হুমায়ূন আছে হৃদয়ে

প্রকাশ : ১৯ জুলাই ২০১৬, ১০:৫৬

এখন খেলা থেমে গেছে মুছে গেছে রং ।।
অনেক দূরে বাজছে ঘণ্টা ঢং ঢং ঢং
এখন যাব অচিন দেশে, অচিন কোন গায়
চন্দ্রকারিগরের কাছে ধবল পঙ্খী নায়

দেখতে দেখতে চন্দ্রকারিগর হুমায়ূনহীন কেটে গেছে অনেক বর্ষা। অনেক বছর। আসংখ্য চান্নি পসর রাইত। তবুও মুছে যায় নি রং। অচিন দেশে চলে গেছে ঠিক কিন্তু এতটুক জনপ্রিয়তা কমেনি অসংখ্য পাঠক-শুভানুধ্যায়ীদের কাছে।

২০১২ সালের ১৯ জুলাই বর্ষার রাতে পরিবার-পরিজন, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ীদের অশ্রুধারায় সিক্ত করে ক্যান্সার আক্রান্ত চিকিৎসাধীন হুমায়ূন নিউইয়র্কের বেলভ্যু হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পাড়ি জমান অচিন দেশে, অচিন কোন গায়।

আজ বৃহস্পতিবার বাংলা সাহিত্যের অন্যতম এই জনপ্রিয় লেখক, নাট্যকার ও চলচ্চিত্রকারের ৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী।

শোকাবহ দিনটিতে তাকে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করবে শিল্প প্রিয় বাঙালি। এ আয়োজনে অনেকে হুমায়ূন ভক্ত ছুটে যাবেন গাজীপুরের পিরুজালীর নুহাশ পল্লীতে। নুহাশ পল্লী ভরে উঠবে ফুলে ফুলে। 

১৯৪৮ সালে ১৩ নভেম্বর নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে নানার বাড়িতে জন্ম নেওয়া হুমায়ূন আহমেদ সরকারি কর্মকর্তা বাবার কর্মস্থল পরিবর্তনের সুবাদে দেশের বিভিন্ন স্থানে শৈশব ও কৈশোর কাটিয়েছেন। এ জন্য হুমায়ূন আহমেদ দেশের বিভিন্ন স্কুলে লেখাপড়া করার সুযোগ পেয়েছেন।

তিনি বগুড়া জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন এবং রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে সব গ্রুপে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। তিনি পরে ঢাকা কলেজে ভর্তি হনএবং সেখান থেকেই বিজ্ঞানে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন শাস্ত্রে অধ্যয়ন করেন এবং প্রথম শ্রেণীতে বিএসসি (সম্মান) ও এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি মুহসীন হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন এবং ৫৬৪ নং কক্ষে তার ছাত্রজীবন অতিবাহিত করেন।

পরে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পলিমার রসায়ন বিষয়ে গবেষণা করে পিএইচডি লাভ করেন। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত থাকা অবস্থায় প্রথম বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী তোমাদের জন্য ভালোবাসা।

১৯৭৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। লেখালেখিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় একসময় অধ্যাপনা ছেড়ে দেন তিনি৷ শিক্ষক হিসেবে ছাত্রদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন এই অধ্যাপক৷

''নন্দিত নরকে'' উপন্যাসিকা রচনার মধ্য দিয়ে কথাসাহিত্যের জগতে তাঁর হাতেখড়ি। সত্তর দশকের (১৯৭০) শেষভাগে থেকে শুরু করে ২০১২-এ মৃত্যু অবধি তিনি ছিলেন বাংলা গল্প-উপন্যাসের অপ্রতিদ্বন্দী কারিকর। এই কালপর্বে তাঁর গল্প-উপন্যাসের জনপ্রিয়তা ছিল তুলনারহিত। তাঁর প্রধান প্রতিভা অসামান্য কাহিনী সৃষ্টি।

তাঁর সৃষ্ট হিমু চরিত্রটি বাংলাদেশের যুবকশ্রেণীকে গভীরভাবে উদ্বেলিত করেছে। একই সঙ্গে মিসির আলি কেন্দ্রিক রহস্যোপন্যাসগুলি লাভ করে বিশেষ পাঠকঅর্ভ্যথনা।

তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্রসমূহ পেয়েছে অসামান্য দর্শক প্রিয়তা। তবে তাঁর টেলিভিশন নাটকগুলি ছিল সর্বাধিক জনপ্রিয়। সংখ্যায় বেশী না হলেও তাঁর রচিত গানগুলি জনপ্রিয়তা লাভ করে। তাঁর মৃত্যুর ফলে বাংলা সাহিত্য ও চলচ্চিত্র অঙ্গনে এক দীর্ঘস্থায়ী শূন্যতার সৃষ্টি হয়।

নাটক ‘কোথাও কেউ নেই’ দিয়ে তিনি মাতিয়ে তোলেন দর্শক। তার ওই নাটকের চরিত্র বাকের ভাইয়ের ফাঁসির প্রতিবাদে ঢাকায় মিছিল-সমাবেশ-অনশন পর্যন্ত হয়।

নাটকে সফলতার পর হাত দেন সিনেমা নির্মাণে। ‘আগুনের পরশমণি’ দিয়ে ব্যাপক সাড়া ফেলে দেন হুমায়ূন। পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কার।

মুক্তিযুদ্ধ তার সাহিত্যে যেমন এসেছে তেমনি ছিল তার বানানো নাটক ও ছবিতেও। তার নির্মিত ‘শ্যামল ছায়া’ পেয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।

হুমায়ূন আহমেদ ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১৩ই নভেম্বর নেত্রকোণা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার কুতুবপুরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ফয়জুর রহমান আহমদ এবং মা আয়েশা আখতার খাতুন তাঁর পিতা একজন পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন এবং তিনি ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পিরোজপুর মহকুমার এসডিপিও হিসেবে কর্তব্যরত অবস্থায় শহীদ হন।

ছোটকালে হুমায়ূন আহমেদের নাম রাখা হয়েছিল ছিল শামসুর রহমান; ডাকনাম কাজল। তাঁর পিতা নিজের নাম ফয়জুর রহমানের সাথে মিল রেখে ছেলের নাম রাখেন শামসুর রহমান। পরবর্তীতে তিনি নিজেই নাম পরিবর্তন করে ‌হুমায়ূন আহমেদ রাখেন।

হুমায়ূন আহমেদের ভাষায়, তাঁর পিতা ছেলে-মেয়েদের নাম পরিবর্তন করতে পছন্দ করতেন। ১৯৬২-৬৪ সালে চট্টগ্রামে থাকাকালে হুমায়ুন আহমেদের নাম ছিল বাচ্চু। তাঁর ছোট ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবালের নাম আগে ছিল বাবুল এবং ছোটবোন সুফিয়ার নাম ছিল শেফালি।

ছাত্র জীবনে একটি নাতিদীর্ঘ উপন্যাস রচনার মধ্য দিয়ে হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যজীবনের শুরু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসীন হলের সাথে সম্পৃক্ত ছাত্র হুমায়ূন আহমেদের এই উপন্যাসটির নাম নন্দিত নরকে। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে উপন্যাসটি প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি।

১৯৭২-এ কবি-সাহিত্যিক আহমদ ছফার উদ্যোগে উপন্যাসটি খান ব্রাদার্স কর্তৃক গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রখ্যাত বাঙলা ভাষাশাস্ত্র পণ্ডিত আহমদ শরীফ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এ গ্রন্থটির ভূমিকা লিখে দিলে বাংলাদেশের সাহিত্যামোদী মহলে কৌতূহল সৃষ্টি হয়। শঙ্খনীল কারাগার তাঁর ২য় গ্রন্থ। এ পর্যন্ত (২০০৯) তিনি দুই শতাধিক গল্পগ্রন্থ ও উপন্যাস প্রকাশনা করেছেন। তাঁর রচনার প্রধান কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম হলো 'গল্প-সমৃদ্ধি'।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রচিত উপন্যাস মধ্যাহ্ন তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা হিসেবে পরিগণিত। এছাড়া জোছনা ও জননীর গল্প আরেকটি বড় মাপের রচনা যা কি-না ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অবলম্বন করে রচিত। তবে সাধারণত তিনি সমসাময়িক ঘটনাবলী নিয়ে লিখে থাকেন

টেলিভিশনের জন্য একের পর এক দর্শক-নন্দিত নাটক রচনার পর হুমায়ূন আহমেদ ১৯৯০-এর গোড়ার দিকে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন। তাঁর পরিচালনায় প্রথম চলচ্চিত্র আগুনের পরশমণি মুক্তি পায় ১৯৯৪ সালে।

২০০০ সালে শ্রাবণ মেঘের দিন ও ২০০১ সালেদুই দুয়ারী চলচ্চিত্র দুটি প্রথম শ্রেণির দর্শকদের কাছে দারুন গ্রহণযোগ্যতা পায়। ২০০৩-এ নির্মান করেন চন্দ্রকথা নামে একটি চলচ্চিত্র। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ২০০৪ সালে নির্মান করেন শ্যামল ছায়া চলচ্চিত্রটি।

এটি ২০০৬ সালে "সেরা বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র" বিভাগে একাডেমি পুরস্কার এর জন্য বাংলাদেশ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। এছাড়াও চলচ্চিত্রটি কয়েকটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়। তাঁর সব চলচ্চিত্রে তিনি নিজে গান রচনা করেন। ২০০৮-এ আমার আছে জল চলচ্চিত্রটি তিনি পরিচালনা করেন। ২০১২ সালে তার পরিচালনার সর্বশেষ ছবি ঘেটুপুত্র কমলা (চলচ্চিত্র)।

এছাড়াও হুমায়ূন আহমেদের লেখা উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র। এর মধ্যে ২০০৬ সালে মোরশেদুল ইসলাম পরিচালিত দুরত্ব, বেলাল আহমেদ পরিচালিত নন্দিত নরকে এবং আবু সাইদ পরিচালিত নিরন্তর। ২০০৭-এ শাহ আলম কিরণ পরিচালিত সাজঘর এবং তৌকির আহমেদ নির্মাণ করেন বহুল আলোচিত চলচ্চিত্র দারুচিনি দ্বীপ।

পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার এর মধ্যে
বাংলা একাডেমী পুরস্কার ১৯৮১
শিশু একাডেমী পুরস্কার
একুশে পদক ১৯৯৪
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (শ্রেষ্ঠ কাহিনী ১৯৯৪, শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র ১৯৯৪, শ্রেষ্ঠ সংলাপ ১৯৯৪)
লেখক শিবির পুরস্কার ১৯৭৩)
মাইকেল মধুসুদন পদক (১৯৮৭)
বাচশাস পুরস্কার (১৯৮৮)
হুমায়ূন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯০)
জয়নুল আবেদীন স্বর্ণপদক

তিনি আছেন তার সৃষ্টির মাঝে, পাঠকদের হৃদয় জুড়ে। থাকবেন অন্তত কাল।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত