প্রয়াণ দিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

বের্টোল্ট ব্রেখট

প্রকাশ : ১৪ আগস্ট ২০১৮, ১২:০০

১.
বিশ্ববিখ্যাত জার্মান কবি, নাট্যকার ও মঞ্চ পরিচালক বের্টোল্ট ব্রেখট। নাট্যকার বের্টোল্ট ব্রেখট করোনারি থ্রম্বোসিসে আক্রান্ত হয়ে ১৯৫৬ সালের ১৪ আগস্ট পূর্ব বার্লিনে মৃত্যুবরণ করেন। নাট্যকার বের্টোল্ট ব্রেখটের স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, ১৮৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি তিনি জার্মানিতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁকে কবর দেওয়া হয় আরেক মহান দার্শনিক হেগেলের সমাধির অল্প একটু দূরেই। মনে পড়ে, ধানমন্ডিস্থ জার্মান কালচারাল সেন্টারে বা গ্যেটে ইন্সস্টিটিউট মঞ্চে ১৯৮৯-৯০ সালের দিকে ‘গ্যালিলিও গ্যালিলি’ নাটক দেখতে গিয়ে প্রথম নাম শুনি জার্মান নাট্যকার বের্টোল্ট ব্রেখটের। তারপর মুদ্ধ না হয়ে উপায় থাকে? সেই কলেজ জীবনে একাধিকবার দেখা নাটকটি এখনো মনে দাগ কেটে আছে।
 
২.
জার্মান নাট্যকার হলেও ব্রেখট নাটক লিখেছেন সারা বিশ্বের মানুষের জন্যে। তাঁর নাটকে মানবতা আর বিশ্বভাতৃত্ব’র পাশাপাশি যুদ্ধ আর শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ ফুটে উঠেছে। স্বাধীন বাংলাদেশে তাই ব্রেখটের জনপ্রিয়তা ও আদর অন্য যে কোন ভিনদেশি নাট্যকারের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশের মঞ্চে ব্রেখট চর্চায় পথিকৃত বলা যায় নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়কে। আসাদুজ্জামান নূরের অনুবাদ এবং পরিচালনায় ব্রেখটের ‘দেওয়ান গাজীর কিস্সা’ বাংলাদেশের মঞ্চের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং সর্বাধিক মঞ্চায়িত নাটক। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় তাদের ২২তম প্রযোজনা হিসেবে ১৯৮৮ সালে 'গ্যালিলিও' নাটকটি মঞ্চায়ন শুরু করে। তখন ‘গ্যালিলিও গ্যালিলি’র চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছিলেন, মন কেড়েছিলেন আলী যাকের। অন্য চরিত্রগুলোতে ছিলেন আসাদুজ্জামান নূর, খালেদ খান, লাকী ইনাম, ফারুক আহমেদ, লুৎফর রহমান জর্জ, কাওসার চৌধুরীসহ আরো অনেকে। নাটকটির নির্দেশনায় ছিলেন আতাউর রহমান। বের্টোল্ট ব্রেখটের ‘দি লাইফ অব গ্যালিলিও গ্যালিলি’ অবলম্বনে নাটকটির অনুবাদ করেছিলেন অধ্যাপক আবদুস সেলিম। আর নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় সম্পর্কে কিছু না বলাটাও শোভন হবে না, কারণ দর্শনীর বিনিময়ে নিয়মিত নাট্য প্রদর্শনীর পথিকৃত এই দলটি। 'গ্যালিলিও'সহ এ দলের বিভিন্ন প্রযোজনা দর্শকপ্রিয়তা লাভ করে। মাইকেল মধুসূদন দত্তের বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ নাটকের মধ্যে দিয়ে এ দলের যাত্রা শুরু। এরপর তারা একে একে মঞ্চে নিয়ে আসে বাকি ইতিহাস, দেওয়ান গাজীর কিসসা, নূরুলদীনের সারাজীবন, ঈর্ষা, মুখোশ, হিম্মতী মা, রক্তকরবী’র মতো অসাধারণ সব প্রযোজনা।

৩.
ইউজিন বের্টোল্ট ফ্রেডরিক ব্রেখট (জন্ম: ১০ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৮ – মৃত্যু: ১৪ আগস্ট, ১৯৫৬) একাধারে কবি, গল্পকার, নাট্যকার, নির্দেশক, অভিনেতা। তবে সব পরিচয় ছাড়িয়ে তার নাট্যকার পরিচিতিই আজ সারা বিশ্বে স্বমহিমায় ভাস্বর। বিশ্বের প্রচলচিত নাট্য ধারার বিরুদ্ধে একাই একটি তীব্র প্রতিবাদের নাম বের্টোল্ট ব্রেখট। খ্রীস্টপূর্ব এ্যারিস্টটলীয় নাট্যভাবনার বিপরীতে নতুন নাট্যরীতির জনক হিসাবেই শুধু নয়, সারা বিশ্বের শ্রেণি শোষণের বিরুদ্ধে ব্রেখট এক বিপ্লবী নাট্যতাত্ত্বিক। তাঁর প্রণীত ফেরফ্রেমডেন, গ্যাসটুস এবং সর্বোপরি এপিক থিয়েটার তত্ত্ব এখন পর্যন্ত নাট্যতত্ত্বে সর্বাধিক আলোচিত মতবাদ। তবে ব্রেখটকে শুধুমাত্র নাট্যকার বা তাত্ত্বিক বললে অন্যায় হবে, কেননা তিনি একজন রাজনীতি সচেতন সমাজকর্মীও বটে। কারণ তাঁর নাট্যচিন্তা ছিলো তৎকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে উৎসারিত। ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, শাসক-শোষিতের দ্বন্দ্ব তাঁর নাটকে সুস্পষ্ট। কখনওবা তিনি মন্দের কাছে ভালোর পরাজয়ও দেখান। কেননা, রোমান্টিক বিপ্লবের চেয়ে তাঁর কাছে বিদ্যমান সত্য শ্রেয়। আর কে না জানে, আজকের সমাজেও প্রায়শই কিংবা বলা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মন্দের কাছে ভাল নিষ্পেষিত, পরাজিত। 

৪.
তাঁর সমালোচকদের কেউ কেউ বলে থাকেন, নাট্যকার বের্টোল্ট ব্রেখট কবি হিসেবেই বেশি পরিচিত। ৪০টিরও বেশী নাটক ও অপেরা তাঁর কাব্যখ্যাতিকে কিছুটা হলেও ম্রিয়মান করেছে। তাঁর নাটকগুলির বেশির ভাগই অন্যের রচনার উপর ভিত্তি করে লেখা। এপিক থিয়েটার তত্ব এবং নাটকে বিযুক্তিবাদ ও প্রয়োগ নাট্যজগতে তার মৌলিক অবদান হিসাবে স্বীকৃত। ১৯৩৩ সালে নাৎসীদের অত্যাচারে দেশ ছাড়ার পর ব্রেখট বাকী জীবনটা অনেকটা ভবঘুরের মতই দেশ থেকে দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন; নিজের দেশ বলে তার কিছু ছিল না। কিছুদিন হলিউডে কাজ করলেও সে জায়গাটি তার পছন্দ হয়নি। পশ্চিমে তিনি নিন্দিত হয়েছিলেন কট্টর মার্ক্সবাদী হিসেবে। সাম্যবাদী সন্দেহে তাঁকে জেরা করা হয়। ১৯৪৯ সালে পূর্ব বার্লিনে ফেরত আসার পরে সেখানেও মূলধারার বাইরের নাটক লেখার কারণে সন্দেহের শিকার হন। অন্যান্য শিল্পীর মত ব্রেখটও মৃত্যুর পরেই তার শিল্পকর্মের স্বীকৃতি পান। যে জার্মানি থেকে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যকার ব্রেখট একদা নির্বাসিত হয়েছিলেন সেই জার্মানি আজ তাকে নিয়ে মাতামাতি করে।

৫.
বের্টোল্ট ব্রেখট মুখ্যত নাট্যকার। বিশ শতকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকে খ্যাতির শীর্ষে উঠেছিলেন, সে জনপ্রিয়তা এখনও তার কমেনি। নাট্যজগতে অদ্যাবধি তিনি অবিস্মরণীয়, নাট্যকলা সম্পর্কে প্রতিষ্ঠা করেছেন নিজস্ব মত ও ধ্যানধারণা, নবোজ্জীবিত করেছেন ইউরোপের নাট্যধারণাকে, মঞ্চকৌশলে এনেছেন নতুন যুগ। আর তাই অগণিত রচনা লেখা হয়েছে বের্টোল্ট ব্রেখটের নাট্যপ্রতিভা নিয়ে, তার 'এপিক থিয়েটার' কিংবা 'সমাজ-জীবনে যুগান্তকারী আন্দোলন' বিষয়ে। প্রথমত প্রধানত নাট্যকারই তিনি। কবি-পরিচয় গৌণ হয়ে গেছে, যদি প্রতিভার স্বাক্ষর সেখানেও ছড়ানো। স্মরণে রাখা দরকার, তাঁর প্রথম আবির্ভাব কবি হিসেবেই, গীতিকবিতা তো লিখতেনই, নিজেই গিটার বাজিয়ে সেসব গেয়ে মুগ্ধ করে দিতেন সবাইকে। 

৬.
অনেক রসবেত্তা মনে করেন যে, বের্টোল্ট ব্রেখটের নাটকের চেয়ে কবিতাই শেষ পর্যন্ত বেশিদিন টিকে থাকবে। বের্টোল্ট ব্রেখট কবিতা লিখতে শুরু করেন তার নাট্যচর্চার পাশাপাশি। বিষয়বস্তু, যেমন নাটকে, এখানেও তেমনি- মানবতার হিতসাধন। প্রথমাবধি লক্ষ্য স্থির ছিল, সে-লক্ষ্যেই সর্বদা শরনিক্ষেপ করেছেন। তাঁর কবিতায় সারল্য আছে এক ধরনের, সরাসরি বক্তব্য স্থাপনের মুন্সিয়ানা। মনে করিয়ে দেয় চীনে কবিতা কিংবা জাপানি হাইকুকে। বের্টোল্ট ব্রেখটের কবিতায় আদি থেকেই ছিল মৃত্যু, ক্ষয়, নিমজ্জন তথা ধ্বংস। মার্ক্সীয় প্রবক্তা হওয়ার পরও চালচিত্রে এ-সবই বর্তমান ছিল, কিন্তু আকাঙ্ক্ষার রূপায়ণ ঘটেছিল ভিন্নভাবে, যা অকল্পনীয় ছিল নৈরাজ্যবাদী বের্টোল্ট ব্রেখটে; এবং তা শুধুই আশা, উদ্দীপ্ত ভাস্বর আশা। ভবিষ্যৎ মানুষের জন্যে। সমালোচকগণ বলে থাকেন, কবি হিসেবেই বেশি পরিচিত ব্রেখটের নাটকগুলির বেশির ভাগই অন্যের রচনার উপর ভিত্তি করে লেখা। তবে তাঁর সৃষ্টিশীলতা অন্যখানে; বের্টোল্ট ব্রেখট তাঁর "ফেরফ্রেমডুংস্এফেক্ট" ("Verfremdungseffekt", অর্থাৎ দূরত্বের ক্রিয়া)-এর জন্য পরিচিত ছিলেন, যার মাধ্যমে তিনি নাটকের দর্শকদেরকে নাটকীয় ইন্দ্রজালের নিষ্ক্রিয় পর্যবেক্ষকের ভূমিকার পরিবর্তে সক্রিয়, চিন্তাশীল অংশগ্রহণকারীর ভূমিকা পালনে উদ্বুদ্ধ করতেন। আজকাল ব্রেখটের মূল পরিচিতি ডি দ্রাইগ্রোশেনওপার অপেরায় লেখা তাঁর গানগুলির জন্য। অন্য অনেক শিল্পীর মত বের্টোল্ট ব্রেখটও মৃত্যুর পরেই তার শিল্পকর্মের স্বীকৃতি পান।

৭.
বের্টোল্ট ব্রেখট জার্মানির বাভারিয়ার আউগসবুর্গ শহরের বুর্জোয়া এক পরিবারে জন্মেছিলেন ১৮৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি। তাঁর বাবা ছিলেন সামান্য ক্যাথলিক দোকানদার। মা ছিলেন গোড়া প্রটেস্টট্যান্ট। তিনি নিজেও দীক্ষিত হয়েছে প্রটেস্টট্যান্ট মতে, মায়ের আদর্শে তিনি ব্যাপটিস্ট হয়েছেন। প্রচলিত বুর্জোয়া শিক্ষা ব্যবস্থাতেই তার বেড়ে ওঠা। চার বছরের প্রাথমিক শিক্ষা জীবন শেষ করে পদার্পণ করেন কনিগলিচেস রিয়েলজিমনেসিয়ামে। এই প্রতিষ্ঠান থেকেই তার পরবর্তী জীবনের পথটা তৈরি হয়েছিলো। ১৬ বছর বয়সে (১৯১৪) তার প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয়। কবিতা আর নাটক নিয়ে অনুরক্ত হওয়ার আগেই তিনি মেডিকেল সায়েন্সে অধ্যয়নের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ১৯১৭ সাল থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত ব্রেখট মিউনিখে চিকিৎসাবিদ্যার ওপর পড়াশোনা করেন, কিন্তু তাঁর ঝোঁক ছিল সাহিত্যের দিকে। মিউনিখের লুডভিগ ম্যাক্সমিলিয়ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর তিনি যোগ দেন আগুস্তবার্গ মিলিটারি হাসপাতালে। সেখানেই তিনি সরাসরি মুখোমুখি হন মানব যন্ত্রণার। প্রথম মহাযুদ্ধ শেষে ১৯২০ সালে মিউনিখ শহরেই এক থিয়েটারে চাকরি নিলেন। এক নাটক রচনা করলেন ১৯২২-এ এবং সকলের ঈপ্সিত বিখ্যাত ক্লাইশট পুরস্কার পেলেন। তারপর আর দেরি করেননি, নানা ধান্দায় ঘোরেননি।স্থির প্রত্যয়ে ঠিক করে নিলেন লেখক হবেন। জীবিকা হিসেবে সাহিত্যসৃজনকেই মেনে নিলেন। প্রথমে প্রচন্ড নৈরাজ্যবাদী ছিলেন, পরে ধীরে ধীরে ঝুঁকলেন মার্ক্সীয় দর্শনের দিকে। বার্লিনে তিনি কিছুদিনের জন্য মঞ্চ পরিচালক মাক্স রাইনহার্ট ও এর্ভিন পিস্কাটর, এবং নাট্যকার কার্ল ৎসুক্মাইয়ারের সাথে কাজ করেন। ১৯২৮ সালে ব্রেশ্ট সুরকার কুর্ট ভাইলের সহযোগিতায় ইংরেজি অপেরা "দ্য বেগার্স অপেরা"-র একটি সম্পূর্ন সংশোধিত সংস্করণ প্রস্তুত করেন। অপেরাটি ডি দ্রাইগ্রোশেন্ওপার (Die Dreigroschenoper) নামে বার্লিনের থিয়েটার আম শিফবাউয়ারডাম-এ মুক্তি পায় ও দারুণ সাফল্য লাভ করে। বার্লিনে ১৯২৪ থেকে ১৯৩৩ পর্যন্ত খ্যাতি-অখ্যাতির শীর্ষে জীবন নির্বাহ করার সময়ে সর্বতোভাবে মার্ক্সীয় লেখকে রূপান্তরিত হলেন।

৮.
বের্টোল্ট ব্রেখটের জীবনে দৈবদুর্বিপাক লেগেই ছিল, ফলে সারাজীবন যাযাবরের ন্যায় দেশ থেকে দেশান্তর ছুটে বেড়াতে হয়েছে বাঁচার জন্য। হিটলারের আমল; নাৎসিরা রাইখশ্টাডে আগুন ধরাল। জর্মনির অভ্যন্তরে এর পরে কী ঘটবে, ধারণা করে নিতে ভুল হয়নি তার। রাইখশটাডের সঙ্গে তার গ্রন্থাদিও ভস্মীভূত করা হয়েছিল অবশ্য। দেশ থেকে পালালেন, প্রথমে সুইটসার্লান্ড, পরে ফ্রান্স, আরও পরে ডেনমার্ক। সাত বছর ছিলেন ডেনমার্কে। জার্মানি অধিকার করে নিলে ফের পালাতে হলো। ফিনল্যান্ড হয়ে সাইবেরিয়া পাড়ি দিয়ে সমুদ্রপথে সোজা আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া। অতঃপর সাত বছর কাটল মার্কিন ভূমিতেই। অনেক খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বের সঙ্গে আলাপ ও সখ্য হলো। বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন জার্মান-ইহুদি সাহিত্যিক লিওন্ ফয়েখট্হ্বাঙ্গের কি টমাস মান, অভিনেতা চার্লি চ্যাপলিন কি চার্লস লাফটন। রাজনীতি সর্বদাই সঙ্গে ছিল, ফলে শান্তি পাননি আমেরিকাতেও। ১৯৪৭-এ হাউস আন্-আমেরিকান অ্যাক্টিভিটিজ কমিটিতে তার শুনানির পরে তিনি সুইজারল্যান্ড চলে গেলেন এবং সেখান থেকে ১৯৪৮ সালে পূর্ব বার্লিনে। এখানেই পত্নী হেলেন হব্বাইগেলের সঙ্গে 'টেয়াটের আম্ কুর্ফ্যুর শটেন্ডাম' থিয়েটারে প্রতিষ্ঠা করলেন 'বের্লিনে অঁসাঁবল'। অতঃপর যে কয় বছর জীবিত ছিলেন মঞ্চই তার সব সময় হরণ করে নিয়েছিল।

৯.
১৯৩০ সালে ব্রেখট মঞ্চস্থ করেন তার প্রথম কম্যুনিস্ট নাটক দ্য মেজার্স টেকেন। ১৯৩২ সালে তিনি হান্স ইসরাইলের সাথে নির্মাণ করেন প্রথম চলচ্চিত্র স্কুলে ওয়াম্পে। মুক্তির সাথে সাথেই বিতর্কিত এই চলচ্চিত্রকে জার্মানিতে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। হিটলারের নাৎসীবাহিনীর উত্থানের সাথে সাথে ব্রেখট আর সব শিল্পী-সাহিত্যিকের মতোই জার্মানি ছাড়তে বাধ্য হন। তিনি প্যারিসে এসে ঠাঁই নেন। এখানে তার একাধিক নাটক মঞ্চস্থ হয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়। ১৯৩৫ সালের ৮ জুন হিটলার সরকার তার জার্মান নাগরিকত্ব বাতিল করে। এ বছরই নিউইয়র্কে তার আরেক বিখ্যাত নাটক দ্য মাদার মঞ্চস্থ হয়। ইউরোপের বেশ কটি দেশ ঘুরে তিনি এবার পাড়ি জমান আমেরিকাতে। আমেরিকার নানা শহরে তার একাধিক নাটক পেশাদারীভাবে মঞ্চস্থ হয়। নাট্যকার ও পরিচালক হিসাবে তার সাফল্য বাড়তে থাকে। 

১০.
১৯৩৩ সালে নাৎসিদের অত্যাচারে দেশ ছাড়ার পর ব্রেখট বাকী জীবনটা অনেকটা ভবঘুরের মতই দেশ থেকে দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন; নিজের দেশ বলে তার কিছু ছিল না। কিছুদিন (১৯৪৫-১৯৪৭) তিনি হলিউডে কাজ করেন। হলিউডে কাজ করলেও সে জায়গাটি তার পছন্দ হয়নি। পশ্চিমে তিনি নিন্দিত হয়েছিলেন কট্টর মার্ক্সবাদী হিসেবে। সাম্যবাদী সন্দেহে তাঁকে জেরা করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে বের্টোল্ট ব্রেখট প্রথমে প্রাগ শহরে ও পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নেন। ১৯৪৭ সালে মার্কিন-সোভিয়েত ঠান্ডা যুদ্ধের জের হিসেবে ব্রেশ্টকে অন্যান্য অনেক চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বের সাথে মার্ক্সবাদী সাম্যবাদী সন্দেহে জেরা করা হয়। জেরার পরপরই একই দিনে, ৩০শে অক্টোবর, তিনি যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ করেন। ১৯৪৯ সালে ব্রেখট জুরিখ ছেড়ে পূর্ব বার্লিনে চলে আসেন। এখানে তিনি বার্লিনার অঁসম্বল গঠন করেন। ১৯৪৯ সালে পূর্ব বার্লিনে ফেরত আসার পরে সেখানেও মূলধারার বাইরের নাটক লেখার কারণে সন্দেহের শিকার হন।

১১.
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে তিনি জার্মানি ফিরে যান। সেখানে আবার নিজের দল করেন। যুদ্ধত্তোর জার্মানীতে ব্রেখটের নাটক সাফল্যের সাথে মঞ্চস্থ হতে থাকে। ১৯৫১ সালে জার্মানীদের জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন তিনি। ক্রমশ সারা ইউরোপে তার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। একাধিক দেশে তার নাটকগুলো মঞ্চস্থ হতে থাকে। সারা বিশ্ব যখন ব্রেখটকে শ্রদ্ধার সাথে বরণ করতে প্রস্তুত তখন ১৯৫৬ সালের ১৪ আগস্ট তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। কিন্তু তার মৃত্যুর পর তার নাটক যেন আরো বেশি করে ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় থেকে আজ পর্যন্ত বিশ্বের অগ্রসর প্রায় প্রতিটি দেশ ও ভাষাতেই ব্রেখটের নাটক মঞ্চস্থ হতে থাকে। আজও পৃথিবীতে তার অনুসারীর কোন অভাব নেই তাই।

(তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, একজন নাট্যকার অথবা একজন কবি: হায়াৎ মামুদ, দৈনিক সমকাল, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত