প্রয়াণ দিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

উৎপল দত্ত

‘যে নাটকের রাজনীতি ভুল, তার সব ভুল’- উৎপল দত্ত

প্রকাশ : ১৯ আগস্ট ২০১৮, ১১:৩৯

১.
বিখ্যাত বাঙালি নাট্য নির্দেশক, অভিনেতা, নাট্যকার, নাট্যতজ্ঞ ও সম্পাদক উৎপল দত্ত। বাংলা নাট্যজগতের প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব উৎপল দত্ত ১৯৯৩ সালের ১৯ আগস্ট বেলা ৩.৩০ মিনিটে মাত্র ৬৪ বছর বয়সে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। উল্লেখ্য যে, উৎপল দত্ত ১৯২৯ সালের ২৯ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। অবিভক্ত বাংলার বরিশালে জন্মগ্রহণ করা স্বাধীনতা উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতির বহুমুখী প্রতিভাশালী এই শিল্পী নিজের সম্পর্কে বলেছিলেন, 'আমি শিল্পী নই। নাট্যকার বা অন্য যে কোনো আখ্যা লোকে আমাকে দিতে পারে। তবে আমি মনে করি আমি প্রপাগাণ্ডিস্ট। এটাই আমার মূল পরিচয়।' সেই বিচিত্র প্রতিভাময় নাট্যব্যক্তিত্ব সৃষ্টিশীল মানুষ উৎপল দত্তের প্রয়াণদিনে, বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি তাঁকে, জানাই শ্রদ্ধাঞ্জলি। উৎপল দত্ত, যিনি আজীবন নাটককে গণমানুষের কাছে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। গণমানুষের রাজনৈতিক, মানসিক, সাংস্কৃতিক চেতনাকে সমৃদ্ধ করতে তাঁর নাটক সেই সময় বিশেষ অবদান রেখেছিল। সূক্ষ্ম ব্যঙ্গবিদ্রূপ সংলাপের মাধ্যমে তাঁর নাটক যেমন একদিকে বিনোদনের খোরাক জোগাত, তেমনি মানুষের মনে দাগ কেটে যেত। উৎপল দত্ত মার্কসবাদী মতাদর্শের অনুসারি ছিলেন। তাঁর প্রত্যেকটি নাটকে রাজনীতি বরাবরই প্রাসঙ্গিক। নাটকে শাসক এবং শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে সরাসরি বক্তব্য নিয়ে দর্শকদের মনোজগৎকে নাড়াতে চেয়েছেন। মঞ্চ নাটকের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে নাটক নিয়ে গণমানুষের কাছে ছুটে গেছেন। শ্রেণি ও ইতিহাস চেতনার ভিত্তিতে তাঁর অসাধারণ নাটক সমূহের অন্যতম টিনের তলোয়ার, রাতেরঅতিথি, ছায়ানট, সূর্যশিকার, মানুষেরঅধিকার, টোটা,লালদুর্গ, তিতুমীর, কল্লোল, দিল্লি চলো, ক্রুশবিদ্ধ কুবা, ব্যারিকেট, একলা চলো রে, জনতার আফিম, অজেয় ভিয়েতনাম ইত্যাদি। শুরুতেই উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, তাঁর একটি অনুভবের উচ্চারণ আমার মনে গভীরভাবে দাগ কেটে আছে ‘ছোটবেলায় বাংলা ভালো করে শিখলে তবে ইংরেজি শেখা যায় এ কথাটিই অনেকে বোঝেন না।’ বলেছিলেন উৎপল দত্ত ‘দেশ’-এর সাথে আলাপনে। রবীন্দ্রনাথ যেমনটি বলেছিলেন, ‘আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি, তারপর ইংরেজি শেখার পত্তন’।

২.
বিশ শতকের দ্বিতীয় অর্ধ জুড়ে বাংলা থিয়েটারের যে বিকাশ ও বিস্তার ঘটেছে, তার অগ্রণী স্থপতিদের মধ্যে উৎপল দত্তের স্থান খুবই উঁচুতে। এ নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই। তিনি যে এক জন যুগস্রষ্টা নাট্যপরিচালক ছিলেন এবং ছিলেন একজন পরাক্রান্ত অভিনেতা, এ কথাও সর্বজনমান্য বলেই মনে হয়। কিন্তু উৎপল দত্তের নাট্যচিন্তা, রাজনীতি ও থিয়েটারের নিবিড় অবিভাজ্য সম্পর্কের বিষয়ে তাঁর অবিচল প্রত্যয়, সমাজ ও শিল্পের আন্তঃসম্পর্ক বিষয়ে তাঁর মতামত, তাঁর সৃষ্ট শিল্প ও তাঁর যাপিত জীবনের মধ্যেকার মিল ও অমিল এই সব কিছু এবং আরও অনেক কিছু নিয়ে গড়ে ওঠা এক বিশাল ও দীর্ঘস্থায়ী বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন উৎপল। আজীবনই এবং এখনও, তাঁর মৃত্যুর পরে দুই দশক অতিক্রান্ত হতে চললেও সে বিতর্ক রয়ে গেছে সজীব ও অর্থময়। শুধু যে বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন উৎপল তা-ই নয়, রেখে গেছেন সৃষ্টির বিপুল বৈভব। বহুকৌণিক ছিল তাঁর সৃজনীপ্রতিভা। নাটক লেখা ও প্রযোজনা ছাড়াও নাটকের দল তৈরি ও তাকে চলমান রাখার কাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। লিখেছেন ও প্রযোজনা করেছেন বহু অতীব জনপ্রিয় যাত্রাপালা। অসংখ্য পথ-নাটিকার মধ্যে রয়ে গেছে তাঁর দীপ্ত মনীষার ছোঁয়া। বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই অনর্গল রচনা করেছেন কালজয়ী সব নাট্যনিবন্ধ। রচনা করেছেন নাট্যগ্রন্থ। লিখেছেন কবিতা। প্রদান করেছেন অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা দেশে ও বিদেশে। অভিনয় করেছেন নাট্যমঞ্চের বাইরে বহু স্মরণীয় চলচ্চিত্রে বাংলায় ও হিন্দিতে। নির্মাণ করেছেন একাধিক চলচ্চিত্র। বহু বার গিয়েছেন বিদেশ ভ্রমণে। নাট্যাচার্যের মতোই তৈরি করেছেন অভিনেতা-অভিনেত্রীর বাহিনী, প্রজন্মের পর প্রজন্মে। চালিয়েছেন নাটমঞ্চ এক দশকেরও বেশি সময় জুড়ে। মতাদর্শগত সংগ্রামের ফলস্বরূপ কারাবরণও করেছেন। এত বিশাল এবং একই সঙ্গে এত বিচিত্র, জটিল, বহুবর্ণ চরিত্র দুশো বছরের বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে খুব বেশি খুঁজে পাওয়া যাবে না। জনগণের মুক্তি সংগ্রামে অবিচল উৎপল দত্ত অজস্র নাটক রচনা করেছেন। নিদের্শনা দিয়েছেন এবং অভিনয়ও করেছেন। পিপলস্ থিয়েটার এবং ভারতীয় গণনাট্যের নানা কর্মকাণ্ডে জনগণকে অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সামিল করতে জীবনের সুদীর্ঘ সময় পার করেছেন। ভারতের রাজনীতি, অর্থনীতি ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণির করতলগত। নির্বাচনী ব্যবস্থায় বুর্জোয়া শ্রেণির রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় বার বার ঘুরে ফিরে আসে। সেখানে জনগণের মুক্তির দিশা নেই। এই সত্যটি উৎপল দত্ত বার বার বলেছেন। বিদ্যমান ব্যবস্থার বিপরীতে শোষণ মুক্ত অসাম্প্রদায়িক সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণের লক্ষ্যে উৎপল দত্ত আমৃত্যু সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে জনগণকে সচেতন করে যুক্ত করতে চেয়েছেন শ্রেণি সংগ্রামে। অসাধারণ উৎপল দত্তের স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা-ভালবাসা।

৩.
বর্ণময় মানুষ, বহুমুখী প্রতিভাধর উৎপলরঞ্জন দত্তের জন্ম ১৯২৯ সালের ২৯ মার্চ অবিভক্ত বাংলার বরিশালে, কীর্তনখোলায়। তাঁর পিতার নাম গিরিজারঞ্জন দত্ত ও মাতা শৈলবালা দত্ত। দেশ ভাগের পর তাঁদের পরিবার ভারতের পশ্চিমবঙ্গেই স্থায়ীভাবে থেকে যায়। তাঁর পড়াশুনা শিলঙের এডমন্ডস স্কুল হয়ে কলকাতার সেন্ট লরেন্স, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ। ১৯৪৮-এ ইংরেজি অনার্স নিয়ে স্নাতক। কলেজের ছাত্রদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন উৎপল। সে বছর বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে ইংরেজি অনার্সে তাঁর স্থান পঞ্চম। স্কুল জীবনেই বাবা-মা'র সঙ্গে পেশাদারি থিয়েটার দেখা শুরু। এবং প্রথম দর্শনেই প্রেম, 'সেইসব মহৎ কারবার দেখে মনে হ'ল, আমার পক্ষে অভিনেতা ছাড়া আর কিছুই হবার নেই। আমার বয়স তখন তেরো'। কলেজ জীবনেই অভিনয় শুরু করে দেন উৎপল দত্ত।উৎপল দত্তের জীবন ও সৃষ্টিকর্মের পানে তাকালে দেখি যেমন ছিল বহুমুখী সৃজনশক্তি, তেমনই ছিল দিকপাল পাণ্ডিত্য। থিয়েটারের মঞ্চে তিনি যেমন ইতিহাস ও রাজনীতির বিশ্লেষণ হাজির করেছেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী সাফল্যে, তেমনই সারা জীবন ধরে আলোচনা, প্রত্যালোচনা, তর্ক-বিতর্কে যেন সৃষ্টি করে গেছেন এক গ্র্যান্ড ডিসকোর্স-এর। বাংলা থিয়েটারের বৌদ্ধিক মেরুদণ্ড তৈরিতে তাঁর থেকে দক্ষ কারিগর কমই খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু থিয়েটার ও রাজনীতির এই দ্বন্দ্ব ও সঙ্গমের মধ্যে থেকে মাঝেমধ্যেই তৈরি হয়েছে নানা স্ববিরোধ উৎপলের জীবনে ও সৃষ্টিতে। যেমন, সত্তর দশকের দ্বিতীয়ার্ধে ক্ষমতাসীন বামপন্থার সঙ্গে তাঁর দূরত্ব, আবার অল্প দিন পরেই বামবৃত্তের চেনা ছকে তাঁর প্রত্যাবর্তন, এর মধ্যে অনেক ‘যদি’ ও ‘কিন্তু’ রয়ে গিয়েছে। মিনার্ভা থিয়েটার তাঁকে কেন ছাড়তে হয়েছিল, তারও সম্পূর্ণ নেপথ্য-বৃত্তান্ত এখনও অনুদ্ঘাটিত। 

৪.
১৯৪৭ সালে নিকোলাই গোগোলের 'ডায়মণ্ড কাট্স্ ডায়মণ্ড' এবং মলিয়েরের 'দ্য রোগারিজ অফ স্ক্যাপাঁ' দিয়েই তাঁর কলেজ জীবনের অভিনয় শুরু। নাটক দুটি প্রযোজনা করেছিলেন কলেজের ইংরেজি অ্যাকাডেমি এবং পরিচালনায় অধ্যাপক ফাদার উইভার। ক্রমশ উৎপল দত্ত ও কলেজের কয়েকজন সহপাঠী মিলে গড়ে তোলেন একটি নাট্যদল - 'দি অ্যামেচার শেক্স্পিয়ারিয়ান্স্'। তাঁদের প্রথম উপস্থাপনা 'রোমিও অ্যাণ্ড জুলিয়েট' এবং ম্যাকবেথ নাটকের নির্বাচিত অংশ। সেই সময়েই, ১৯৪৭-এর অক্টোবরে, ইংলণ্ডের বিখ্যাত পরিচালক ও অভিনেতা জেফ্রি কেণ্ডাল তাঁর 'শেক্স্পিয়ারিয়ানা' নাট্যদল নিয়ে ভারত সফরে আসেন। কেণ্ডালের আহ্বানে উৎপল যোগ দেন সফররত সেই নাট্যদলে। ১৯৪৭-এর অক্টোবর থেকে জানুয়ারি ১৯৪৮ পর্যন্ত শেক্সপিয়ারিয়ানা নাট্যদল কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে তাদের প্রযোজনা মঞ্চস্থ করে। নাট্যমোদীরা অভিভূত হয়। জেফ্রি কেণ্ডালের দলে তখন উৎপল নিয়মিত অভিনয় করেছেন। ইউরোপীয় থিয়েটার দলের শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা উৎপলের নাট্যজীবনে বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল। কেণ্ডালের কাছেই শিখেছিলেন - There is no art without discipline and no discipline without sacrifice. তাঁর কাছেই উৎপল পেয়েছেন শেক্সপীয়রের নাটক অভিনয় করবার বিশেষ শিক্ষা। 

৫.
এই সময়েই কেণ্ডাল-কন্যা জেনিফারের সঙ্গে উৎপল দত্তের পরিচয়। অচিরেই যার উত্তরণ ঘটে প্রণয়ে। পরবর্তীতে জেনিফারের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটলে তীব্র কষ্ট হয় উৎপলের। সে দহনের রেশ বহন করেন তিনি আজীবন। জেনিফারের সম্পর্ক মনে রেখে একাধিক কবিতাও লিখেছেন তিনি। সহধর্মিণী শোভা সেনের কথন অনুযায়ী, উৎপলের কাছে কবিতা ছিল ব্যক্তিগত আবেগ অনুভূতি অথবা কোনও তাৎক্ষণিক বক্তব্য প্রকাশের মাধ্যম। আবৃত্তিশিল্পী হিসেবেও তিনি ছিলেন অতুলনীয়। তুরস্কের কবি নাজিম হিকমতের লেখা, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অনুবাদে ‘জেলখানার চিঠি’ কবিতার অসাধারণ আবেগি আবৃত্তি কানে ভাসে। সেই সাথে ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র হোসেন মিয়ার গায়ন, সুর আমাকে সবসময়ই তাঁর কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।

৬.
উৎপলের ছোটবেলা, পারিবারিক পটভূমি ও নানা বিরোধী স্রোতের মধ্যে দাঁড়িয়ে এক বালকের সৃষ্টিসত্তার জাগরণ ঘটতে দেখি আমরা। স্কুল ও কলেজে, বিশেষ করে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়ার সময় তাঁর নাট্যক্ষমতার বিকাশের পটভূমিটিও স্পষ্ট। এর পর উৎপল দত্তের জীবনের এক মাহেন্দ্রক্ষণে গুরুত্বলাভ ঘটে। ইংরেজ নাট্যব্যক্তিত্ব জেফ্রি কেন্ডালের পেশাদার নাট্যশালায় দীক্ষা ও প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে পরবর্তী জীবনের পেশাদার নাট্যকর্মী উৎপল সর্বাঙ্গীণ বিকাশের ঠিকানা খুঁজে পান। জেফ্রি কেণ্ডালকে 'গুরু' মেনে 'শেক্স্পিয়ারিয়ানা' দলে যোগ দিলেও উৎপল দত্ত তাঁদের নিজস্ব নাট্যদল 'দি অ্যামেচার শেক্স্পিয়ারিয়ান্স্' তুলে দেননি। বরং মাঝে মধ্যেই শেক্স্পিয়ার, বার্নাড শ, শেরিডান, প্রিস্টলি, নোয়েল কাওয়ার্ডের নাটক মঞ্চস্থ করেছেন তারা। এবং সেই সময়েই উৎপল দত্ত অভিনেতা হিসাবে কলকাতার নাট্যসমালোচকদের স্বীকৃতি পেয়েছেন। এই পথে চলেই ১৯৪৯ সালের শেষ দিকে, কবি-গায়ক দিলীপ রায়ের প্রস্তাব মতো, উৎপলরা তাদের দলের নাম বদলে রাখেন লিটল থিয়েটার গ্রুপ - এল টি জি। ততদিনে কুড়ি বছরের সদ্যযুবা উৎপল ঠিক করে ফেলেছেন তিনি নাটক-অভিনয়ের জগতেই থাকবেন। সমাজের পরিবেশ তখন কেমন? বিশ্বের অঙ্গনে সোভিয়েত রাশিয়ার মতাদর্শের অপ্রতিরোধ্য অগ্রগতি। সঙ্গে যোগ দিয়েছে মাও-সে-তুঙের জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্নকারী চীন। এদিকে দেশ স্বাধীন হবার সাত মাসের মাথায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত। পার্টির নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন সাংস্কৃতিক কর্মীদেরও রেহাই নেই। মার্কসবাদী দর্শনে আকৃষ্ট উৎপলের মনোভঙ্গী কলেজ পত্রিকায় প্রকাশিত, 'সময় এগিয়ে চলে, এমন কি শরৎচন্দ্রের যুগও অতিক্রান্ত হতে চলেছে। নতুন প্রজন্মের মৃত্যুর বিরুদ্ধে জেহাদ, তাদের কাব্যলক্ষ্মী হলেন শ, লরেন্স, জয়েস এবং হাক্সলি। ম্যাঞ্চেস্টার এবং স্তালিনগ্রাদ তাদের দুর্গ; ডাস ক্যাপিটাল তাদের নতুন বেদ। তাদের আনুগত্য তথ্যের প্রতি, আঙ্গিকের আতিশয্যের বিরুদ্ধে তাদের চ্যালেঞ্জ। রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটছে সাহিত্যে, শ্রেণীসংগ্রামে এবং শোষিত বঞ্চিতের মহাক্ষুধায়।' 

৭.
এরপরই লিটল থিয়েটার গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা উৎপল দত্তের গোত্রান্তর ঘটে। মার্ক্সবাদী জীবনবীক্ষায় তাঁর আস্থা দৃঢ়তর হতে থাকে। কারণ রাজনৈতিক দর্শনের দিক থেকে তিনি ছিলেন বামপন্থী ও মার্ক্সবাদী। ভারতীয় গণনাট্য সংঘের ছত্রছায়ায় থিয়েটার করার স্বল্পকালীন অভিজ্ঞতার পরে তিনি ফিরে আসেন নিজের দলের সৃজনী-বৃত্তে। কিন্তু ‘জনতার মুখরিত সখ্য’ থেকে আর দূরে থাকেননি কখনও। ইংরেজি পেশাদার থিয়েটারের কঠোর শৃঙ্খলার সঙ্গে এ বার যোগ হয় রাজনৈতিক থিয়েটার গড়ে তোলার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। পথ-নাটকের সৃষ্টি ও প্রযোজনার সঙ্গে সঙ্গে পেশাদারি ভিত্তিতে মিনার্ভা রঙ্গালয় চালানোর দুরূহ নিরীক্ষায় নিযুক্ত হন উৎপল ও তাঁর দল এল টি জি। তত দিনে সত্তর দশকের উত্তাল সময় এসে পড়েছে। নকশালপন্থী রাজনীতির প্রতি আকর্ষণ থেকে তৈরি নাটক ‘তীর’ উৎপলকে সংকটের সীমায় নিয়ে যায়। বামপন্থার মূল ধারার সঙ্গে সংঘাত ও দ্বন্দ্বের কারণে মিনার্ভা থিয়েটার ছাড়তে হয় উৎপলকে। উপর্যুপরি গ্রেফতার, কারাবাস ও রাজনৈতিক তৎপরতায় উৎপলের জীবন এই সময়-পর্বে বিক্ষুব্ধ, টালমাটাল। এর পর অক্লান্ত উৎপল গড়ে তোলেন নতুন নাট্যসংস্থা পিপলস লিটল থিয়েটার। এক আধুনিকতর নাট্য-ব্যক্তিত্বের অভ্যুদয় লক্ষ করি আমরা। রাজনৈতিক যাত্রাপালা রচনা ও প্রযোজনায় নতুন ঘরানা সৃষ্টি করেন এই পর্বেই। চলচ্চিত্রের অনন্য অভিনেতা হিসেবেও এই দ্বিতীয় পর্বে উৎপলের প্রতিষ্ঠালাভ ঘটে।

৮.
ইংরেজি নাটক প্রযোজনার পাশাপাশি লিটল থিয়েটার গ্রুপ শুরু করে বাংলা নাটক। পঞ্চাশের দশকে এল টি জি মঞ্চে উপস্থাপিত করে রবীন্দ্রনাথের নাটক - অচলায়তন, কালের যাত্রা, গুরুবাক্য, সূক্ষবিচার, তপতী। ক্রমশ উৎসারিত হয় ঐতিহাসিক সব প্রযোজনা - অঙ্গার, ফেরারি ফৌজ, কল্লোল, অজেয় ভিয়েতনাম, তীর। পরবর্তীতে অভ্যন্তরীণ সংকটে এল টি জি ভেঙে যায়। প্রিয় মঞ্চ মিনার্ভা থিয়েটার ছাড়তে হয়। ১৯৭০ সালের ২২ এপ্রিল, লেনিনের জন্মদিনে, মিনার্ভায় এল টি জি'র শেষ নাট্যাভিনয় - লেনিনের ডাক। এরপরে জন্ম নেয় পিপলস লিটল থিয়েটার - পি এল টি। ১৯৭১ থেকে শুরু হয় তাদের নিয়মিত প্রযোজনা। আবারও মানুষজনকে অভিভূত করে সেইসব অসামান্য নাটক, অভিনয় - টিনের তলোয়ার, সত্যজিৎ রায়ের মতে, ভারতীয় থিয়েটারের সর্বোচ্চ শিখর। 'কল্লোল' মঞ্চস্থ হবার পর, বিশেষত উৎপল নকশালবাড়ির সংগ্রামের সমর্থনে পশ্চিমবাংলার এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াবার কারণে, বাজারি সংবাদপত্রগুলি কল্লোলের বিজ্ঞাপন ছাপা বন্ধ করে দেয়। এমন কী সি পি এমের মুখপত্র 'দেশহিতৈষী'ও একসময় সে বিজ্ঞাপন ছাপেনি। এরপরে 'তীর' নাটক, যা নকশালবাড়ি আন্দোলনের সমর্থনে লিখিত, উপস্থাপিত হবার কালে উৎপল দত্তকে বোম্বাই থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। দিন দশেকের মধ্যে মুচলেকার বিনিময়ে ছাড়া পান নাটককার। উৎপল চলে যান রাজস্থান - একটি আন্তর্জাতিক প্রযোজক সংস্থার 'গুরু' চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে। এই ঘটনায় প্রবল বিতর্কের সূত্রপাত। নকশালপন্থীদের মতে এ উৎপলের বিশ্বাসঘাতকতা। এল টি জি উৎপল এবং তাঁর স্ত্রী শোভাকে বহিষ্কার করে। কিছুকাল পরে উৎপল-অনুরাগীরা বোঝাবার চেষ্টা করেন এ ছিল তাঁর কৌশল। পরবর্তীকালে উৎপল তাঁর 'Towards a Revolutionary Theatre' গ্রন্থে এমন ধারণা গড়বার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিয়েছেন। 

৯.
এক অসামান্য স্মৃতিচারণায় স্ত্রী শোভা সেন লিখেছেন, ‘বিয়ের পর উৎপলের সঙ্গে ইউরোপ ও সোবিয়েত ভ্রমণ থেকে ফেরার পর নতুন নাটক ধরা হল৷ অদ্বৈত মল্লবর্মণের বিখ্যাত উপন্যাস ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ নাট্যরূপ দিয়ে উৎপলের পরিচালনায় ১৯৬৩ সালের ১০ মার্চ দোলপূর্ণিমার দিন মিনার্ভায় মঞ্চস্হ হল৷ আমাদের সনির্বন্ধ অনুরোধ, এই নাটকে ‘নবান্ন’খ্যাত নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য অংশগ্রহণ করেছিলেন৷ উৎপলের সামরিক শৃঙ্খলা ও বৈজ্ঞানিক মহলা পদ্ধতির মধ্যে ওই অসুস্হ প্রবীণ অভিনেতা ধীরে ধীরে অভ্যস্হ হয়েছেন৷ রাতের পর রাত জেগে ওই সময়ে মহড়া চলত৷ পরিচালকের কোনও ক্লাম্তি নেই৷ তার সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে আমাদেরও ঘুম নেই৷ মালোপাড়ার ভাষা আর উচ্চারণ নীলিমা দাসের মতো অভিনেত্রী শিখেছিল বিজনদার কাছে৷ আমরা ততদিনে এস আর দাস রোডে নতুন পাড়ায় উঠে এসেছিলাম৷ এই ফ্ল্যাটটি উৎপলের খুব পছন্দ ছিল৷ ষাটের দশকের এই পর্বে উৎপলের সৃজনশক্তি তুঙ্গ স্তরে উঠেছিল৷ সারা রাত এই সময়ে চলত থিয়েটারের মহড়া৷ আমরা দিনের বেলা ঘুমিয়ে বা বিশ্রাম নিয়ে ক্লাম্তি দূর করতাম৷ কিন্তু উৎপল গোটা দিন মগ্ন থাকত নাট্য ও প্রবন্ধ রচনা বা অন্য সারস্বতচর্চায়৷ পাশাপাশি এরই মধ্যে সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মীর মতো পথনাটক বা বক্তৃতা দিয়ে প্রচার সমাবেশের মধ্যমণি ছিল উৎপল৷ সন্ধ্যায় হোত নাটকের শো৷ উৎপলের এই নিরলস পরিশ্রম এবং দানবীয় কর্মকাণ্ডের রহস্য কী? এই সময়ে শরীরের স্বাভাবিক ক্লাম্তি, অবসাদ এবং নিদ্রার অমোঘ প্রভাব কাটাতে উৎপল নিয়মিত স্নায়ু উত্তেজক, অত্যম্ত ক্ষতিকারক ‘কোরিড্রেন’ ওষুধ খেয়ে গেছে৷ আমি জানার পর এই আত্মবিনাশকারী ওষুধ খাওয়া বন্ধের চেষ্টা করেছি৷ হাতের কাছ থেকে ওষুধ সরিয়ে ফেলেছি৷ কিন্তু আমাকে লুকিয়ে দিনের পর দিন ওই ওষুধ খেয়ে উৎপল তার সৃজনক্ষমতা চাঙ্গা রেখেছে৷ রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে কৃত্রিম উপায়ে চিম্তাশক্তি ও লেখনীকে দ্রুতগতিসম্পন্ন ও সপ্রতিভ রাখতে গিয়ে উৎপলের শরীরের যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছিল৷ এই মারণ স্টেরয়েড ওষুধগুলি উৎপলের বিভিন্ন অত্যাবশ্যক অঙ্গ- প্রত্যঙ্গের চিরস্হায়ী ক্ষতি করে দিয়েছিলক্ট যা তার অকালমৃত্যুর অন্যতম কারণ৷ ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উৎপলের জীবনের একটি সেরা পরিচালনার দৃষ্টাম্ত হয়ে থাকবে৷ বিজন ভট্টাচার্যের মতো খ্যাতিমান, শক্তিশালী অভিনেতাও পরিচালক উৎপলের দাপটে পার্ট মুখস্হ করতে বাধ্য হয়েছিলেন৷ আসলে বিজনদা ছিলেন আবেগাশ্রয়ী অভিনেতা, তাই চরিত্রে ডুবে গিয়ে পার্ট ভুলে যেতেন৷ কিন্তু উৎপলের মতে, অভিনেতার এত আবেগপ্রবণ হওয়া উচিত নয়, বৈজ্ঞানিক থিয়েটারে এটা চলে না৷ যাই হোক, ‘তিতাস’ খুব জনপ্রিয় হয়েছিল৷ বিশিষ্ট লোকসঙ্গীত শিল্পী নির্মলেন্দু চৌধুরির সুরে ও গানে, তাপস সেনের আলোর মায়ায়, মালোপাড়ার মাটির গন্ধমাখা জীবন-চিত্রণে, কৌম সংস্কৃতির পরিচয়ে এই নাটক প্রাণবম্ত হয়ে ওঠে৷ ‘তিতাস’-এর অন্য আকর্ষণ ‘কালোবরণ’ চরিত্রে উৎপলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ অভিনয়৷ আমার অনুতাপ, আজকের থিয়েটারের ছাত্রছাত্রী বা দর্শক এগুলি দেখতে পেল না৷ কারণ, ‘ফরিয়াদ’ ছবির লম্পট, নির্মম হোটেলমালিক কিংবা ‘অমানুষের’ মহিম ঘোষাল অথবা ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’ ছবির মগনলালের থেকে কালোবরণ একেবারে আলাদা৷ কলকাতা পুরসভা ‘তিতাস’ নাটকে হলের মাঝখানে ক্যাট ওয়াকের জন্য র্যাম্প ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করল৷ এর মধ্যে বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় ‘তিতাস’ দেখে ভীষণ মুগ্ধ হয়েছিলেন৷ উৎপলের প্রতিটি নাটক তিনি দারুণ আগ্রহভরে প্রথমেই দেখতেন৷ উৎপল নাট্যাঙ্গিক শিখেছিল মস্কোয় রুশ নাট্যনক্ষত্র অখলপকভের কাছে৷ শেষে সত্যজিৎবাবুর নির্দেশে কলকাতা পুরসভা এই নাটকের ছাড়পত্র দিতে বাধ্য হয়েছিল৷ বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে এটা সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে৷ ষাটের দশকের দিনগুলি ছিল অস্হির, উত্তেজনাময়৷ ১৯৬২ সালের চীন-ভারত সীমাম্ত সঙঘর্ষের উত্তপ্ত পরিবেশের মধ্যে এই দেশের এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতার বিষে আক্রাম্ত হয়েছিলেন৷ শাসকশ্রেণী ও প্রভাবশালী গণমাধ্যমের ক্রমাগত ইন্ধনে ১৯৬৪ সালে কলকাতার রাস্তায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ল৷ সঙঘর্ষের লেলিহান আগুনে মধ্য কলকাতার কলাবাগান বস্তি পুড়ে ছাই হয়ে গেল, কাছেই বিডন স্ট্রিটে মিনার্ভা থিয়েটারে রাজনৈতিক মদতপুষ্ট দুষ্কৃতীরা হামলা চালাল৷ কারণ, সেখানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন৷ এর প্রতিবাদে উৎপল বিখ্যাত জার্মান নাট্যকার ফ্রিডরিশ ভোলফের ‘প্রোফেসার মামলক’ মূল জার্মান ভাষা থেকে অনুবাদ করে মঞ্চস্হ করেছিল৷ শাসকশ্রেণী কীভাবে জাতিদাঙ্গাকে কাজে লাগিয়ে মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে, এই নাটকে তা দেখানো হয়েছিল৷ এই নাটকেই সিনেমার প্রখ্যাত অভিনেত্রী রিনা (অপর্ণা সেন) এল টি জি- তে যোগ দিয়েছিল৷ রিনা ছিল আমার বহুদিনের পরিচিত৷ সে আমায় শোভামাসি বলে ডাকত৷ কিন্তু উৎপলকে রিনা রীতিমতো ভয় পেত সে সময়ে৷ বিশেষত থিয়েটারের প্রশিক্ষণ শিবিরে৷ রিনার সমস্ত সমস্যা, নালিশ আমায় জানাত৷ মহলার সময় আমিও অবশ্য উৎপলকে ভয় পেতাম৷ এই নাটকে প্রফেসার মামলকের চরিত্রে উৎপলের অবিস্মরণীয় অভিনয় আমাদের বিস্মিত করে দিয়েছিল৷ ১৯৬৫ সাল আমার জীবনের এক উত্থাল-পাথাল পর্ব৷ আমার জীবন মানে তো উৎপলকে কেন্দ্র করেই তা আবর্তিত৷ সে বছর মার্চে মিনার্ভায় মঞ্চস্হ হয়েছিল উৎপল রচিত ও পরচালিত ‘কল্লোল’ নাটক৷ ১৯৪৬ সালের ভারতীয় নৌ-বিদ্রোহ এবং যুদ্ধ জাহাজ ‘খাইবার’এর ঐতিহাসিক ভূমিকা নিয়ে উৎপলের এই নাটক অবশ্যই আমাদের থিয়েটারের ইতিহাসে একটি ক্রোশফলক।’

১০.
আশির দশকের শেষ দিক থেকেই অসুস্থ হতে শুরু করেন উৎপল। বিচিত্র প্রতিভার নাট্যব্যক্তিত্ব উৎপল দত্তের সৃষ্টিশীল জীবনের অবসান ঘটে ১৯৯৩ সালের ১৯শে আগস্ট। বর্ণময় এই বাঙালি অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক ও লেখক উৎপল দত্তের জন্মদিনে জানাই আবারো শ্রদ্ধাঞ্জলি। অভিনেতা, পরিচালক ও লেখক উৎপল দত্ত (মার্চ ২৯, ১৯২৯ - আগস্ট ১৯, ১৯৯৩) ছিলেন সব ধরনের অভিনয়ে স্বচ্ছন্দবিহারী। যেমন তিনি সিরিয়াস রোলে দুর্দান্ত অভিনয় করতেন, তেমনই মজাদার অভিনয় করতেন কমিক রোলে। ভিলেনের ভূমিকাতেও তিনি কম যেতেন না। ভুবন সোম-এ তাঁর চরিত্রাভিনয় বা শ্রীমান পৃথ্বীরাজ-এ তাঁর কৌতুকাভিনয় অথবা জয় বাবা ফেলুনাথ-এ মগনলাল মেঘরাজ – এ কি ভোলা যায়। উৎপল দত্ত অভিনীত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র – বিদ্যাসাগর (১৯৫০), মাইকেল মধুসূদন (১৯৫০), চৌরঙ্গী (১৯৬৮), ভুবন সোম (১৯৬৯), গুড্ডি (১৯৭১), ক্যালকাটা ৭১ (১৯৭১), শ্রীমান পৃথ্বীরাজ (১৯৭৩), ঠগিনী (১৯৭৪), যুক্তি, তক্কো আর গপ্পো (১৯৭৪), কোরাস (১৯৭৪), পালংক (১৯৭৫), অমানুষ (১৯৭৫), জয় বাবা ফেলুনাথ (১৯৭৮), গোলমাল (১৯৭৯), হীরক রাজার দেশে (১৯৮০), আঙ্গুর (১৯৮২), পার (১৯৮৪), পথভোলা (১৯৮৬), আজ কা রবিনহুড (১৯৮৭), আগন্তুক (১৯৯১), পদ্মা নদীর মাঝি (১৯৯৩) ইত্যাদি।

১১.
উৎপল দত্ত জন্মেছিলেন এক সংক্ষুব্ধ সময়ের বুকে। সমগ্র বিশ্বএবং বিশেষ করে পাক-ভারতীয় উপমহাদেশে তখন কালকের সকালটি কেমন হবে একথা বলাছিল দুষ্কর। বিশ শতকের প্রথম দশক থেকে বৈশ্বিক রাজনৈতিক পট পরিবর্তনেরসঙ্গে সঙ্গে বদলে যেতে থাকলো অর্থনৈতিক অবস্থা, সামাজিক মূল্যবোধেরপ্যাটার্ন, মানুষের আর্ন্তজাগতিক ভূগোল এবং তৎসম্পর্কিত বাহ্যিক আচার-আচরণ, যা চল্লিশের দশকে গিয়ে আরও পরিণত হলো। উৎপল দত্তের বেড়ে ওঠা এই কালখণ্ডে।এই সময়ের কল্যাণে যিনি বিশ্বের পাশে পেয়েছিলেন জীবনের অসংখ্যশাখা-প্রশাখাময় বৈচিত্র্যের সন্ধান। সেই কালোত্থিত জীবনের বৈচিত্র্যসংযাতরাজনৈতিক রসায়ন উৎপল দত্তের নাটকের প্রধান মনোযোগ। রাজনৈতিক নাট্যশালা এক অনন্য রণক্ষেত্র। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ রাজনৈতিক সংগ্রামের এইরণাঙ্গনে নানা ভূমিকায় নানা রূপে উৎপল দত্তের প্রবেশ ও সংগ্রাম। অভিনেতা, প্রযোজক, পরিচালক, নাট্যকার, নাট্যান্দোলন কর্মী- যখন যে রূপে প্রয়োজন তখনসে রূপে আবির্ভূত উৎপল দত্ত। অন্যদের থেকে তিনি স্বতন্ত্র কারণ এই সবগুলোক্ষেত্রে তাঁর সফলতা ছিল তুঙ্গে। তবে নাট্যকার হিশেবে সকল প্রতিভাকে অতিক্রম করেছেন তিনি। এই শিল্পী-যোদ্ধার অক্ষয় তূণীরের শ্রেষ্ঠ আয়ূধ তাঁরনাটক। রাজনীতি যেমন মানুষকে মানুষের খুব কাছে নিয়ে যায়, চিনতে শেখায়, অধিকার সচেতন করে, সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথের দিশা দেখায়, ভুল-শুদ্ধ-প্রয়োজন-অপ্রয়োজনীয়তাকে বোঝার মঞ্চ তৈরি করে দেয়, তেমনি নাটক মানুষের সঙ্গে সরাসরি রাজনৈতিক, আত্মিক, সামাজিক, সাংস্কতিক, ঐতিহ্যিক সংগ্রামের যোগাযোগ স্থাপন করে। 

১২.
তাঁর মানুষ সংক্রান্ত চেতনা শ্রেণিসমাজের বাস্তব চেতনাকেই ধারন করে। সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদি মানুষ সম্পর্কে তাঁর গভীরতম ধারনা তাঁর নাটকগুলোকে সফল করেছে। বঙ্গীয় রেনেসাঁসের এক বিশ্লেষকও তিনি। উনিশ শতকের বঙ্গীয় সামন্তশ্রেণির বিরুদ্ধে মধুসূদনের বিদ্রোহকে তিনি মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছেন, মধুসূদন শেষ পর্যন্ত উনিশ শতকের ঘুণধরা ও বিকলাঙ্গ সমাজের বিরুদ্ধে মূর্তিমান বিদ্রোহ। নাটক উৎপল দত্তের কাছে নিছক অবসর-বিনোদনের আশ্রয় নয়, তা অস্ত্র ; এবং এই নাট্যকারের হাতে তা ‘টিনের তলোয়ার’ও নয়, তা ‘রাইফেল’। উৎপল দত্তেররাজনৈতিক নাটকগুলোর মধ্যে আবার পাওয়া যায় শ্রেণীচেতনা, ইতিহাস চেতনা ওমধ্যবিত্ত চেতনা। ‘টিনের তলোয়ার’, ‘রাতের অতিথি’, ‘ছায়ানট’, ‘সূর্যশিকার’, ‘মানুষের অধিকার’ প্রভৃতি নাটকে যেমন পাওয়া যায় শ্রেণীচেতনা সচেতনতা, তেমনি ‘টোটা, ‘লাল দুর্গ’, ‘তিতুমীর’, ‘কল্লোল’,‘দিল্লী চলো’, ‘ক্রুশবিদ্ধ কুবা’ প্রভৃতি নাটকের ইতিহাস চেতনা, ‘অঙ্গার’, ‘ফেরারী ফৌজ’ প্রভৃতি নাটকের মধ্যবিত্ত চেতনা তাঁর নাটককে দেয় ভিন্নমাত্রা। 

১৩.
উৎপল দত্তের নাটকে ভারতবর্ষের সমাজ, রাজনীতির পাশাপাশি উঠে এসেছে বিশ্বরাজনীতি, অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রয়াস, মানবতার জয়তুজীবনজিজ্ঞাসা প্রভৃতি বিষয়। ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ আজীবন সংগ্রামী। এখানেযেমন অন্যায়, অত্যাচার, দখল, শাসন-শোষণ নিত্য চলেছে, তেমন নিপীড়িত, শোষিত, সর্বহারা মানুষ তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে বারবার; আদায় করেছে তাদের কাঙ্ক্ষিত অধিকার। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক গণ-বিপ্লবের কাহিনী তাঁর নাটকেরঅন্যতম বিষয়বস্তু। গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময়কালে হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, ১৮৫৭ সালের ভারতীয় মহাবিদ্রোহ, নীলবিদ্রোহ, সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, ওয়াহাবি আন্দোলন, জালিয়ানওয়ালাবাগের রক্তাক্ত অধ্যায়, আজাদ হিন্দ ফৌজের দুঃসাহসিক অধ্যায়, ভারতের নৌবিদ্রোহ, দেশবিভাগের মর্মদন্তু ঘটনা ইত্যাদি। শুধু তাই নয়, বিশ্বের সংগ্রামী মানুষের মরণপণ সংগ্রামী ঘটনাগুলিও তাঁর নাটকে ধরা পড়েছে গভীর ইতিহাস বীক্ষার আলোকে।পৃথিবীর প্রথম শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র গঠনের যে ঘটনা আজও সর্বহারা শ্রেণীর চোখের মণি সেই প্যারি কমিউন, অক্টোবর বিপ্লবের পূর্ব ও উত্তরকাল, ফ্যাসিবিরোধী সংগ্রাম, চীনের বিপ্লব, ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধ, কিউবা, ইন্দোনেশিয়া, একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় ও প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের কলঙ্কজনক ভূমিকা- সবই তিনি লিপিবদ্ধকরে গেছেন তাঁর নাটকের বিষয়বস্তুতে।

১৪.
আগেই লিখেছি, নিজেকে তিনি বলতেন ‘প্রোপাগান্ডিস্ট’। প্রচলিত সমাজব্যবস্থার ভিত কাঁপিয়ে দেওয়া ছিল তাঁর প্রোপাগান্ডার বিষয়। প্রোপাগান্ডা করতে গেলে দরকার মানুষকে ক্রুদ্ধ করে তোলা। গণ-আন্দোলনের পথে নামলে প্রকাশ পাবে সেই ক্রোধ ও সংগ্রামেরমুষ্টিবদ্ধ প্রয়াস। উৎপল দত্ত তাঁর সমগ্র নাট্যজীবনে এই ব্রতকেই শিরোধার্য করেছিলেন। ইতিহাস আশ্রিত নাটকগুলোর মধ্যে ‘কল্লোল’, ‘ব্যারিকেড’, ‘একলা চলো রে’, ‘জনতার আফিম’, ‘তিতুমীর’, ‘সন্ন্যাসীর তরবারি’, ‘ক্রুশবিদ্ধকুবা’, ‘টোটা’, ‘অজেয় ভিয়েতনাম’ উল্লেখযোগ্য। ভারতের ঐতিহাসিক নৌ-বিদ্রোহ নিয়ে লেখা ‘কল্লোল’ উৎপল দত্তের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক নাটক।এই নাটকের মধ্য দিয়ে তিনি ইতিহাসের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে এই বিদ্রোহ নতিস্বীকার করেছিল। কিন্তু না, ‘কল্লোল’ নাটকেকরেনি। উৎপল দত্তের নিজস্ব ভাষ্যে পাওয়া যায় : ‘৪৬-এর নৌ-বিদ্রোহ একবৈপ্লবিক প্রক্রিয়ার সূচনা। এই সেই প্রক্রিয়া যা ব্রিটিশ কংগ্রেস-মুসলিমলিগ চক্রের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত করতে বাধ্য করলো স্বতঃসিদ্ধভাবে।ইতিহাসের প্রক্রিয়াই তাই। এই সেই প্রক্রিয়া এবং ষড়যন্ত্র যাতে সমগ্রভারতবর্ষটাই প্রজ্জ্বলিত হলো বিদ্রোহে। এই সেই প্রক্রিয়া যার অমোঘ নিয়মেভারতী বুর্জোয়া সশস্ত্র সংগ্রামের দুঃস্বপ্নে আজও ভীত। এই প্রক্রিয়াবৈপ্লবিক স্বপ্নের। বিপ্লবের। তাই থিয়েটারের বর্ণমালায় ‘খাইবার’ আত্মসমর্পণ করেনি যেমন আইজেনস্টাইনের ‘ব্যাটেনশিপ পোটেমকিন’-এ করেনি, যদিও ইতিহাস বলেকরেছিল। পোটেমকিনের বিদ্রোহীরা মহান অক্টোবর বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে এসেনিজেদের উপনীত করেছিল। ইতিহাসের মানদণ্ডে পোটেমকিন নাবিকদের আত্মসমর্পণ কোনবিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বৈপ্লবিক প্রক্রিয়ার তার পুনঃসূচনা। সেই বৈপ্লবিক প্রক্রিয়ার এক অন্যতম উপাচার কল্লোল।’ এই নাটকের সব ঘটনাই ঐতিহাসিকএই অর্থে যে, ১৯৪৬ সালের নৌ-বিদ্রোহে যা ঘটেছিল তা থেকেই এর আদ্যোপান্ত গঠিত। তার মানে এই নয় যে খাইবার নামক জাহাজে এই ঘটনা ঘটেছিল নাট্যকার একাধিক জাহাজের অভিজ্ঞতাকে একত্রিত করে একটিমাত্র জাহাজে সন্নিবেশ করেছেন, সংক্ষেপন করেছেন। ‘খাইবার’কে এখানে প্রতীকীভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে সববিদ্রোহী জাহাজের প্রতিনিধি হিসেবে। প্রকৃত ইতিহাস যদি উন্মোচিত হয় তবেআমরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে পারি কিভাবে সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল ওমোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ নাবিকদের বিনা শর্তে আত্মসমর্পণের উপদেশ দিয়ে শেষপর্যন্ত নাবিকদের বন্দী করালেন এবং ব্রিটিশ লৌহ শক্তির যবনিকায় প্রেরণ করেসকল প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের অন্যতম শরিক হয়ে ইতিহাসের বিড়ম্বনায় রূপান্তরিতহলেন। এ কথা এখন স্পষ্ট যে দুই নেতার সরাসরি বিদ্রোহ-বিরোধীতা মোলায়েম ভাষায় আত্মসমর্পণের জাল তৈরি করেছিল। কারণ তারা তখন নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে স্বাধীনতার দর-দস্তুর করতে অনেক ব্যস্ত ছিলেন। কংগ্রেসের এই দেউলিয়া রাজনীতি নাটকে স্পষ্ট।

১৫.
‘কল্লোল’ নাটক একটি বিশেষ যুগকে ধরে রেখে সেই যুগের বৈশিষ্ট ফুটিয়ে তুলেছে। এ নাটক একটি যুগসৃষ্টির অধিকারী, এইকারণেই যে ঐ বিশেষ যুগের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক চেহারার যথাযথপ্রতিফলন ঘটে এ নাটকের সর্বত্রে। ‘একলা চলরে’ নাটকে দেখি ‘দেশেরবিনা রক্তপাতে’ স্বাধীনতার সঙ্গে প্রকৃত গান্ধীবাদীদের নিগ্রহ। যারা নিগ্রহকরেছেন তারাও কংগ্রেসি, তবে তারা ভূস্বামী, জমিদার। স্বাধীনতার মুনাফাতারাই লুটেছেন বেশি। মুনাফার তাগিদে সাম্প্রদায়িকতার ইন্ধন তারাই জুটিয়েছেননির্লজ্জভাবে। চাষীর অন্ন খেয়ে ভুঁড়ি বাড়িয়ে কৃষক সমাজকে ভাগ করেছেনমুসলমান চাষী এবং হিন্দু চাষী আক্ষ্যা দিয়ে। নাট্যকার দেখিয়েছেন স্পষ্টভাবেশান্তি এবং ক্ষমার প্রতীক সত্যাগ্রহী কংগেসি পিতাও রেহাই পায়নি ব্রিঠিশরাজশক্তির পুলিশবাহিনীর হাত থেকে যখন তারা জানতে পেরেছে তার পুত্রব্রিটিশের মূলোচ্ছেদে সশস্ত্র বিপ্লবীদের সঙ্গে যুক্ত। পুত্র সহিংস বলেঅহিংস পিতাকে ক্ষমা করেনি। ‘রাইফেল’ নাটকের বিষয়বস্তু ত্রিশ থেকেচল্লিশের দশক পর্যন্ত। ১৯৩৪ সালে ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরেবিপ্লবী দলের যে অভ্যুত্থান ঘটেছিল সেটাকে নাট্যকার তুলে ধরেছেন এখানে।আন্দোলন নিয়ে বিপ্লববাদী ও গান্ধীবাদীদের মধ্যে যে মতদ্বৈততা ছিল তাকে নাট্যকার রূপায়িত করেছেন অসাধারণ নাট্যোৎকণ্ঠায়। অবশ্য এই মতদ্বৈততায় উৎপলদত্ত বিপ্লববাদেই বিশ্বাসী। নাটকের শুরুতেই নাট্যকার সূত্রধর চরিত্রের মাধ্যমে সেই প্রশ্নই তুলে ধরেছেন, ‘‘কান পেতে শুনুন, চারিদিকে ঢক্কানিনাদ, দেশ স্বাধীন হয়েছে বিনা রক্তপাতে, অহিংস সংগ্রামের দৌলতে! দেশ নাকিস্বধীন হয়েছে খদ্দর পরার ফলে, আমরা একমনে চরকা কেটেছি বলে! অহিংস সংগ্রামের ফলে দেশ স্বাধীন? তবে কি ক্ষুদিরামের নাম মুছে ফেলা হবে ইতিহাসথেকে? বিনা রক্তপাতে দেশ স্বাধীন? তবে কি সূর্যসেনের রক্ত রক্ত নয়? তবে কিসে যুগে ঝাঁসির রানী লক্ষ্ণীবাই আর তিতুমীর, আর এযুগে নৌ-বিদ্রোহী আরসুভাষচন্দ্রের সশস্ত্র আই. এন. এ. বাহিনী আমাদের কেউ নয়?’ এইসংলাপের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয় নাট্যকারের আদর্শ। পরাধীন ভারতে যারা দোসর ছিলতারাই ’৪৭ পরবর্তী ভারতে ক্ষমতায় বসে। তাই গণমানুষের স্বাধীনতার স্বপ্নথেকেই যায়। উৎপল দত্ত বোধহয় এটাই দেখাতে চান যে, পরাধীন ভারতে ব্রিটিশরা যেমন সাধারণ মানুষের ওপর নির্যাতন চালাত, শাসন-শোষণ করত, ঠিক তেমনিভাবে শোষণ নির্যাতন করে স্বাধীন দেশের কংগ্রেসীরা। কংগ্রেসী স্বাধীনতাকে নাট্যকার স্বাধীনতা বলতে নারাজ। সেটা শুধু ক্ষমতার পালাবদল, কাঠামো বদল নয়।নাটকের শেষে তাই বিপ্লবীরা আবার ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয় ব্যক্ত করে। লুকিয়ে রাইফেল নিয়ে তারা আবার ঘুরে দাঁড়াতে চায়। নাট্যকার স্পষ্টভাবে বোঝাতে চেয়েছেন অস্ত্র ছাড়া বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে জেতা সম্ভব নয়। তাই রাইফেল হয়ে ওঠে গণমানুষের হাতিয়ার। 

১৬.
‘ফেরারী ফৌজ’ নাটকে নাট্যকার ১৯৪৭ পূর্ব ভারতবর্ষের রাজনীতি ও আন্দোলনকে তুলে ধরেছেন। বাংলার আন্দোলনের ইতিহাসে যা অগ্নিযুগ নামে পরিচিত সেই যুগটি যেন ভেসে ওঠে চোখের সামনে। ইতিহাসকে এভাবে নতুন মাত্রায় উপস্থাপন করেন তিনি তাঁর রচনায়। ’৬০ এর দশকে লেখা এই নাটকের বিষয়বস্তু হিসেবে উঠে এসেছে স্বাধীনতা আন্দোলনে বিপ্লববাদীদের সাহসী ভূমিকাও কার্যকলাপ। তিনি ষাটের দশকে বিপ্লবীদের উত্থান-পতন, সংগ্রাম-বিচ্যুতিকে দেখিয়েছেন। এই বিপ্লবী আসলে কমিউনিস্টরা আর কংগ্রেস হলো রূপান্তরিত ব্রিটিশশক্তি। অশোক এই নাটকের অন্যতম প্রধান চরিত্র। শচী, বঙ্গবাসী, রাধারানী সবাই যেন বিপ্লবী। কেই প্রত্যক্ষ কেই পরোক্ষভাবে। এসব চরিত্রের মধ্য দিয়েনাট্যকার আমাদের ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে নারীদের সাহসিকতাকে তুলে ধরেছেন। কৃষকবিদ্রোহের নেতা তিতুমীরকে চব্বিশ পরগণার তৎকালীনব্রিটিশ রেসিডেন্ট এজেন্ট, ক্রফোর্ড পাইরন, একজন গবেষক হিসেবে হাজির করেছেন ‘তিতুমীর’ নাটকে। তিতুমীরের ঐতিহাসিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার ফাঁকে ফাঁকে তিনি বাংলার প্রাচীন পুঁথি গবেষণায় মত্ত। নাট্যকারএখানে একদিকে ক্রফোর্ড পাইরনের গবেষকের আপাত বিচ্ছিন্নতার সঙ্গে সঙ্গে তারঔপনিবেশিক স্বার্থরক্ষার বিষয়টিকে সুনিপুণ নাট্যকারের মতো আমাদের তিতুমীরের সাম্প্রদায়িকতা বিরোধীতা, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীতার লক্ষ্যে পৌঁছেদেয়। এ নাটকে তিতুমীর নাট্যকারের চোখে একজন অতিকথার নায়ক। ‘অতিকথা’ সমাজবিজ্ঞানীদের মতে মানুষকে এক বিশ্বাস প্রদান করে, যার ফলে সে নৈতিক বা ধর্মীয় কাঠামোর মাধ্যমে ঐ বিশ্বাসের দ্বারা বর্তমান জীবনকে ব্যখ্যা করতেচায়। তিতুমীরের চোখে দেশের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামই ধর্মরক্ষা করারসংগ্রাম : ‘যার যা আছে সব কিছু দিয়ে দিতে হবে, তবেই সে এই সংগ্রামের প্রকৃত যোদ্ধার দায়িত্ব বহন করার উপযুক্ত হবে।’

(তথ্যসূত্র : দেশ : ৩০ মার্চ, ১৯৯১, দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা, উৎপল দত্ত / রাজনীতি ও থিয়েটার : বাবলু ভট্টাচায, উৎপল দত্ত / জীবন ও সৃষ্টি : অরূপ মুখোপাধ্যায়, থিয়েটারওয়ালা, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত