জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

শিল্পের সারথি শিল্পী মুর্তজা বশীর

প্রকাশ : ১৭ আগস্ট ২০১৮, ১৭:০৩

১.
বাংলাদেশের একজন প্রধানতম চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর। করিতকর্মা প্রতিভা হিসেবে পরিচিত এই শিল্পী চিত্রশিল্পে নিজস্ব ধরণ প্রতিষ্ঠা করেছেন। সম্মানজনক পেশাজীবনের মধ্য দিয়ে কাজকে ক্রমশ নিয়ে গেছেন বিমূর্ত বাস্তবতার দিকে। প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী, কার্টুনিস্ট ও ভাষা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী মুর্তজা বশীরের ৮৭তম জন্মদিন আজ। ১৯৩২ সালের ১৭ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার বাবা উপমহাদেশের প্রখ্যাত ভাষাবিদ জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্। শিল্পের সারথি শিল্পী মুর্তজা বশীরের জন্মদিনে তাঁকে জানাই জন্মদিনের শুভেচ্ছা। বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব- একাধারে চিত্রকর, কবি, শিক্ষক, লেখক, চলচ্চিত্রনির্মাতা, শিল্পনির্দেশক, গবেষক ও মুদ্রাবিশারদ। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার কারণে তাকে দেশ ত্যাগ করতে হয়। এত পরিচয় নিয়েই মুর্তজা বশীর বাংলাদেশের শিল্পকলার আকাশে উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। বটবৃক্ষ হয়ে আজও ছায়া দিচ্ছেন অনুজসমদের। নিজের জীবন, আন্দোলন, সংগ্রাম, প্রতিবাদ আর নিজের সৃষ্টিকে এ দেশের সঙ্গে- এ দেশের মানুষের সঙ্গে শিল্পী মুর্তজা বশীরের মিলিয়ে দেওয়া সম্পূর্ণভাবে অনন্য। এ যাত্রা তাঁর নিজেরই যাত্রা। তাঁর এ যাত্রা- আমাদের নিজেদের চেনারও যাত্রা। এ যাত্রা আমাদের নিজ যোগ্যতায় বৈশ্বিক হয়ে ওঠার। শিল্পী মুর্তজা বশীর আমাদের আধুনিক বাংলাদেশ গঠনের দিশারীদের একজন। তিনি আন্দোলনের জন্য অনেক কার্টুন ও ফেস্টুন এঁকেছেন। তার কার্টুনগুলো দেশ ও ভাষার জন্য লড়াই এবং ত্যাগের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। মুর্তজা বশীরের চিত্রকলায় নাগরিক জীবন থেকে বেশি এসেছে গ্রামীণ জীবনের কথা। ১৯৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় স্ব্বাধীনতার দাবিতে আয়োজিত বাংলাদেশ চারু ও কারুশিল্পীদের মিছিলের অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি। শিল্পী মুর্তজা বশীরের জন্মদিনে তাঁর জন্য শুভ কামনা নিরন্তর। চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব জহির রায়হান এই কীর্তিমান মুর্তজা বশীরের গল্পগ্রন্থ ‘কাঁচের পাখির গান’-এর ভূমিকায় লিখেন এ ক’টা লাইন, ‘মুর্তজা বশীর একজন নিঃসঙ্গ মানুষ। নিঃসঙ্গ চিত্রকর। নিঃসঙ্গ লেখক। তাঁর জীবনের এই নিঃসঙ্গতার অন্ধকারের মধ্যে থেকেও তিনি চান হীরের মতো উজ্জ্বল দ্যুতি। তিনি মানুষকে ঘৃণা করেন। ঘৃণা করেন বলেই হয়তো তাদেরকে গভীরভাবে ভালোবাসতেও জানেন। আর এটাই হচ্ছে মুর্তজা বশীরের রচনার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য।’

২.
মুর্তজা বশীরের অনন্য গুণাবলির কথা হয়তো অনেকেই জানেন না, উপন্যাস রচনায় পুঙ্খানুপুঙ্খ নির্মাণ শৈলী এবং ব্যতিক্রম বিষয়বস্তুর জন্য তিনি প্রশংসিত হয়েছেন। কলকাতার সমসাময়িক জীবন এবং সামাজিক সমস্যা নিয়ে ১৯৫৪ সালে তিনি ’আল্ট্রামেরিন’ শিরোনামের একটি উপন্যাস লেখেন। ১৯৬৯ সালে বশীর ছোটগল্প সংকলন ’কাচঁ এর পাখির গান’ প্রকাশ করেন। ’মিতার সঙ্গে চার সন্ধ্যা’ ও ’অমিতাক্ষর’ শিরোনামের আরো দুটি উপন্যাস লিখেছেন তিনি। ’মুর্তজা বশীর: মূর্ত ও বিমূর্ত’ হল তার নির্বাচিত কাজের সংকলন। ১৯৬৪ সালে নির্মিত বাংলা ছবি ’নদী ও নারী’ এর চিত্রনাট্যকার এবং শিল্প পরিচালক ছিলেন তিনি। ১৯৬৫ সালে নির্মিত ’ক্যাসে কাহো’ উর্দু ছবির শিল্প পরিচালক ছিলেন। সমকালীন জীবন ও সমস্যাকে ধারাবাহিকভাবে চিত্রায়িত করেছেন তিনি, এমনকি এখনো অনুসন্ধান করে চলেছেন শিল্পের বিচিত্র দিক। বার্ধক্য তাকে ছুঁতে পারেনি। অতল জীবন তাঁর। চুরাশি পেরিয়ে এখনো সক্রিয় আছেন মুর্তজা বশীর। নিজের অভিজ্ঞতা বিলিয়ে যাচ্ছেন তরুণদের মধ্যে। আজো পত্রিকার পাতা নান্দনিক হয়ে ওঠে তাঁর তুলির টানে। এখনো রাঙিয়ে তুলছেন ক্যানভাস নতুন শিল্প-আঙ্গিকে। অক্লান্ত তিনি। শিল্পের সারথি বলেই তাঁর দীর্ঘ জীবনটি নিবেদিত শিল্পের করতলে। তিনি সবসময়ই তাঁর সময় থেকে অগ্রসর। অগ্রসর যে সে সম্পর্কে তিনি পুরোপুরি সচেতনও। এখানে তুলে দেয়া হলো নিজের সম্পর্কে মুর্তজা বশীরের মূল্যায়ন- আমি যখন ট্রান্সপারেন্সি বা স্বচ্ছতা নিয়ে কাজ করেছি, তখন সেটা লোকে বোঝেনি। আমি যখন ‘দেয়াল সিরিজ’ নিয়ে কাজ করলাম, তখনো প্রশ্নবিদ্ধ হলাম। স্বাধীনতার পরে যখন এপিটাফ ফর মার্টিয়াস করলাম আমাকে শুনতে হয়েছে, বশীর অ্যানাটমির বই থেকে আঁকছে। সেসময় আমি শিল্পকলা একাডেমির পুরস্কার পেয়েছিলাম বলে অনেকে ছবি নামিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু আজকে সেসব ছবি কি আমার কাছে আছে? না, একটাও নেই। লোকে খোঁজে, আপনার দেয়াল বা এপিটাফ সিরিজের কাজ আছে? আমি কখনোই ক্রেতার মুখের দিকে তাকিয়ে ছবি আঁকি না।

৩.
সম্প্রতি বাবা বহুভাষাবিদ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে নিয়ে লিখলেন দীর্ঘ প্রবন্ধ। তিনি সেখানে দেখিয়েছেন, মুসলমান পরিচয় ও বাঙালি পরিচয়কে একসঙ্গে করে তাঁর বাবা কীভাবে বাঙালি সমাজের সংস্কারকরূপে আবির্ভূত হয়েছেন। বর্তমানে তাঁর বাবার জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে তিনি গবেষণা কাজে নিয়োজিত আছেন। আগামীতে একক চিত্রপ্রদর্শনী করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। মুর্তজা বশীর তাঁর জীবনের শুরুর পর্বে বাঙালি পরিচয়ের মধ্যে পাশ্চাত্যের ধারণাকে আদর্শ মেনেছিলেন। তবে বাঙালিত্বের পরিচয় ধীরে ধীরে যেভাবে তাঁর জীবনে তার সৃজনশীলতায় চলে এসেছে- এ এক ধারাবাহিক চর্চারই ইতিহাস। বামপন্থি রাজনীতির আদর্শে দীক্ষা নিয়ে তিনিই জড়িয়েছিলেন ভাষা আন্দোলনে। ছবি এঁকে বলেছেন, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। ‘রক্তাক্ত ২১শে’ শীর্ষক এ ছবি ভাষা আন্দোলন নিয়ে আঁকা প্রথম ছবি। আবার গত শতকের ষাটের দশকে তাঁর আঁকা ‘দেয়াল’ সিরিজ সেই সময়ের সমাজের দমবন্ধ অবস্থার চিহ্নই বহন করে। এ পর্ব দিয়ে তিনি শুরু করলেন তাঁর ‘বিমূর্ত বাস্তবতা’ ধারণা ও শৈলীর প্রকাশ। ‘দেয়াল’ সিরিজ সম্পর্কে কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ লিখেছিলেন, ‘বশীরের দেয়াল বিমূর্ত নয়, কল্পনাপ্রসূতও নয়। এখানে দৃশ্যমান বস্তুর প্রতিনিধিত্ব করা হয়েছে যা দৈনন্দিন জীবনে অনেকেরই অভিজ্ঞতার বিষয়। কিন্তু যা কেউ সচেতন হয়ে দেখে না বা মনে রাখে না।’

৪.
একাত্তরে তিনি ‘স্বা-ধী-ন-তা’ মিছিলে নেতৃত্বদানকারীদের অন্যতম। এর আগে ১৯৭১ সালের ১১ মার্চ তৎকালীন পাকিস্তানের মিনিস্ট্রি অব ইনফরমেশন অ্যান্ড সায়েন্টিফিক অ্যাফেয়ার্স আয়োজিত আরসিসিভুক্ত দেশের শিল্পীদের প্রদর্শনী বর্জন করেন। এ সময় তিনি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর বর্বরোচিত হামলার প্রতিবাদে পাকিস্তান সরকারের খেতাবপ্রাপ্তদের খেতাব বর্জনের আহ্বান জানান। ১৯৭২ সালে ‘বাংলাদেশ ১৯৭১’ শিরোনামে এঁকেছিলেন ছয়টি রেখাচিত্র। পাকিস্তানকে ডায়নোসোর রূপে প্রতিপন্ন করে তিনি দেখিয়েছেন- কীভাবে এ দেশের নারী-পুরুষ ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী নির্বিশেষে এর বিরুদ্ধে লড়াই করছে। নিজের জীবনের প্রতি মায়া থেকেই পরিবার নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পালিয়ে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে আঁকলেন মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের শ্রদ্ধা জানিয়ে ‘শহীদ শিরোনাম’ সিরিজ। এ সম্পর্কে চলচ্চিত্র পরিচালক আলমগীর কবীর লিখেছিলেন, ‘এপিটাফ সিরিজে বশীর তাঁর স্বভাবসুলভ সৃজনশীলতা আর উদ্ভাবনী প্রতিভায় আমাদের রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে অমর করতে চেয়েছেন। পাথরের নুড়ির ফর্মে তিনি দেখতে পান মানুষের অঙ্গ-প্রতঙ্গের প্রতিচ্ছবি, যার সাহায্যে শহীদদের অকুতোভয় আত্মার স্থাপনা হয়েছে চিরন্তনতার ব্যাঞ্জনায়।’ ১৯৭৮ সালে তাবিজ, সোলেমানি নকশা, জায়নামাজে থাকা বিভিন্ন ফর্মের অনুপ্রেরণায় আঁকলেন ‘জ্যোতি’ নামে এক সিরিজ। এ সম্পর্কে প্রফেসর এমিরেটাস আনিসুজ্জামান বলেছেন, ‘এসব ছবিতে তিনি ধরতে চেয়েছেন এদেশীয় মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাসগত সব জনপ্রিয় অভিব্যক্তি।’

৫.
১৯৫০ সালে কমিউনিস্ট পার্টি আহূত ময়মনসিংহের হাজং, ভারতের তেলেঙ্গানা ও পশ্চিমবঙ্গে দক্ষিণ ২৪ পরগনার কাকদ্বীপে মুক্ত এলাকা দিবস- এই প্রচারাভিযানকালে তিনি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ওই সময় তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বিচারাধীন আসামিরূপে পাঁচ মাস ছিলেন কারারুদ্ধ। ১৯৮২ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সমিতির সভাপতি হিসেবে তিনি স্বৈরাচারী শাসকের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ডাকা ধর্মঘটের নেতৃত্ব দেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এ ব্যাপারে সর্বপ্রথম অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।

৬.
১৯৮০ সালে তিনি জাপান ভ্রমণে যান। ঘোর কাটল তাঁর জাপানের সংস্কৃতি দেখে। বললেন, ‘মনে হলো আমি ময়ুরপুচ্ছধারী কাক। আমি কে? আমার উত্স কোথায়?’ জানতে শুরু করলেন নিজের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে। টেরাকোটা, প্রাচীন শিলালিপি ও মুদ্রা নিয়ে গবেষণায় মগ্ন হয়ে আরো বিশেষভাবে জানলেন নিজেকে। পালযুগের চিত্রকলা, কালিঘাট চিত্রকলার আঁকার পদ্ধতি, প্রাক রেনেসাঁর ছবি থেকে প্রেরণা এবং বাইজেন্টাইন শৈলীর অনুসরণে আঁকলেন এ অঞ্চলের নাগরিক নারীদের গত শতকের নব্বইয়ের দশকে। বাংলাদেশের চিত্রকলায় তাঁর আঁকা নারী একদম স্বকীয়- সবার থেকে আলাদা। ষাটের দশকে ও ইতালিতে শিক্ষাগ্রহণের সময় তিনি আঁকার জন্য বেছে নিয়েছিলেন সাধারণ মানুষদের। তাদের নিত্যজীবন-আচরণ তাঁর কাছে ছিল প্রেরণা। আর কবিতা-গল্পে লিখেছেন এ দেশের মধ্যবিত্ত জীবনের চালচিত্র। যারা জীবনপণ সংগ্রাম করে বাঁচে আপন মহিমায়। আবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বা সিলেটে বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনে করা ম্যুরালে আঁকলেন চিরায়ত বাংলার চিত্র।

৭.
বাবা উপমহাদেশের প্রখ্যাত ভাষাবিদ জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্। মা মরগুবা খাতুন। নয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি সপ্তম পুত্র ও কনিষ্ঠ সন্তান। যে শিশুটি জন্ম নেয় ১৯৩২ সালের ১৭ আগস্ট, বুধবার ঢাকায়। জন্মের সময় পিতা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ জন্মক্ষণ ও নাম স্বহস্তে লিপিবদ্ধ করেন। পিতৃপরিচয়েই তিনি খ্যাতিমান হতে পারতেন অনায়াসে। মুর্তজা বশীর সে পথে হাঁটেননি। বাবা নবজাতকের নাম রাখলেন আবুল খয়ের মুর্তজা বশীরুল্লাহ। পরে বাবার পরিচয়ে পরিচিত হবেন না বলেই তিনি নামের সামনের ও পেছনের অংশ ছেঁটে নাম ধারণ করলেন- মুর্তজা বশীর। ছোটবেলায় মুর্তজা বশীর ছিলেন খুবই দুরন্ত। জন্মের আগেই তাঁর একটি হাত মায়ের গর্ভবাস থেকে বেরিয়ে এসেছিল। ফলে তাঁর মাকে দু’রাত খাটের স্ট্যান্ড ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল। এজন্য মা বলতেন, তুই জন্মের আগেও জ্বালিয়েছিস, এখনো জ্বালাচ্ছিস। বাবাকে অনেকেই প্রশ্ন করেছেন এতগুলো সন্তান জন্মদানের বিষয়ে। তিনি এর উত্তরে বলতেন, শেষেরটা যে জিনিয়াস হবে না, কে জানে?

৮.
শৈশবে বাবার পাঠাগারের প্রতি মুর্তজার ছিল তীব্র আকর্ষণ। বিশেষ করে মাসিক বিচত্রা, ভারতবর্ষ, বঙ্গশ্রী, প্রবাসে, মডার্ন রিভিউ প্রভৃতি মাসিক পত্রিকা বা গ্রন্থে নন্দলাল বসু, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুধীন খস্তগির, সারদাচরণ, বরদাচারণ উকিল প্রমুখের ছবির প্রতি ছিল বিশেষ টান। এছাড়া এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিয়ায়—মাতিস, মাইকেলেঞ্জেলো, ভ্যান গগ, গগা, পিকাসো, এঁদের ছবি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতেন। ফলে ১৯৫৬ সালে ইতালির ফ্লোরেন্সের উপিজি গ্যালারি কিংবা ১৯৫৮ সালে প্যারিসের ল্যুভর মিউজিয়ামে এঁদের চিত্রকর্ম দেখে মনে হয়েছিল সবই তাঁর চেনা। বইয়ে চিত্রকলার রঙিন ছবি ও অলঙ্করণ। পরম আগ্রহে তিনি বইয়ের ছবিগুলো বারবার দেখতেন এবং আঁকার চেষ্টা করতেন।

৯.
তাঁকে নিয়ে অন্য আরেকটি গল্প, ১৯৫৪ সালে রমনা পার্কে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায় ঘুরতে যান মুর্তজা বশীর, সঙ্গে প্রিয় বন্ধু কাইয়ুম চৌধুরী। মুর্তজা বশীরের শারীরিক গঠন ৫ ফুট, বিপরীতে কাইয়ুম চৌধুরী বেশ লম্বা—৫ ফুট ৭ ইঞ্চির রোগা-পাতলা এক তরুণ। ফলে দুজনকে একসঙ্গে নজরে পড়ার মতো। মেলায় শ্যামলা রঙের একটি মেয়ে, চোখে কাজল, মেয়েটিকে দেখে তরুণ বশীরের ভালো লাগে। সে মেয়েটির পিছু নেয়, এ দোকান থেকে সে দোকানে। তখন মেয়েটির বান্ধবী বলে, দেখ দেখ ছেলেটি আবার এসেছে। বান্ধবীর কথা শুনে মেয়েটি মুর্তজা বশীরের দিকে তাকিয়ে মাটিতে থুথু ফেলে। চোখ-মুখ বাঁকা করে বলে, বেটে কোথাকার। মুর্তজা বশীর সেই স্মৃতিচারণ করে বলেন, এই প্রথম দেখলাম, একটি রমণীর চেহারা ঘৃণায় কতটুকু কুৎসিত হতে পারে। প্রতিজ্ঞা করলাম, আমি আমার এই অসৌন্দর্য শিল্পের গরিমা দিয়ে ঢেকে দিব। এটাই তাঁর শিল্প-জীবনের বড় প্রেরণা হিসেবে পরবর্তী সময়ে ভূমিকা রেখেছে। আর তিনি সারা জীবন জেদটা বহাল রেখেছেন। সে জেদ আরো এবং আরো নতুন শিল্প সৃষ্টির।

১০.
শৈশবে ছবি আঁকার প্রতি আকর্ষণ থাকলেও, ঠিক শিল্পী হয়ে ওঠার বাসনা তাঁর ছিল না। চারুকলায় তাঁর পড়াশোনার শুরু কমিউনিস্ট পার্টির দিকনির্দেশনায়। ১৯৪৭ সালে মুর্তজা যখন পিতার কর্মস্থল বগুড়ার করনেশন ইনস্টিটিউটে নবম শ্রেণির ছাত্র তখনই তিনি আকৃষ্ট হন রাজনীতিতে। কমিউনিস্ট পার্টি অফিসের জন্য মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিনের ছবি আঁকতে আঁকতে অঙ্কনে হাতেখড়ি। রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখতেন ব্যানার শিল্পীদের গ্রাফ করে ছবি আঁকার কৌশল। তখন তিনি কমিউনিস্ট পার্টি সমর্থিত ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে যুক্ত। কমিউনিস্ট পার্টির প্রখ্যাত নেতা ভবানী সেন ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর বগুড়ায় পার্টি অফিসে বশীরের আঁকা ছবি দেখে তাঁর অটোগ্রাফ বইতে লিখেন—আর্টিস্টের কাজ হলো শোষিত জনগণের ভাব ও দুঃখ-দুর্দশাকে চিত্রের ভেতর দিয়ে এমনভাবে ফুটিয়ে তোলা যাতে সমাজে সে আর্ট নবজীবন সৃষ্টি করতে পারে।’ এই বাণী কিশোর বশীরকে আলোড়িত করে, ব্রত হিসেবে নেন চিত্রশিল্পী হওয়ার। সেই ব্রত তিনি এখনো পালন করে চলেছেন। 

১১.
১৯৪৯ সালে ঢাকা গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টস (বর্তমান চারুকলা ইনস্টিটিউট)-এ দ্বিতীয় ব্যাচের শিক্ষার্থী হিসেবে ভর্তি হন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ তাঁর সময়ের এক অগ্রসর আধুনিক মানুষ হওয়া সত্ত্বেও চিত্রশিল্পী পেশার অনিশ্চয়তার কারণে প্রথমে তিনি পুত্রের এ ইচ্ছা ঠিক মেনে নিতে পারছিলেন না। তবে শেষ পর্যন্ত অপত্য স্নেহের কাছে পিতার অনিচ্ছা টিকল না, পুত্রকে চারুকলায় পড়ার অনুমতি দিয়ে দিলেন। এখানে উল্লেখ্য, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ যেহেতু ধর্মভীরু ছিলেন, ফলে অনেকেই ভাবতেন, তাঁর ছবি আঁকার প্রতি আগ্রহ নেই। ১৯২৮ সালে তিনি যখন প্যারিসের সরবন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করে দেশের উদ্দেশে যাত্রা করেন, ভারতীয় ছাত্র সমিতি ল্যুভর মিউজিয়ামের দুই খণ্ডের রঙিন ক্যাটালগ উপহার দেয়। কেননা তিনি ছিলেন শিল্পপ্রেমিক। এই দুই খণ্ডের ক্যাটালগ বশীরের আগ্রহের কেন্দ্রে ছিল। ১৯৫৪ সালে মুর্তজা বশীর পাঁচ বছর মেয়াদি শিল্পশিক্ষা শেষ করে প্রথম বিভাগে পাশ করেন। সহপাঠী হিসেবে পেয়েছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী, রশীদ চৌধুরী, আব্দুর রাজ্জাকসহ খ্যাতিমান অনেককে। প্রথম থেকেই বশীর সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষকে তাঁর চিত্রকলার বিষয়বস্তু করেছেন।

১২.
ছাত্রজীবনেই প্রথম কারাবরণের অভিজ্ঞতা হয় মুর্তজা বশীরের, সময়টা ১৯৫০। হাজংবিদ্রোহের সময় রাস্তার দেয়ালে পোস্টার সাঁটায় মুর্তজা বশীর পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের ১৪ নাম্বার সেল, যার কাব্যিক নাম ছিল শকুন্তলা ফাটক, সেখানে তিনি বিচারাধীন বন্দি হিসেবে ছিলেন। সেখানে নিরাপত্তা বন্দি হিসেবে অবস্থান করছিলেন- বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ আবদুল্লাহ আলমুতী শরফুদ্দীন, শ্রমিকনেতা আবদুল বারি, আবুল আকছাদ, ক্ষেতমজুর নেতা মনু মিয়া প্রমুখ। জেলে বসেই মুর্তজা বশীরের কবিতা লেখার সূচনা, সেই সঙ্গে কিছু ছোটগল্পও লিখে ফেলেন। পাঁচ মাস জেলে কেটে বেরিয়ে ছবি আঁকার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। পরে জয়নুল আবেদিনের পরামর্শে আবার চিত্রকলায় ফিরে আসেন।

১৩.
১৯৫৪ সালে পরীক্ষার ফল প্রকাশের আগেই তিনি কলকাতায় আশুতোষ মিউজিয়ামে চার মাসের একটি আর্ট অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্সে যোগ দেন। বশীর এখানেই প্রথম পাশ্চাত্য আর্টের ইতিহাস, ভারতে শিল্পের ইতিহাস, শিল্পের তত্ত্ব ও নান্দনিকতা বিষয়ে শিক্ষার সুযোগ পান। এখানে তিনি অর্দ্ধেন্দু কুমার গাঙ্গুলী, বাগেশ্বরী অধ্যাপক কল্যাণকুমার গাঙ্গুলী, মিউজিয়াম কিউরেটর দেবপ্রসাদ ঘোষ, ভাস্কর প্রদোষ দাশগুপ্ত প্রমুখ গুণী ব্যক্তিদের শিক্ষক হিসেবে পান। আর্ট কলেজ থেকে পাশ করার পর ১৯৫৫ সালে বছরখানেক নবাবপুর সরকারি স্কুলে ড্রয়িং শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। সেখানে পঞ্চম শ্রেণিতে তাঁর ছাত্র ছিলেন বর্তমান পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, কালি ও কলম সম্পাদক আবুল হাসনাত প্রমুখ। এরপর ১৯৫৬ সালে মুর্তজা বশীর উচ্চতর শিক্ষার জন্য পিতার অর্থায়নে ইতালির ফ্লোরেন্সে যান। আকাদেমিয়া দ্য বেল্লি¬ আর্টিতে এক বছর চিত্রকলা এবং আরেক বছর ফ্রেসকো নিয়ে পড়াশোনা করেন। ফ্লোরেন্সে রেনেসাঁর ঐতিহ্য তাঁকে প্রভাবিত করে। এ সময় অধ্যাপক কাপুকিনি ছিলেন তাঁর শিক্ষক। তাঁর কাজে ফিগারের সরলীকরণ ও ন্যূনতম রঙ ব্যবহারের শৈলী বশীরকে আকৃষ্ট করে।

১৪.
১৯৭১ সালের নভেম্বরের প্রথমদিকে সপরিবারে প্যারিসের উদ্দেশে দেশ ত্যাগ করেন শিল্পী। ইতালিতে দু’বছর কাটিয়ে ১৯৫৮ সালের শেষদিকে মুর্তজা বশীর লন্ডনে আসেন। লন্ডনে তিনি স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য যান কিন্তু ছ’মাস কাটিয়ে বাবার আদেশে দেশে ফিরতে বাধ্য হন। লন্ডনে জীবিকা নির্বাহের জন্য নানা কাজ করতে হতো বলে তেমন একটা ছবি আঁকতে পারেননি। এ সময় তিনি বিবিসি’র বাংলা অনুষ্ঠান ‘আন্জুমান’-এ খবর ও অন্যান্য কথিকায় অংশগ্রহণ করেন এবং সেসময় তিনি লন্ডন প্রবাসী বন্ধু ফজলে লোহানীর উত্সাহে লাইব্রেরিতে বই পড়েছেন আর এভাবেই সমসাময়িক ইংরেজি সাহিত্য সম্বন্ধে তাঁর আগ্রহ জন্মায়।

১৫.
দেশে ফেরার পর ঢাকায় চাকুরি না পাওয়ায় ভাগ্যান্বেষণে করাচি যান তিনি। করাচি তখন পাকিস্তানের রাজধানী, সব সুযোগ-সুবিধা সেখানেই। প্রথমে কিছুদিন তাঁর কাটল বন্ধু নাট্যকার সাঈদ আহমেদের সঙ্গে সামরিক অফিসারদের সার্ভিসেস ক্লাবে। আমেরিকান ফ্রেন্ডস অব মিডল ইস্ট সংস্থার পাকিস্তান প্রধান মি. ওয়াটসনের সঙ্গে পরিচয় হওয়ায় তাঁর একক প্রদর্শনী আয়োজনের সুযোগ ঘটে। ১৯৫৯-এর মে মাসে ওই সংস্থার উদ্যোগে তাঁদের অফিসে ফ্লোরেন্স ও করাচিতে আঁকা বশীরের ২৪টি ছবি নিয়ে একক চিত্রপ্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। উদ্বোধন করেন তদানিন্তন শিক্ষামন্ত্রী হাবিবুর রহমান। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তাঁর বাবা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ উপস্থিত ছিলেন। এবং তিনি শিক্ষামন্ত্রীকে তাঁর ভিজিটিং কার্ড পাঠান, যেখানে শিল্পী মুর্তজা বশীরের কথা উল্লেখ ছিল। করাচিতে এটি ছিল কোনো বাঙালি শিল্পীর প্রথম একক আয়োজন। সেই সময় তাঁর কাজ শিল্পী ও শিল্পের সমঝদারদের মধ্যে বেশ আলোচিত হয়। ১৯৫৮ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকায় প্রেসক্লাবে ফ্লোরেন্স ও করাচিতে আঁকা ২০টি ছবি নিয়ে তাঁর পরবর্তী প্রদর্শনীর আয়োজন হয়। প্রদর্শনী চলাকালে লেনিন পুরস্কারপ্রাপ্ত বিশিষ্ট উর্দুকবি ও শিল্পরসিক ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ ঢাকা এসেছিলেন। তিনি তখন পাকিস্তান আর্টস কাউন্সিল লাহোর শাখার সচিব ছিলেন। বশীরকে তিনি লাহোরে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। তাঁর আমন্ত্রণে বশীর লাহোরে গেলেন। ১৯৬০ সালের জানুয়ারিতে পাকিস্তান আর্টস কাউন্সিল লাহোরের ‘আল হামরায়’ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। প্রদর্শনীর শিরোনাম ছিল—‘পেইন্টিংস, ড্রয়িং অ্যান্ড লিথোগ্রাফস বাই মুর্তজা বশীর’।

১৬.
মুর্তজা বশীর তাঁর কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৮০ সালে একুশে পদক, ১৯৭৫ সালে শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৮৯ সালে বাংলা ১৪০০ বছর উপলক্ষে চট্টগ্রাম আইনজীবী সহকারী সমিতি কর্তৃক সম্মাননা, ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম ইয়ুথ কয়ার প্রদত্ত একুশে মেলা পদক, ২০০৩ সালে সুলতান স্বর্ণপদক, ২০০৭ সালে কবি চন্দ্রাবতী স্বর্ণপদকসহ আরও বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার এবং সম্মান অর্জন করেছেন তিনি। তিনি বিভিন্ন চারুকলা প্রদর্শনীতে জুরি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ ও বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য।

১৭.
১৯৬২ সালে শিল্পী মুর্তজা বশীর ত্রিশ বছর বয়সে বিয়ে করেন। তাঁর স্ত্রীর নাম আমিনা। তাদের দুই কন্যা মুনিরা যুঁই ও মুনিরা যূথি এবং একমাত্র পুত্র মেহেরাজ যামী। মুর্তজা বশীরের ভাষায়, আমার দুই মেয়ে এক ছেলে। ছেলেমেয়েরাও যার যার সংসারে ব্যস্ত। শুধু বড় মেয়েটাই কাছাকাছি থাকে। ছোট মেয়ে থাকে চট্টগ্রামে, ব্যাংকার। ছেলেটা ব্যাংকে চাকরি করে। কিন্তু দেশ নিয়ে সে হতাশ। আমেরিকা চলে যেতে চায়। জীবনসঙ্গিনী ছেড়ে যাওয়ার পর এক বছরেরও বেশি সময় ধরে শিল্পী মুর্তজা বশীরের জীবন পুরোপুরি বদলে গেছে। নিয়ম করে প্রতি শুক্রবার স্ত্রী আমিনা বশীরের সমাধি জিয়ারত করতে যান। এর মধ্যেই স্ত্রীকে বিষয় করে আঁকা বিভিন্ন সময়ে শিল্পীর ১২টি রেখাচিত্র এবং রেখাচিত্র থেকে স্থানান্তর করা সেরিগ্রাফি নিয়ে প্রদর্শনীর আয়োজন করে গ্যালারি কায়া। 

১৮.
১৯৬৪ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত চলচ্চিত্রের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন মুর্তজা বশীর। চলচ্চিত্রে তিনি সমাজবাস্তবতা ও শিল্পিত রুচির স্বাক্ষর রেখেছেন। ‘নদী ও নারী’র সঙ্গে তিনি আদ্যোপান্ত জড়িয়ে ছিলেন চিত্রনাট্য ও সংলাপ লেখক, শিল্প নির্দেশক ও প্রধান সহকারী পরিচালক হিসেবে। কারওয়াঁ চলচ্চিত্রের কাহিনি, চিত্রনাট্য ও সংলাপ তাঁর লেখা। ‘ক্যায়সেকহু’ চলচ্চিত্রের শিল্প নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। এসবের পূর্বে ১৯৬১ সালে লাহোরে থাকাকালীন চলচ্চিত্রকার ডাবি¬উ. জেড. আহমেদের সহকারী রূপে চাকুরিতে নিয়োজিত ছিলেন।

১৯.
মুর্তজা বশীর মূলত চিত্রশিল্পী হলেও সংস্কৃতির অন্যান্য শাখায়ও তিনি বিচরণ করেছেন। বিশেষ করে সাহিত্য সাধনায় এবং চলচ্চিত্রশিল্পে তিনি অনেকটা সময় সক্রিয় থেকেছেন। চিত্রকলায় তিনি বাস্তববাদী ও সমাজমনস্ক হলেও সাহিত্যে তিনি অনেক রোম্যান্টিক। তবে তাঁর ছোটগল্পের ক্ষেত্রে সামাজিক দায়বদ্ধতা ও সমাজবাস্তবতার প্রাধান্য দেখা যায়। তাঁর উল্লে¬খযোগ্য সাহিত্যকর্ম হচ্ছে—গল্পগ্রন্থ ‘কাঁচের পাখির গান’ (১৯৬৯), উপন্যাস ‘আলট্রামেরিন’ (১৯৭৯), কবিতাগ্রন্থ- ‘এসরেণু’ (১৯৭৬), ‘তোমাকেই শুধু’ (১৯৭৯) এবং ‘এসো ফিরে অনসূয়া’ (১৯৮৫), নির্বাচিত রচনা ‘মুর্তজা বশীর : মূর্ত ও বিমূর্ত’ (২০০১) ও গল্পসমগ্র। মুদ্রা গবেষক হিসেবেও তাঁর খ্যাতি রয়েছে। ১৯৮৯ সালে জার্নাল অর ল্যুমেসমেটিক সোসাইটি অব ইন্ডিয়া নামে বেনারস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত জার্নালে তাঁর সুলতানি আমলের মুদ্রা সংক্রান্ত ৬টি প্রবন্ধ ছাপা হয়। হাবশী সুলতানদের বিষয়ে বিশদ কোনো প্রকাশনা না থাকায় তিনি এ বিষয়ে উত্সাহী হয়ে লেখেন—যা ২০০৪ সালের একুশে বইমেলায় ‘মুদ্রা ও শিলালিপির আলোকে বাংলার হাবশী সুলতান ও তত্কালীন সমাজ’ গ্রন্থরূপে প্রকাশিত হয়েছে।

২০.১
এই ভাষা সংগ্রামী জীবনের নানা দিক নিয়ে বিভিন্ন সময়ে অকপটে আপন কথা বলেছেন। অংশ বিশেষ তুলে ধরছি।

২০.২
ছেলেমেয়েরা কেউ বাবার মতো চিত্রশিল্পী হলো না বলে কষ্ট পান?
মুর্তজা বশীর : না। ছেলেমেয়েরা কেউ আঁকাআঁকি করে না। ছোট মেয়েটা চেয়েছিল। আমি উৎসাহ দিইনি। চিত্রশিল্পীর জীবন বড় কষ্টের। আমি চাইনি আমার ছেলেমেয়েরা এই কষ্ট করুক।
আপনার বাবাও চাননি আপনি আর্টিস্টের দূরূহ জীবন বেছে নেন। মুর্তজা বশীর : ছোটবেলায় আমি আসলে ভাবিনি আর্টিস্ট হব। কমিউনিস্ট পার্টি চেয়েছিল বলে আর্ট কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। আমার বাবাও বলেছিলেন, প্যারিসে আমি দেখেছি আর্টিস্টের জীবন খুব কষ্টের। আমি চাই না আমার ছেলে সেই কষ্টের ভেতর দিয়ে যাক। পরে অবশ্য রাজি হন তিনি। বাবার টাকায় ইতালিতে পড়তে যাই। ১৯৫৬ সাল থেকে ৫৮ সাল পর্যন্ত ইতালির ফ্লোরেন্সে ছিলাম। আমার বাবা অবশ্য চেয়েছিলেন আমি ইউরোপ যাই।
মানে রঙের ওপর শিল্পীর দখল থাকবে, শিল্পীর ওপর রঙের না?
মুর্তজা বশীর : হ্যাঁ। আমার স্ত্রী একটা কথা বলে, আমি নাকি অনেকটা উটের মতো। মানে যখন কাজ করি না, একেবারেই করি না। আবার যখন কাজ করি, একেবারে খাওয়া-দাওয়া ভুলে। হয়ত একমাস-দুমাস টানা কাজ করলাম। সাধারণত আমি কখনো রাতে ছবি আঁকি না। আমি মদ্যপ অবস্থায়ও ছবি আঁকি না। আমি বিদেশে দেখেছি, আমাদের দেশেও দেখেছি অনেক শিল্পী মদ খেয়ে ছবি আঁকেন। হুইস্কি, ভদকা, জিন খেতে খেতে ছবি আঁকেন। কিন্তু কখনো অ্যালকোহলের ইনফ্লুয়েন্সে ছবি আঁকি না। ছবি আঁকা আমার কাছে প্রার্থনার মতো। সকালে ঘুম থেকে উঠে স্নান করি, দাড়ি কাটি, আফটার সেভ লোশন লাগাই, গায়ে পারফিউম লাগাই। একেবারে পবিত্র হয়ে আমি ছবি আঁকতে বসি। একেবারে টানা নয়টা পর্যন্ত। তারপর ব্রেকফাস্ট করতে যাই।
যখন ছবি আঁকেন না তখন কী কোনো অস্থিরতা কাজ করে?
মুর্তজা বশীর : না। তখন তো ভাবতে থাকি কী আঁকব। একটা গল্প আছে, লিওনার্দো ভিঞ্চিকে যখন দ্য লাস্ট সাপার আঁকার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়, তখন উনি আঁকবেন বলে জানান, কিন্তু আঁকেন না। ঘোরেন ফেরেন, কিন্তু আঁকেন না। তখন অন্য আগ্রহী শিল্পীরা ডিউকের কাছে অভিযোগ করলেন, কী এক শিল্পী নিয়ে এলেন, সে তো ঘোরে-ফেরে কাজ করে না। ডিউক ভিঞ্চিকে ডেকে বললেন, কী ব্যাপার আপনি আঁকা শুরু করছেন না কেন? তখন ভিঞ্চি বললেন, যখন একজন শিল্পী কাজ করে না, মানে সে কাজ করে না, তা নয়। তখন তার মস্তিষ্ক কাজ করে। আমারও তা-ই। মানে যখন ছবি আঁকি না, তখন ভাবি। সাধারণত রাতে ছবি আঁকি না, তবে সামনে এক্সিবিশনের ডেট থাকলে রাতেও আঁকি। এক্সিবিশনের ডেট সামনে থাকলে ছবি আঁকা হয় বেশি। একটা প্রেসার কাজ করে।

২০.৩ 
ছোটবেলায় আর্টিস্ট হতে চেয়েছিলেন?
মুর্তজা বশীর : না। ছোটবেলা থেকে আমি কিন্তু কখনো আর্টিস্ট হওয়ার স্বপ্ন দেখিনি। কল্পনায়ও ছিল না। এটা ঘটনাচক্রে ঘটে গেছে। তবে আঁকা ছবি দেখতে আমার খুব ভালো লাগত। দশের আগের কথা মনে নাই। তবে দশ বছর বয়সের পরের কথা মনে আছে। আমার বাবার লাইব্রেরিতে প্রচুর পত্রিকা আসত। কলকাতা থেকে। নানা জায়গা থেকে। সেসব পত্রিকায় আঁকা ছবি ছাপা হতো। ভারতের বিখ্যাত শিল্পীদের আঁকা ছবি ছাপা হতো। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকায় ইউরোপের শিল্পীদের ছবি ছিল। ওগুলো দেখতে খুব ভালো লাগত। ১২ বছর বয়সে স্কুলের বইয়ে আঁকা রেখাচিত্রে বাবার খাতা দেখার লাল-নীল কলম দিয়ে রং করতাম।
কিশোর বয়সের কোন বিষয়টা সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে?
মুর্তজা বশীর : রবিবারে আমাদের বাড়িতে ইংলিশ ফুড হতো। সেদিন আমরা বাবার সঙ্গে টেবিল চেয়ারে বসে খেতাম। চামচ-কাঁটাচামচ, ছুরি দিয়ে। মা গ্লাসের মধ্যে ন্যাপকিন সাজিয়ে রাখতেন খুব সুন্দর করে, যেন ফুল ফুটে আছে। একটা গল্প বলি শোনো, আমি তো অনেক খাটো। তখন আমি ঠিক কিশোর না, আরো বড় হয়েছি, একদিন একটা মেয়ে খুব বাজেভাবে আমাকে দেখিয়ে বলেছিল, এহ্ কী বিশ্রী খাটো! সেদিন মনে খুব জেদ চেপেছিল, বিশেষ কেউ হব। যেন মেয়েরা পেছনে ঘোরে আর আমি চেয়ে না দেখি।

২০.৪
আপনার লেখালেখি বিষয় যদি কিছু বলতেন ?
মুর্তজা বশীর: আমার একমাত্র উপন্যাস আত্মজৈবনিক, গল্পগুলা সমাজের ব্যবচ্ছেদ। আর কবিতা ব্যক্তিগত।
জীবনের সবচেয়ে বড় সুখ কোনটা?
মুর্তজা বশীর : আমি একুশের সঙ্গে ছিলাম। ভাষা আন্দোলনে যোগ দেওয়া আমার জীবনের সেরা অর্জন।

(তথ্যসূত্র : মুর্তজা বশীর: মূর্ত ও বিমূর্ত, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক বণিক বার্তা, দৈনিক প্রথম আলোসহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত