জহির রায়হান

প্রকাশ : ১৯ আগস্ট ২০১৬, ১২:০৬

সাহস ডেস্ক

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে এবং জীবনস্পর্শী প্রতিবাদী সাহিত্য ধারায় জহির রায়হান এক বিশিষ্ট শিল্পী। চলচ্চিত্র প্রতিভার পরবর্তী আশ্রয়স্থল হলেও তার আবির্ভাব ঘটেছিল কথাসাহিত্যে। সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক, রাজনৈতিক কর্মী, চিত্রপরিচালক- নানা পরিচয়ে তার কর্মক্ষেত্রের পরিধি স্পষ্ট। বাহান্নর ভাষা আন্দোলন ও একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণের দ্বারা এদেশে সৎ শিল্পীর ভূমিকা কীরকম হবে- জীবন দিয়ে তিনি তার উদাহরণ হয়ে আছেন। 

১৯৩৫ সালের ৫ আগস্ট (নানা বইয়ে তার জন্ম তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে ১৯ আগস্ট, কিন্তু তার বোন দাবি করেছেন জহির রায়হানের জন্ম তারিখ ৫ আগস্ট) তৎকালীন নোয়াখালি জেলার ফেনী মহকুমার অর্ন্তগত মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। প্রকৃত নাম আবু আবদার মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ। ডাক নাম জাফর। তার পিতামহ মোহাম্মদ এমদাদউল্লাহ নোয়াখালিতে আইন ব্যবসায় নিয়োজিত ছিলেন। কিন্ত এই ব্যবসায় সর্বদা সত্যাশ্রয়ী থাকা সম্ভব হয় না, এই বিবেচনায় অত্যন্ত ধার্মিক এমদাদউল্লাহ আইন পেশা ছেড়ে কলকাতার খিদিরপুরে ব্যবসা করতে শুরু করেন। তার পিতা মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতেন। আরবীতে তিনি উচ্চ ডিগ্রিধারী ছিলেন। পরে তিনি কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ইংরেজি শিক্ষার প্রতি তার অনুরাগ ছিল সহজাত। হাবিবুল্লাহর আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গীর প্রভাবে পরবর্তীকালে তার পরিবারে সাহিত্য-সংস্কৃতির মুক্ত ও অনুকূল পরিবেশ গড়ে ওঠে। ’৪৭ সালে দেশবিভাগের পর তিনি কলকাতা ত্যাগ করে ঢাকা চলে আসেন এবং ঢাকা আলীয়া মাদ্রাসার ফেকাহ্‌ ও আরবী দর্শনের অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হন। চাকুরী জীবনের শেষদিন পর্যন- তিনি এই পদেই কর্মরত ছিলেন। ১৯৬৫ সালে ৬৪ বছর বয়সে তিনি মারা যান। 

জহির রায়হানের মাতা সৈয়দা সুফিয়া খাতুনের জন্ম এক রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে। তিনি নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেছিলেন। তার পিতৃকুল ছিল তালুকদার। রক্ষণশীল হলেও প্রভাবশালী এই পরিবারে তৎকালীন জাতীয়তাবাদী এবং স্বদেশী আন্দোলনের স্পর্শ যে লাগেনি তা নয়। শোনা যায়, মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনকালে সুফিয়া খাতুন নিজ হাতে সূতো কেটে কাপড় বুনে পরতেন। তখন তিনি তেরো-চৌদ্দ বছরের কিশোরী।

পাঁচ পুত্র ও তিন কন্যার জননী স্নেহময়ী সুফিয়া খাতুন সন্তানদের শিক্ষার ব্যাপারে ছিলেন অত্যন্ত সর্তক ও যত্নশীল। তার প্রথম সন্তান শহীদুল্লাহ কায়সার (১৯২৭-১৯৭১), দ্বিতীয় নাফিসা কবির, তৃতীয় জহির রায়হান, চতুর্থ জাকারিয়া হাবিব, পঞ্চম সুরাইয়া বেগম, ষষ্ঠ শাহেনশা বেগম, সপ্তম ওবায়দুল্লাহ, সর্বকনিষ্ঠ সাইফুল্লাহ। 

পেশায় সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সার ছিলেন এদেশের একজন বিশিষ্ট সাহ্যিতিক। তিনি বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন, প্রথম থেকেই ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য। ১৯৫২, ১৯৫৫ ও ১৯৫৮ সালে তিনি কারাভোগ করেছেন। তার লেখা সারেং বৌ (১৯৬২) ও সংশপ্তক (১৯৬৫) উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। পিতা ও মাতার বংশের সত্যঘটনা অবলম্বনে তিনি সংশপ্তক উপন্যাস লিখেছেন, জানিয়েছেন তার বোন শাহেনশা বেগম। তাছাড়া ‘পেশেয়ার থেকে তাসখন্দ (১৯৬৬)’ ভ্রমণ কাহিনী ও স্মৃতিকথা ‘রাজবন্দীর রোজনামচা (১৯৬২)’ তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষদিকে ১৪ ডিসেম্বর কুখ্যাত আল-বদর বাহিনী কর্তৃক নিজ বাড়ি থেকে তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

নাফিসা কবির রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম.এ পাস করে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ইন্দো-পাক ট্রেড ইউনিয়ন’ বিষয়ে গবেষণা করেন। রাজনীতির সঙ্গেও তার সংশ্লিষ্টতা ছিল।  

জহির রায়হান তৃতীয় সন্তান
জাকারিয়া হাবিব (জ্যাক) সুফিয়া খাতুনের চতুর্থ সন্তান। ভাইবোনদের মধ্যে তিনি জহির রায়হানের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ছিলেন। জ্যাক একজন চিত্রনির্মাতা ও চিত্র পরিচালক। চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও তার সাহিত্যচর্চা উল্লেখের দাবি রাখে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তার গল্প-কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য : গল্প-‘নায়িকা’, ‘তোমার জন্য’। কবিতা- ‘আমার চেতনাগুলো’, ‘বাহাত্তুরের একুশের মিছিলে’, ‘জ্বলন্ত অগ্নিতে মূর্ত দুটি প্রাণ’ ইত্যাদি। 

পঞ্চম সুরাইয়া বেগম একজন চিকিৎসক। ২০০১ সালে তিনি মারা গেছেন।ষষ্ঠ সন্তান শাহেনশা বেগম। সপ্তম ওবায়দুল্লাহ। কনিষ্ঠ সন্তান সাইফুল্লাহ। 

জহির রায়হানের স্কুল জীবনের অধিকাংশ অধিকাংশই কেটেছে কলকাতায়। ১৯৪০ সালে তিনি কলকাতা মডেল স্কুলে ভর্তি হন। পিতা হাবিবুল্লাহ তখন কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসার শিক্ষক। মডেল স্কুলে জহির প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। এরপর তাকে মিত্র ইনস্টিটিউশনে (মেইন) ভর্তি করা হয়। এখানে ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হলে তিনি আলীয়া মাদ্রাসার অ্যাংলো-পার্শিয়ান বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর জহির তার পিতার সঙ্গে মজুপুর গ্রামে চলে আসেন এবং সেখানে গ্রামের স্কুলেই তিনি লেখাপড়া করেন। স্থানীয় আমিরাবাদ হাই স্কুল থেকে ১৯৫০ সালে তিনি প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। 

১৯৫৩ সালে জহির রায়হান ঢাকা কলেজ থেকে আইএসসি পাশ করে বাবার ইচ্ছানুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে সম্মান শ্রেণীতে ভর্তি হন। এক বছর পর তিনি অর্থনীতি ছেড়ে বাংলা বিভাগে সম্মান শ্রেণীতে ভর্তি হন এবং ১৯৫৮ সালে দ্বিতীয় শ্রেণীতে অনার্স ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর যথারীতি এমএ ক্লাসে ভর্তি হন।  

তার সহপাঠী আবদুর রাজ্জাক জানাচ্ছেন, “চাপা স্বভাবের, বেঁটে-খাটো, মুখাবয়ব ও গলার স্বর তেমন আর্কষণীয় নয় এমন একজন সতীর্থ পেলাম, যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পর্বের এমএ ক্লাসে পড়ি। ১৯৫৮-৫৯ সেশনের কথা। আমি এসেছি এমএ প্রথম পর্ব থেকে আর উপরোক্ত সতীর্থ এসেছেন বিএ অনার্স পাশ করে। ছাত্র হিসেবে সিরিয়াস ছিলেন না। হপ্তায় একদিন কিংবা বড়জোর দু’দিন ক্লাসে আসতেন। দু’একটা ক্লাস করেই হুট করে চলে যেতেন। ক্লাসেও আসতেন এমন সময় যখন ঘন্টা পড়ে গেছে, ক্লাসের রোলকলও প্রায় শেষ। চুপটি মেরে পেছনের বেঞ্চিতে বসতেন। হাতে খাতাপত্র থাকতো না, টিউটোরিয়ালও জমা দিতে দেখিনি কোনদিন। আমাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশার কিংবা সেমিনারে বসে বই পড়ার অছিলায় আড্ডা মারার সময় ছিলো না তার। ভীষণ ব্যস্ত মনে হতো তাকে, যেন ব্যবসায়ী কেউ, শখ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে বেড়াতে এসেছেন। বেশভূষায় কথাবার্তায় টিপ-টপ, ছিমছাম। 

এমন সতীর্থের প্রতি কৌতূহল জাগা স্বাভাবিক। ক’দিন পরেই জানতে পারলাম ইনিই তরুণ গল্পকার জহির রায়হান; চলচ্চিত্র শিল্পে তখন তার শিক্ষানবিশি চলছে। ডিগ্রির মোহ ছিল না তার।” (জীবনী গ্রন্থমালা (পৃষ্ঠা : ১১), অমর একুশে বাংলা একাডেমীর নিবেদন : ১৯৮৮)

সাহিত্যচর্চা ও সাংবাদিকতা
জহির রায়হান স্কুল জীবন থেকে কবিতা লিখতেন। লিখতেনও অবলীলায়। ছোটবেলা থেকেই তার লেখার অভ্যেস। লিখতেন, ছিঁড়তেন আর পড়ে শোনাতে ভালোবাসতেন। প্রথম দিকে পরিবারের সদস্যরাই ছিলেন তার রচনার একনিষ্ঠ শ্রোতা। জীবনের বিচিত্র বিষয়ে আগ্রহ ছিল তার।

প্রথম প্রকাশিত রচনা একটি কবিতা- ‘ওদের জানিয়ে দাও’। 

ওদের জানিয়ে দাও

ওরা আমার ভাইবোনকে 

কুকুর বিড়ালের মত মেরেছে। 

ওদের ষ্টীম রোলারের নীচে... 

ওদের জানিয়ে দাও।

ওরা দেখেও যদি না দেখে

বুঝেও যদি না বুঝে

আগুনের গরম শলাকা দু’চোখে দিয়ে

ওদের জানিয়ে দাও,

মরা মানুষগুলোতে কেমন জীবন এসেছে। 

কবিতাটি ১৯৪৯ সালে ‘নতুন সাহিত্য কুটির’ থেকে প্রকাশিত ‘চতুষ্কোণ’ পত্রিকায় ছাপা হয়। তার প্রথম প্রকাশিত ছোটগল্প ‘হারানো বলয়’। এটি প্রকাশিত হয় ড. আলিম চৌধুরী এবং এমএ কবীর সম্পাদিত ‘যাত্রিক’ পত্রিকায় ১৯৫১ সালে; তখন তিনি ঢাকা কলেজের ছাত্র।  

তার প্রথম উপন্যাস ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’ প্রথমে সাপ্তাহিক ‘চিত্রালী’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেছে সন্ধানী প্রকাশনী। নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের জীবনচিত্র প্রতিফলিত হয়েছে এই উপন্যাসে। নায়ক কাসেদ একজন কেরানী। কেরানী জীবনের স্বপ্ন ও সামর্থ্যের করুণ-মধুর কাহিনী নিয়ে উপন্যাসটি গড়ে উঠেছে। কেরানী কাসেদের গতানুগতিক রংচটা জীবনে প্রেম, কল্পনা , স্বপ্ন, দ্বন্দ্ব- সর্বোপরি প্রেমের ক্ষেত্রে শংকা, দোদুল্যমানতা, আশাভঙ্গের চিত্র ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’ । 

‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাস প্রকাশিত হয় ১৩৭১ সালে, প্রকাশক সন্ধানী প্রকাশনী, ঢাকা। এটি জহির রায়হানের জীবনের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনের দুঃখ-দারিদ্র, সংস্কার-সংকীর্ণতা প্রেম-এই উপন্যাসের মূল বিষয়। 

জহির রায়হানের পরবর্তী উপন্যাস ‘আরেক ফাল্গুন’। প্রকাশকাল ১৩৭৫ বঙ্গাব্দ। প্রকাশক : সন্ধানী প্রকাশনী, ঢাকা। এই উপন্যাসটি ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে রচিত। ’৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারীর আন্দোলনে জহির রায়হান কারারুদ্ধ হন। জহির রায়হানের সাহিত্যে ভাষা-আন্দোলন স্থান পেয়েছে সবচেয়ে বেশি। ড. হুমায়ুন আজাদ যথার্থই বলেছেন, “জহির রায়হান সম্ভবত বাংলাদেশের একমাত্র কথাসাহিত্যিক যার উদ্ভবের পেছনে আছে ভাষা আন্দোলন,...। যদি বায়ান্ন’র একুশ না ঘটতো তবে জহির রায়হান হয়তো কথাশিল্পী হতেন না।”

ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে তৎকালীন ছাত্র, অধ্যাপক, কেরানীসহ সাধারণ মানুষের চিন্তা-ভাবনার রূপায়ণ ঘটেছে এই উপন্যাসে। বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারি’র শহীদদের উদ্দেশ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে শ্রদ্ধাজ্ঞাপণ উপলক্ষে পঞ্চান্ন সালের একুশের কর্মসূচী এবং তাকে কেন্দ্র করে জ্বলে ওঠা আন্দোলন ‘আরেক ফাল্গুন’ উপন্যাসের উপকরণ।

‘বরফ গলা নদী’ উপন্যাস প্রকাশিত হয় ১৩৭৬ সালে। প্রকাশ করেন সন্ধানী প্রকাশনী, ঢাকা। উপন্যাসটি প্রথমে ‘উত্তরণ’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। এটি এক শহুরে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের কাহিনী। 

‘আর কতদিন’ প্রকাশিত হয় ১৩৭৭ বঙ্গাব্দে। এটিও ‘সচিত্র সন্ধানী’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। এটি একটি প্রতীকধর্মী রচনা। এই ক্ষুদ্রাকার রচনাটিতে কোনো কাহিনী বলার প্রয়াস নেই, চরিত্র সৃষ্টির প্রয়োজন সে কারণেই দেখা দেয়নি। ‘বর্ণের নামে, জাতীয়তার নামে, সংস্কৃতির নামে মানুষ মানুষকে হত্যা করছে নির্মমভাবে। বিপন্ন মানবতা এবং নিপীড়িত- লাঞ্ছিত মানুষ অশুভের অন্ধকার থেকে কল্যাণের আলোতে ছুটে চলেছে, ‘মানুষের এ এক নিরন্তর যাত্রা’। এই চলমান জনতার স্রোত থেকে লেখক তপু এবং ইভাকে প্রতিনিধি হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তারা ছুটে চলেছে, পেছনে তাদের ভয়ঙ্কর পশুর দল। তারা পলায়নের মধ্যেও ঘর বাধার স্বপ্ন দেখে।  

‘তৃষ্ণা’ উপন্যাসের রচনাকাল ১৯৬২ সাল। প্রকাশকাল ১৩৮২ বঙ্গাব্দ। ধারাবাহিকভাবে সাপ্তাহিক ‘চিত্রালী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এখানে ঔপন্যাসিক, শওকত ও মার্থার মধ্য দিয়ে মানুষের চিরন্তন জীবনতৃষ্ণার কথা ব্যক্ত করেছেন। ন্যূনতম নিশ্চিন্তি, সুখ আর শান্তির জন্যে শওকত ও মার্থা জীবন মন্থন করেছে দু’হাতে, কিন্তু জীবন তাদের কিছুই দেয়নি। 

‘কয়েকটি মৃত্যু’র প্রকাশকাল ১৩৮২ বঙ্গাব্দ। এটি প্রথম সাপ্তাহিক ‘সচিত্র সন্ধানী’তে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। 

জহির রায়হানের প্রথম প্রকাশিত ছোটগল্প ‘হারানো বলয়’ (যাত্রিক পত্রিকা)। এরপর বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তার অনেক ছোটগল্প প্রকাশিত হয়। তার প্রথম গল্পগ্রন্থ' ‘সূর্যগ্রহণ’ প্রকাশিত হয় ১৩৮৬ বঙ্গাব্দে ( ইনল্যান্ড প্রেস, ঢাকা)। জহির রায়হান নিজেই ‘জহির রায়হানের একশ’ গল্প নামে একটি গল্প সংকলন প্রকাশের পরিকল্পনা করেছিলেন। বলাবাহুল্য, সেটি কখনো বাস্তবায়িত হয়নি। ছাত্রজীবনে বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তবে তার সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি সম্ভবত ‘খাপছাড়া’ পত্রিকায়। তিনি তার বড় বোনের স্বামী এমএ কবীর ও ড.আলিম চৌধুরী সম্পাদিত ‘যাত্রিক’ পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৫৬ সালে ‘প্রবাহ’ নামক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। ‘এক্সপ্রেস’ পত্রিকার কার্যকরী সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া জহির রায়হান ‘সমকাল’, ‘চিত্রালী’, ‘সচিত্র সন্ধানী’, ‘সিনেমা’, ‘যুগের দাবী’ প্রভৃতি পত্রিকার সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি ‘চিত্রালী’-তে ‘প্রবেশ নিষেধ’ শিরোনামে কিছুদিন একটি ধারাবাহিক ফিচার লিখেছিলেন।

রাজনৈতিক জীবন
রাজনৈতিক ঘটনা-আন্দোলন কিশোর জহিরকে নাড়া দিতো। জহির রায়হানের জন্মের কয়েক বছর আগে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ঘটে গেছে, তারঅভিজ্ঞতা মানুষের মন থেকে মুছে যাবার আগেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। বিভাগ পূর্ব বাংলাদেশে তখন হিন্দু ও মুসলমান মধ্যবিত্তের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও প্রতিযোগিতা চলছে জীবনের নানান ক্ষেত্রে। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়, জহির তখন মিত্র ইন্সটিটিউটের ছাত্র। এই সময়ে আরো একটি দুর্যোগ নেমে আসে- ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ। এর মাত্র ক’বছর পরেই ’৪৬ সালে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটে। এই ঘটনাগুলো কিশোর জহিরের মনে প্রভাব বিস্তার করে। 

’৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অনতিকাল পরেই পূর্বপাকিস্তানের শিক্ষিত মধ্যবিত্তের স্বপ্ন ভঙ্গ হয়। তারা অনুভব করে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের যাবতীয় সম্পদ, পুঁজি, ক্ষমতা সবই পশ্চিম পাকিস্তানীদের করতলগত-তারা ক্ষমতার উৎস নয়, ক্ষমতার সহায়ক ছাড়া তারা আর যে কিছুই নয়! 

১৯৪৫ সালে ‘ভিয়েতনাম দিবস’-এর মিছিলে জহির অংশগ্রহণ করেন। সেই মিছিলে পুলিশ লাঠিচার্জ করলে অন্যান্যদের সঙ্গে তিনিও আহত হন। ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের মিছিলেও তিনি উৎসাহের সঙ্গে যোগ দিতেন। দেশ-বিভাগের পর গ্রামের বাড়িতে ফিরে এসে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের সক্রিয় সদস্য বসন্ত ভৌমিক ও ক্ষিতিশ চক্রবর্তীর সান্নিধ্যে আসেন। তার রাজনৈতিক চেতনায় এদের প্রভাব পড়েছিল নিশ্চয়ই। এরপর জহির চলে আসেন ঢাকায়। এ সময়ে অগ্রজ শহীদুল্লাহ কায়সারের দ্বারা সক্রিয় রাজনীতিতে অনুপ্রাণিত ও দীক্ষিত হন। এছাড়া বড় বোন নাফিসা কবীর ও তার স্বামী ড. আহমদ কবীরও জহিরের রাজনৈতিক চেতনাকে লালন করেছিলেন। 

১৯৫৩ কী ৫৪ সালের দিকে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন। এ সময়ে মনি সিংহের দেয়া রাজনৈতিক নাম ‘রায়হান’ গ্রহণ করেন। ছাত্রাবস্থায় রাজনৈতিক কারণে একাধিকবার কারারুদ্ধ হয়েছেন তিনি। প্রথমে ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময়ে কারাবরণ করেন। ২০ ফেব্রুয়ারী ঢাকা শহরে মিছিল, ধর্মঘট, জনসমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে তদানীন্তন সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। 

২১ ফেব্রুয়ারি সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দশ জনের খন্ড খন্ড মিছিল বের হয়। প্রথম দশজনের মধ্যে ছিলেন জহির রায়হান। ১৯৫২ সালের এই ঘটনা বর্ণনা করে তিনি লিখেছেন, “ছাত্রদের গ্রুপে ভাগ করা হলো। আমি ছিলাম প্রথম দশজনের ভেতর।... ১৪৪ ধারা ভাঙ্গা হবে। কিন্তু প্রথম ব্যাচে কারা যাবে? হাত তুলতে বলা হলো। অনেক ছাত্র থাকা সত্ত্বেও হাত আর ওঠে না। কারণ ক্যাম্পাসের বাইরে পুলিশ বন্দুক উঁচিয়ে পজিশন নিয়ে বসে আছে। ভাবখানা এই যে, বেরুলেই গুলি করবে। ধীরে ধীরে একটা দু’টো করে হাত উঠতে লাগলো। গুণে দেখা গেলো আটখানা। আমার পাশে ছিলো ঢাকা কলেজের একটি ছেলে। আমার খুব বাধ্য ছিলো। যা বলতাম, তাই করতো। আমি তুলে ওকে বললাম হাত তোল। আমি নিজেই ওর হাত তুলে দিলাম। এইভাবে দশজন হলো। (জীবনী গ্রন্থমালা (পৃষ্ঠা : ১৪), অমর একুশে বাংলা একাডেমীর নিবেদন : ১৯৮৮)

এই মিছিল অল্প কিছুদূর অগ্রসর হবার পরেই পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে। 

এ বছরই জুন মাসে শহীদুল্লাহ কায়সারকে ধরতে এসে পুলিশ জহিরকে ধরে নিয়ে যায়। সেবার তিনমাস কারাভোগ করেন তিনি। এরপরে তিনি ১৯৫৫ সালে গ্রেফতার হয়ে তিনসপ্তাহ বন্দী থাকেন। ১৯৫৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে জহির পুনরায় রাজনৈতিক কারণে গ্রেফতার হন এবং তিনমাস কারাগারে থাকেন। 

পরে স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে পর্যন্ত তিনি প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, তবে বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে তার যোগ ছিলো বরাবরই। পার্টিতে নিয়মিত চাঁদা দিতেন বলেও জানা যায়। তার রাজনৈতিক বক্তব্যের প্রতিফলন এ সময়ের বিভিন্ন রচনায় যেমন পাওয়া যাবে, তেমনি পাওয়া যাবে তার নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোতে। এ প্রসঙ্গে তার ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবির কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

বিবাহিত জীবন
পরিচালক এহতেশামের ‘এ দেশ তোমার আমার’ ছবিতে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করার সময়ে ওই ছবির নায়িকা সুমিতা দেবীর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা হয়। অতঃপর ১৯৬১ সালে তিনি সুমিতা দেবীর সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। তাদের দু’ সন্তান- বিপুল রায়হান ও অনল রায়হান।

পরে ১৯৬৮ সালে জহির রায়হান চিত্রনায়িকা সুচন্দাকে বিয়ে করেন। সুচন্দা ও জহির রায়হানের দু’ সন্তান- অপু এবং তপু।

চলি, আবার দেখা হবে
স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে জহির রায়হান চলে যান ভারতে- বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য। জহিরের অনুজ জাকারিয়া হাবিব তার ভারতে যাবার বর্ণনা দিয়ে বলেছেন, জহির রায়হান ১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল কুমিল্লা দিয়ে ভারতে চলে যান। একজন লোক তাকে নিয়ে যাবার দায়িত্বে ছিলেন, সঙ্গে গাড়িতে সঙ্গী ছিলেন তিনি নিজে । জহির ওই ব্যক্তির সঙ্গে চলে গেলেন, গাড়ি নিয়ে ফিরে এলেন তিনি। জাকারিয়া জানান, তখন জহিরের ‘খালি পা, পরণে লুঙ্গি, গায়ে আধা ময়লা একটি শার্ট’। যাবার পূর্বমুহুর্তে কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে আলিঙ্গন করে অশ্রুসিক্ত কন্ঠে জহির বলেন, “চলি আবার দেখা হবে, সুদিনে এই বাংলায়। ... আমার জন্য কোন চিন্তা করো না। পথের মানুষ আমি পথেই নেমে গেলাম।”

কলকাতায় গিয়ে বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে জহির রায়হানের যোগাযোগ হয়। সে সময়ে কলকাতায় বাংলাদেশের যে-সব সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী এবং সংস্কৃতিকর্মী শরণার্থী হয়ে গিয়েছিলেন, তাদেরকে সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার উদ্দেশ্যে ‘বাংলাদেশ লিবারেশন কাউন্সিল অব ইন্টেলিজেন্সিয়া’ গঠিত হয়। এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন ডক্টর আজিজুর রহমান মল্লিক। তিনি এই সংগঠনের সভাপতি ও জহির রায়হান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। জহির অত্যন্ত নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে এই দায়িত্ব পালন করেন। সে সময়ে তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করেন। 

বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলো। কিন্তু সবার অংশগ্রহণের পদ্ধতি এক না হতেও পারে না। জহির স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ নিয়েছিলেন বন্দুক হাতে নয়- তিনি সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকার; যুদ্ধে তার ভূমিকা ছিলো চলচ্চিত্রকারের, আর তার অস্ত্র ছিলো ক্যামেরা। চলচ্চিত্র পরিচালক আলমগীর কবির এ প্রসঙ্গে বলেন, “২৫ মার্চ ’৭১ থেকে বাঙলার বুকে বিদেশী দানবের তান্ডবনৃত্য। কিন্তু কিংকর্তব্যবিমুঢ়তায় ভুগতে হয়নি জহিরকে...।সে জানতো পরিবর্তিত অবস্থায় তার কর্তব্য কী।” 

“যে মুষ্টিমেয় সংখ্যক শিল্পী সাহিত্যিক স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের মধ্যে অগ্রণী ভূমিকা পালন নিয়েছিলেন কামরুল হাসান, জহির রায়হান, হাসান ইমাম ও অন্যান্য কয়েকজন। দুভাগ্যবশতঃ অস্থায়ী সরকারের কোন কোন মহলের কাছে জহিরের রাজনৈতিক ‘রং’ উপাদেয় ছিলনা। ফলে মাঝে মাঝে স্বাধীনতা যুদ্ধে জহিরের অংশগ্রহণের উদ্যম উৎসাহকে রীতিমত বাধা প্রদান করা হতো। বলা বাহুল্য জহিরকে নিরস্ত্র করার ক্ষমতা তাদের ছিল না। সে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে গিয়েছিল আত্মার তাগিদে।...” 

“সে জানতো যে দেশকে ভালবাসা এবং তাকে মুক্ত করার প্রচেষ্টা তার জন্মগত এবং আদর্শগত অধিকার। তাই আমরা জহিরকে দেখেছি এক বহুমুখী ভূমিকায়। এ বেলা সে পাক- মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মিছিলে নেতৃত্ব দিচ্ছে, ওবেলা দেখতাম সাংস্কৃতিক দলের অনুশীলনে স্ক্রিপ্ট পুর্নবিন্যাস করছে। যখন কিছু কিছু লোককে দেখেছি নিজেদের ফিল্মের প্রিন্ট বিক্রি করে আর্থিক সাচ্ছল্য বাগাতে সচেষ্ট, ঠিক তখনি দেখেছি জহিরকে তার ‘জীবন থেকে নেয়া’র ভারতে বিক্রয়লব্ধ সমুদয় অর্থ বাংলাদেশ সরকারকে দান করতে, স্বীয় অর্থকষ্ট থাকা সত্ত্বেও। ঘরে স্ত্রী সুচন্দা জ্বরে অজ্ঞান, বড় ছেলে অপুও অসুস্থ। জহির ঘরে নেই। স্টুডিওতে। রাত নেই, দিন নেই, ঘুম নেই- ‘স্টপ জেনোসাইড’ তৈরি করছে। ও জানতো বাঙলার স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রচারই যথেষ্ট নয়। বিশ্বের সকল পরাধীন শোষিত মানুষের সংগ্রামের সাথে বাঙালীর স্বাধীনতা আন্দোলনের একাত্মতা বোঝাতে হবে এই ছবির মাধ্যমে।”

১৯৬৬ সালে চীন-রাশিয়া কেন্দ্রিক রাজনৈতিক বিরোধের সময় শহীদুল্লাহ কায়সার মস্কোপন্থী হলে এ ব্যাপারে জহির ছিলেন দোদুল্যচিত্ত। ’৬৯ গণ অভ্যুত্থানের দিকে জহিরের মধ্যে পিকিংপন্থী প্রভাব প্রত্যক্ষ করা যায়। ’৭০ সালে ‘এক্সপ্রেস’ পত্রিকা প্রকাশনার সময়ে তিনি মাওপন্থী উপদলগুলোর সাথে যোগাযোগ রাখেন। তাদের মোটা অঙ্কের টাকাও দিতেন। মস্কোপন্থীদের সাথে পারিবারিক ও বান্ধব সম্পর্ক ছিন্ন না করলেও তিনি পিকিংপন্থীদের প্রতি সহানুভূশীল ছিলেন এবং এদের মধ্যে ঐক্য কামনা করতেন। ২৫ মার্চের সময়গুলোতে তিনি দীর্ঘস্থায়ী গণযুদ্ধের কথা ভাবতেন। ওই সময় পার্টির সাথে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হয়ে তিনি কলকাতা চলে যান এবং সেখানে আওয়ামী লীগ প্রধান সরকারের রোষানলে পড়েন, তার সেক্টরে যাতায়াত সীমিত করা হয়। এই সরকারের নেতৃবর্গ পশ্চিমবঙ্গে সেন্সর বোর্ডকে ‘স্টপ জেনোসাইড’-এর ছাড়পত্র না দিতে অনুরোধ করেন। কারণ প্রথমত এ ছবিটি লেনিনের কোটেশন দিয়ে শুরু এবং আন্তর্জাতিকতার সুরে শেষ। দ্বিতীয়ত এ ছবিটিতে সরাসরি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা রয়েছে- এ দিকে আওয়ামী নেতারা তখনো কামনা করছেন মার্কিন সাহায্য। তিনি এ সময় চীনের ভূমিকাকে সমর্থন করতেন না। তিনি কোন মাওবাদী উপদলেও যোগ দেননি। 

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে জহির রায়হান ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর ঢাকা ফিরে আসেন। ফিরে এসে শুনলেন অগ্রজ শহীদুল্লাহ কায়সার ১৪ ডিসেম্বর থেকে নিখোঁজ। তিনি পাগলের মতো তাকে খুঁজে বেড়াতে লাগলেন। সাংবাদিক সম্মেলনে দৃপ্ত কন্ঠে বললেন, “বুদ্ধিজীবী নিধনের পেছনে এক আন্তর্জাতিক চক্রান্ত আছে এবং এই চক্রান্তের সমস্ত রহস্য তিনি অচিরেই ভেদ করবেন।” তার উদ্যোগে বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন- কমিটি গঠিত হয়। তিনি নিজে তদন্তের কাজে নেমে পড়েন। এমনি সময়ে কোনো একটি সূত্র থেকে সংবাদ পেলেন শহীদুল্লাহ কায়সার জীবিত অবস্থায় মিরপুরে আটক হয়ে আছেন। জহির রায়হান ৩০ জানুয়ারি সার্চ পার্টির সঙ্গে মিরপুরে যান। এরপর তার আর কোনো সংবাদ পাওয়া যায়নি। নিখোঁজ ভাইকে খুঁজতে গিয়ে তিনি নিজেই চিরকালের জন্যে নিখোঁজ হয়ে গেলেন।

চলচ্চিত্র জীবন
জহির রায়হান ছিলেন এদেশের প্রগতিশীল চলচ্চিত্র আন্দোলনের পুরোধা। তিনি ছিলেন একাধারে কাহিনীকার, চিত্রনাট্য রচয়িতা, পরিচালক, চিত্রগ্রাহক এবং প্রযোজক। চলচ্চিত্রের আঙ্গিক ও গঠনশৈলীর নানান দিক নিয়ে তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চলচ্চিত্র শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এদেশে তিনিই প্রথম ইংরেজি ছবি ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ নির্মাণ করেন। তৎকালীন পাকিস্তানে প্রথম রঙীন ছবি ‘সঙ্গম’ তৈরি করেন জহির রায়হান, তার হাতেই প্রথম সিনেমাস্কোপ ছবি ‘বাহানা’র জন্ম। 

এদেশে সাধারণ মানুষের কাছে তাই জহির রায়হান কথাসাহিত্যিক অপেক্ষা চলচ্চিত্রকার হিসেবেই বেশি পরিচিত। 

ছাত্রজীবন থেকেই জহির রায়হান ছায়াছবি সম্পর্কে আগ্রহী ছিলেন। ছাত্রজীবনের শুরুতে চলচ্চিত্র সংক্রান্ত বই এবং পত্রপত্রিকার সঙ্গে তার পরিচয় ছিলো। ’৫২ সালে কারাবরণের পর মুক্তি পেয়ে তিনি কলকাতায় প্রমথেশ বড়ুয়া মেমোরিয়াল ফটোগ্রাফিক স্কুলে চলচ্চিত্র বিষয়ে শিক্ষা লাভের জন্যে ভর্তি হন। কিন্তু দশ মাসের কোর্স তিনি সমাপ্ত করতে পারেননি, ছয় মাস পড়াশুনা করার পর অর্থাভাবে ঢাকায় ফিরে আসেন। তারপর ছাত্রজীবন শেষ হবার আগেই ’৫৬ সালের শেষদিকে প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক এ জে কারদারের সঙ্গে পরিচিত হন। সে সময়ে কারদার ‘জাগো হুয়া সাবেরা’ ছবি করার জন্য ঢাকায় আসেন। কারদার জহিরকে এই ছবির সহকারী পরিচালক নিযুক্ত করেন। এখান থেকেই শুরু হয় জহির রায়হানের চলচ্চিত্র জীবন। ‘জাগো হুয়া সাভেরা’র পর তিনি পরিচালক সালাউদ্দিনের ‘যে নদী মরুপথে’ এবং পরিচালক এহতেশামের ‘এদেশ তোমার আমার’ ছবিতে সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৬ সালে ঢাকায় স্থাপিত হয় ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (এফডিসি)। এবার তিনি নিজেই ছবি তৈরিতে হাত দিলেন, সহকারী নয়- পরিচালক হিসেবে। 

১৯৬১ সালে তার প্রথম পরিচালিত ছবি ‘কখনো আসেনি’ মুক্তি লাভ করে। এরপর তিনি পরিচালনা করলেন ‘সোনার কাজল’ (১৯৬২), ‘কাঁচের দেয়াল’ (১৯৬৩), ‘সঙ্গম’ (উর্দু : ১৯৬৪), ‘বাহানা’ (১৯৬৫)’, ‘বেহুলা’ (১৯৬৬), ‘আনোয়ারা’ (১৯৬৭)’ এবং ‘জীবন থেকে নেয়া’ (১৯৭০)। তার ‘আর কতদিন’ উপন্যাসের ইংরেজি ভাষান্তরিত ছবি ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ সমাপ্ত হবার আগেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়। তিনি চলে যান ওপার বাংলায়। সেখানে বাংলাদেশী সিনেমার এই প্রাণপুরুষ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অত্যাচারকে কেন্দ্র করে তৈরী করেন প্রামাণ্যচিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’ ও ‘বার্থ অব আ নেশন’। সেখানে তার তত্ত্বাবধানে বাবুল চৌধুরীর ‘ইনোসেন্ট মিলিয়ন’ এবং আলমগীর কবীরের ‘লিবারেশন ফাইটারস’ নামক প্রামাণ্যচিত্র দু’টি নির্মিত হয়। 

চিত্র পরিচালনার পাশাপাশি জহির রায়হান অনেকগুলো ছবি প্রযোজনা করেন। সেগুলো হলো, ‘জুলেখা (১৯৬৭)’, ‘দুই ভাই’ (১৯৬৮)’, ‘সংসার’ (১৯৬৮), ‘সুয়োরাণী-দুয়োরাণী’ (১৯৬৮), ‘কুচবরণ কন্যা’ (১৯৬৮), ‘মনের মত বউ’ (১৯৬৯), ‘শেষ পর্যন-’ (১৯৬৯) এবং ‘প্রতিশোধ’ (১৯৭২)। 

দেশের সমকালীন রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের পটভূমিতে নির্মিত ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটি সংগ্রামী মানুষের আলেখ্য হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। যে সময়ে ছবিটির জন্ম , সে সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা স্মরণ করলে এই ছবিকে একটি দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা বলে মানতে হয়। এই ছবিটি নির্মাণ করতে গিয়ে পরিচালক জহির রায়হান অনেক সরকারি বাধার সম্মুখীন হন। ছবি নির্মাণের নেপথ্যের কাহিনী : ’৭০ সালের ১৬ জানুয়ারি জহির রায়হান ‘তিনজন মেয়ে ও এক পেয়ালা বিষ’ নামে একটি ছবি করার জন্য এফডিসিতে আবেদন করেন। ২০ জানুয়ারি এফডিসি কর্তৃপক্ষ ছবিটির অনুমোদন দেয়। ২৮ জানুয়ারি জহির রায়হান ছবির নাম পরিবর্তন করেন- ‘জীবন থেকে নেয়া’। ১ ফেব্রুয়ারি ছবির শুটিং শুরু হয়। ১২ ফেব্রুয়ারি তিনি ‘দৈনিক সংবাদ’-এ এক সাক্ষাৎকারে গণআন্দোলন নিয়ে ছবি তৈরী করার কথা ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, “যদি পত্রিকার পৃষ্ঠায় গণআন্দোলনের খবর লেখা যেতে পারে- তবে সে আন্দোলনকে বিষয়বস্তু করে চলচ্চিত্র করা যাবে না কেন?”

তিনি প্রশ্ন করেন, এদেশের কথা বলতে গেলে রাজনৈতিক জীবন তথা গণআন্দোলনকে বাদ দিয়ে চলচ্চিত্র কি সম্পূর্ণ হতে পারে? আমি তাই গণআন্দোলনের পটভূমিতে ছবি করতে চাই।” 

তৎকালীন সরকার এতে উদ্বিগ্ন বোধ করেন। এফডিসি কর্র্তৃপক্ষ ১৩ মার্চ ছবিটির এক্সপোজড ফিল্ম আটক করে নিয়ে যায় এবং জহির রায়হানকে অবিলম্বে চিত্রনাট্য জমা দেবার নির্দেশ দেয়। ১৪ মার্চ তিনি চিত্রনাট্য জমা দেন। তথ্য সচিব জহির রায়হানের সঙ্গে সমগ্র বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার পর চিফ সেক্রেটারিকে জানান, তিনি চিত্রনাট্য পড়েছেন, পরিচালক ইতোমধ্যে কিছু দৃশ্য পরিবর্তন করেছেন এবং তিনি সম্পূর্ণটাই সেন্সর বোর্ডের সিদ্ধান্তের উপর ছেড়ে দিতে সম্মত আছেন। 

এই প্রসঙ্গে তথ্য সচিব আরো লিখেন, প্রারম্ভিক বা নির্মাণ পর্বে কোনো ছবির কাজ বন্ধ করার বিধান নেই। তাছাড়া এর ফলে জনমনে উত্তেজনা সৃষ্টি হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

৮ এপ্রিল সেন্সর বোর্ড ছবিটি দেখেন। এতে উপস্থিত ৮ জনের মধ্যে ৬ জনই চিত্রায়িত দৃশ্যাবলী বাস্তব ও দেশে বিরাজমান ঘটনার সঙ্গে মিল রয়েছে বলে মনে করেন। অতঃপর ১০ এপ্রিল ‘জীবন থেকে নেয়া’ মুক্তি পায়।

‘জীবন থেকে নেয়া’ বিজ্ঞাপিত হয় এভাবে :

একটি দেশ

একটি সংসার

একটি চাবির গোছা

একটি আন্দোলন... 

এই ছবির প্রধান অভিনেতা-অভিনেত্রীরা হলেন : খান আতা, সুচন্দা, রাজ্জাক, রওশন জামিল, রোজী, শওকত আকবর,আনোয়ার হোসেন, বেবী জামান। সঙ্গীত পরিচালক-খান আতা, চিত্রগ্রাহক-আফজাল চৌধুরী, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার এবং পরিচালক-জহির রায়হান। 

’৬৫ সালে জহির রায়হান ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ ছবি করার কথা ঘোষণা করেছিলেন। বলা হয়েছিল, আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতের এই ছবি নির্মিত হবে ইংরেজি ভাষায় এবং ডাব করা হবে বাংলা, উর্দূ, রুশ এবং ফরাসি ভাষায়। উর্দূ এবং ইংরেজি সংলাপ লিখেছেন কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, রুশ সংলাপ লিখবেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী রুশ ঔপন্যাসিক মিখাইল শলোকভ। প্রধান চরিত্রে থাকবেন আফজাল চৌধুরী এবং সঙ্গীত পরিচালনা করবেন খান আতা। ‘জীবন থেকে নেয়া’র সাফল্যের পর জহির রায়হান এই ছবির কাজ শুরু করেন ’৭০ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে। ছবির মহরত অনুষ্ঠিত হয় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল-এ। পরিচালক ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ ছবির নায়ক-নায়িকা ওমর চিশতি ও অলিভিয়া গোমেজকে সাংবাদিকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। কিন্তু কয়েকদিন পর তিনি আকস্মিকভাবে সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে অলিভিয়ার বদলে নায়িকা হিসেবে ববিতার নাম ঘোষণা করেন। তারপর শুটিং শুরু হবার অল্প কিছুদিন পরেই স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়। ছবি অসমাপ্ত রেখে তিনি চলে যান ভারতে। 

ষাটের দশকে জহির রায়হান ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ নামে একটি ছবি তৈরীর পরিকল্পনা করেছিলেন। মুর্তজা বশীর ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’র চিত্রনাট্য লিখেছিলেন, জহির রায়হান সেটি এফডিসিতে জমাও দিয়েছিলেন। নবারুণ ফিল্মসের ব্যানারে ছবিটি তৈরী হবার কথা ছিল। বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করার কথা ছিলো খান আতা, সুমিতা, রহমান, শবনম, আনোয়ার, সুচন্দা, কবরী প্রমুখ শিল্পীরা। কিন' এ ছবি নির্মাণের অনুমতি তাকে দেওয়া হয়নি। মতুর্জা বশীর জানিয়েছেন, “এফডিসিতে খুঁজলে ছবির চিত্রনাট্য পাওয়া যাবে।” 

স্বীকৃতি ও সম্মাননা
জহির রায়হানের ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাস ১৯৬৪ সালে ‘আদমজী পুরস্কার’ লাভ করে। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলা উপন্যাসের ক্ষেত্রে বিশিষ্ট অবদানের জন্য তাকে বাংলা একাডেমী পুরস্কারে (মরণোত্তর) ভূষিত করা হয়। 

তৎকালীন পাকিস্তানে ১৯৬৫ সালে জহির রায়হান পরিচালিত ‘কাঁচের দেয়াল’ ছবিটি ‘নিগার পুরস্কার’ লাভ করে। এই ছবিটি ৭টি শাখায় পুরষ্কার জিতে নেয়। তিনি শ্রেষ্ঠ পরিচালকের সম্মান লাভ করেন। 

১৯৭২ সালে তাসখন্দ চলচ্চিত্র উৎসবে তার ‘জীবন থেকে নেয়া’ এবং ‘স্টপ জেনোসাইড’ ছবি দুটিকে বিশেষ পুরস্কার দেওয়া হয়। 

এছাড়া তার অর্ন্তধানের পর বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন জহির রায়হানের স্মৃতি রক্ষার উদ্দেশ্যে কয়েকটি কর্মসূচী ঘোষণা করে। এসবের মধ্যে ‘মন্তেজ সিনে ক্লাব’, ঢাকা সিনে ক্লাব’ এবং ‘সন্ধানী প্রকাশনী’- এই তিনটি সংগঠন ‘জহির রায়হান ফাউন্ডেশন’ গঠন করার কথা ঘোষণা করে। চলচ্চিত্র নির্মাণের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আর্থিক সাহায্য দান ছিলো এই ফাউন্ডেশনের অন্যতম উদ্দেশ্য। 

সাহিত্য কর্ম এবং শিল্পকৃতি
উভয় ক্ষেত্রেই জহির রায়হানের প্রতিভার আশ্চর্য বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। কথাসাহিত্যে তার অবদান যেমন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করতে হয়, তেমনি চলচ্চিত্রে তার দান মেনে নিতে হয় বিস্ময়ের সঙ্গে। এই উভয় মাধ্যমেই তিনি মানুষের কথা বলেছেন। পরিবেশ এবং পরিস্থিতির সঙ্গে তাকে আপস করতে হয়েছিলো বলে, হয়তো তাকে আভিধানিক অর্থে বামপন্থী বা কমিউনিস্ট বলা যাবে না। কিন্তু বামপন্থী রাজনীতি বা কমিউনিজম যে প্রধান উদ্দেশ্য মানুষের কল্যাণ এবং মুক্তি, জহির রায়হানের সাহিত্য ও শিল্পের একমাত্র লক্ষ্য ছিলো তা-ই। তার সমসাময়িক লেখক শিল্পীদের ভেতর তিনি ছিলেন সবচেয়ে আধুনিক।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত