জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

আহমদ রফিক

প্রকাশ : ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৩:২৬

১.
মহান ভাষা আন্দোলনের অন্য সংগঠক, রবীন্দ্র-গবেষক, কবি-প্রাবন্ধিক বাংলাদেশের বয়োজ্যেষ্ঠ লেখক আহমদ রফিক। আহমদ রফিকের জন্ম ১৯২৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। আমাদের সবার অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার প্রিয় ব্যক্তিত্ব আহমদ রফিকের জন্মদিনে এই মানুষটিকে জানাই নিরন্তর শুভেচ্ছা। আহমদ রফিক একাধারে কবি, প্রবন্ধকার ও গবেষক। কিন্তু ভাষাসৈনিক ও রবীন্দ্র গবেষক হিসেবেই সুপরিচিত। তিনি বলেছেন, ‘ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ আমাকে প্রভাবিত করেছে।’ চিকিৎসক হিসেবে ডিগ্রি গ্রহণ করেও তিনি পেশা হিসেবে বেছে নেননি, আজন্ম সাহিত্য সাধনা করে গেছেন একরিনষ্ঠ একাগ্রতায়। কলকাতার টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট তাঁকে রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য উপাধিতে ভূষিত করেছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গ্রন্থ- কবিতা : নির্বাসিত নায়ক, শ্রেষ্ঠ কবিতা; প্রবন্ধ-গবেষণা : দেশবিভাগ : ফিরে দেখা, গীতাঞ্জলি : রবীন্দ্রনাথ ও নোবেল পুরস্কার, একুশের দিনলিপি, নানা আলোয় রবীন্দ্রনাথ, ভাষা আন্দোলন : ইতিহাস ও তাত্পর্য, বাঙলা বাঙালি আধুনিকতা ও নজরুল, নির্বাচিত প্রবন্ধ; সম্পাদনা : বাংলা একাডেমি চিকিত্সা বিজ্ঞান পরিভাষা কোষ প্রভৃতি। তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদকসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। আমাদের জ্ঞানী-পন্ডিতের সংখ্যা নিতান্ত স্বল্প না হলেও সমাজে জ্ঞানী, বিবেকবান, নীতিনিষ্ঠ পণ্ডিতজনের বড়ই অভাব। যারা মেরুদন্ড সোজা রেখে আজীবন চলেছেন, তেমন মানুষের তো আকাল চলছে দেশে। হাতেগোনা যে দু-চারজন আছেন তাদেরই একজন আহমদ রফিক। যিনি আমাদের ক্ষমতার রাজনীতির কেনাবেচার হাটে পার্থিক লোভ-লালসায় নিজেকে কখনো বিকিয়ে দেননি। বিপরীতে আমাদের শাসকগোষ্ঠীর অগণতান্ত্রিক-স্বেচ্ছাচারী এবং ফ্যাসিবাদী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে বরাবর সোচ্চার থেকেছেন।

২.
বরেণ্য লেখক-গবেষক, প্রগতিবাদী চিন্তাবিদ-সর্বজন শ্রদ্ধেয় আহমদ রফিক রাজনীতির বাইরে লেখালেখি ও সাহিত্যচর্চাকে জীবনের একমাত্র ব্রত হিসেবে বেছে নিয়েছেন। মেধাবী চিকিৎসক হওয়া সত্ত্বেও চিকিৎসাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেননি। মানুষের দেহের রোগ প্রতিরোধ করার চেয়ে জাতির মনের রোগ প্রতিরোধ করতেই তিনি বদ্ধপরিকর। নিরন্তর লেখালেখির মাধ্যমে এই দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। পেশাগতভাবে ওষুধ ও শিল্প ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত থাকলেও সাহিত্য-সংস্কৃতি ও মনন চর্চাতেই তিনি ব্যাপৃত ছিলেন আজীবন। আজও তিনি পুরোপুরিভাবে সাহিত্যকর্মে সক্রিয়। উল্লেখওয, মহান ভাষা আন্দোলনের অন্য সংগঠক, রবীন্দ্র-গবেষক, কবি-প্রাবন্ধিক বাংলাদেশের বয়োজ্যেষ্ঠ লেখক আহমদ রফিকের ৯০তম জন্মদিন উপলক্ষে আগামী ১৪ সেপ্টেম্বর শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টায় বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠান ও সম্মাননা গ্রন্থের প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। এ অনুষ্ঠানে আপনি সবান্ধব আমন্ত্রিত।

৩.
আহমদ রফিক ৮৯ বছর পূর্ণ করে ৯০তে পা রাখলেন। জীবনের যে পথে তিনি এগোলেন, সে পথে তাঁর জীবনকে কেন্দ্র করে শতবর্ষের দিকে এগোচ্ছেন। আহমদ রফিক সুস্থ আছেন, তাঁর স্মৃতিশক্তি প্রখর, ভাবনাশক্তি উজ্জ্বল, নিজের চিত্তবৃত্তিকে বহুভাবে প্রকাশের ক্ষেত্রে তাঁর বিন্দুমাত্র আলস্য নেই, উৎসাহের অভাব নেই, বয়সের ভার বলে একটা কথার প্রচলন আছে, তাঁর বেলায় সেটি একেবারেই ছায়া ফেলতে পারেনি। সে যে আমাদের কত বড় সৌভাগ্য বলে বোঝানের মতো নয়। শতবর্ষের কথা বলছিলাম। আর ১০ বছর পরই আহমদ রফিক শতবর্ষী হবেন। তিনি শতায়ু পার হয়ে আমাদের সামনে উজ্জ্বল বর্তিকা হয়ে থাকবেন, চিন্তার সমুজ্জ্বলতায়। আহমদ রফিক বাংলা ভাষায় একজন শ্রেষ্ঠ লেখক, শ্রেষ্ঠত্বের একটি পরিমাপ তিনি নিজের কাজকে কেন্দ্র করে গড়ে তুলতে চেয়েছেন। আহমদ রফিক বলতেই চিন্তার একটি দৃশ্যপট আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হয়। সেটিই তাঁর পরিমাপ। সেখানেই বিশেষভাবে তাঁকে পাওয়া যায়। সেখানেই তিনি আহমদ রফিক। সেখানেই রয়েছে অখণ্ড মনুষ্যবাদ ও আন্তর্জাতিকতা। সেখানে রবীন্দ্রনাথ রয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ যে রয়েছেন সেটাই সেখানকার বড় বৈশিষ্ট্য ও পরিচয়।

৪.
আহমদ রফিক। সংগ্রামে, সৃজনে ও মননে এক অনন্য বাঙালী মনীষা। তাঁর সৃষ্টিজগৎ বিশাল এবং বহুমাত্রিক। বাল্যকাল থেকেই রাজনীতি ও সাহিত্যচর্চা শুরু। মুক্ত ও প্রগতিশীল চেতনার ধারক ও বাহক হিসেবে সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রাম ও খাঁটি বঙালিত্ব অর্জনের সাধনাই ছিল তাঁর একমাত্র ব্রত। জীবন সায়াহ্নে এসে আজও মুক্তচিন্তা ও অসাম্প্রদায়িকতার আদর্শ থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হননি। অর্থ, ক্ষমতা, লোভ-লালসার প্রতি বরাবরই ছিলেন নির্মোহ। মানবকল্যাণ ও সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামে নিবেদিতপ্রাণ আহমদ রফিক রাজনীতি শুরু করেছিলেন স্কুল জীবনে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনে যোগদানের মাধ্যমে। ষাটের দশকে এসে রাজনীতি থেকে বিদায় নিলেও তিনি কখনও রাজনীতিবিমুখ হননি বরং আজও তাঁর জীবনের অন্যতম অবলম্বন রাজনীতি ও সমাজ ভাবনা। নীতিহীন রাজনীতির বিরুদ্ধে সারাজীবনই সোচ্চার ছিল তাঁর কণ্ঠ ও কলম। সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রাম তথা রাজনৈতিক কারণে বহুবার বিপর্যস্ত ও বিপন্ন হয়েছে তাঁর ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবন। প্রগতিশীল রাজনৈতিক আন্দোলনে তিনি যে ত্যাগ ও সততার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত। 

৫.
রবীন্দ্র গবেষণা, ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাস গবেষণা এবং সাহিত্য গবেষণায় দু’বাংলায় আহমদ রফিকের তুলনা আহমদ রফিক নিজেই। আলোচ্য বিষয়গুলো নিয়ে তিনি এত বিশাল, ব্যাপক, পূর্ণাঙ্গ ও পাণ্ডিত্যপূর্ণ গবেষণা করেছেন, যা বাংলাদেশের গবেষণা জগতের ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হবে। প্রাবন্ধিক, কবি ও কলামিস্ট হিসেবেও তিনি সুখ্যাতি অর্জন করেছেন। তাঁর সৃষ্টিসম্ভার বিশেষত রবীন্দ্র গবেষণা ও মননশীল গদ্য রচনা সমগ্র বাংলা সাহিত্যে আপন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ¦ল। বিষয়বৈচিত্র্য ও গভীরতার দিক থেকে প্রবন্ধ সাহিত্যে তাঁর অবদান অতুলনীয়। তিনি যে সমস্ত গ্রন্থ রচনা করেছেন সেগুলো পাঠ করলেই তাকে জানা যাবে। 

৬.
আহমদ রফিককে চিনতে এবং বুঝতে হলে তাঁর জীবনব্যাপী সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রাম, সৃজনশীল ও গবেষণাধর্মী রচনা এবং গ্রন্থপঞ্জির সঙ্গে পরিচিতি একান্ত আবশ্যক। তাঁর প্রথম রচনা দারিদ্র্য ও সামাজিক বৈষম্য বিষয়ক একটি প্রবন্ধ। স্কুলে পড়ার সময় তিনি এ প্রবন্ধটি লিখে দেশ পত্রিকায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ‘শিল্প সংস্কৃতি জীবন’ প্রকাশিত হয় ১৯৫৮ সালে। বর্তমানে তাঁর রচিত ও সম্পাদিত পুস্তকের সংখ্যা ৭৫টির অধিক বলেই জানি। আরও বেশ কিছু গ্রন্থ প্রকাশের অপেক্ষায় আছে। সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, রাজনীতিসহ আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আহমদ রফিকের প্রজ্ঞা ও পাণ্ডিত্যপূর্ণ রচনা বাংলা ও বাঙালির জীবনের অনন্য সম্পদ। তাঁর মূল্যবান ও উচ্চমানসম্পন্ন রচনাবলী বাংলা ভাষীদের কাছে অবিনশ্বর হয়ে থাকবে।

৭.
বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক তিনি। একুশের অমর শহীদদের স্মরণে ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের এক রাতের যৌথ শ্রমে নির্মিত প্রথম শহীদ মিনারেরও তিনি অন্যতম স্থপতি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি রয়েছে তাঁর অগাধ বিশ্বাস। সর্বস্তরে বাংলাভাষার প্রচলন এবং একুশের স্মৃতি রক্ষা আন্দোলনেরও তিনি অন্যতম পথিকৃৎ। ১৯৭৬ সালে তাঁরই উদ্যোগে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে সর্বপ্রথম গঠিত হয় ‘একুশে পরিষদ’ এবং ‘ভাষা আন্দোলন জাদুঘর।’ তাঁরই সক্রিয় উদ্যোগ ও পরিকল্পনায় ১৯৮৬ সালে গঠিত হয় বাংলাদেশে রবীন্দ্র বিষয়ক গবেষণার প্রথম প্রতিষ্ঠান ‘রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্র ট্রাস্ট।’ সম্প্রতি তিনি গড়ে তুলেছেন ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চার পীঠস্থান ‘ভাষা ও সংস্কৃতিচর্চা কেন্দ্র।’ বর্তমানে তিনি একুশে চেতনা পরিষদ, শওকত ওসমান স্মৃতি পরিষদ-এর সভাপতিসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত। 
আহমদ রফিক একাধারে একজন দক্ষ সংগঠক এবং অপরদিকে তিনি তাত্ত্বিক, গবেষক, লেখক ও বহুগ্রন্থ প্রণেতা। একজন মানুষের মধ্যে সাধারণত এত গুণের সমাবেশ ঘটে না, আহমদ রফিক এদিক থেকে ব্যতিক্রম। 

৮.
দলীয় রাজনীতির সমর্থক না হয়েও এবং বর্তমানে রাজনৈতিক পরিম-লের বাইরের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও তিনি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছেন শুধুমাত্র তাঁর মেধা, মনন, অক্লান্ত শ্রম ও যোগ্যতার বলে। প্রচারবিমুখ হওয়া সত্ত্বেও তাঁর পরিচিতি সীমিত পরিসরে সীমাবদ্ধ নয়। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ছাড়াও দেশ-বিদেশ থেকে বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। সাহিত্য ক্ষেত্রে অবদানের জন্য ১৯৭৯ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৯৫ সালে একুশে পদক, রবীন্দ্র বিষয়ক গবেষণার জন্য ২০১১ সালে বাংলা একাডেমি কর্তৃক রবীন্দ্র পুরস্কার (মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক প্রদত্ত) লাভ করেন। ২০১২ সালে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন আহমদ রফিকের নামে ঢাকা শহরে একটি রাস্তার নামকরণ করে। সরকারী-বেসরকারীভাবে বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান থেকেও তিনি অসংখ্য সম্মাননা, সংবর্ধনা ও স্বর্ণপদক লাভ করেন। আন্তজার্তিক স্বীকৃতি লাভও তাঁকে গৌরবদীপ্ত করেছে। কলকাতার টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট থেকে পেয়েছেন ‘রবীন্দ্রতত্ত্বচার্য’ উপাধি (১৯৮৭)। ভারতের ত্রিপুরা সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দফতর কর্তৃক পেয়েছেন সম্মাননা ও সংবর্ধনা। 

৯.
আহমদ রফিকের একটি সাক্ষাৎকার পাঠ করা জরুরি বিবেচনায় তুলে ধরছি। 
০ ব্যাক্তিগত জীবনে কোন বিশেষ ঘটনা আপনাকে প্রভাবিত করে?
০০ বিশেষ বিশেষ রাজনৈতিক ও সামাজিক ঘটনা আমাকে খুব নাড়া দেয়। অনেক সময় ওই বিষয়ে লিখতে আমাকে উদ্ভুদ্ধ করে। 
০ আত্মপ্রকাশলগ্নে কোন প্রতিবন্ধকতার কথা আপনার মনে পড়ে?
০০ আমি মেডিকেলের ছাত্র ছিলাম। সাহিত্য নিয়ে পড়াশুানা করিনি। তাই অনেকের ধারনা আমি সাহিত্য ভালো বুঝি না। ফলে মানুষের মাঝে আমার লেখা গ্রহণ যোগ্যতা পেতে সময় লাগে। যেমন, আমার প্রথম বইটি লিখি ১৯৫৬ সালে। কিন্তু এটি প্রকাশ হয় ১৯৫৮ সালে। তখন আমার সমবয়সী কেউ ভালো লিখতে পারতেন না। রবীন্দ্র চর্চা নিয়ে অনেক লিখেছি। আমার অনেক ভালো বই প্রকাশ হয়েছে। কিন্তু তার সীকৃতি মানুষের কাছে পাইনি। তা পেতে অনেক সময় লেগেছে। যদি ডাক্তার না হয়ে অধ্যাপক হতাম তাহলে, এ সীকৃতি সহজেই পেতাম। মনে করি, এটি আমার জীবনে বড় প্রতিবন্ধকতা। 
০ প্রথম বই প্রকাশের স্মৃতি জানাবেন কি?
০০ আমার প্রথম বইয়ের নাম 'শিল্প সংস্কৃতি জীবন'। এটি একটি প্রবন্ধ। প্রকাশিত হয় ১৯৫৮ সালে। কহিনুর লাইব্রেরি বইটি প্রকাশ করে। এটি লেখার জন্য অনেকের দারস্থ হই। অনেক পরিশ্রমের ফসল এটি। বইটি প্রকাশ হওয়ার পর আমার অনেক ভালো লেগেছে। কারণ পরিশ্রম বেশি হলেও একটি ভালো কাজ করতে পেরেছি। 
০ শৈশব-কৈশোরের বন্ধুদের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ আছে কি?
০০ না। শৈশব-কৈশোরে আমার বন্ধু কম ছিল। আমি একাকিত্ব বেশি পছন্দ করতাম। মনে পরে, ১৯৪৭ সালে স্কুলে জীবনে ৬০-৭০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ৩ জন ছিল মুসলমান শিক্ষার্থী। আর বাকি সব ছিল হিন্দু শিক্ষার্থী। দেশ বিভাজনের পর তারা সবাই ভারতে চলে যায়। ফলে আমার বন্দুও কমে যায়। তাই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। 
০ এখন আপনার বন্ধু কারা?
০০ আমার প্রকৃত নেই বলেলই চলে। তবে কিছু ঘনিস্ট মুখ আছে। তাদের বয়স আমার চেয়ে কম। তারা হচ্ছে সংস্কৃতি পরিমণ্ডলের কিছু চেনা মুখ। 
০ কোন বই আপনি বারবার পড়ে থাকেন?
০০ রবীন্দ্রনাথ আমার প্রিয়। তার ছিন্নপত্র বারবার পড়তে ভালো লাগে। এটির ভাষা, বিষয় চিত্র সবই ভালো লাগে। এতে যেন প্রকৃতি কোমল স্পর্শ রয়েছে। 
০ কোন বই বা লেখকের লেখায় আপনি ঈর্শ্বাবোধ করেন?
০০ কারো লেখাই পড়ে আমি ঈর্শ্বাবোধ করি না। তবে ভালো লেখা বা বই পড়ে অনুপ্রানিত হই। 
০ আপনার প্রিয় সঙ্গীতশিল্পী কারা?
০০ এ সময়ের মধ্যে হচ্ছে সচিনদেব বর্মন। তার লোকসঙ্গীত ও পল্লীগীতি আমার পছন্দ। এছাড়া পঙ্কজ কুমার মলি্লক, দেবভট্ট বিশ্বাসের গান ভালো লাগে। রবীন্দ্র সঙ্গীতও শুনে থাকি। 
০ শিল্পকলার অন্য কোন শাখায় আপনার আগ্রহ রয়েছে? 
০০ আর কোনো শাখায় আগ্রহ নাই।
০ ব্যক্তিগত জীবনের কোন সীমাবদ্ধতা আপনাকে কষ্ট দেয়?
০০ এটি অনুভব করি না। তবে এক সময় ছিল। যৌবনে রাজনীতির কারণে সাহিত্য চর্চায় ব্যাঘাত ঘটত। এটিই মাঝে মধ্যে আমার মনে কষ্টের দাগ কাটত। 
০ আপনার চরিত্রের শক্তিশালী দিক কোনটি বলে আপনি মনে করেন?
০০ কোনো কাজ হাতে নিলে সেটি ভালোভাবে সম্পন্ন করার জন্য ইচ্ছা, শ্রম, সময় দিয়ে থাকি। যেভাবেই হোক, সেটি সম্পন্ন করেই থাকি। মনেহয় এটিই আমার একটি বড় গুন। 
০ নিজের সম্পর্কে বেশি শোনা অভিযোগ কোনটি?
০০ যেহেতু নিঃসঙ্গতা আমার প্রিয়। তাই অনেকে আমাকে অবৈষয়িক মানুষ বলে থাকেন। কেউ কেউ অসামাজিকও বলেন। 
০ নিজের সম্পর্কে প্রিয়জনদের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি শোনা প্রশংসা বাক্য কোনটি?
০০ সবাই বলেন, মানুষকে সাহায্য করি। মানুষের পাশে দাড়ানোই আমার স্বভাব। 

১০.
এবার আহমদ রফিকের রচনা থেকে পাঠ করা যাক। ‘তৃতীয় শহীদ মিনার’ রচনায় তিনি লিখেছেন, ‘স্বাধীনতার পরে বাহাত্তর সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নাগরিকরা তাদের প্রথম শহীদ দিবস পালন করেছিল ভগ্ন শহীদ মিনারে। নতুন শহীদ মিনারের ব্যাখ্যা ও তাৎপর্য নিম্নরূপ : মিনার এবং তার স্তম্ভগুলো মাতৃভূমি-মাতৃভাষা তথা মাতা এবং তার শহীদ সন্তানদের প্রতীক। মধ্যখানের স্তম্ভটি মায়ের এবং পাশে দুটি করে চারটি স্তম্ভ সন্তানের প্রতীক। সাতান্ন থেকে একাত্তর সাল_ চৌদ্দটি বছর ওই চেতনাই ছিল শহীদ মিনারের রূপকল্প; যা হামিদুর রহমানের সাতান্ন সালের শহীদ মিনারে প্রথম প্রতিফলিত হয়েছিল, যা আংশিকভাবে হলেও তেষট্টি সালে সমাপ্ত শহীদ মিনারে উপস্থিত ছিল। বাহাত্তর সালে নতুনভাবে নকশা করতে গিয়ে হামিদুর রহমান সে চেতনাকে অক্ষুণ্ন রেখেছিলেন। মাতা এবং সন্তানের প্রতীক স্তম্ভ নিয়ে গড়ে ওঠা শহীদ মিনার এ দেশের মানুষের চেতনায় স্থায়ী আসন নিয়েছিল। হামিদুর রহমানের ছাপ্পান্ন সালের পরিকল্পনাতে শহীদ মিনারের স্তম্ভগুলো মাতা ও সন্তানের প্রতীক, অর্ধবৃত্তাকারে মাতা তার শহীদ সন্তানদের অনন্তকাল ধরে রক্ষা করছেন, যারা তাঁর মর্যাদা রক্ষার জন্য নিজেদের বিসর্জন দিয়েছে। আর সেই জন্য গৌরবান্বিত মা তাদের দোয়া করছেন, সন্তানদের আত্মত্যাগের মহিমায় মা ঝুঁকে পড়েছেন একটু স্নেহে, আর চারটি সন্তানের মধ্য দিয়ে তিনি তার লাখো-কোটি সন্তানকে দেখতে পাচ্ছেন। বাহাত্তর সালের পরিকল্পনাতেও মায়ের দৃষ্টির প্রতীক স্তম্ভে চোখের নকশা ছিল। স্তম্ভগুলো বিশুদ্ধ শ্বেতমর্মরে চৌদ্দ ফুট উচ্চ মঞ্চের ওপর স্থাপিত হবে, সিঁড়ি, রেলিং, সবই সাদা মার্বেল পাথরের করা হবে, শ্বেতমর্মরে সম্পন্ন সমগ্র মিনারটিতে একটি স্বর্গীয় পবিত্রতা ফুটে উঠবে।’ [বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন গ্রন্থ থেকে]

১১.
একনজরে আহমদ রফিক 
জন্ম : ১২ সেপ্টেম্বর ১৯২৯, শাহবাজপুর, কুমিল্লা
পিতা : আবদুল হামিদ, মা রহিমা খাতুন।
স্ত্রী : ডা. এসকে রুহুল হাসিন।
শিক্ষা : নড়াইল মহকুমা হাইস্কুল (১৯৪৭); হরগঙ্গা কলেজ, মুন্সীগঞ্জ (১৯৪৯); স্নাতক (চিকিৎসা বিজ্ঞান) : ঢাকা মেডিকেল কলেজ (১৯৫৮)।
পেশা : শিল্প ব্যবস্থাপনা ও সাহিত্যকর্ম।
প্রতিষ্ঠাতা : মেসার্স ওরিয়ন ল্যাবরেটরিজ লি. (১৯৬৪), প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, রবীন্দ্র চর্চা কেন্দ্র ট্রাস্ট (১৯৮৯)
উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : নির্বাসিত নায়ক (১৯৬৬); বাউল মাটিতে মন (১৯৭০); রক্তের নিসর্গে স্বদেশ (১৯৭৯); শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৯৮); নির্বাচিত কবিতা (২০০১), প্রবন্ধ-গবেষণা : শিল্প সংস্কৃতি জীবন (১৯৫৮); নজরুল কাব্যে জীবনসাধনা (১৯৫৮); আরেক কালান্তর (১৯৭৭); বুদ্ধিজীবীর সংস্কৃতি (১৯৮৬); রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রচিন্তা ও বাংলাদেশ (১৯৮৭); একুশের ইতিহাস আমাদের ইতিহাস (১৯৮৮); ভাষা আন্দোলন : ইতিহাস ও তাৎপর্য (১৯৯১); ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি ও কিছু জিজ্ঞাসা (১৯৯৩); বাঙালি বাংলাদেশ (১৯৯৭); রবীন্দ্রভুবনে পতিসর (১৯৯৮); বাঙলা বাঙালি আধুনিকতা ও নজরুল (১৯৯৯); প্রসঙ্গ : বহুমাত্রিক রবীন্দ্রনাথ (২০০২); রবীন্দ্রভাবনায় গ্রাম : কৃষি ও কৃষক (২০০২); রবীন্দ্রনাথের চিত্রশিল্প (১৯৯৬) ইত্যাদি।

১২.
আজ আহমদ রফিকের জন্মদিন উপলক্ষে আবারো তাঁর প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।

(তথ্যসূত্র : বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, ইন্টারনেট)

লেখক: আবদুল্লাহ আল মোহন 
সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ভাসানটেক সরকারি কলেজ, ঢাকা

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত