জন্মদিনের শুভেচ্ছাঞ্জলি

মিতালী হোসেন

প্রকাশ : ১৪ আগস্ট ২০১৮, ১৬:৪৩

১.
পাঠক বা বন্ধু মহলে তিনি মিতালী হোসেন নামেই সুপরিচিত। রবি ঠাকুর কথিত ‘স্নেহবলে নারী মাতা’র উজ্জ্বলতম প্রতিনিধি মিতালী হোসেন। তিনি স্বপ্ন দেখতে জানেন, দেখাতেও। সামাজিক দায়িত্ব বোধে জাগ্রত বলেই স্বত:প্রণোদিত হয়ে এগিয়ে আসেন অসহায়ের সেবায়। তিনি সাহিত্য সেবক, সাধিকাও। কেবলমাত্র নারী অধিকারই নয়, মানবাধিকারেও সরব তাঁর কণ্ঠ, লেখনি। তিনি ভীষণই পরমত সহিষ্ণু। অকপটে মনের কথাটি নিজেই শুধু বলেন না, অন্যকেও সমভাবে বলতে দেন, মন দিয়ে শোনেনও। তাঁর লেখার সমালোচনাও করা যায় তাই নির্ভয়েই। তাতে সম্পর্কের বিচ্যুতির আশংকা থাকে না। বরং সম্প্রীতি বাড়েই।

২.
টেলিভিশনের উপস্থাপিকা, সুলেখিকা, ভ্রমণ পিপাসু। তাঁর রচনা বিশেষত ভ্রমণ কাহিনি অনেকেরই প্রিয়। তিনি এরই মধ্যে ঘুরে ফেলেছেন সারা বিশ্বের প্রায় ৩৫ টি দেশ। তার মধ্যে ২৪ টি ভ্রমণ নিয়েই লিখেছেন ভ্রমণ কাহিনী। সে সব বইতে তাই পাই সেখানকার মানুষ আর তাদের জীবন্ত ইতিহাসকে। তিনি জীবনানন্দে ঘুরেছেন, লিখেছেনে আপন প্রেরণার টানে এবং বই প্রকাশ করেছেন আলো ছড়াতে। তবে এত সব কিছুর পরও পাঠকের কাছে তার একান্ত চাওয়া, বই পড়ার অভ্যাস ঘরে ঘরে গড়ে উঠুক, বাড়িতে বাড়িতে পাঠাগার হোক। বই পড়া ও মুক্ত আলোচনার নিয়মিত অভ্যাসের মধ্য দিয়ে পরিবারই হোক সুস্থ সংস্কৃতি-কৃষ্টি চর্চার সর্বোত্তম শিক্ষালয়। কারণ বই এবং মুক্তচিন্তা চর্চাই পারে আমাদের এক জীবনে এক হাজার জীবন দেখার সুযোগ করে দিতে। তাই সবারই বই পড়ার ইচ্ছেটা প্রবলভাবেই থাকা উচিত, বইয়ের বিষয় নিয়ে যুক্তি বিবাদ আর আলাপনের অভ্যাসও গড়ে তোলাটা জরুরি। তিনি মনে করেন, এক জীবনে হাজার জীবনের সঙ্গে পরিচয় করায় বই।

৩.
মিতালী হোসেন ১৯৬১ সালের আজকের দিনে সিরাজগঞ্জ শহরের বাসভবনে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা আনোয়ার হোসেন রতু, মাতা সৈয়দা ইসাবেলা। স্বামী খন্দকার মোজাম্মেল হক একজন অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা। পুত্র খন্দকার অমিতাভ ও কন্যা মৌটুসি খন্দকার। শৈশবের দুরন্ত সময়ে দেখেছেন রাজনৈতিক উত্তাল পটপরিবর্তন, দেখেছেন মুক্তিযুদ্ধ এবং নতুন মানচিত্র ও নতুন পতাকা। আজো অন্তরে, অনুভবে গভীরভাবে ধারণ করেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।

৪.
একাত্তরের নির্যাতিত নারীদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রায় সাড়ে চার দশকের একটি জাতীয় দাবি পূরণের পদক্ষেপ নেওয়া হলো। কারণ ১৯৭১ সালে বীরাঙ্গনা নারীরা আমাদের দেশের স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে একটি বিশাল ভূমিকা রেখেছে। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা আমাদের স্বাধীনতা পেয়েছি। শুধু শহীদই নয় বীরাঙ্গনাদের কারণেও আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। তাই আমাদের এই বীরাঙ্গনাকে স্বীকৃতি দেয়া জরুরি ছিলো। শহীদদের কাতারে তাদেরকেও স্বীকৃতির জন্য আইনি কাজ করেছেন যে কয়েকজন, তাদের মধ্যে অন্যতম নাম মিতালী হোসেন। বীরাঙ্গনাদের সমন্বিত তালিকা প্রস্তুত এবং তাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদাসহ মুক্তিযোদ্ধাদের মতো আনুষঙ্গিক সুবিধা নিশ্চিতে নির্দেশনা চেয়ে সিরাজগঞ্জের সালেহা ইসহাক উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রী সংগঠনের সভাপতি মিতালী হোসেন ও বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলীর দায়ের করা ক’বছর আগে রিট আবেদনের শুনানি শেষে হাইকোর্ট রুল জারি করে। রায়ের বাস্তবায়ন ও পরবর্তী প্রক্রিয়া নিয়ে মিতালী হোসেন যে কথাগুলো বলেছিলেন, গুরুত্বের বিবেচনায় তিাঁর বক্তব্যটি তুলে ধরা প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করি। 

তিনি বলেছিলেন, ‘বাহাত্তর-পঁচাত্তর পর্যন্ত সামাজিকভাবে যে পুনর্বাসন চেষ্টা হয়েছিল- বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এই প্রচেষ্টা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের চাওয়া সমাজ তাদের সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করবে। একজন মুক্তিযোদ্ধার চেয়ে দেশ মাতৃকার জন্য তাদের ত্যাগ কোন অংশে কম নয়। সেটা একজন মুক্তিযোদ্ধার চেয়ে অনেক বেশি। সেই যুদ্ধ তারা মুক্তিযুদ্ধের তেতাল্লিশ বছর পরও করে যাচ্ছে। বীরঙ্গনা শব্দটি খুবই নেতিবাচক অর্থে আমাদের দেশে ব্যবহৃত হয়েছে। আমরা তাদেরকে বীরাঙ্গনা বলে হেয় প্রতিপন্নের চেষ্টা করি। অথচ তারা নিজেরাই একেকজন বীর। যে কারণে আমরা তাদের জন্য মুক্তিযোদ্ধার সম্মান ও সম্মানী চাই। এ কারণেই আদালতের দ্বারস্থ হয়েছি। আদালত ন্যায্য দাবির পক্ষেই রায় দিয়েছেন। সরকার পক্ষও এ ব্যাপারে আপত্তি করেননি। আমরা বিশ্বাস করি, সরকারেরও এ বিষয়ে আপত্তি থাকার কথা নয়। ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিকভাবে মনে করি বঙ্গবন্ধু কন্যা যখন ক্ষমতায় তখন এটা না হওয়ার কোন কারণ নেই। এটা বাস্তবায়নে রাষ্ট্রকেই পদক্ষেপ নিতে হবে। আমরা চাই মৃত্যুর পরও তাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হোক।’ মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাঁর গভীর আবেগ ও ভালোবাসা প্রকাশিত হয়েছে বলেই প্রয়োজনীয় ভুমিকা পালনেও দ্বিধা করেননি বলেই আজকে সরকার একাত্তরের নির্যাতিত নারীদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

৫.
এখানে উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, লেখিকা মিতালী হোসেন তাঁর ‘একাত্তরে আমি’ গ্রন্থেও খুঁজে পাই মুক্তিযুদ্ধের অন্য ইতিহাসকে, যেখানে তিনি গণমানুষের ইতিহাস তুলে ধরেন। একাত্তর ও মুক্তিযুদ্ধের উপর ব্যাক্তিমানুষের উপলব্ধি, আবেগ ও ঘটনাচক্র নিয়ে চমৎকার একটি বই। এই বইতে আমরা দেখি একজন দ্বাদশী কিশোরীর চোখে একাত্তর ও মুক্তিযুদ্ধের উপলব্ধি, দেশত্যাগ, বাঙলা-বাঙালির দু:খ-কষ্ট-ত্যাগ, আবেগ, উৎকন্ঠা ও নানান ঘটনা। একাত্তরকে গণমানুষ কিভাবে দেখেছে, যাপন করে এসেছে, বাঙলার গণমানুষকে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী, বিহারী ও তাদের বাঙালি দোসর জামাত-ছাত্র সংঘ-মুসলিম লীগ-রাজাকার-আল বদর-আল শামসদের হাতে কতটা নির্মমতা সহ্য করতে হয়েছে, ব্যাক্তি-পারিবারিক জীবনে একাত্তরের উপলব্ধি, ফলাফল ও প্রভাব কেমন ছিল, তার বর্ণনাও ইতিহাসের অংশ। গণমানুষকে নিয়ে লেখা মিতালী হোসেনের এরকমই একটি আত্মজীবনীমূলক বই ‘একাত্তরে আমি’।

(সংক্ষেপিত)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত