অনুভব আহমেদ’এর কবিতা গুচ্ছ
প্রকাশ : ০১ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৭:৩৩
। এক ।
সে মৃত্যুকে ছুঁতে চাইলো
আমি তাকে ছুঁলাম
জানতে চাইলাম "আচ্ছা! মৃত্যু মানুষকে কোথায় নিয়ে যায়?"
প্রচন্ড ভালোবেসে ছিলাম তাকে
সে কাঁপা গলায় বললো
তুমি কিছুই জানোনা
এখানে ভীষণ অন্ধকার!
আমি মুচকি হাসলাম।
আলতো করে বললাম জীবনের পাশে যেটুকু অন্ধকার
সেটুকুর জন্যই বেঁচে থাকাটা দরকার।
এতোদিন ধরে তো তাই আছি, বেঁচে আছি।
কী দিয়েছে তোমার বেঁচে থাকা?
দু 'হাতে জঞ্জাল সরানো ক্লান্তির কুব্জ
আর্তনাদ আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়া!
এসব থেকে মুক্তি চাই আমি।
তবে কী মৃত্যু তোমাকে পাইয়ে দেবে সকল না পাওয়া!
চিরকালের মতো ঘুমোতে চাওয়ার নামই বুঝি মুক্তি!
বিশাল আকাশে উড়তে থাকা নিঃস্ব পাখিটার মতো একলা করে দিয়ে
মেঘের মতো উড়ে দূরে চলে গেলো সে
কি সহজেই বলে দিয়ে গেলো ভুলে যেও-
যেনো ভুলে যাবার দিনগুলো বড় মনোরম হয়!
হা হা হা হা!
তোমার কাছে ভুলে যাবার মানে বুঝি মরে যাওয়া?
অবশ্য মৃত্যুর প্রসঙ্গ এলেই জীবনটাকে আমি ভালোবেসে ফেলি প্রচন্ড ভালোবাসায়।
তুমি জানোনা সে বিশ্বাসঘাতক!
কী নিদারুণ ঠকিয়েছে আমায়!
আমি সত্যিই জানিনা
তবে কোনো একদিন কেউ একজন বলেছিলো আমায়
বিশ্বাসঘাতক প্রেমিকার জন্য তবু বেঁচে থাকা যায়
বিশ্বস্ত প্রেমিকাকে হারালে কী বাঁচা যায়?
সেই থেকে আমি জানি
বিশ্বস্ত প্রেমিকাকে হারাতে দিতে নেই
আর বিশ্বাসঘাতক প্রেমিকার জন্য মরে যেতে নেই।
। দুই ।
যাপিত সময়কে জীবন বলি আমি
তার সেই দীর্ঘ যাপনের গল্প শুনতে আমি তার কাছে আসি
শুনি!
তিনি বলেন দুই আনার লজেন্স ছেড়ে বিড়ি ধরবার ইতিহাস
যুদ্ধের সময় দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া
পাশের বাড়ির মালবিকার জন্য
কেমন করে টেবিলে উল্টে গিয়েছিলো মদের গেলাস।
কাঁধের কার্নিশ উচু করে তিনি বলেন যুদ্ধে শহীদ হওয়া তার বন্ধু অমলের কথা,শহীদদের কথা
স্বাধীন বাংলার আকাশে প্রথমবার উড়তে থাকা উচ্ছসিত পতাকার কথা
স্বাধীন হবার উল্লাসের কথা।
যুদ্ধে বিধ্বস্ত একটা দেশের ঘুরে দাঁড়াবার কথা।
স্বপ্নের কথা
আমি শুনি।
কেবল শুনি!
তিনি ডুকরে কাঁদেন
আমার দিকে তাকিয়ে রাগী স্বরে বলেন তোমরা তাদের মনে রাখোনি
তোমরা ভুলে ভুলে গিয়েছ বারবার
তোমরা ভেঙেছো, পুড়িয়েছ কারো বিশ্বাস
কেড়ে নিয়েছ কারো ঘর
তোমরা অবলীলায় করতে দিয়েছ অন্যায়
চুপ করে থেকে থেকে করেছ পাপ।
তিনি বলেন, তিনি বলে যান
হাহাকারের কথা,অসংখ্য মানুষের কথা,তাদের যাপনের কথা
তার সংগে মিশে যাবার কথা।
সমস্ত দিনশেষের বিদায়ী রোদ্দুর যেমন হয়
তিনি দেখতে ঠিক তেমন
সারাদিন আলো ছড়িয়ে এখন যেনো তার ফুরিয়ে যাবার সময়,যেনো তিনি অপেক্ষা করছে নিভে যাবার।
তিনি বলে যান তার সেই সুন্দর স্বপ্নের কথা
স্বপ্নের মতো দেখতে চাওয়া দেশটার কথা
আমি তার গা ঘেষে বসে থাকি,
তার ছানি পড়া চোখে তৃষ্ণা দেখি।
। তিন ।
কে যেনো বলছিলো
এখানে আর দাঁড়াবেন না
সন্ধ্যে হয়ে এলো দিদি
এবার বাড়ি যান।
একটা নিস্তব্ধ নীরব জীবন নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম।
ধুলোর মতো মিশে গিয়েছিলাম
ভীড়ের মধ্যে
একটুকরো ঘরে, চেনা রাস্তার অচেনা মোড়ে।
কত লোকই তো হারে
আমিও হেরে গিয়েছিলাম
মানুষ ভেবে চেনা মুখের কাছে।
সেদিন নোনাধরা দেয়ালের গা ঘেষে পুরনো আমি দাঁড়িয়েছিলাম
একটা নতুন পথের সন্ধানে।
আমি দাঁড়িয়েছিলাম সমাজ সংস্কারকে অস্বীকার করবার ধৃষ্টতা নিয়ে
আমি দাঁড়িয়েছিলাম ধুলোবালির জীবন আর সাদামাটা কিছু স্বপ্ন নিয়ে।
আমি দাঁড়িয়েছিলাম ফুল পাখি সমেত ছোট্ট একটা পৃথিবী নিয়ে।
সেদিন তুমি এলেনা!
খুব অবাক হলাম না
কেবল দেউলিয়া হলো দীর্ঘ রাত
বিশ্বাসঘাতক প্রেমিকাকে ভালোবেসে আমি কোনো প্রেমিককে কাঁদতে দেখিনি
বিশ্বাসঘাতক প্রেমিককে ভালোবেসে আমরা কেঁদেছি বারংবার।
ভালোবাসা এক অনন্ত যাত্রা
দীর্ঘ যাত্রায় ক্লান্ত তুমি!
সেদিন রেজিস্ট্রি অফিসের বারান্দায় তোমার ক্লান্তি মেখে জমেছিলো গভীর গাঢ় অন্ধকার
আমার বাড়ি ফেরার পথে
খুব বেশী কিছু ছিলোনা হারাবার
শুধুমাত্র সমস্ত জীবন জড়িয়ে গেলো বারান্দার সেই গভীর গাঢ় অন্ধকার।
। চার ।
তুই কখনো আমাকে চাসনি,না চেয়েই আমি পুরোটা তোর।
অথচ সেজুতি জানেনা তার পাবার অহংকারে কেবলই ফাঁকি।
স্টেশনের ক্ষীণ আলোয় চমকে উঠলাম, ভুল দেখছিনা তো!
তুই এসে সহাস্যে জনতে চাইলি "কেমন আছ অরুণদা? "
গলায় ঢেলা পাকানো অন্ধকার ঠেলে কেবল বলতে পারলাম "ভালো "!
একমুহুর্তের জন্য কী পৃথিবীটা এসে থমকে রইলো আমার চারপাশে?
বুকের ভেতর এতো কাছাকাছি থাকিস তুই
অথচ হাতছানির দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা তোকে মনে হলো আলোকবর্ষ।
তোর কপালের গাঢ় নীল টিপ, চোখে মায়া কাজল আর পরিপাটি শাড়ির আবরণে সুখের ছাপ স্পষ্ট।
আমার সামনে দাঁড়ানো তুই যেনো অন্য এক মানবী!
যাকে আমি কখনো চিনিনি,হয়তোবা জানিওনি কখনো।
আমার ভেতরে লালিত সেই তুই যে আজও বড্ড ছেলেমানুষ!
যে সেজুতিকে ছাপিয়ে দাপিয়ে বেড়াতো আমাকে।
যে অদম্য সাহসে একঘর লোকের সামনে সেজুতিকে বলে বসেছিলো "আমি তোমার বরটাকে বড্ড ভালোবাসি গো "।
আমার ভেতরে লালিত তুই আজও সেই তুই,অবেলায় আমাকে ঘেটে দিয়ে যাওয়া তুই।
তখন তোর বয়স কতোইবা! ষোলো কী সতেরো!
তোর ছেলেমানুষী কত কথার বিহ্বল আবেগ আমাকে নিয়েছে তোর দিকে
অন্যায় জেনেও দুর্নিবার আকর্ষণে এগিয়েছি তোর পথে
গভীর থেকে গভীর মগ্নতায়।
বুকের কোরকে তিলতিল করে সাজিয়েছি ভালোবাসা।
যখন বুঝেছি আর পথ নেই
তখন থেকে আমার মধ্যে অবিরল কাঁচ ভেঙে যাচ্ছে ঝনঝন শব্দে।
নিজেকে আমি সামলে রাখতে পেরেছি খুব
কেবল মনটাকে সামলাতে পারিনি এক রত্তির।
আমার সামনে দাঁড়ানো তোকে ট্রেনটা আবার নিয়ে যাবে বহুদূর
যেমন করে বহুদিন আগে নিয়ে গিয়েছিলো তোর মাথার সিঁদুর!
। পাঁচ ।
যে প্রিয়জন ছেড়ে চলে গেছে খানিক দূর
তাকে আবার ফিরে পেতে ইচ্ছে করে
তাকে আমি কার কাছে চাইতে পারি?
ছেলেবেলায় মা বলতেন "যদি কারো কাছে চাইতেই হয় তবে ঈশ্বরের কাছে চাও"
আমি চাই
তাই ঈশ্বরের কাছে চাইতে আমাকে দাঁড়াতে হয় নির্দিষ্ট প্রার্থনালয়ের সামনে
ঈশ্বর তো সেখানেই থাকেন!
অথচ ঈশ্বরকে আমার সব জায়গায় পেতে ইচ্ছে করে!
আমি বয়ে বেড়াই প্রিয় এবং ভয়াবহ শোক
প্রিয়জনের খানিক দূরে যাবার শোক
আমি অপেক্ষা করি
"অপেক্ষা"খুবই শাদামাটা আটপৌড়ে শব্দ
কেবলমাত্র অপেক্ষারত মানুষই জানে এই একটি শব্দে কতোটা হাহাকার থাকে!
কতোটা ভালোবাসা নীরব নিভৃতে মোড়ানো থাকে!
খুব প্রিয়জনের মৃত্যু আমাদের অতোটা ভাবিয়ে তোলেনা
কারণ আমরা জানি মৃত্যু এক অনিবার্য সত্য
আমরা তাদের জন্য পালন করি শোক;সহজ স্বাভাবিক শোক।
অথচ প্রিয়জনের খানিক দূরে চলে যাওয়ার জন্য পালিত শোক হয়
নিজেকে সামলে উঠতে উঠতে এলোমেলো হবার মতো বিমুঢ় ভয়াবহ শোক
বারবার ফিরে পেতে চাইবার মতো গাঢ় শোক।