প্রয়াণ দিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ

প্রকাশ : ১৮ আগস্ট ২০১৮, ১১:৩১

১.
মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ ছিলেন একজন বাঙালি সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক এবং ইসলামী পণ্ডিত। বাংলার সাংবাদিকতার ভুবনে মওলানা আকরম খাঁ এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। তিনি বাংলা ভাষার প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। সাময়িকপত্র প্রকাশ ও গ্রন্থ রচনার মাধ্যমে মওলানা আকরম খাঁ নিজের বহুমুখী প্রতিভার পরিচয় দিয়ে হয়ে উঠেছিলেন জীবন্ত কিংবদন্তি। মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ ১৯৬৮ সালের ১৮ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ ১৮৬৮ সালের ৭ জুন ( মতান্তরে ৮/৯ জুন) তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পাক-ভারত উপমহাদেশের গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব হিসেবে তাঁর অবদান অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই বলেই সংশ্লিষ্টজনদের মতামতে সুষ্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে।

২.
মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ বাঙালি মুসলিম জাগরণের এক অবিস্মরণীয় যুগপুরুষ। বাংলার ভাষা-সাহিত্যের গবেষণায় যেমন তিনি অবদান রেখেছেন। তেমনি সমকালীন রাজনীতিক আন্দোলন ও বঙ্গীয় মুসলমানের আধুনিক সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও তিনি এক বিশিষ্ট নাম। তাঁর মোস্তফা-চরিত যেমন মহানবী (স.)-এর বস্তুনিষ্ঠ জীবনী তেমনি তাঁর রচিত মোসলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস গ্রন্থটি আমাদের সামাজিক ইতিহাস প্রণয়নে একটি অন্যতম আকর গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত। ১৯১০ সালে সাপ্তহিক মোহাম্মদী ও দৈনিক খাদেম প্রতিষ্ঠা করেন। তারপর ১৯২১ সালে উর্দূ জামানা ও বাংলা দৈনিক সেবক প্রকাশ করেন। মুসলিম সমাজকে জাগাবার জন্য ১৯৩৬ সালে তাঁর সম্পাদনায় দৈনিক আজাদ প্রকাশ করেন। ১৯৩৬ সালের অক্টোবর মাসে মওলানা আকরম দৈনিক আজাদ পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন। সেই সময় এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল এবং দৈনিক আজাদ ছিল বাংলাভাষার প্রথম সংবাদ পত্র। মুসলিম লীগের সমর্থন যোগাতে এই বাংলা পত্রিকাটি সেই সময় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। 

৩.
নানা প্রয়োজনে প্রায়শই আমাকে জাতীয় প্রেসক্লাবে যেতে হয়, সেখানকার অতিথি কক্ষেও বসে প্রয়োজনীয় কাজটি করতে হয় বলে সেই সেখানকার দেয়ালে রক্ষিত প্রথম ছবিটিই মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ সাহেবের।নিয়মিত দেখি আর আমাদের সাংবাদিকতার জগতে তাঁর মূল্যবান অবদানকেই মনে পড়ে। আমি জানি না, আমাদের জাতীয় প্রেসক্লাব কর্তৃপক্ষ মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ –র মতোন কিংবদন্তিতুল্য সাংবাদিকদের জন্মদিন-প্রয়াণ দিন স্মরণে কোন বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে কী না।

৪.
জ্ঞানানুসন্ধানী মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ (জন্ম : ৭ জুন, ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দ – প্রয়াণ : ১৮ আগস্ট, ১৯৬৮) (ইংরেজি: Maulana Mohammad Akram Khan) ইসলাম ধর্ম এবং বাংলা ও ভারতের মুসলমানদের ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। তার সময় মাদরাসায় সামান্য কিছু ইংরেজি শেখার ব্যবস্থা থাকলেও বাংলা লেখাপড়ার কোন ব্যবস্থা ছিল না। বুকে অদম্য সাহস ও ইচ্ছা থাকলে অসম্ভবকে যে সম্ভব করা যায় তার উজ্জ্বল নমুনা আকরম খাঁ। তিনি নিজ প্রচেষ্টায় ইংরাজিতে প্রচুর জ্ঞান অর্জন করেন এবং বাংলা ভাষার একজন বলিষ্ঠ সাহিত্যিক হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। আরবী, ফারসি ও উর্দুতে তার প্রচুর জ্ঞান ছিল। তিনি ফারসিতে কবিতা লিখতেন। আকরম খাঁ ছিলেন অসাধারণ বাগ্মী অন্যদিকে ছিলেন ক্ষুরধার লেখনির অধিকারী। বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা যে বাংলা এবং বাংলা ভাষা ছাড়া যে অন্য কিছুই না, সে বিষয়ে ১৩২৫ বঙ্গাব্দেই আকরম খাঁ লিখেছিলেন, “দুনিয়ায় অনেক রকম অদ্ভুত প্রশ্ন আছে, বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা কি? উর্দু না বাংলা? এই প্রশ্নটা তাহার মধ্যে সর্বাপেক্ষা অদ্ভুত। নারিকেল গাছে নারিকেল ফলিবে না, বেল?...বঙ্গে মুসলিম ইতিহাসের সূচনা হইতে আজ পর্যন্ত বাংলা ভাষাই তাদের লেখ্য, কথ্য ও মাতৃভাষা রুপে ব্যবহৃত হইয়া আসিতেছে এবং ভবিষ্যতেও মাতৃভাষারুপে ব্যবহৃত হইবে। ” (বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য পত্রিকা, মাঘ ১৩২৫)

৫.
‘চেনা মানুষের মুখ’ গ্রন্থ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সাংবাদিক, রাজনীতিক, ইসলামিশাস্ত্রজ্ঞ মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ বিষয়ে লিখেছেন, ‘উনিশ শতকের ধারায় খ্রিষ্টান মিশনারিদের সঙ্গে ধর্মবিষয়ক বিতর্কে প্রবৃত্ত হয়ে তিনি যেসব প্রবন্ধ ও পুস্তিকা লেখেন, যেমন ‘মূল বাইবেল কোথায়?’ (আল এসলাম, বৈশাখ ১৩১৫) এবং ‘যীশু কি নিষ্পাপ?’ (কলিকাতা, ১৯১৫), এতে তাঁর ধর্মপ্রচারক-রূপটাই প্রধানত স্পষ্ট। পির-প্রথা, দরগাহ-পূজা, বাল্যবিবাহ প্রভৃতি সামাজিক সংস্কার-বিষয়ে মওলানা ইসলামাবাদী আল এসলামের পৃষ্ঠায় যে আন্দোলন চালান, তার প্রতি মওলানা আকরম খাঁরও সমর্থন ছিল। সেইসঙ্গে কোরআনের অনুবাদে হাত দিয়ে তিনি একইসঙ্গে তাঁর ধর্মপ্রাণতা ও মাতৃভাষাপ্রীতির পরিচয় দিয়েছেন। মোস্তফা-চরিতে পরস্ফুটিত হয়েছে তাঁর যুক্তি-নির্ভরশীলতা আর অতি উৎকৃষ্ট গদ্য রচনার ক্ষমতা। বাঙালি মুসলমানের লেখা হজরত মোহাম্মদের প্রথম জীবনীগ্রন্থ শেখ আবদুর রহিমের ‘হজরত মোহাম্মদের জীবনচরিত ও ধর্মনীতি’তে (১৮৮৭) যুক্তিবাদের সূচনা দেখা দিয়েছিল, এই শতাব্দীর তৃতীয় দশকে তার প্রবল প্রতিষ্ঠা ঘটে মোস্তফা-চরিতে। হজরত মোহাম্মদের জীবনকে আকরম খাঁ অলৌকিকতার আকররূপে বিবেচনা করেননি। তাই ‘সিনাচাক’ বা ‘মোজেজা’ প্রভৃতি বিষয়ে তিনি বাস্তববুদ্ধি-প্রণোদিত যে-বিচার করেছিলেন, তা প্রাচীনপন্থীদের মনঃপূত হয়নি।’

৬.
প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ মওলানা আকরম খাঁ সম্বন্ধে বলেছেন ‘মওলানা আকরম খাঁ সাহেব বহু বিষয়ে আমাদের বাঙালি মুছলিম সমাজের অগ্রপথিক। পত্রিকা পরিচালনার ব্যাপারে তিনিই প্রথম হিন্দু সমাজের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।... কাগজে ছবি ছাপান জায়েজ কি না-জায়েজ, এ নিয়ে যখন আমাদের আলেম সমাজে তুমুল তর্ক চলছিল, তখন তিনি ‘সমস্যা ও সমাধান’ লিখে এ তর্কের সমাধান করেন।... কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দু সংস্কৃতির লালন, বিকাশ, বিস্তারের জন্য যে ব্যাপক আয়োজন চলছিল, তার পাশে বাংলার মুসলমানের সংস্কৃতিকেও স্থান দিতে হবে, এ আন্দোলন মওলানা সাহেবই শুরু করেন বলে মনে পড়ে। বাংলার মুসলমানরা আরবী ও ফারসী ভাষার যেসব শব্দ তাদের কথায় হামেশা ব্যবহার করে থাকেন, সেই সব শব্দকে সাহিত্যে স্থান দেওয়ার জন্য মওলানা সাহেব যে প্রচার করেন, তা নিস্ফল হয় নাই।... এ দেশে বহু বিষয়ে মওলানা আকরম খাঁ একক।’ 

৭.
শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম ‘অগ্রনায়ক মওলানা আকরম খাঁ’ স্মৃতিচারণমূলক রচনায় জানাচ্ছেন, ‘আকরম খাঁকে কখনো মনে হয়েছে তুরন্ত রাজনীতিক, কখনো মনে হয়েছে পাঁড় ব্যবসায়ী, কখনো মনে হয়েছে তিনি একজন যুগপ্রবর্তক, সমাজসংস্কারক। তাঁকে জ্ঞানতপস্বী বলেও মনে হতো। সাহিত্য-সাংবাদিকতায় তো তুখোড় ছিলেনই। ‘জয় মোহাম্মদী’ নামে মাসিক মোহাম্মদীতে তিনি যে প্রবন্ধটি লিখেছিলেন তার ভাষা ও ভাবনা একজন শক্তিশালী সাহিত্যিকের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। প্রসঙ্গত আরো স্মরণে আনতে চাইছি যে তাঁর জীবনের শেষ প্রহরে তাঁকে পেয়েছিলাম আমরা আমাদের বাংলাদেশ-বাঙালিত্বের আন্দোলনের সড়কে। সময় এসেছে, পরের প্রজন্মেরও সন্তান আমরা, তাঁর স্মৃতির উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন করি। এই সঙ্গে যোগ করি তাঁর আরেকটি বিশেষ কীর্তির কথা। সেইটে হলো তাঁর আপন অভিজ্ঞতা দিয়ে পেশাদার সংবাদকর্মী গড়ে তোলার প্রয়াস। সহকর্মী আবুল কালাম শামসুদ্দীন, মোহাম্মদ মোদাব্বের প্রমুখ তো ছিলেনই, তরুণ অনেক সাংবাদিককেও তিনি তৈরি করেছেন। উদাহরণত যেমনটা বলবার, এই আমরাই তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, আমাদের তিনি প্রাত্যহিক প্রতিবেদন লেখার এবং প্রাত্যহিক সংবাদ তৈরির কাজে সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতা দিতেন। এইভাবে তাঁর পরিকল্পিত উদ্যোগে একদল নবীন সাংবাদিকের অভ্যুদয়। আমাদের দেশের আজ দিনের যে সাংবাদিকতার বিস্ফোরণ, তার যাত্রা শুরু, যতটা খেয়ালে আনতে পারি, ঢাকার ঢাকেশ্বরী রোডের আজাদ অফিসের সেই বাড়িটা থেকেই। আবারও বলি, বোধ করি এতক্ষণে বোঝাও গেছে, একদা আমার নিজেরও সাংবাদিকতার হাতেখড়ি ওই আজাদ অফিসেই। মনে পড়ছে, বিকেলের দিকে মওলানা আমাদের নিয়ে লনে বসতেন। এবং সেই দিনের পত্রিকায় প্রকাশিত আমাদের কাজের ভুলভ্রান্তি সবটাই বাতলে দিতেন। সাংবাদিকতায় একদা আমাদের যাত্রা শুরুর কালে মওলানা আকরম খাঁকে পেয়েছিলাম শিক্ষকের ভূমিকায়। এই দিনে বারংবার করে সেই তাঁকেই স্মরণ করছি, যিনি আমাদের সেকালে সড়কের সন্ধান দিয়েছিলেন।’
 
৮.
আকরম খাঁ ১৮৬৮ সালের ৭ জুন পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনা জেলার হাকিমপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মওলানা আবদুল বারি খাঁ ছিলেন মধ্যবঙ্গের একজন বিখ্যাত আলেম এবং পীর। আকরম খাঁ পিতার গুণে গুণান্বিত ছিলেন। তার মাতার নাম বেগম রাবেয়া খাতুন। বিচিত্র অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ ছিল আকরম খাঁর জীবন। শৈশবে গ্রামের মক্তবে শিক্ষারম্ভ করেন। ১২-১৩ বছর বয়সে একই দিনে কলেরায় পিতা-মাতাকে হারিয়ে নানার কাছে প্রতিপালিত হন তিনি। ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি অনুরাগবশত ইংরেজি স্কুল ত্যাগ করে কলকাতার আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি আশৈশব অনুরাগ বশত ইংরেজি স্কুল ছেড়ে কলিকাতা আলীয়া মাদ্রাসা থেকে কৃতিত্ত্বের সঙ্গে শেষ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। লেখাপড়ার পাশাপাশি তিনি কৃতি খেলোয়াড় হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। মুসলিম স্পোর্টিং ক্লাবের তিনি প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। খুব অল্প বয়সেই তিনি সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত হন। আলিয়া মাদ্রাসা থেকে ফাজিল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি সমাজ, জাতি ও দেশ সেবায় আত্মনিয়োগ করতে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন।

৯.
তাঁর পেশাগত ও রাজনৈতিক জীবন খুব অল্প বয়সেই শুরু হয়। সাংবাদিক হিসেবে তিনি প্রথম কাজ করেন আহল-ই-হাদিস ও মোহাম্মদী আখবার পত্রিকায়। মোহাম্মদ আকরম খাঁ ১৯০৮ থেকে ১৯২১ সালের মধ্যে মোহাম্মদী ও আল-এসলাম পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। কর্মজীবন শুরু করার সাথে সাথে তিনি বুঝতে পারলেন যে, অচতন মুসলিম সমাজকে সচেতন করার জন্য সবচেয়ে বড় হাতিয়ার সংবাদপত্র। অতঃপর তিনি নিজে কলকাতা হতে ১৯২০ থেকে ১৯২২ সালের মধ্যে জামানা ও সেবক নামে দুটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। সেবক অসহযোগ ও স্বদেশী আন্দোলনকে সমর্থন যোগায়। সেবক নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় এবং সরকার বিরোধী সম্পাদকীয় লেখার জন্য আকরম খাঁ গ্রেপ্তার হন। পরে ১৯৩৬ সালের অক্টোবরে তিনি ওই সময়ের একমাত্র বাংলা দৈনিক পত্রিকা আজাদ প্রকাশ করেন। এ পত্রিকাটি বঙ্গ বিভাগোত্তরকালে মুসলিম লীগের পক্ষে জনসমর্থন সৃষ্টির ক্ষেত্রে যথেষ্ট অবদান রাখে।

১০. 
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক জীবন আরম্ভ করেন। মওলানা আকরম খাঁ ছিলেন ১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম লীগের একজন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। আকরম খাঁ তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন ভারতীয় ন্যাশনাল কংগ্রেসের একজন সমর্থক হিসেবে। তাঁর প্রধান লক্ষ্য ছিল বাঙালি মুসলমানদের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষা করা। এ উদ্দেশে তিনি ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ গঠনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯১৮ থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত তিনি খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনএ অংশগ্রহণ করেন। ১৯২০ সালে ঢাকার আহসান মঞ্জিলে অনুষ্ঠিত অধিবেশনে তিনি খিলাফত কমিটির সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। এ সম্মেলনে বিশিষ্ট খেলাফত নেতৃবৃন্দ মওলানা আবুল কালাম আজাদ (১৮৮৫-১৯৫৮), মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী (১৮৭৫-১৯৫০) এবং মওলানা মুজিবুর রহমান (১৮৭৩-১৯২৪) উপস্থিত ছিলেন। আকরম খাঁকে তুরস্কের উসমানীয় খিলাফতের জন্য অর্থ সংগ্রহের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯২০ থেকে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত তিনি খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের উদ্দেশে জনগণকে অবহিত করার জন্য বাংলার বিভিন্ন এলাকায় জনসভার আয়োজন করেন। 

১১.
হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতিতে বিশ্বাসী আকরম খাঁ ১৯২২ সালে কলকাতায় চিত্তরঞ্জন দাশ-এর স্বরাজ্য পার্টি এবং ১৯২৩ সালে বেঙ্গল প্যাক্টএর প্রতি সমর্থন জানান। ১৯২৬-১৯২৭ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং সমসাময়িক অন্যান্য রাজনৈতিক ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে আকরম খাঁ ভারতীয় জাতীয় রাজনীতির প্রতি আস্থা হারিয়ে স্বরাজ্য পার্টি ও কংগ্রেস উভয় দল থেকেই পদত্যাগ করেন। ১৯২৯ থেকে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত তিনি প্রজা বা কৃষক রাজনীতির সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত হন। ১৯৩৫ সালে বেঙ্গল প্রজা সমিতিতে অনৈক্য দেখা দিলে ১৯৩৬ সালে তিনি কৃষক রাজনীতি ত্যাগ করেন এবং সক্রিয়ভাবে মুসলীম লীগে যোগ দেন। তিনি ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত মুসলিম লীগের সেন্ট্রাল ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগের পর তিনি পূর্ব বাংলায় চলে আসেন এবং ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। এছাড়া তিনি বিভিন্ন সময়ে নিখিল ভারত মুসলীম লীগ, পাকিস্তান মুসলীম লীগ, প্রাদেশিক মুসলীম লীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সভাপতি ছিলেন। ১৯৫১-তে প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতির পদ ত্যাগ করেন এবং ১৯৫৪-এর গণপরিষদ ভেঙে দেয়া হলে তিনি রাজনীতি থেকে অবসর নেন। ফিরে আসেন ‘আজাদ’ সম্পাদনার দায়িত্বে। দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মুখপত্র হিসেবে ‘আজাদ’ পরিচালনা করতে থাকেন।

১২.
সংবাদপত্রের স্বাধীনতা অর্জনের আন্দোলনেও আকরম খাঁ অংশগ্রহণ করেন। আইয়ুব সরকার কর্তৃক জারিকৃত প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশনস অর্ডিনেন্সের প্রতিবাদে ঢাকায় সাংবাদিকদের যে বিক্ষোভ হয় তাতে তিনি নেতৃত্ব দেন। দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সম্মিলিত বিরোধীদলের প্রার্থী ফাতেমা জিন্নাহর প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন মওলানা আকরম খাঁ। রবীন্দ্র সঙ্গীত পাকিস্তানের আদর্শবিরোধী এ বক্তব্য উপস্থাপন করে পাকিস্তান সরকার রেডিও এবং টেলিভিশন থেকে রবীন্দ্রনাথের গান প্রচার বন্ধের সিদ্ধান্ত নিলে সরকারের সে পদক্ষেপের প্রতি আকরম খাঁ সমর্থন প্রদান করেন।

১৩.
সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক পরিচিতি ছাড়াও মওলানা আকরম খাঁর আরেকটি বিশেষ পরিচয় রয়েছে- তা হলো তিনি বাংলা গদ্য সাহিত্যের একজন বিশিষ্ট শিল্পী। মুসলিম বাংলার জাতীয় জাগরণের ইতিহাসে তার সাহিত্য সাধনা মূল্যবান ভূমিকা রাখে। আরবি, ফারসি, উর্দু ও সংস্কৃত ভাষায় ব্যুৎপন্ন আকরম খাঁ বাংলায় রাজনীতি, ধর্ম ও সমাজ চিন্তামূলক গ্রন্থ রচনায় পারদর্শিতার পরিচয় দেন। বাংলা সাহিত্যে তার অক্ষয় কীর্তি হজরত মোহাম্মদ (দ.)-এর জীবনী ‘মোস্তফাচরিত’ এবং পবিত্র কোরআনের বঙ্গানুবাদ ‘তফসিরুল কোরআন’।

১৪.
তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ সমস্যা ও সমাধান, মোস্তফা চরিত, আমপারার বঙ্গানুবাদ। তাঁর মোসলেম বাংলার সামাজিক ইতিহাস-গ্রন্থে তিনি পীরবাদ ও সুফীবাদের প্রভাবসহ বাঙালি সমাজের বিভিন্ন দিক এবং বাঙালি মুসলমানদের অবনতির কারণ আলোচনা করেছেন। তাছাড়া তিনি আকবর এর ‘দীন-ই-ইলাহী’র সমালোচনা করেন এবং আওরঙ্গজেব-এর ধর্মনিষ্ঠা ও তৎকালীন সমন্বয় প্রবণতার বিরুদ্ধে তার জেহাদের প্রশংসা করেন।
 
১৫.
মওলানা আকরম খাঁ সম্বন্ধে আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করলে আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তার সমসাময়িককালে বাঙালি মুসলমান নিজস্ব ভাষা প্রশ্নে অত্যন্ত দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েছিল। তারা মাতৃভাষা হিসেবে উর্দু গ্রহণ করবে না বাংলা গ্রহণ করবে? এমতাবস্থায় তৎকালীন মনীষী ব্যক্তিগণ বাংলার পক্ষে মত দেন। যেমন ইসমাইল হোসেন সিরাজী তার এক বক্তৃতায় বলেন- ‘ভ্রাত : বঙ্গীয় মুসলমান! আর নিদ্রিত থাকিও না। বাংলা ভাষাকে অবহেলা এবং অশ্রদ্ধা না করিয়া ইহার সেবা করিতে প্রবৃত্ত হও।’ এয়াকুব আলী চৌধুরী লেখেন- ‘বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা বাঙ্গালা, ইহা দিনের আলোর মত সত্য।’ এ প্রসঙ্গে মওলানা আকরম খাঁ মন্তব্য করেন এভাবে- “দুনিয়ায় অনেক রকম অদ্ভুত প্রশ্ন আছে। ‘বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা কি? উর্দু না বাঙ্গালা?’ এই প্রশ্নটা তাহার মধ্যে সর্বাপেক্ষা অদ্ভুত। নারিকেল গাছে নারিকেল ফলিবে, না বেল?... বঙ্গে মোছলেম ইতিহাসের সূচনা হইতে আজ পর্যন্ত বাংলা ভাষাই তাহাদের মধ্যে লেখ্য ও কথ্য মাতৃভাষা রূপে ব্যবহৃত হইয়া আসিয়াছে এবং ভবিষ্যতেও মাতৃভাষারূপে ব্যবহৃত হইবে।” তৃতীয় বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সম্মেলনের অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি মওলানা আকরম খাঁর এই বক্তব্য বাংলা ভাষাকে আরেক ধাপ এগিয়ে যেতে সাহায্য করে, বাংলাকে মাতৃভাষায় প্রতিষ্ঠিত করতে বিশেষ ভূমিকা রাখে বলে অনেকে মনে করেন। 

১৬.
মনীষী মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁকে নিয়ে শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম বলছেন, ‘আকরম খাঁ অবদান রেখে গেছেন অনেক ক্ষেত্রেই। মুসলিম বাংলার সক্রিয় রাজনীতিতেও নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন তিনি, যেমন সেকালের মুসলিম লীগ আন্দোলনের তিনি ছিলেন অন্যতম নেতা। আকরম খাঁ সামাজিক কুসংস্কারের বিরোধী ছিলেন। ধর্ম বিষয়ে ব্যক্তিগত বিচার ও যুক্তি প্রয়োগের অধিকারে বিশ্বাসী বলেও তাঁর পরিচয় ঘটে। প্রাচীনপন্থী ধর্মশিক্ষার সহজাত ইংরেজ শাসনবিরোধী মনোভাবও তাঁর মধ্যে অল্প বয়সে জেগেছিল। ছাত্রজীবনের কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, সেকালে ফোর্ট উইলিয়ামের কাছাকাছি পদচারণা করতে করতে মনে এই কেল্লা দখলের নানা রকম পরিকল্পনা জাগত। পরবর্তীকালে সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে স্বাধীনতা আন্দোলনের কর্মী ও নেতার ভূমিকা তিনি পালন করেছেন। সে কথা আপাতত থাক, আপন অভিজ্ঞতা সাক্ষ্য দেয়, মওলানা আকরম খাঁকে পেয়েছি আমরা আমাদের ’৪৮-৫২-র ভাষা আন্দোলনের পুরোভাগে। বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা যে বাংলা এবং বাংলা ভাষা ছাড়া যে অন্য কিছুই না, সে বিষয়ে ১৩২৫ বঙ্গাব্দেই আকরম খাঁ লিখেছিলেন- “দুনিয়ায় অনেক রকম অদ্ভুত প্রশ্ন আছে, বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা কি? উর্দু না বাংলা? এই প্রশ্নটা তাহার মধ্যে সর্বাপেক্ষা অদ্ভুত। নারিকেল গাছে নারিকেল ফলিবে না, বেল?...বঙ্গে মুসলিম ইতিহাসের সূচনা হইতে আজ পর্যন্ত বাংলা ভাষাই তাদের লেখ্য, কথ্য ও মাতৃভাষা রুপে ব্যবহৃত হইয়া আসিতেছে এবং ভবিষ্যতেও মাতৃভাষারুপে ব্যবহৃত হইবে।” (বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য পত্রিকা, মাঘ ১৩২৫)।’

১৭.
বঙ্গীয় মুসলমান সমাজের সাংবাদিকতার পথিকৃৎ ক্ষণজন্মা পুরুষ ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন। মুসলিম জাগরণে তার অবিস্মরণীয় অবদান চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণযোগ্য। জীবনব্যাপী অবদানের জন্য মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ পেয়েছেন নানা সম্মাননা ও পদক। ১৯৮১ সালে বাংলদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।

১৮.
মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ ১৯৬৮ সালের ১৮ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকার বংশালে আহলে হাদীস মসজিদে প্রার্থনারত অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। মওলানার জীবন এক গৌরব দীপ্ত ইতিহাস যা প্রায় এক শতাব্দীকে পরিব্যাপ্ত করে রেখেছে।

(তথ্যসূত্র : বাংলাপিডিয়া, উইকিপিডিয়া, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক কালের কণ্ঠসহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত