড়া তাঁর অন্যান্য ভাষাবিজ্ঞানও রয়েছে। কিশোরসাহিত্য : লাল নীল দীপাবলি বা বাংলা সাহিত্যের জীবনী, ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না (১৯৮৫), আব্বুকে মনে পড়ে (১৯৮৯), বুক পকেটে জোনাকী পোকা (১৯৯৩), কতো নদী সরোবর বা বাংলা ভাষার জীবনী (১৯৮৭), (১৯৯৬)অন্ধকারে গন্ধরাজ (২০০৩)। এছাড়া তাঁর অন্যান্য কিশোর সাহিত্যও রয়েছে। সম্পাদনা : আধুনিক বাংলা কবিতা (১৯৯৪), মুহম্মদ আবদুল হাই রচনাবলী (১ম খন্ড, ২য় খন্ড ও ৩য় খন্ড; ১৯৯৪), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রধান কবিতা (১৯৯৭)। 

১৭.
হুমায়ুন আজাদের অনেকগুলো সত্তা। প্রতিটিতেই তিনি সৃজনশীলতা ও মননশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি সবসময় লিখেছেন সচেতনভাবে। তাই তাঁর লেখার প্রক্রিয়াটি হচ্ছে একটি যৌক্তিক প্রক্রিয়া, তাঁর লেখার প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি শব্দ ছুটে যায় অভীষ্ট সিদ্ধির দিকে। চুড়ান্তভাবে তিনি বুঝতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশের সমাজকে, সংস্কৃতিকে, অর্থনীতি ও রাজনীতিকে সর্বোপরি বাংলাদেশের সমগ্র প্রসঙ্গ কাঠামোকে। আর বোঝার ভিতর দিয়েই তিনি সিদ্ধান্ত টেনেছিলেন 'সবকিছু নষ্টদের অধিকারে চলে গেছে'। তাঁর আমরা কি এই বাঙলাদেশ চেয়েছিলাম গ্রন্থে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের দূরবস্থার সাহসী বর্ণনা আছে। তবে হুমায়ুন আজাদ যে গ্রন্থটির জন্য পাঠকের কাছে সবচেয়ে বেশি পরিচিত হন তা হলো 'নারী'। 'নারী' হলো তাঁর শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। এই গ্রন্থটির জন্য তিনি সমালোচিত হন, বিতর্কিত হন। নারী গ্রন্থটি উপভোগ করে পাঠকের হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা। নারীবাদী ভাবনার এটি একটি আন্তর্জাতিক ভাষ্য। তিনিই প্রথম এ দেশে নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্বের সংগঠিত রূপ পাঠকদের সামনে হাজির করেন। যদিও এই তত্ত্ব ইউরোপের কিন্তু তিনি তা এইদেশের প্রেক্ষাপটেই উপস্থাপন করেন অসাধারণ ভঙ্গিমায়। বইটির জন্য তিনি প্রতিক্রিয়াশীল ও ধর্মান্ধদের প্রবল বিরোধীতার মুখোমুখি হন। সেসময়ের সরকার এটিকে নিষিদ্ধ করে। যদিও পরে আদালতের রায়ে তা অবমুক্ত হয়। এরই অনুষঙ্গ হিসেবে হুমায়ুন আজাদ অনুবাদ করেন সিমন দ্যা বেভোয়ারের 'দ্যা সেকেন্ড সেক্স'-'দ্বিতীয় লিঙ্গ' নামে।

১৮.
বাংলাদেশে যখন মৌলবাদ বিস্তার লাভ করতে থাকে, বিশেষ করে ২০০১ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত, তখন ২০০৪ সালের বইমেলাতে বের হয় তাঁর উপন্যাস 'পাক সার জমিন সাদ বাদ'। এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হলে তাঁর অন্য অনেক গ্রন্থের মতো এটিও সমালোচিত হয়। দেশের মৌলবাদী গোষ্ঠি তার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়, এবং বিভিন্ন স্থানে হুমায়ুন আজাদের বিরুদ্ধে প্রচারনা চালায়। রাজপথ থেকে একসময় ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে সংসদে। ২০০৪ খ্রিস্টারব্দে ২৫ জানুয়ারি তৎকালীন সংসদ সদস্য দেলোয়ার হোসেন সাঈদী জাতীয় সংসদে হুমায়ুন আজাদের পাক সার জমিন সাদ বাদ বইটিকে ইসলাম বিরোধী আখ্যায়িত করে বক্তব্য দেন এবং এ ধরনের লেখকদের লেখা বন্ধ করতে ব্লাসফেমি আইন প্রণয়নের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।এই বইটিতে হুমায়ুন আজাদ তীব্র ব্যঙ্গাত্মক ভাষায় বাংলাদেশের মৌলবাদীগোষ্ঠী স্বরূপ চিত্রিত করেন। মৌলবাদীরা প্রকাশ্যে তাঁকে হত্যারও হুমকি দেয়। কিন্তু তিনি এসবের কোনোকিছুকেই তোয়াক্কা করেননি। তিনি তাঁর নিজের বিশ্বাস মতো লিখে গেছেন, কথা বলে গেছেন। প্রতিদিনের মতোই ছিল তাঁর দিনলিপি। তিনি এই বইটিতে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধীতাকারী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীকে ফ্যাসিবাদী সংগঠন হিসেবে উল্লেখ করেন এবং এর কঠোর সমালোচনা করেন । আর তারই জের ধরে ২০০৪ সালে হুমায়ুন আজাদের উপর সন্ত্রাসী হামলা হয়, যার দায়িত্ব পরবর্তীতে জমিয়াতুল মুজাহেদীনের সন্ত্রাসবাদীরা স্বীকার করে। ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৪ সাল। বাংলা একাডেমিতে বইমেলা চলছে। সন্ধ্যার পর বইমেলা থেকে বেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিজের বাসায় যাবার পথে ঘাতকদের আক্রমণের শিকার হন তিনি। তাঁর পবিত্র রক্তে পিচ্ছিল হয়ে ওঠে টিএসসি চত্ত্বর। গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এদিকে রাজপথ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ছাত্র-জনতার মিছিলে-মিছিলে। মুহুর্তের মধ্যেই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। আহত হুমায়ুন আজাদ বেঁচে আছেন কি নেই তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দেয়। এই ঘটনা সরকারের টনক নড়িয়ে দেয়। বাধ্য হয়ে সরকার সেসময় তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠায়। তিনি সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে আসেন। কিন্তু মৃত্যু তাঁর পিছু ছাড়েনি। 

১৯.
২০০২ সালে তিনি বিশ্বখ্যাত কবি হাইনরিশ হাইনের ওপর কাজ করার জন্য জার্মান সরকারের নিকট একটি বৃত্তির আবেদন করেছিলেন। হত্যাপ্রচেষ্টার ঘটনার কিছুদিন পরেই জার্মান সরকার তাঁকে সেই কাজ করার জন্য বৃত্তি প্রদান করেন। তিনি জার্মানির মিউনিখে চলে যান। সেখানেই ২০০৪ সালের ১১ আগস্ট আকষ্মিকভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন হুমায়ুন আজাদ। ২৭ আগষ্ট তাঁর মৃতদেহ বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয় এবং ওই দিনই জন্মস্থান বিক্রমপুরের রাঢ়িখাল গ্রামের পারিবারিক বাসভবন প্রাঙ্গণে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। 

২০.
সংশয় প্রকাশ করতে দারুণ পছন্দ করতেন হুমায়ুন আজাদ। বলা হয়ে থাকে তিনি ছিলেন স্বঘোষিত নাস্তিক।কারন হিসেবে বলা হয়- তিনি আস্তাকুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন প্রচলিত প্রায় সমস্ত প্রথাকে। নিজে হয়ে উঠেছিলেন কঠোরভাবে প্রথাবিরোধী। তাঁর সমস্ত বই, প্রবন্ধ, কবিতা সৃষ্টি হয়েছে প্রথাকে অস্বীকার করে। তাঁর প্রবচনগুচ্ছ এদেশের পাঠক সমাজকে করে তুলেছে সচেতন, অপরদিকে ভণ্ডদের করে তুলেছে ক্রুদ্ধ। আর এ কারণেই তিনি হয়ে ওঠেছিলেন এদেশের কান্ট। হুমায়ুন আজাদের লেখালেখির পুরোটাই ছিল বিজ্ঞানমনস্ক ও যুক্তিবাদী এবং মানবিকতার চেতনায় জাগ্রত। তিনি নিজেই ছিলেন তাঁর চিন্তা-চেতনা ও বিশ্বাসের মুখপত্র। তাই বলে তিনি তাঁর রাজনৈতিক আদর্শকে কখনো ঢেকে রাখেননি। তাঁর বিশ্বাস ছিল বৈষম্যহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি এবং তিনি তা অনেকবারই উল্লেখ করেছেন। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিকেই তিনি মুক্ত মানবের মুক্ত সমাজ গড়ার পক্ষে অনুকূল বলে মনে করতেন। জন্মদিনে মানবতাবাদী এই মহান মানুষটিকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ না করে কি উপায় আছে?

২১.
শামসুর রাহমানকে নিয়ে হুমায়ুন আজাদ লিখেছিলেন ‘নি:সঙ্গ শেরপা’। সেই তিনিই আবার বিভিন্ন সময়ে কঠোর সমালোচনা করতে দ্বিধা করেননি শামসুর রাহমানের। সৃষ্টিশীল শিল্পীদের জীবন বোধহয় এমনই, সময়ের উনুনে জ্বলে, রূপ পরিবর্তিত হয়, প্রচলিত ধারনা বদলাতে মোটেই কুণ্ঠিত হন না। বিশেষ করে হুমায়ুন আজাদ হলে তো কথাই নেই। কবি শামসুর রাহমান তাই হুমায়ুন আজাদের মৃত্যুতে ব্যথিত, শোকাহত হয়ে লিখেছিলেন একটি কবিতা- কবিতার নাম ‘তুমি আজ অধিরাজ’:
‘মূর্খেরা ভেবেছে তুমি অস্ত্রাঘাতে নিষ্প্রাণ হলেই
নিভে যাবে তোমার সৃষ্টির আলোমালা,
অথচ জানে না ওরা, সর্বদা সজীব তুমি, অমর।
তোমার প্রোজ্জ্বল রচনাবলী, তোমার শরীর
কোনকালে বিলুপ্ত হলেও
যুগ যুগ জ্বলজ্বলে রয়ে যাবে বাংলার দলিলে;
কুটিরে, নদীর ঢেউয়ে, দেশপ্রেমী প্রতিটি প্রাণের
আসনে, হে কবি, হুমায়ুন, তুমি আজ অধিরাজ।’

বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কবি শামসুর রাহমান এ কবিতায় শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে গিয়ে হুমায়ুন আজাদকে অধিরাজ বলে অভিহিত করেছেন। বলেছেন বাংলার দেশপ্রেমিক মানুষের হৃদয়ের আসনে তাঁর অবস্থান অত্যন্ত উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে দেবে। হুমায়ুন আজাদ বেঁচে থাকবেন এদেশের মানুষের কুটিরে কুটিরে, নদীর স্রোতে। কবি শামসুর রাহমানের এই মতের সাথে আমরা কোনভাবেই দ্বিমত পোষণ করতে পারি না বলেই জাতির নানা ক্রান্তিলগ্নে তাঁকে গভীরভাবে শ্রদ্ধাসহকারে স্মরণ করি।

(তথ্যসূত্র : বাংলাপিডিয়া, হুমায়ুন আজাদের বিভিন্ন বই, বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্র-পত্রিকা, বিডিনিউজ২৪.কম, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত